শেষ পর্ব
মূল দ্বীপে পৌঁছে গেছে। একটা সুন্দর হুড খোলা ফোর হুইল জিপে পাহাড়িয়া পথ বেয়ে ওপরে উঠেছে তারা। জিপটা বেশ লম্বা। ড্রাইভারের পাশে বসেছে ক্যাপ্টেন। পেছনে একটা লম্বা সিটে একাই বসেছে মেয়েটি। বিপরীত দিকের সিটটিতে পাশাপাশি বসেছে লর্ড ও ছেলেটা। সবাই চুপ করে আছে।
সেই বিভীষিকাময় রাতের ঘটনাগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছে ছেলেটির। আল্লাহর অশেষ করুণায় আজো বেঁচে আছে সে। সেই মহান আল্লাহর ইশারায় পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। যাদের ভয়ে তারা পালিয়েছিল, তারাই আজ তাদের অতিথি করে নিয়ে যাচ্ছে। এই তো দুনিয়ার খেলা। এসব মানুষের সহজে বোধগম্য হয় না। এই দ্বীপের নাম ফ্লাওয়ার্স আইল্যান্ড রাখা হয়েছে কেন, কে রেখেছে? এক সঙ্গে দুটো প্রশ্ন করে নীরবতা ভাঙল মেয়েটি।
‘এ নাম আমিই রেখেছি। ছোটবেলা থেকেই ফুলের প্রতি আমার একটা প্রবল আকর্ষণ ছিল। আমি বাগানে কাজ করতে ভালোবাসতাম। তাই এই দ্বীপের বাসিন্দাদের বলে দিয়েছিলাম, তারা যেন তাদের বাড়িতে ছোট হলেও একটা বাগান করে। তাই এ দ্বীপের প্রায় সব বাড়িতেই ফুলের বাগান আছে। সেই থেকে আমি এই দ্বীপের নাম রেখেছি ‘ফ্লাওয়ার্স আইল্যান্ড’, বলেই আনমনা হয়ে গেল লর্ড।
‘ফুলের সঙ্গে মানুষের জীবনের চমৎকার সাদৃশ্য আছে। কলি থেকে ধীরে ধীরে ফুল ফোটে। সেই ফুল কিছু সময় সুন্দর হয়ে ফুটে থাকে। এক সময় ঝিমিয়ে যায়, ঝরে পড়ে যায়। আবার কোনো কোনো ফুল কলি অবস্থাতেই বোঁটা থেকে খুলে পড়ে যায়। আবার কোনো কোনো ফুল পূর্ণাঙ্গ রূপে প্রস্ফুটিত হওয়ার পর ঝড়ো বাতাসে তার পাপড়িগুলো পড়ে যায়। ফুল বলতেই সুন্দর। তবে কতগুলো ফুল দেখতে সুন্দর, কিন্তু সুগন্ধ ছড়ায় না। সেসব ফুলকে মানুষ দূর থেকে উপভোগ করে কিন্তু নাকের কাছে নিয়ে আসে না। আর কিছু ফুল আছে, সুগন্ধ ছড়িয়ে মানুষকে মুগ্ধ করে। মানুষ সেসব ফুলের সৌন্দর্যও উপভোগ করে সেই সঙ্গে নাকের কাছে এনে তার সুগন্ধ নিয়ে থাকে। এসব ফুলই সার্থক। ফুল কখনোই নিজের রূপ, সৌন্দর্য, সুগন্ধ নিজের উপকারে লাগাতে পারে না। সে সব বিলিয়ে দেয় সর্বসাধারণের জন্য। সত্যি, এ দ্বীপ ছেড়ে যেতে খুবই খারাপ লাগছে।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল লর্ড। কেউ কিছু বলল না। একসময় পৌঁছে গেল বাংলোর সামনে। ঘড়িতে দুটো দশ বাজে।
বিকেলে দ্বীপটা ঘুরে দেখতে বেরোল, ক্যাপ্টেন তাদের ঘুরিয়ে আনবে। সে-ই গাড়ি ড্রাইভ করছে। তার পাশের সিটে বসেছে মেয়েটি। পেছনের সিটে ছেলেটি। দ্বীপের মার্কেট, আবাসিক এলাকা, বিদ্যুৎ প্রকল্প প্রভৃতি ঘুরিয়ে দ্বীপের পশ্চিম সৈকতে তাদের নিয়ে এলো। সৈকতটা ছোট কিন্তু মনোরম। সৈকতে আরামে হেলান দিয়ে বসার জন্য কয়েকটা চেয়ার পাতা আছে আর তার ওপর আছে বিশাল ছাতা এখানকার পানি গাঢ় নীল, টলটলে পরিষ্কার। বিলল ঢেউগুলো তীরে এসে শান্তভাবে ভেঙে যায়, আবার ফিরে আসে।
সূর্যটা যেন পানির ওপর এসে পড়েছে। সমুদ্রের লবণাক্ত পানিতে সূর্যের প্রতিচ্ছবি অত্যন্ত সুন্দরভাবে চিত্রায়িত হয়েছে। সূর্যের প্রভাবে পশ্চিমাকাশ রক্তিম হয়ে উঠেছে। আকাশে নানা ধরনের মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। একটু একটু ঠান্ডা লাগছে। দূর দিয়ে পাখির ঝাঁক উড়ে চলেছে। সবমিলে এক অপূর্ব পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। তিনজনেই কিছুক্ষণ সমুদ্রের হাঁটু পানিতে হাঁটাহাঁটি করে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। চেয়ারে হেলান দিয়ে বিশ্রাম করছে। তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। ছেলেটি ও মেয়েটির মাঝের চেয়ারে ক্যাপ্টেন বসেছে। সূর্যের অর্ধেকটা যেন পানির মধ্যে ডুবে গেছে। যেন একটা বিশাল আগুনের থালা হারিয়ে যাচ্ছে সমুদ্রে। একসময় ডুবে গেল পুরোটাই। পশ্চিমাকাশ এখনো রক্তিম আছে। একটু পরেই নামাজে দাঁড়িয়ে গেল ছেলেটি। ছেলেটি নামাজে দাঁড়াতেই উঠে দাঁড়াল ক্যাপ্টেন।
‘ম্যাডাম, আসুন আমরা গাড়িতে বসি, ততক্ষণে উনি আসুক’, বলে গাড়ির দিকে হাঁটতে লাগল ক্যাপ্টেন।
মেয়েটিও পিছে পিছে এলো। বুঝতে পারছে না ক্যাপ্টেন কেন তাকে নিভৃতে নিয়ে যেতে চাচ্ছে। গাড়িটা পশ্চিম দিকে মুখ করে দাঁড় করানো। দুজনই সামনে উঠে বসল। কেশে গলাটা পরিষ্কার করে মেয়েটির দিকে তাকাল ক্যাপ্টেন। ‘ম্যাডাম, আমিও আমার ভাইয়ের সঙ্গে এখান থেকে চলে যাব সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই দ্বীপে একটা স্কুল আছে। সেখানকার হেডমাস্টার খুব জ্ঞানী-গুণী লোক। চিন্তা করছি আমার বদলে তার হাতে এ দ্বীপের ভার তুলে দিতে বলব ভাইকে। আমার মনে হয়, এসব দায়িত্ব পালনে আমার চেয়ে তিনিই বেশি উপযুক্ত।
