মুগ্ধতা ব্লাড ব্যাংকে আপনার দেওয়া তথ্য বাঁচাতে পারে একটি জীবন। আপনার তথ্য দিন, প্রয়োজনে রক্ত খুঁজুন এখানে।

অগ্নিঝরা মার্চ: উত্তাল সেই দিনগুলো (পর্ব-৩)

আকবর হোসেন

২৮ মার্চ, ২০২১ , ১২:৩৫ পূর্বাহ্ণ ;

মার্চের উত্তাল দিনগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের বর্ণনায় এক ভিন্ন মাত্রা পায়। নিজেরা সম্মুখ বা গেরিলা যুদ্ধে সরাসরি অংশ নিয়েছেন তাঁরাই আবার লিখেছেন সেইসব দিনের বর্ণনা। নির্মোহ দৃষ্টিতে এরকমই বর্ণনা দিয়ে একাত্তরের উত্তাল মার্চের অনেক তথ্য তুলে ধরেছেন মুক্তিযোদ্ধা আকবর হোসেন। সাত পর্বের এই ধারাবাহিকটির তৃতীয় পর্ব আজ প্রকাশিত হলো।

…………………………………………………………

পর্ব ৩

১৬ মার্চ ১৯৭১ এর এই সময়ে দেশের সকল মানুষ যেন এক সঙ্গে জ্বলে উঠে। শহর, বন্দর, গ্রাম চারদিকে শুধু মিছিল আর মিছিল।  এই মিছিলের শেষ আর শুরু বলতে কিছু ছিলো না। এখন যেমন একটা মিছিল আয়োজন করতে সংগঠকদের ছুটাছুটি করতে হয় কর্মীদের পিছনে। প্রয়োজনীয় রসদ যোগাতে হয় একটা মিছিলের জন্য।  তখন প্রতিদিন এরকম শত শত মিছিল বের হয়েছে জনতার স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগে। মিছিলের একটাই ভাষা তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব, শেখ মুজিব।  তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা। বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো। শ্লোগানে শ্লোগানে গোটা দেশ উত্তাল হয়ে উঠে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতা খান ওয়ালী খান ও গাউস বক্স বেজেঞ্জা ঢাকায় আসেন। তারা দেশের পরিস্থিতি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন।  ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর না করার মতো কোন যুক্তি অবশিষ্ট থাকে না। তবু ঢাকায় এসে আলোচনার কথা বলেন ইয়াহিয়া খান।  আগেই বলেছি মার্কটালী বিবিসি’র মাধ্যমে বাংলাদেশের সব খবরাখবর পরিবেশন করায় দেশের মানুষ  উন্মুখ হয়ে থাকতো বিবিসি’র খবর শোনার জন্য।  আকাশ বানী থেকেও দেব দুলাল বন্দোপাধ্যায় কিংবা ইভা নাথ পরিবেশিত  খবর বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করতো। ইতোমধ্যে শহরে বসবাসকারী মানুষজন তাদের পরিবার পরিজনকে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য গ্রামের বাড়িতে পাঠাতে থাকে। কখন কি ঘটে এই আতঙ্কে সতর্ক চলাফেরা শুরু হয়। তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা বলতে ট্রেন ও নৌ-পথ ছিলো অন্যতম। আজকের মতো বাস সার্ভিস বা বিমান সার্ভিস ছিলো না। ব্যক্তিগত যানবাহন ছিলো হাতে গোনা।  তবে মানবিক মূল্যবোধের কোন কমতি ছিলো না। প্রত্যেকেই নিজের চেয়ে অপরের উপকারের জন্য ছিলো নিবেদিত।  আজ আমাদের মধ্যে যে স্বার্থান্ধতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় জেঁকে বসেছে একাত্তরের সেই দিনগুলোর কথা মনে হলে স্বাধীনতার স্বাদ অনেকটা পানসে হয়ে যায়।

