জেএসসি পরীক্ষায় ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেলে কোনো এক বসন্তের বিকেলে পরমার পাহাড় দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো প্রত্মতাত্ত্বিক পিতার প্রয়াসে। বিশাল চা বাগানের চিবুক চিরে শঙ্খচূড় সাপের মতো বয়ে যাওয়া চিকন পথের মাধুরি ঘেঁটে ওরা খুঁজে নিয়েছিলো পাহাড়ের গন্তব্যগহন। জীবনে প্রথমবারের মতো পাহাড় দেখার পর পরমা পরমানন্দ অনুভব করেছিলো বুকের ভেতর। সেই শিমুল তুলোর মতো ওর তুলতুলে বুকটা কোনো এক নির্দয় খঞ্জর কেমন যেন ক্ষত বিক্ষত করে দিয়েছে আজ। ময়না তদন্তের ঘরে শুয়ে শুয়ে সেরকম অদ্ভুত অনুভূতিময় রক্তাক্তপাঠ ও টের পেতে থাকে।
আহা আজি এ বসন্তে
কতো ফুল ফোটে
কতো পাখি গায়
…………………..
আহা আজি এ বসন্তে
…………………..
বন ময়ূরের মতো পেখম মেলে পাহাড়ি মেয়েদের মতো নেচে-গাওয়া গানের পয়ারগুলো পুরনো পলেস্তরার মতো খসতে থাকে গীত বিতানের গহীন থেকে।
পাহাড় থেকে পৃথিবী ও আকাশটা কেমন দেখায়? পরমানন্দে পিতাকে জিজ্ঞেস করেছিলো পরমা সেদিন। যদিও ওর ভূবিদ্যা সম্বন্ধে সম্যক ধারণা ছিলো।
পাহাড়ের উপর থেকে পৃথিবীকে পৃথিবীর চেয়েও ছোট আর দূরের আকাশকে আরও কাছের দেখায়। পাহাড় চিরে উড়ে আসা কুরুক ফুলের গন্ধ মেশানো হাওয়ার তরঙ্গে ভাসতে ভাসতে বলেছিলেন ওর প্রবীণ পিতা। ও ছোট পৃথিবী দেখতে চেয়েছিলো বোধহয়। বোধহয় আঙুলের উপর পুরো আকাশটা তুলে আনতে চেয়েছিলো। বিধায় ওর অন্তরের অভ্যন্তরে পাহাড়ে উঠার কাঙক্ষা জন্মে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে।
আমি কি পাহাড়ে উঠতে পারবো? এই বয়ানের পর পাহাড় সম্বন্ধে পরমা দর্শনার্থীর মতো প্রশ্ন ছুড়ে বসেছিলো প্রত্মতাত্ত্বিক পিতার প্রবল অভিজ্ঞতার প্রতি।
প্রত্যেক মানুষ তার নিজ নিজ অটলতা, সহিষ্ণুতা আর আত্মবিশ্বাসের মাধ্যমে পাহাড়ে উঠতে সক্ষম। বিপুল বিশ্বাসের জোরে বলছিলেন পিতা। তখন পরমার পুরো পাহাড়টাই হতে ইচ্ছে করেছিলো। এরপর উনি পরমার নিঃসঙ্গ হাসিকে সঙ্গ দিতে হেসেছিলেন। দ্বিধাহীন, সংশয়হীন হেসেছিলেন। ওনার হাসিতে কোনো হেঁয়ালিপনা ছিলো না। কোনো অবজ্ঞা ছিলো না।
ওসব এখন কেবলই স্মারকগ্রন্থের মতো একটি বস্তুগত ক্যানভাস। তবু কয়েকটা তেলচিটচিটে স্মৃতির পাতা উল্টাতে উল্টাতে পরমা পিতা পিতা বলে অদ্ভুত চিৎকার করে ওঠে। ওর চিৎকার চার দেয়ালেই প্রতিধ্বনিত হয়ে ওর দিকেই ফিরে আসতে থাকে।
আমি পাহাড় হবো। স্নাতকোত্তরে উঠে কোনো এক কেমিস্ট্রি ক্লাসের ফাঁকে ও ওর দুজন বয়ফ্রেন্ডকে বলেছিলো। পাহাড়ের কথা শুনে বয়ফ্রেন্ডদের প্রচন্ডভাবে পাহাড় দেখার তৃষ্ণা পেয়ে বসেছিলো। পরমা ওদের তৃষ্ণাকে ভেবেছিলো বিশ্বাস। বিশ্বাসের ক্রেচে ভর করে ওরা দিন তারিখ ঠিক করে। সামনের শীত।
পাতার মর্মর অনুরণন তুলে কবে আসবে সেই শীত? ওর বয়ফ্রেন্ডরা বিয়ারের বোতলে বুঁদবুঁদি তুলে কেবল ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে থাকে।
কোনো এক পাতা ঝরার দিনে পাহাড় দেখার সুযোগ আসে মর্মর অনুরণনে। সকালের বুক থেকে তখনও শিশিরের গন্ধ মোছেনি। তখনও পুরো চা বাগান যেন শুয়ে আছে সমস্ত সুনসানের উপর। বাগানের চিবুক চিরে শঙ্খচূড় সাপের মতো বয়ে যাওয়া চিকন পথের কুয়াশা ভেদ করে ওরা তিনজন এগুচ্ছিলো অচেনা পাহাড়ের অভিমুখে।
কুয়াশার ক্লাউডে এগুতে এগুতে কোনো এক খাদে পড়ে পথ হারায় পরমা। সঙ্গতার ভেতরেও নিঃসঙ্গতা অনুভব করে ও। অ্যান্ডারসনের রূপকথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসে দুটো রাক্ষুসে দেবদূত! তোমরা আমার সুহৃদ, আমার সফরসঙ্গী। আমার বিশ্বাসের এক জোড়া ইষ্পাত-ক্রেচ। সেই তোমরাই…। বলেই একগুচ্ছ থুথু ছড়িয়ে পাহাড়ের সুঁড়ঙ্গ বেয়ে পালানোর চেষ্টা করে ও।
কে সুহৃদ? কে সফরসঙ্গী? কে বিশ্বাসের ক্রেচ? এসবের কোনোটাই আমরা না। আমাদের নাম পুরুষ। আমরা পুরুষ। আর তুমি হলে নারী। বিনোদনী নারী। আবেদনময়ী নারী। নারী আর পুরুষ। পুরুষ আর নারী। এর বাইরে কিছু নেই, আর কিছু থাকতে পারে না। এসো নারী, পুরুষের বাহু বন্ধনে তোমাকে সমর্পণ করো আনুগত্যশীল অন্ধের মতো। আমাদের শয়তান জেগে ওঠেছে। নাভির নিচে জাহান্নাম জ¦লছে। শয়তানকে পুঁততে হবে জাহান্নামে। এসো নারী, আমাদের বাহু বন্ধনে তোমাকে সমর্পণ করো আনুগত্যশীল অন্ধের মতো।
তাহলে শয়তানের আরেক নাম পুরুষ! পিতা তো এ কথা ওকে কখনো বলেননি। এই অজ্ঞতার অন্ধকারে কাঁপতে কাঁপতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গালি দিতে থাকে পরমা। কেনো তারা পুরুষ সম্বন্ধে কোনো বিষয় রাখলো না।
আস্তে আস্তে শয়তান রূপান্তরিত হতে থাকে পুরুষে। অজস্র নখ ওর নাকমুখ পেঁচিয়ে ধরে রূপকথার রক্তখেকো লতার মতো। নাভির নিচে যেন একটা শঙ্খচূড় সাপ ঢুকছে আর বেরুচ্ছে, বেরুচ্ছে আর ঢুকছে। মনে হতে থাকে, হায়েনার থাবায় থেতলে যাচ্ছে ওর শিমুল তুলার মতো তুলতুলে শরীরপাহাড়। যেন ভেঙেচূড়ে গুঁড়ো করে দেবে ওরা ওর পলি মাটির হাড়গোড়ের প্রান্তর। পরমার আর কিছুই মনে পড়ে না। কেবল অস্পষ্টতায় আবছা হয়ে আসে ওর পৌরাণিক পৃথিবী।
জ্ঞান ফিরে এলে দেখে ও এক মূর্তি উপাসকের ঘরে। উলুধ্বনির উপর ভেসে আছে যার জিভ ও জীবন। আর ধূপের ধুম্রজাল ছড়িয়ে আছে যে এক প্রবল প্রার্থনায় ডুবে। পরমার ক্ষত বিক্ষত পৃথিবীর চিমনিতে দপ্ করে জ্বলে উঠে একফিতে আলোর ঝিলিক। কতোদিন হয়ে গেলো ও এই আলো দেখেনি।
পিচ্ছিল আর শ্যাতশ্যাতে ডানাগুলো সেই ঝিলিক-ঝর্ণায় মেলে ধরতে চায় পরমা। আমি মুসলমান ঘরের মেয়ে। মানে আমি মুসলমান। দৈনিক পাঁচবার মাটিতে সেজদাহ্ করে শূন্যের ঈশ্বরকে বিশ্বাস করি। আমাকে অবশ্যই আমার হারিয়ে যাওয়া গন্তব্য-গহন ফিরিয়ে দিবেন। ফিরিয়ে দিবেন পিতামাতার মতো মহত্তর মসজিদ। ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে অনুরোধে আর্তনাদ করতে থাকে মূর্তি উপাসকের তুলসি ধোয়া জলে ভেজা পায়ে নতজানু হয়ে।
পরমার মতো পরম পাহাড় দেখে মূর্তি উপাসকের মন্দিরে শয়তান জেগে ওঠে। শয়তানের আরেক নাম পুরুষ! সে ভুলে যায় পাপ-পুণ্যের পার্থক্য। ভুলে যায় ঋগবেদের শ্লোক। উন্মাদের মতো পরমার পাহাড়কে পাঁকিয়ে ধরে ধূপ-ধোঁয়ার কুণ্ডলী। খাদ ভেঙে প্রবাহিত হতে থাকে গঙ্গার জল। ক্ষরিত রক্তফুলে ঢেকে যেতে থাকে শিবলিঙ্গের স্ফূরণ। পরমার আর কিছুই মনে পড়ে না। বিষন্ন সূর্যের মতো ঢলে পড়তে থাকে কোনো এক সান্ধ্য বলিরেখার বলয়ে।
রাত বাড়ছে। নষ্ট ল্যাম্পোস্টের নিচে শুয়ে আছে কতো পথ। কোন পথে পা বাড়ালে পরমা পাবে ওর প্রিয় গন্তব্য। যেখানে আছে ওর শান্তির নীড়। পাখি পাখি বেলা। শখের সাজদানি। প্রিয় রেসিপির ঘ্রান। জানে না। মাতার কথা মনে পড়তেই পেটের ভেতর ক্ষুধাটা কেমন পাণ্ডবের চক্রের মতো ঘূর্ণি পাঁকাতে থাকে।
ক্ষুধা আর তৃষ্ণা সমেত শরীর নিয়ে অচেনা অন্ধকারের ভেতর দৌড়াতে দৌড়াতে ধাক্কা খেয়ে কোনো এক কর্তব্যরত পুলিশের পায়ের উপর উবু হয়ে পড়েছিলো পরমা। মনের সংশয় খানিক সংকোচিতও হয়েছিলো পরিচিতি ইউনিফরমের সাহসে। ক্লেদাক্ত চোখেমুখে আশার আভা প্রস্ফুটিত হয়েছিলো ওর।
পুলিশ! ক্ষীণকন্ঠে ডেকেছিলো পরমা।
বিপদে পড়লে এরকম খাকি ইউনিফরমের কাছে যাবি। আশ্রয় চাবি। আমাদের অবর্তমানে সেই তোর পিতামাতা, সেই তোর পরমাত্মা। কোনো এক শরতের দুপুরে থানায় কর্তব্যরত কোনো এক পুলিশ অফিসারের সামনে পিতা আমাকে বলেছিলেন।
স্যার, আমাকে বাঁচান। বলেই বিনম্র শ্রদ্ধায় ইউনিফরমকে জড়িয়ে ধরেছিলো পরমা। মাতার মতো ভালোবেসে পিতার মতো নিরাপদ আশ্রয় দেবে ভেবে। পুরুষকে পিতা ভেবে আররেকবার ভুল ভেবেছিলো পরমা।
সেকি! ইউনিফরমের ভেতর পিতা নেই, পুলিশ নেই! টের পায় একজন পুরুষের প্রতাপশীল অস্থিত্ব। পুরুষত্বের বিষবীজে ভরতে থাকে ওর বিষন্ন পাহাড়ের পলি মাটির প্রান্তর। পরমার পরম গহন ফেটে চৌচির হতে থাকে বির্যের প্রাচীন প্রবাহে।
বছর পাঁচেক আগে পরমা পাহাড়ে উঠতে চেয়েছিলো। পাহাড়ে উঠলে নাকি পৃথিবীকে পৃথিবীর চেয়ে আরও ছোট দেখায়। আজকে পরমার কাছে সেরকমই মনে হতে থাকে নিজেকে। পুরুষের পাহাড়ে উঠতে উঠতে ওর পরম পৃথিবীটা সত্যি সত্যিই যেন ছোট হয়ে আসছে, সংকোচিত হয়ে আসছে।
পিতার কাছে পাহাড়ের প্রবল প্রাচুর্যের গল্প শুনে পরমা পাহাড় হতেও চেয়েছিলো। পুরুষত্বের প্রতাপশীল পাহাড় দেখে ওর আর পাহাড় হবার কাঙ্ক্ষা করে না। অটলতা আর আত্মবিশ্বাসের প্রান্তর ভেঙে ও আজ নিঃসহায়, নিস্তব্ধ।
দূরতম আরশ যেন ঈশ্বরের দয়ায় ভেঙে আসতে চাইছে ওর সমূহ কান্না ও করুণার স্তূপে। অন্ধকার মেঘের ভেতর খাণ্ডব চাঁদ গড়াতে গড়াতে কোনো এক অচেনা অসীমের মাঝে যেন নাই হয়ে গেলো। নক্ষত্ররাজিও আস্তে আস্তে ওদের গতিপথ বদলে যেন ডুবে যাচ্ছে কোনো এক অজানা মরকের মর্ত্যে!
ভিকটিমের শরীরে সে ধরনের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। ডিএনএসহ অন্যান্য নমুনা পরীক্ষা নিরীক্ষার পর ফরেনসিক ল্যাব থেকে প্রতিবেদন এসেছে। আহা আইন! আহা প্রতিবেদন! ময়না তদন্তের ঘরের বাইরে তখনও পাহাড় নামক পদ নিয়ে সাংবাদিকরা সাংঘাতিকভাবে তর্কে জড়িয়ে যাচ্ছিলো পরসস্পর।
আত্মহণনের আগে সে পাহাড় হতে চেয়েছিলো।
সরকারি কর্মকর্তার কাছ থেকে মরদেহ নিতে এসে পরমার পিতা কোনো এক সাংবাদিককে বলেছিলেন। তর্ক ক্রমেই বাড়ছে। সমস্ত তর্ক পেছনে ফেলে মরদেহবাহী মাইক্রোবাসটা এগিয়ে চলছে পাবর্ত্য চট্টগ্রামের কোনো এক পাহাড়ের দিকে…
লেখক : তরুণ সাহিত্যিক।
প্রকাশিত বই দুইটা।
এক. ওকাবোকা তেলাপোকা (২০১৬) -শিশুতোষ
দুই. এলিয়েনের দেশ পেরিয়ে (২০১৭)-শিশুতোষ।