ভাইয়া আমাকে বলে দিয়েছে, তার রেখে যাওয়া সম্পদগুলো আমি যেন মানুষের বিশেষ করে মেয়েদের কল্যাণার্থে কাজে লাগাই। আমার মনে হয়, আমার চেয়ে তিনিই এ কাজের জন্য বেশি উপযুক্ত হবেন। এসব কাজের আনজাম তিনিই ভালো দিতে পারবেন। আমি আপনার প্রতি যথেষ্ট অন্যায় করেছি, কষ্ট দিয়েছি, আমাকে মাফ করবেন’, বলে কান্না ঢাকার জন্য অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল।
ক্যাপ্টেনকে কথা শেষ করার সুযোগ দিয়েছিল মেয়েটি। ‘আপনি এভাবে বলছেন কেন?’ ক্যাপ্টেনকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য মুখে যা এলো তাই তাড়াতাড়ি বলে ফেলল মেয়েটি।
‘আপনিও চলে যাবেন কেন, খুলে বলুন তো।’
‘শুধু আপনার জন্য’, সামনে তাকিয়ে উদাস কণ্ঠে বলল ক্যাপ্টেন।
‘আমার জন্য?’ কিছুটা হলেও অবাক হলো মেয়েটি। ক্যাপ্টেন যে তাকে পছন্দ করে তা সে আগেই জানে। কিন্তু সে যে এতটা ভালোবেসে ফেলেছে এটা সে জানে না।
‘হ্যাঁ, আপনার জন্য। কারণ আমি আপনাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলাম, আমার সেই স্বপ্ন অর্থহীন। আমি জানি আপনি আমাকে ঘৃণা করেন। আপনি আমাকে কখনো পছন্দ করবেন না। আপনি চাইলে আমি আপনার জন্য পৃথিবীর যে কোনো জায়গায় যেতে রাজি আছি, কিন্তু আমি জানি তা কখনো হবে না। এ দ্বীপে থাকলে আপনাকে আমার খুব মনে পড়বে, তাতে শুধু দুঃখই বাড়বে। তাই আমি আমার ভাইয়ে সঙ্গে চলে গিয়ে নতুন জীবন শুরু করতে চাই’, একনাগাড়ে দ্রুত কথাগুলো বলে থামল ক্যাপ্টেন। ‘সরি, বিয়ে করব না’, বলে দুহাত দিয়ে মুখ ঢাকল। পকেট থেকে রুমাল বের করল। মেয়েটিরও মন খারাপ হয়ে গেল। ‘আমি আপনার অবস্থা উপলব্ধি করতে পারছি, কিন্তু…’ বলে থেমে গেল মেয়েটি। ‘আপনি বলতে চান যে, কিন্তু আমি ওই ছেলেটিকে আমার জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসি’, বলে নামাজরত ছেলেটিকে দেখিয়ে বলল ক্যাপ্টেন। ‘ঠিক, বলিনি?’
ক্যাপ্টেনের অনুমান ক্ষমতা দেখে থ’ বনে গেল মেয়েটি। শুধু এতটুকু বলতে পারল ‘আপনি বুঝলেন কেমন করে?’ আর বলতে পারল না। লজ্জায় মুখ ঢাকল সে।
‘আমি সাইকোলজির ছাত্র ছিলাম’, বলল ক্যাপ্টেন। যেন এতেই সব ব্যাখ্যা আছে। কিছু বলতে যাবে মেয়েটি, হঠাৎ চুপ হয়ে গেল ছেলেটি আসছে বলে।
ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে গেল ক্যাপ্টেন। সামনে দাঁড়াল ছেলেটি। ছেলেটির আগেই ক্যাপ্টেন মুখ খুলল।
‘শুনুন, আমি আপনার ওপর অনেক নির্মম অত্যাচার করেছি, আমাকে আপনি আপনার ছোট ভাই মনে করে ক্ষমা করে দেবেন’, হাত জোড় করল ক্যাপ্টেন।
‘আরে, কী করছেন?’ বলে ক্যাপ্টেনের জোড় করা হাত দুটো পৃথক করে দিল সে। দৃশ্য দেখে গাড়িতে বসেই কেঁদে ফেলল মেয়েটি। একটু পর তাদের ঘুরতে দেখে মুখ লুকাল মেয়েটি।
‘আমি কিছুই মনে করিনি, আপনি শান্ত হোন’, বলে ক্যাপ্টেনের কাঁধে হাত রাখল ছেলেটি। চোখ মুছল ক্যাপ্টেন। ছেলেটিও নিজের চোখ মুছল। এগোতে যাবে ছেলেটি, থামাল ক্যাপ্টেন।
‘এটা নিন’, জিপের চাবির রিং বাড়িয়ে ধরল তার দিকে। সামনে শূন্যে দুহাত স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে বলল ‘প্লিজ…’, হেসে চাবির রিংটা হাতে নিল ছেলেটি। হাসি ফুটে উঠল বাকি দুজনের মুখেও।
পাহাড় বেয়ে ওপরে উঠছে জিপ। খুব সাবধানে গাড়ি চালাচ্ছে ছেলেটি। পাশের সিটে বসেছে মেয়েটি। পেছনের সিটে ক্যাপ্টেন। মৃদু-মন্দ হাওয়া বইছে। মেয়েটির চুলগুলো বাতাসে উড়ছে। আকাশে চাঁদ উঠেছে। মনোরম পরিবেশের মধ্য দিয়ে ছুটছে গাড়ি। উইন্ডশিল্ডের মধ্য দিয়ে হেডলাইটের আলোয় উদ্ভাসিত রাস্তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ছেলেটি।
‘আপনি খুব সুন্দর করে গাড়ি চালাতে পারেন, স্বীকার করতে আপত্তি নেই, আমিও এতটা পারি না’, পিছনে থেকে মৃদু হেসে বলল ক্যাপ্টেন।
‘যাহ!’ লজ্জা পেল ছেলেটি। এরপর আর কোনো কথা হলো না। পেছন থেকে ক্যাপ্টেন দেখছে, মেয়েটি কিছুক্ষণ পরপর ছেলেটির দিকে তাকাচ্ছে। কিন্তু ছেলেটি একবারও তাকায়নি। ডাইনিং রুমে বিশাল টেবিলে খেতে বসেছে লর্ড, ক্যাপ্টেন, ছেলেটি ও মেয়েটি। খাবার পরিবেশন করছে একজন ওয়েটার।
‘আপনাদের আমেরিকা যাওয়ার সব বন্দোবস্ত করে ফেলেছি’, খেতে খেতেই বলল লর্ড। কাল সাড়ে চারটায় জাহাজ নোঙ্গর তুলবে, আপনারা প্রস্তুত থাকবেন।’
‘আচ্ছা’ দুজনে একই সঙ্গে সাড়া দিল। খাওয়া শেষে টুকটাক গল্প করে সবাই উঠল।
‘দুজনের জন্য দুটো সুন্দর সাজানো-গোছানো কামরা দেয়া হয়েছে, বাথরুম বারান্দাতে আছে। যার যার কামরায় এসে ঢুকল দুজনে।
পরদিন সকালে গোসল করে সব গুছিয়ে প্রস্তুত হলে গেল দুজনে। তাদের দুজনকে লর্ড একটি করে সুন্দর চামড়ার ব্যাগ দিয়েছে। আর দিয়েছে ছেলেটির জন্য এক জোড়া শার্ট-প্যান্ট। মেয়েটিকে দিল একটি থ্রি-পিস। কাপড়গুলো অত্যন্ত দামি। আরো দিয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী। গতকাল মূল দ্বীপে পৌঁছে ইঞ্জিনিয়ার তাদের কমপক্ষে কাপড়ের ব্যাগ দুটো নেয়ার জন্য খুব অনুরোধ করল।
‘আপনি আমাদের জন্য যা করেছেন, তার ঋণ কোনোদিন শোধ করতে পারব না, ঠিক আছে আপনার কথা রাখছি’, ছেলেটি তার জন্য একজোড়া শার্ট-প্যান্ট বের করে নিয়েছে। মেয়েটিও তাই করেছে। তারপর আর কিছু বলেনি। বাকি মালপত্র নিয়ে বাড়িতে ফিরে গেছে। সব চামড়ার ব্যাগ গুছিয়ে নিয়েছে। আমেরিকায় ঢুকলেই প্রয়োজন হবে বলে কিছু ডলার দিয়েছে। বাকি সময়টা বাংলো ঘুরে, লর্ড কোয়ার্টার ও আশপাশটা ঘুরে কাটিয়ে দিল। তাদের সঙ্গে ছিল ক্যাপ্টেন।
লর্ডের রুচির তারিফ করতে হবে। সে বাংলোটাকে রাজপ্রাসাদতুল্য করে বানিয়েছে। নীচতলায় একটা মিউজিয়ামও গড়ে তুলেছে। সেখানে তার সব সংগ্রহের জিনিস সাজানো আছে। তার সংগ্রহের কতগুলো অনেক দামি জিনিস।
আজ দুপুরের আগেই খেয়ে-দেয়ে বিশ্রাম নেয়ার জন্য ঘুরে-ফিরে কেবল বিছানায় শুয়েছে। এই সময় বেড লকারের ওপর রাখা টেলিফোন সারা ঘরে মৃদু মিউজিকের আওয়াজ ছড়িয়ে দিল। রিসিভার কানে ঠেকাল ছেলেটি। ‘হ্যালো!’ ওপাশ থেকে ভেসে এলো, আমি অবসরপ্রাপ্ত মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, চিনতে পারছেন?’
‘পারছি, অবসরপ্রাপ্ত কেন?’
‘একটু জোক করলাম, মাফ করবেন। শুনুন আজ বিকেলে আপনাদের বিদায় বেলায় কিন্তু আমিও উপস্থিত থাকব।’
‘অবশ্যই।’
‘আপনাদের জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে, রাখি গুডলাক।’
‘মানে?’ লাইন কেটে যাওয়ায় জবাব মিলল না।
একইভাবে মেয়েটিকেও ফোন করল ইঞ্জিনিয়ার।
কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে প্রস্তুত হয়ে ব্যাগ হাতে ঠিক আড়াইটায় নীচে নেমে এলো ছেলেটি। নীচে তাদের জন্য চেয়ারে বসে অপেক্ষা করছে লর্ড ও ক্যাপ্টেন। তাদের দুজনের জন্যও দুটো চেয়ার আছে।
‘বসুন, উনি ততক্ষণ আসুক’, ছেলেটিকে বলল ক্যাপ্টেন। কিন্তু বসল না ছেলেটি। একটু দূরে চৌদ্দ-পনেরজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। সেদিকে এগোলো সে। সেখানে ছেলেটির পরিচিত অনেক মুখ আছে। প্রথমেই দাঁড়াল সেই দুজনের সামনে, যারা তাকে প্রথমদিন খুব কষ্ট দিয়ে এখানে নিয়ে এসেছিল।
‘আমাদের মাফ করবেন’, মাথা নীচু করে বলল দুজনই। ‘এসব বলে লজ্জা দেবেন না’, বলে তাদের মাথা উঁচু করে দিল। আর কিছু না বলে তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরে গেল।
এবার দাঁড়াল তাদের সামনে যাদের বন্দী করে সে মেয়েটিকে নিয়ে পালিয়েছিল। তাদের কেউ তাকে কিছু বলল না বা বলতে পারল না। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এলো আরেকজনের সামনে। এ লোকটি প্রথম দিন তাকে রুটি খাইয়ে দিয়েছিল। তাকে নামাজের জন্য ডেকে দিয়েছিল।
‘তুমি, তুমি আমার ছেলের মতো’, লোকটি যে অনেক কষ্টে কান্না চেপে রেখেছে তা বুঝতে কষ্ট হলো না ছেলেটির। তার চোখের কোণগুলো চিক চিক করছে।
‘হ্যাঁ’, সায় দিল ছেলেটি। আর কিছু বলতে পারল না লোকটি। হাত মেলাল আর সঙ্গে। কিন্তু লোকটি যেন তার হাতটা ছাড়তে চাচ্ছিল না। নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও হাতটা সরিয়ে নিল ছেলেটি। ডান হাতটা তার কাঁধে রাখল, কিছু বলতে পারল না। তার চোখেও পানি এসে গেল। কান্না লুকানোর জন্য ঝট করে ঘুরে দাঁড়াল লোকটি।
আরো কয়েকজনের মুখ চেনে ছেলেটি। কিন্তু তারা এখানে উপস্থিত নেই। বাকি সবার সঙ্গে হাত মিলিয়ে মাথা নীচু করে ফিরে এলো সে।
ততক্ষণে মেয়েটি বেরিয়ে এসেছে। চেয়ারে বসেছিল। এতক্ষণ সবাই তার দিকে তাকিয়ে ছিল। সে ফিরে আসতেই উঠে দাঁড়াল।
‘পৌনে তিনটা বাজে। সময় কম; রওনা হওয়া যাক, কি বলেন?’ দাঁড়িয়ে ছেলেটিকে বলল লর্ড।
‘ঠিক আছে’, বলে সামনে এগোলো ছেলেটি। ‘দুটো গাড়ি কেন?’
‘সামনেরটায় আপনারা দুজন, পেছনেরটায় আমরা’, বলেই ড্রাইভিং সিটে উঠে বসল ক্যাপ্টেন।
‘একটাতেই তো যাওয়া যেত’, এগিয়ে এসে বলল ছেলেটি।
‘কেন, কোনো অসুবিধা আছে? ওই যে উনি উঠে বসেছেন, আপনিও উঠুন।’ নরম গলায় বলে ক্যাপ্টেনের বামপাশে উঠে বসল লর্ড। অগত্যা ছেলেটি ড্রাইভিং সিটে উঠে বসল। পাশে বসে আছে মেয়েটি। গাড়ি এগোতে শুরু করতেই দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর উদ্দেশে হাত নাড়ল, ছেলেটি, সেই সঙ্গে মেয়েটিও। তাদের গাড়িটা সামনে আছে। পেছনে আসছে আপনারটা। চুপচাপ সামনের দিকে গাড়ি চালাচ্ছে ছেলেটি। নীচে নামছে। ‘এদের ছেড়ে যেতে আমার খুব খারাপ লাগছে’, নীরবতা ভাঙল মেয়েটি।
‘আমারও’, সামনে তাকিয়েই জবাব দিল ছেলেটি।
দ্বীপের ছোট্ট শহরটার মধ্য দিয়ে দ্রুত ছুটছে গাড়ি দুটো। চারটার একটু পরই তারা বন্দরে পৌঁছে গেল। গাড়ি দুটো পার্ক করে নেমে পড়ল সবাই। পাশেই নোঙর করে আছে ছোট জাহাজটা।
কাঠের লম্বা সিঁড়ি দিয়ে জাহাজে উঠতে যাবে এমন সময় একটা গাড়ি হার্ড ব্রেক করে থেমে গেল। ড্রাইভারের পাশের সিট থেকে লাফিয়ে নামল ইঞ্জিনিয়ার।
ড্রাইভারকে ‘গুডলাক’ বলে তাদের উদ্দেশে হাত নেড়ে তাদের কাছে এলো। নীরবে চওড়া সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠছে। সবার মনই ভারাক্রান্ত। জাহাজে উঠতেই একজন তাদের স্বাগত জানাল। লর্ডকে দেখে স্যালুট করল। পরিচয় করিয়ে দিল লর্ড ‘ইনি এই জাহাজের ক্যাপ্টেন, আর এনারা আমার সম্মানিত বিদায়ী অতিথি’, তাদের দেখিয়ে বলল।
তারা এসে দাঁড়াল জাহাজের ডেকে। ক্যাপ্টেনের হাতের প্যাকেটটা এ প্রথম দেখতে পেল। সময় কম, কোনো ধরনের ভূমিকা ছাড়াই শুরু করল লর্ড ‘আমি আগামী তিন দিনের মধ্যে যারা এই দ্বীপে বন্দী আছে তাদের নিজ নিজ দেশের তীরে নামিয়ে দেয়ার জন্য পাঠিয়ে দেব, হয়তো আগামী দশ-বারো দিনের মধ্যে তারা বাড়িতে ফিরতে পারবে। তাদের মোটা অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে।’ থামল লর্ড। এরপর বিভিন্ন স্থানে নিযুক্ত আমার এজেন্টের সঙ্গে ও অন্যান্য চক্রের সঙ্গে দেনা-পাওনা মিটিয়ে বাকি কাজ শেষ করে আগামী সাত দিনের মধ্যে আমি এ দ্বীপাঞ্চল ত্যাগ করব। আমার সঙ্গে নাকি এও যাবে।’ বলে ক্যাপ্টেনকে দেখাল লর্ড। তাহলে আমার একজন সঙ্গী বাড়বে, ভালোই হলো। সবাই মাথা নীচু করে কথা শুনছে। ‘সে প্রস্তাব করছে এ দ্বীপের স্কুলের হেডমাস্টারকে এ দ্বীপের দায়িত্বভার দিয়ে যেতে, আমি রাজি হয়েছি। কারণ লোকটি সৎ, নীতিবান ও জ্ঞানী। আমি এ দ্বীপ ছেড়ে চলে যাওয়ার আগেই আমেরিকায় প্রবেশ করবেন। তাই আপনাদের কাছে আমার একটা অনুরোধ আপনারা কি রাখবেন?’ বলে ক্যাপ্টেন বাদে সবার মুখের দিকে তাকাল লর্ড। লর্ডকে থামতে দেখে সবাই মুখ তুলে তাকাল।
‘আপনারা হয়তো ভাবছেন, অনুরোধটা হয়তো কঠিন হবে আসলে তা না’, সবাইকে চুপ করে থাকতে দেখে বলল লর্ড।
‘অনুরোধটা হলো, আপনারা ভালোভাবে আমেরিকায় পৌঁছে প্রথমে পাঁচ-সাত দিন আমাদের সম্পর্কে কাউকে কিছু জানাবেন না। কারণ তাতে বিভিন্ন দেশ তাদের কোস্টগার্ডদের সতর্ক করে দিলে আমরা হয়তো ধরা পড়ে যাব। ফলে আমাদের আর নতুন জীবন শুরু করা যাবে হবে না। বিশ্বাস করুন, আমরা আর কখনোই নিজেদের অপরাধের সঙ্গে জড়াব না’, যেন কেঁদে ফেলবে লর্ড।
‘ঠিক আছে, আমরা আপনার কথা রাখব’, মুখ ফসকে বলে ফেলল ইঞ্জিনিয়ার।
‘আপনি তো এখানেই থাকছেন, আপনার তো কথা রাখার প্রশ্নই ওঠে না’, কথাটা ধরল মেয়েটি।
‘তাই তো! কিন্তু আপনারা কিছু বলছেন না, এদিকে লর্ডের অবস্থা দেখে মুখ ফসকে বলে ফেলেছি।’ কাঁচুমাচু করে বলল ইঞ্জিনিয়ার।
‘উহু। আপনি দুপুরে টেলিফোন করে বলেছিলেন যে, আপনি আমাদেরকে সারপ্রাইজ দেবেন, সেটা কী?’ বলল ছেলেটি।
‘তাহলে তো ওটাও মুখ ফসকে বলে ফেলেছি’, যেন কৈফিয়ত নিল ইঞ্জিনিয়ার।
‘উহু। আমাকেও বলেছিলেন, দুবার মুখ ফসকাতেই পারে না’, বলল মেয়েটি।
‘আমার মনে হয় আপনি আমাদের সঙ্গে যাচ্ছেন। তার কারণ আপনি আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। অথচ আপনার দাঁড়ানোর কথা ওনাদের পাশে’, বলল ছেলেটি।
‘আমি তো দেখছি, আপনারাই আমাকে সারপ্রাইজ দিলেন’, এ কথায় সবাই হেসে উঠল।
হাসি থামিয়ে মেয়েটি বলল, ‘আপনি কেন আমাদের সঙ্গে যাবেন?’
‘পরে খুলে বলব’, বলল ইঞ্জিনিয়ার। হাসিতে মুখ ভরে গেছে।
‘ঠিক আছে, আপনার অনুরোধ রাখার চেষ্টা করব’, বলল ছেলেটি। মেয়েটিও বলল।
‘আপনাদের ঋণ শোধ করার নয়, তাই বিনিময় নয়, ফ্লাওয়ার্স আইল্যান্ডের পক্ষ থেকে আপনাদের বিদায়কালে যৎসামান্য উপহার দেয়া হবে প্লিজ গ্রহণ করে আমাদের ধন্য করুন’, বলল লর্ড।
ক্যাপ্টেন বাম হাতে কাগজের প্যাকেটটা রেখে ডান হাতে খুলে ফেলল কভারটা। প্যাকেটের ভেতর থেকে একটা বড় টকটকে লাল গোলাপ বের করল। সেটি ধরিয়ে দিল মেয়েটির হাতে। এরপর ছেলেটির, তারপর ইঞ্জিনিয়ারের হাতে একটা করে গোলাপ ফুল গুঁজে দিল।
‘ফ্লাওয়ার্স আইল্যান্ডের শেষ উপহার ফুল, আর অফুরন্ত ভালোবাসা’, বলল ক্যাপ্টেন।
‘আমাদের তিনজনের পক্ষ থেকেও’, বলল মেয়েটি। ‘আপনাদের দুজনকে ফ্লাওয়ার্স আইল্যান্ডের সব বাসিন্দার পক্ষ থেকে ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছি’, বাকি দুজন মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।
‘আপনাদেরও ধন্যবাদ’, বলল লর্ড।
ঘড়ির দিকে তাকাল ছেলেটি। চারটা পঁচিশ বাজে। হাত থেকে ঘড়িটা খুলে ফেলল। বাড়িয়ে ধরল ক্যাপ্টেনের দিকে। ‘এই যে আপনার ঘড়ি, নিন এক মুহূর্ত অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে ছেলেটির হাত থেকে নিল ঘড়িটা। আবার বাড়িয়ে ধরল তার দিকে। ‘সেদিন আপনার মৃত্যুর কত সময় বাকি আছে তা দেখার জন্য দিয়েছিলাম, কিন্তু আজ আপনাকে এটা আমার পক্ষ থেকে উপহার হিসেবে দিচ্ছি, প্লিজ নিন’, নিয়ে নিল ছেলেটি। হাসি ফুটে উঠল সবার মুখে। হাতে পরে নিল ঘড়িটি। বিদায় নেয়ার সময় হয়ে এলো, হয়তো আপনাদের সঙ্গে আর দেখা হবে না’, বলতে বলতে তাদের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে নিল ক্যাপ্টেন ও লর্ড। ‘আপনারা সুখে থাকুন, শান্তিতে থাকুন, চলি গুডলাক’, বলেই আর দাঁড়াল না লর্ড। ঘুরে পা বাড়াল। তার পেছন পেছন ক্যাপ্টেন। আশপাশে তারা ছাড়া আর কেউ নেই।
একটু পর নোঙর তুলল জাহাজ। জাহাজের রেলিং ধরে দাঁড়াল তিনজন। নীচে দাঁড়িয়ে আছে ফ্লাওয়ার্স আইল্যান্ডের লর্ড ও তার সহযোগী ক্যাপ্টেন। তাদের দেখে হাত নাড়ছে। তারাও প্রতিউত্তর দিচ্ছে। ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে জাহাজটি। পেছনে কারো কাশির আওয়াজ পেয়ে তিনজনই ঘুরে দাঁড়াল। দেখল এ জাহাজের ক্যাপ্টেন দাঁড়িয়ে আছে। তাড়াতাড়ি তিনজনই চোখ মুছল। ‘চলুন, আপনাদের থাকার ঘর দেখিয়ে দিই’, বলে হাঁটতে শুরু করল ক্যাপ্টেন তার পেছনে চলল তিনজন।
সেদিনই সন্ধ্যার পর জাহাজের ছাদে তাদের বিকেলের চা-নাশতা দেয়া হয়েছে। বিকেলটা তাদের নিজ নিজ ঘর গোছাতেই কেটে গেল। বড় একটা ছাতার নীচে একটা গোলটেবিল ঘিরে সবাই বসেছে। তাদের সামনে গরম স্যান্ডউইচ চলে এসেছে। ইঞ্জিনিয়ার একটা স্যান্ডউইচ কেবল হাতে নিয়েছে এমন সময় ক্যাপ্টেন এলো, তবে বসল না।
‘আমি একটু ব্যস্ত আছি, আপনাদের সঙ্গে অন্য সময় বসব, আপনারা ভালোভাবে খাবেন, কোনো সমস্যা হলেই আমাকে জানাবেন’, এক মুহূর্ত থামল ক্যাপ্টেন। ‘আর আপনাদের সময় কাটানোর জন্য লর্ড কিছু বই দিয়েছে ইচ্ছে করলেই সেগুলো নিয়ে পড়তে পারেন, গুডবাই’, বলে ইঞ্জিনিয়ারের দিকে দুষ্টুমি করে চোখ টিপে চলে গেল। তারা দুজনে যে বন্ধু মানুষ, তাই। বাকি দুজনও খেতে শুরু করল। কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলল না। সবাই যেন ধ্যানমগ্ন হয়ে আছে। চাঁদের স্নিগ্ধ আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। কিছুক্ষণ পরপর সাগর থেকে ভেসে আসা ঠান্ডা বাতাসে কেঁপে উঠল। নীরবতা ভাঙল মেয়েটি। শেষ স্যান্ডউইচটা তুলে নিতে নিতে ইঞ্জিনিয়ারকে লক্ষ্য করে বলল, ‘এবার আপনার কাহিনি শুরু করুন।’