মুক্তিযুদ্ধে একজন সাধারণ গ্রামবাসী নিজে না খেয়ে কীভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের খাইয়েছে এটা যদি লিখতে যাই তাহলে সব মুক্তিযোদ্ধা এবং স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি বলে দাবীদারদের রীতিমতো আসামীদের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। আমরা স্বাধীনতার পর থেকে ইতিহাসের অনেক বিকৃতি দেখেছি। মুক্তিযুদ্ধের অর্জিত বিজয়গুলো একটি বিশেষ শ্রেণির ভোগ দখলে চলে গেছে। মুক্তিযুদ্ধে যে সাধারণ মানুষেরা চরম আত্মত্যাগ শিকার করেছে তারা উপেক্ষিত থেকে গেছে। অসীম সাহসে জীবন বাজি রেখে যে দামাল ছেলেরা যুদ্ধ করেছে তাদের অধিকাংশই ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। যুদ্ধে অংশ্র না নিয়েও এখন অনেকে বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের সময় ৪/৫ বছরের  শিশুরাও অনেক মুক্তিযোদ্ধা কোটায় সরকারি চাকুরীর সুবিধা প্রাপ্য। আর অসহায় বঞ্চিত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নিবেদিত কবিতা, “লক্ষ লক্ষ প্রাণের দাম, অনেক দিয়েছি উজাড় গ্রাম, সুদে আসলে আজকে তাই, যুদ্ধ শেষের পাওনা চাই”- নীরবে নিভৃতে কাঁদে সেইসব মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণ।

১৯৭১ এর ১৭ মার্চ মানুষের বাঁধভাঙা মিছিলে গোটা দেশ উত্তাল হয়ে উঠে। এদিন ছিলো বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। দেশের বিশিষ্ট রাজনৈতিক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক সবাই ছুটে আসেন ধানমন্ডির ৩২ নং রোডের বাড়িতে। সবাই বঙ্গবন্ধুর সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুকে জন্মদিনের রক্তিম শুভেচ্ছা জানান। আগের দিন প্রোসিডেন্ট হাউসে ইয়াহিয়ার সাথে বৈঠকে অংশ নেন জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি গিয়েছিলেন কালো  ব্যাচ পরে ইয়াহিয়া খানকে এদেশের নিরীহ  নিরীহ মানুষের উপর গুলিবর্ষণ ও হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ জানাতে। ইয়াহিয়ার সাথে দেশের দেশের পরিস্থিতি ও ক্ষমতা হস্তান্তর বিষয়ে প্রায় আড়াই ঘন্টা আলোচনা হয়।কিন্তু কোন ফলাফল ছাড়াই আলোচনা শেষ হয়। তখন ঢাকাসহ সারাদেশে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে অফিস, আদালত, বাসভবন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সর্বত্র পাকিস্থানি সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণ ও হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে কালো পতাকা উড়ছিলো। ইয়াহিয়া খান স্বচক্ষে এই দৃশ্য দেখে কৌশলী অবস্থান গ্রহণ করেন। তিনি বলেন, আলোচনা চলবে, আলোচনার মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে৷ বঙ্গবন্ধুর জোরালো দাবী গণপরিষদের অধিবেশন আহ্বান করে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা নির্ধারুণ করুণ। তখনও অসহযোগ আন্দোলন চলছিলো। বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালিত হচ্ছিলো।এইদিন বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দেন এদেশের আদায়কৃত খাজনা,ট্যাক্স, শুল্ক স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানে আর যাওয়া হবে না। জমা দিতে হবে বাঙালী মালিকানাধীন ইস্টার্ন মার্কেটাইল ব্যাংকে। সরকারি কর্মচারীরা বঙ্গবন্ধুর সেই নির্দেশ মোতাবেক স্টেট ব্যাংকে টাকা জমাদান বন্ধ করে দেন। এসময় চট্টগ্রাম বন্দরে খালাস অপেক্ষায়  থাকা ত্রাণ সাহায্য হিসেবে পাওয়া ৪ হাজার গ্রাম চট্টগ্রামে খালাস না করে করাচীতে পাঠিয়ে দেয়ার খবর জানাজানি হলে চট্টগ্রামসহ দেশের মানুষ আবারও ফুঁসে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে জুলফিকার আলী ভুট্টো ও ইয়াহিয়া খান আলোচনার নামে কালক্ষেপন করতে থাকে। ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে সেই ষড়যন্ত্র আরও পাকাপোক্ত হয়। তারা যে কোন পন্থায় বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতা হাতছাড়া করতে রাজী নয়।

চলবে…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *