ভ্রমণ করতে কার না ভালো লাগে। অনেকদিনের ইচ্ছে ছিল ট্রেনে করে লং জার্নি করা। অবশেষে এবার ঈদের পর তা হলো। বদরগঞ্জ টু সান্তাহার। সান্তাহার থেকে বগুড়া তারপর রংপুর। যাওয়ার সময় কমবেশি ১৯৭ কি.মি। আর ফিরতি পথ প্রায় ৩০০+ কি.মি।
চলতি মাসের ২৫ তারিখ সকাল সাড়ে আটটায় বের হই বাড়ি থেকে। বদরগঞ্জ স্টেশনে উপস্থিত হয়ে টিকেটের খোঁজ করলে জানা গেল ট্রেন অনেক দেরী আছে। প্রায় দশটা অথবা সাড়ে দশটার দিকে ট্রেন। তাই এতক্ষণ দেরী না করে সফরসঙ্গীর সাথে মাঝখানে গন্তব্য পরিবর্তন করার জন্য কিছুক্ষণ কথা চালাচালি হলো। পরে সিদ্ধান্ত হলো যেখানে যাওয়ার প্ল্যান ছিল এবং যেখানে যাবার জন্য বের হয়ে এসেছি সেখানেই যাবো; কী হবে হবে! কী আর করার! ততক্ষণে ভ্রমণের জন্য একটু সদাই করা হলো। বড় একটা পানির বোতল আর চিপসের প্যাকেট ছয়টা।
ইতোমধ্যে অনেক বার স্টেশন মাস্টারের কক্ষে গিয়ে খোঁজ নেওয়া হচ্ছিল ট্রেন আসবে কখন আরো, ওখান থেকে ফিরতি ট্রেন আছে কি না, থাকলেও কখন! এভাবে বেশ কিছু সময় কেটে গেল। টিকেট সংগ্রহ করা হলো। ট্রেন এলো। উঠে পড়লাম। অন্যরকম এক উত্তেজনা কাজ করছিল। এই প্রথম এতদূর যাচ্ছি ট্রেনে। ভাবতেই অন্যরকম শিহরণ কাজ করছিল। আসনবিহীন যেতে হবে ১৯৭ কি.মি। ট্রেন চলছে…
ট্রেনে উঠেই কিছুক্ষণ পর পরিচিত দুয়েকজনের দেখা হয়ে গেল। ঢাকা যাবেন ওনারা। চলতে চলতে টিটি এসে গেলেন। লং জার্নিতে টিকেট নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়লে কী অবস্থা হয় সেদিন দেখেছিলাম। আলহামদুলিল্লাহ আমাদের কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়নি। টিকেট সংগ্রহ করবেন নিরাপদে রেলভ্রমণ করবেন।
একের পর এক স্টেশন ছেড়ে ছুটছি গন্তব্যের দিকে…ট্রেন চলছে তার গতিতে। ছোটবেলায় বইয়ে পড়া ছড়াটির কথা মনে আছে?
ঝকঝকাঝক ট্রেন চলেছে
রাত দুপুরে ঐ
ট্রেন চলেছে ট্রেন চলেছে
ট্রেনের বাড়ি কই
সত্যিই তো তার বাড়ি কই? সে শুধু চলছে আর চলছে। একে একে সবাই তাদের গন্তব্যে এসে গেলেই নেমে পড়ছে। কিন্তু ট্রেনের কী কোনো গন্তব্য আছে? সে তো ছুটেই চলছে।
পথেঘাটে চললে মাঝেসাঝে যে বিড়ম্বনা পোহাতে হয় তারচে দ্বিগুণ বিড়ম্বনা স্টেশনে এলে, ট্রেনে চড়লে। হাত তালি দিয়ে এসে টাকা নিয়ে যায়। আরে কী রে ভাই! সারা জীবন মাথা ঠুকিয়ে পড়ে থাকলেও কেউ টাকা দেয়না আর এরা এসেই হাত তালি দিয়ে টাকা নিয়ে যাবে। কী একটা অবস্থা। আমার সফরসঙ্গী ওদের টাকা দিয়ে বিদায় করলো। যাবার পথেই দু’দুবার। হাত তালি দিয়ে টাকা ইনকাম কম কথা নয়! হাহাহা!
দাঁড়িয়েই যাচ্ছিলাম তখনো। ভেবেছিলাম হয়তো যেতে যেতে অনেকে বিভিন্ন স্টেশনে নেমে গেলে বসে পড়বো কোনোভাবে। সেটা আর হয়নি। তাই দাঁড়িয়েই রইলাম। চিপস আর পানি চলছে টুকটাক। যাত্রী ছিল অনেক। ঈদ করে প্রায় সকলেই তাদের চাকুরীস্থলে ফিরছিল।
বদরগঞ্জ>পার্বতীপুর>ফুলবাড়ী>বিরামপুর>পাঁচবিবি>জয়পুরহাট>আক্কেলপুর অতিক্রম করে অবশেষে প্রায় সাড়ে বারোটার দিকে আমাদের গন্তব্যে পৌঁছলাম। সান্তাহার। সান্তাহার জংশন। অনেক সুন্দর। বিশেষ করে প্লাটফর্ম থেকে নেমে শহরে প্রবেশ পথটা অসম্ভব সুন্দর। দুই দিকে পানি দ্বারা আবৃত আর মাঝখান দিয়ে চলার পথ। সোজা সামনে শিমুল গাছ। চোখ জুড়ানো দৃশ্য। সেই পথ ধরেই হাঁটা দিলাম। একটু পেট পুজো করা দরকার এবার। দীর্ষ প্রায় দুশো কিলোমিটার দাঁড়িয়ে এসে অবস্থা খুবই খারাপ। সেই সাথে সুয্যি মামার রাগান্বিত চেহারার কারণে অনেক ক্লান্ত লাগছিল। একটু হেঁটে বাজারের কাছে যেতেই আখের রস বিক্রি করছেন একজনকে পেলাম। দুই গ্লাস, দুজনের জন্য। আলহামদুলিল্লাহ। ভেতরটা ঠান্ডা হলো। সেখানে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিলাম। যোহরের নামাজের সময় হয়ে আসছিল। তাই আর দেরী না করে উঠে পড়লাম। এদিকে আমার সফরসঙ্গী মোবাইলের মাধ্যমে কাছাকাছি ভালো খাবার কোথায় পাওয়া যায় তার সন্ধান চালাচ্ছিলেন। দেরী না করে প্রবেশ করলাম হাজী বিরিয়ানির দোকানে৷ মোরগ পোলাও। ওনাদের মেন্যু তে ডিমসহ ছিল তবে আমরা ডিম ছাড়া নিলাম। খেতে খেতেই আজান দিয়ে দিলো। খাওয়া শেষ করে আবারো রওয়ানা করলাম স্টেশনের উদ্দেশ্যে। ও হ্যাঁ, আর আসার সময় ট্রেন থেকে নেমেই আগে খোঁজ করেছিলাম যে রংপুরের ফিরতি ট্রেন কখন। তারা জানালো তিনটা পনেরো তে। তাই আর বেশিক্ষণ শহরের বুকে আমাদের পদধূলি বিতরণ করতে পারলাম না। স্টেশনে ফিরে এসে নামাজের প্রস্তুতি নিলাম। আমরা মুসাফির অবস্থায় ছিলাম। নামাজ কসর করতে হবে। অযু-এস্তেঞ্জা সেরে যোহরের কসর সালাত আদায় করলাম। তারপর সালাত আদায় করে এদিকওদিক একটু হাঁটাহাঁটি করে টিকেটের সন্ধানে গেলাম। টিকেট সংগ্রহ করলো আমার সফরসঙ্গী। ফিরে এলাম স্টেশনে। ট্রেন তিনটা পনেরো তে।
সফরসঙ্গীসহ রইলাম ট্রেনের অপেক্ষায়। এদিক সেদিক হেঁটে বেড়াচ্ছি। শরীরটা বড্ড ক্লান্ত লাগছে। আবার টিকেট যেটা সংগ্রহ করা হয়েছে সেটাও আসনবিহীন। এটা দেখে আরো ক্লান্ত লাগছে৷ প্রায় দুইশো কিলোমিটার দাঁড়িয়ে এসে আবার দাঁড়িয়ে যেতে হবে এটা ভেবেই দম ছুটছিল। সময় হয়ে এলে ট্রেন এসে পড়লো। গেলাম কাছে। কিন্তু দেখি এটা আমাদের ট্রেন না। আমরা রংপুর এক্সপ্রেসের টিকেট সংগ্রহ করেছি। পরে সেখানে থাকা কর্তব্যরত ভাইকে জিজ্ঞেস করে জানলাম এই ট্রেন ডিলে চলতেছে। দেরীতে আসবে। এবার আর না হেঁটে সোজা চলে গেলাম স্টেশন মসজিদে। ব্যাগ রেখে শুয়ে পড়লাম। অনেকক্ষণ বিশ্রামের পর স্পিকার থেকে অস্পষ্ট শব্দে কোনো ঘোষণা ভেসে আসছিল। মনোযোগ দিয়ে কষ্ট করে বুঝতে পারলাম আমাদের ট্রেন এসেছে। দ্রুত উঠে ওই প্লাটফর্মে গেলাম।