এক গ্লাস পানি শেষ করে রুমাল দিয়ে মুখ মুছে শুরু করতে যাবে ইঞ্জিনিয়ার, এমন সময় কফি নিয়ে এলো ওয়েটার। কফিতে দুই চুমুক দিয়ে শুরু করল ইঞ্জিনিয়ার, ‘আমি আমেরিকান একজন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, তবে কোথাও চাকরি করি না।’ কফির কাপে আবার চুমুক দিল ইঞ্জিনিয়ার, ‘আমি একজন ফ্রিল্যান্স ক্রাইম রাইটার’, যেন বোমা ফাটাল ইঞ্জিনিয়ার। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, এসব পত্রিকায় মাঝেমধ্যেই আমার লেখা প্রকাশ পায়’, সহজে সাধারণভাবে বলে চলেছে লোকটি। ফ্লাওয়ার্স আইল্যান্ডের লর্ডের জাহাজে চাকরি নেয়ার পর থেকে পত্রিকায় আমার লেখা প্রকাশ পায়নি, তবে ফিরতে পারলে এক মাসের মধ্যে নারী পাচারের ওপর ধারাবাহিক প্রতিবেদন লেখা শুরু করব। হয়তো সেগুলো নিউ ইয়র্ক টাইমস বা ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশ পাবে’, কফি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে দেখে কয়েক চুমুকেই শেষ করল। ‘প্রায় এক বছর আগে জানতে পারি আফ্রিকা থেকে অনেক নারী পাচার হয়ে যাচ্ছে। বাবা-মা ডিভোর্স হয়েছিল অনেক আগে, আমি একাই থাকতাম’, বলে থামল ইঞ্জিনিয়ার।
‘আপনি বিয়ে করেননি?’ জিজ্ঞেস করল মেয়েটি।
‘না। যা-ই হোক তারপর চলে এসেছিলাম আফ্রিকায়, প্রায় এক মাস খোঁজখবর করে অনেক কিছু জানতে পারলাম। শেষে ঠিক করলাম এদের আস্তানার সবকিছু জানতে হবে, বলতে গেল একদিন ভাগ্যক্রমে সুযোগ পেয়েও গেলাম। যে জাহাজে করে আপনাদের প্রথম দ্বীপ থেকে মূল দ্বীপে আনা হয়েছিল, সে জাহাজটা দক্ষিণ আফ্রিকার এক তীরে ভেড়ে। খবর পাই, সে জাহাজের ফার্স্ট মেরিন ইঞ্জিনিয়ার আসার পথে রাতে প্রচুর ড্রিংক করে জাহাজ থেকে পানিতে পড়ে মারা গেছে। এই সুযোগে আমি ছদ্ম পরিচয়ে জাহাজে চাকরি নিই।’
‘ফ্লাওয়ার্স আইল্যান্ডে পৌঁছে থাকার জন্য লর্ড আমাকে ওই বিয়াল্লিশ নম্বর বাড়িটা দিয়েছিল। তারপর থেকে আমি সব খোঁজখবর নিতে থাকি। গত তিন মাস থেকে আমিও এদের হাত থেকে মুক্ত হয়ে আমেরিকায় পাড়ি জমানোর চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু পারছিলাম না। কারণ পালালেই ওরা আমাকে ধাওয়া করত। আমার মুখ বন্ধ করে দিত। আজ আপনাদের সঙ্গে সঙ্গে আমারো সৌভাগ্যের দ্বার খুলে গেছে’, বলে থামল ইঞ্জিনিয়ার।
‘গতকাল এই দ্বীপে লর্ডের কাছ থেকে সব শোনার পর, মূল দ্বীপে ফিরে লর্ডকে সুকৌশল আরো যাচাই করি। শেষ পর্যন্ত নিশ্চিত হই যে, লর্ড তাদের সঙ্গে প্রতারণা করছে না। তখন আমি লর্ডকে আমার পরিচয়ও দিয়ে দিই। প্রথমে আমার কথা শুনে তিনি অবাক হয়ে যান। আমি তাকে আপনাদের সঙ্গে আমেরিকায় ফিরে যাওয়ার কথা বললে তিনি একবাক্যেই রাজি হয়ে যান এবং আমার সব বকেয়া বেতন পরিশোধ করে দেন। তবে তিনি আমাকে এমনভাবে প্রতিবেদন লেখার অনুরোধ জানান যেন পরবর্তীতে দ্বীপ বাসিন্দাকে কোনো ঝামেলায় জড়াতে না হয়’, বলে থামল লোকটি।
মুখে হাসি ফুটে উঠল ইঞ্জিনিয়ারের। ‘গতকালই আপনাদের সারপ্রাইজ দেয়ার ব্যাপারটা লর্ড-ক্যাপ্টেনকে জানাই, কিন্তু আপনারাই আমাকে সারপ্রাইজ দিয়েছেন’, বলে হো হো করে হেসে উঠল ইঞ্জিনিয়ার। ‘আর কিছু বলার নেই’, হাসি থামিয়ে বলল সে।
‘এখন ওঠা যায়’, বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল ছেলেটি। দীর্ঘক্ষণ পর সে মুখ খুলল।
‘প্লিজ, বসুন, আর কিছুক্ষণ গল্প করি’, মেয়েটির কণ্ঠে অনুরোধের ছোঁয়া আছে।
‘ঠিক আছে, আপনারা গল্প করুন’, বলে পা বাড়াল ছেলেটি। মন খারাপ হয়ে গেল মেয়েটির। উঠে পড়ল দুজনে।
নীচে নামছে তিনজনই। ছেলেটির পাশে আছে ইঞ্জিনিয়ার। মেয়েটি পেছনে আছে।
‘আপনি যদি কিছু মনে না করেন, তবে আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?’ হঠাৎ করেই ছেলেটিকে বলল ইঞ্জিনিয়ার।
‘বলুন’, বলল ছেলেটি।
‘উম’, যেন জিজ্ঞেস করতে দ্বিধাবোধ করছে ফ্রিল্যান্স রাইটার। আপনি যে গার্ডদের কাছ থেকে রাইফেল নিয়েছিলেন, তো আপনি কি রাইফেল চালাতে জানেন?’
‘জি’, নির্লিপ্তভাবে জবাব দিল।
‘কীভাবে জানলেন? আই মিন কোথায় শিখেছেন?’
‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোরে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের স্কুল-কলেজ পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের যুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়, যেন তারা সঙ্কটকালে দেশ বাঁচাতে হাতে অস্ত্র তুলে নিতে পারে’, বলে থামল ছেলেটি। কী ভেবে, আপনি কি মনে করেছিলেন, আমি কোনো মুজাহিদ গ্রুপের সদস্য?’ প্রশ্ন করল ছেলেটি।
‘না’, অপ্রস্তুত হয়ে গেল রাইটার। ‘শুধু কৌতূহল মেটানোর জন্যই আপনাকে জিজ্ঞেস করেছি।’
আর ওই ব্যাপারে কোনো কথা হলো না। দেখা হয়ে গেল জাহাজের ক্যাপ্টেনের সঙ্গে।
‘চলুন, জাহাজের কোথায় কী আছে তা আপনাদের ঘুরিয়ে দেখাই’, বলল ক্যাপ্টেন।
পরদিন কেবল সূর্য উঠেছে। সুন্দর এক সকাল। মেয়েটি জাহাজের রেলিংয়ের ধারে চেয়ারে বসে আছে। তার পাশের কামরাটা ছেলেটির। তার পরেরটা ইঞ্জিনিয়ারের। দুজনের কেউই এখনো বাইরে বের হয়নি।
ছেলেটি কে? তার পরিচয় কী? তার নাম, ঠিকানা এখনো তার পক্ষে জেনে নেয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনি। কেন যেন ছেলেটির সামনে দাঁড়িয়ে ব্যক্তিগত কথা বলতে তার মুখের কথা জড়িয়ে যায়। বেশ কয়েক দিন চেষ্টা করেও সে তার নামটা পর্যন্ত জিজ্ঞেস করতে পারেনি। ছেলেটিও তার সম্পর্কে কোনোদিন কিছু শুনতে চায়নি। যেন তার প্রতি তার কোনো আগ্রহই নেই। এ জন্যই হয়তো সে পারেনি।
বিমানবন্দরের ওই ঘটনার পর থেকে সে ছেলেটির সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করত। নিজে বাঁচার জন্য তার সঙ্গে অনেক দুর্ব্যবহার করেছে। কিন্তু বাংলো থেকে পালিয়ে বের হওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে তার আগের ধারণা পাল্টে যেতে থাকে। সে অনেকভাবে খেয়াল করে দেখেছে, নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া তার দিকে ছেলেটি তাকায়নি, আর তাকালেও এক পলকের জন্য। সবসময় চোখ নীচের দিকে রেখেছিল। বিশেষ করে ফ্লাওয়ার্স আইল্যান্ড থেকে পালানোর সময় নৌকা উল্টে অন্য দ্বীপে ওঠার পর যেন এ ব্যাপারে সে আরো সতর্ক হয়ে গিয়েছিল। আজ পর্যন্ত তার হাত পর্যন্ত সে স্পর্শ করেনি। অথচ সে অনেক যৌক্তিক সুযোগ পেয়েছিল। চতুর্থ দ্বীপে মোমের আগুনে হাত দেয়ার ঘটনাটাও সে অনুমান করে নিয়েছে। এসবের কারণেই কি সে তার প্রতি অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছে? বাংলো থেকে পালানোর পর যখন ঢাল বেয়ে দুজনে গড়িয়ে পড়ার সময় যা ঘটেছিল তারপর থেকেই সে তাকে পছন্দ করতে শুরু করে। কিন্তু সে ছেলেটিকে এখনো তার হৃদয়ের কথা কোনোভাবেই জানাতে পারেনি। কেন পারেনি তা নিজেও ভালোভাবে জানে না। সকালের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে কখন যে ভাবনার রাজ্যে বিচরণ করতে শুরু করেছিল তা নিজেও বলতে পারবে না। কারো গলার আওয়াজে ভাবনায় বাধা পড়ল।
‘গুড মর্নিং। কেমন আছেন?’
তাকালো মেয়েটি। ঘর থেকে কেবল বের হচ্ছে ইঞ্জিনিয়ার। তাকেই উদ্দেশ করে বলছে। আশপাশে আর কেউ নেই।
‘গুড মর্নিং, ভালোই আছি। আপনি কেমন আছেন?’
‘ভালো’, হেসে জবাব দিল। পাশে এসে দাঁড়াল ইঞ্জিনিয়ার। ঘরে ঢুকে আর একটা চেয়ার এনে তাকে বসতে দিল মেয়েটি।
‘এতদিন এক সঙ্গে থাকলাম, এখনো ছেলেটির নাম জানতে পারিনি’, কোনো প্রসঙ্গ ছাড়াই বলল মেয়েটি।
‘আমিও জানি না’, বলল ইঞ্জিনিয়ার।
‘প্লিজ, আপনি কি তার নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর ইত্যাদি জেনে নিতে পারবেন?’ বলতে বলতে রক্তিম হয়ে উঠল তার মুখখানা, ব্যাকুল ভাবটা লুকাতে পারল না।
‘কেন, খুবই দরকার?’ হেসে বলল ইঞ্জিনিয়ার। আবার কিছু বলতে যাবে এমন সময় এলো ক্যাপ্টেন।
‘ব্রেকফাস্ট রেডি, যেতে হবে।’
সেদিনই বিকেলবেলা। জাহাজের ছাদে ছাতির নীচে আবার তাদের বিকেলের নাশতা দেয়া হয়েছে।
‘ম্যাডাম, আমেরিকায় পৌঁছতে পারলে আপনি যাবেন কোথায়?’ হঠাৎ করেই প্রশ্ন করল ছেলেটি।
‘নিউ ইয়র্কে।’
‘সেখানে কে আছে?’ প্রশ্নটা করল ইঞ্জিনিয়ার।
‘আমার বাবা-মা, বড় ভাই-ভাবি।’
‘আপনারা কি বাংলাদেশি’, আবার জিজ্ঞেস করল ইঞ্জিনিয়ার।
‘জি।’
‘আমেরিকায় কত দিন থেকে আছেন?’ প্রশ্ন করেই চলল ইঞ্জিনিয়ার।
‘আমার ভাই আমার চেয়ে সাত বছরের বড়, আমার ভাইয়ের বয়স যখন পাঁচ বছর, তখনই বাবা আমাদের সবাইকে নিয়ে আমেরিকায় চলে আসেন। ওখানকার এক বড় ফার্মে চাকরি নেন। একপর্যায়ে আমরা আমেরিকার নাগরিকত্ব পেয়ে যাই। তারপর বাবা সেখানে ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। বর্তমানে বাবা-ভাই দুজনে ব্যবসা দেখাশোনা করছেন’, সংক্ষেপে খুলে বলল মেয়েটি।
‘এত প্রশ্ন করায় কিছু মনে নেবেন না, আসলে পত্রিকায় লেখার জন্যই এত প্রশ্ন করছি’, জানাল রাইটার।
‘ঠিক আছে, আপনি প্রশ্ন করুন’, আশ্বস্ত করল মেয়েটি।
‘আপনি বাংলাদেশে কেন গিয়েছিলেন?’