উঠে পড়লাম ট্রেনে। ট্রেন চলছে। ততক্ষণে আছরের ওয়াক্ত হয়ে গেছে। নামাজের কামরা খুঁজছিলাম। দুই/এক কামরা এগিয়েই পেয়ে গেলাম। দ্রুত অযু করে নামাজের কামরায় প্রবেশ করলাম। ছোট্ট অনেক। মোটের ওপর ৫/৬ জনের জায়গা হবে। দেখি তিনজন ভাই জামাত করে ফেলেছেন ইতোমধ্যে। আমার সফরসঙ্গী আমার আগে অযু করে এসে সালাত শুরু করেছে। আমি একা একাই আদায় করলাম। এই প্রথম যানবাহনে সালাত আদায়ের অভিজ্ঞতা হলো। কসর সালাত আদায়ের অভিজ্ঞতাও এবারেই প্রথম। ট্রেনের দুলুনির কারণে নামাজে রুকুতে বেসামাল অবস্থা। আলহামদুলিল্লাহ এটা ভেবে প্রশান্তি লাগছিল যে যাই হোক অন্তত এতদূর পথ আর দাঁড়িয়ে যেতে লাগবে না। নামাজের কামরাতেই বসে পড়লাম। ট্রেন চলছে। আমার সফরসঙ্গী মোবাইলে একটু ট্রেনের লোকেশন দেখে নিচ্ছিল। ম্যাপে লোকেশন দেখেই তো টাস্কি! আরেহ ট্রেন কই যায়! রংপুর রুটে না গিয়ে ট্রেন চলছে অন্যদিকে। বগুড়ার দিকে। ভাবলাম এই বুঝি হলো এবার! পরে সেখানে উপস্থিত ভাইদের কথাবার্তা থেকে বুঝতে পারলাম ট্রেন বগুড়া হয়ে ঘুরে যাবে রংপুর। আমরা ভেবেছিলাম হয়তো সরাসরি রংপুর যাবে। জানা না থাকলে যা হয় আরকি!
দেখতে দেখতে মাগরিবের ওয়াক্ত হয়ে এলো। নামাজ আদায়ের জন্য অলরেডি দ্বীনি ভাইয়েরা জমতে শুরু করেছেন। এবার গবেষণা শুরু হলো ক্বিবলা নির্ধারণ নিয়ে। আমার সফরসঙ্গী, সাথে আরো দুই ভাই তাদের মোবাইলে কম্পাস বের করে নিশ্চিত হচ্ছিলেন। ক্বিবলা চিহ্নিত করে জামাতে মাগরিব আদায় করা হলো। মাগরিবের কসর নাই। আমাদের পর আরো বেশ কয়েকটা জামাত করতে হয়েছে। যেহেতু কামরাটা ছোটো তাই একেবারে সম্ভব নয়। ৫/৬ জন করে জামাত করা হচ্ছিল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই কামরাটা ফাঁকা হয় গেল। আমি, আমার সফরসঙ্গী ভাই, আর দুইজন আমরা তখন শুরু থেকেই নামাজের কামরাতে বসেই যাচ্ছিলাম। রব্বের কাছে কৃতজ্ঞতা যে এবার আর এতদূর পথ দাঁড়িয়ে যেতে হচ্ছেনা। একের পর এক স্টেশন অতিক্রম করে ছুটছিল আমাদের ট্রেন।
সান্তাহার>তালোড়া>বগুড়া>সোনাতলা>মহিমাগঞ্জ>বোনারপাড়া>বাদিয়াখালি>গাইবান্ধা>বামনডাঙ্গা>পীরগাছা>কাউনিয়া। কাউনিয়ায় এসে প্রায় বিশ-পঁচিশ মিনিট দেরী করে তারপর রংপুরের দিকে ছুটে ট্রেন।
রংপুরের দিকে আসার পথেই ইশার ওয়াক্ত হয়ে গেলে তখন শুধু আমরা দুজন নামাজের কামরায়। আমি আর আমার সফরসঙ্গী। নামাজ আদায় করলাম। তার পরপরই ট্রেন স্টেশনে পৌঁছায়৷ দীর্ঘ জার্নির ফলে ততক্ষণে আমরা দুজনই তখন ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। বিছানায় গা এলিয়ে দিলেই সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়বো। রাত ন’টা তখন। স্টেশন থেকে বেরিয়ে বাস নিয়ে রওয়ানা করি বাড়ির পথে….
আমার জন্য এখন পর্যন্ত এটাই স্মরণীয় ভ্রমণ হিশেবে থাকবে। নতুন অভিজ্ঞতা ট্রেনে নামাজ আদায় করা এবং কসর নামাজের। ইনশাআল্লাহ সামনে আবারো নতুন কোনো জায়গায় ভ্রমণে বের হবো।
হাবিবুল্লাহ মিসবাহ তুবা
শিক্ষার্থী
রংপুর আইডিয়াল নার্সিং ইনস্টিটিউট
রংপুর
০১৮৭০৯১২২০১