‘ছুটিতে, আত্মীয়-স্বজনদের কাছে।’
‘ওহ হো, এখনো আপনার নামটাই…’ শেষ করতে পারল না ইঞ্জিনিয়ার।
‘এক্সকিউজ মি, আপনারা গল্প করুন, আমি উঠছি’ বলে আর দাঁড়াল না ছেলেটি। অবাক হয়ে বাকি দুজন চেয়ে থাকল তার গমনপথের দিকে।
পরদিন সন্ধ্যার অনেক পর বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটি। চাঁদের স্নিগ্ধ আলোয় ভরে গেছে চারদিক। বাংলাদেশে থাকা মায়ের কথা ভাবছে সে।
মা কি জানে তার ছেলে এখনো বেঁচে আছে? আমেরিকায় বড় ভাই কি জানে তার ভাই তার কাছে ফিরছে? তার কাহিনি শুনে কি তাকে এত পরে ভর্তি করে নেবে। তা না হলে লেখাপড়ায় সে এক বছর পিছিয়ে যাবে।
কারো পদশব্দে ফিরে তাকাল ছেলেটি। মেয়েটি এদিকেই আসছে। ঘরে ঢুকে পড়ল ছেলেটি।
দুদিন পর সকাল বলে আমেরিকান উপকূল থেকে অনেক দূরে জাহাজ থেমে গেছে। আর এগোনো যাবে না। তিনজনই তৈরি। বোট নামানো হয়েছে পানিতে। বোটটা জাহাজের গায়ের সঙ্গেই লাগানো আছে। এ কদিন তাদের দেখতে দেখতেই চলে গেল। প্রতিদিন সকালে ব্রেকফাস্ট করত। দুপুরের আগেই গোসল করত। তারপর লাঞ্চ করে ঘুমাত। বিকেল বেলা চা-নাশতা করত। রাতে ডিনার করত। রাতে ঘুম দিত। বাকি সময়টা বিভিন্ন কাজে কেটে যেত। ছেলেটা বেশিরভাগ সময় ঘরে থাকত। বইপত্র পড়ত। মেয়েটাও পড়ত। তবে কখনো কখনো বারান্দায় বসে থাকত। বিশেষ করে সকাল বেলা। এ জাহাজের ক্যাপ্টেনের সঙ্গে ইঞ্জিনিয়ারের আগে থেকেই খাতির ছিল। দুজনে প্রায় গল্প-গুজবে মেতে থাকত। ইঞ্জিনিয়ার মাঝে মধ্যে মেয়েটিকেও সঙ্গ দিত।
তবে ছেলেটির সঙ্গে আর কোনো কথাবার্তা হয়নি। সেই সুযোগই সৃষ্টি হয়নি। যেন ছেলেটি হঠাৎ করেই তাদের কাছ থেকে অনেক দূরে সরে গেছে।
জাহাজ থেকে তিনজনই বোটে নামল। তাদের লাগেজ আগেই বোটে তোলা হয়েছে।
‘আপনাদের হয়তো তেমন আতিথেয়তা করতে পারিনি, মাফ করবেন’, রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে ক্যাপ্টেন।
‘যথেষ্ট করেছেন’, জবাব দিল ছেলেটি।
‘বন্ধু, হয়তো আর দেখা হবে না, বিদায়’, ইঞ্জিনিয়ারকে উদ্দেশ করে বলল ক্যাপ্টেন। আর পাশে দাঁড়িয়ে আছে এ জাহাজের ইঞ্জিনিয়ার।
‘বিদায়’, বলতে জাহাজের সঙ্গে বোটকে বেঁধে রাখা বাঁধনটা খুলে দিল ইঞ্জিনিয়ার। স্রোতের ধাক্কায় জাহাজ থেকে খানিকটা সরে গেল বোটটা।
বোটের ইঞ্জিন স্টার্ট দিল ইঞ্জিনিয়ার। তারপর স্টিয়ারিং ধরে গিয়ার দিল। যেন প্রাণ ফিরে পেল বোট। এগোতে শুরু করল। সবার চোখ ভিজে গেছে। বোট থেকে তারা হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছে আর জাহাজ থেকে তার প্রতিউত্তর আসছে।
একটু পর জাহাজের লোকগুলোকে আর দেখা যাচ্ছে না। এক সময় বিন্দুতে পরিণত হলো স্বয়ং জাহাজটাই।
বোটটা বেশ বড়। আর ইঞ্জিনটা বেশ শক্তিশালী। সাগরের বড় বড় ঢেউ কেটে দ্রুত এগিয়ে চলেছে। লাগেজগুলোকে যতদূর সম্ভব আড়াল করে রাখা হয়েছে। যাতে সাগরের ছিটকে আসা পানিতে না ভেজে।
বোটের পেছনে স্টিয়ারিং ধরে সামনের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে আছে ইঞ্জিনিয়ার। বোট সামলাতে ব্যস্ত।
বোটের মাঝামাঝি বসে আছে মেয়েটি। আশপাশে তাকানো ছাড়া তার আর কিছু করার নেই। একবার তাকাল সামুুদ্রিক মাছে পূর্ণ পাত্রটার দিকে। তার পাশে আছে তিনটা ছিপ। এসবও তাদের বোটে তুলে দেয়া হয়েছে। বোটের একদম সামনে বসে আছে ছেলেটি। তাকিয়ে আছে সামনে খোলা সাগরের দিকে। দুপুর নাগাদ পূর্বপরিকল্পিত একটা ছোট্ট দ্বীপে নামল তারা। কিছু নারকেল গাছ ছাড়া এ দ্বীপে আর কিছুই নেই। আশপাশে কয়েকটা ছোট ছোট দ্বীপ আছে।
জোহরের নামাজ পড়ে নিল ছেলেটি। এর মধ্যে বোট থেকে হটপট তিনটা দ্বীপের ছোট সৈকতে আনা হয়েছে। খাওয়া শেষ হলে বিশ্রাম নিতে বসল।
ইঞ্জিনিয়ার বোট চালিয়ে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। একটা নারকেল গাছের গায়ে হেলান দিয়ে চোখ বুজে বিশ্রাম নিতে শুরু করল। ছেলেটি বসে আছে। তারও চোখ বন্ধ।
মেয়েটি যে কখন তার সামনে এসে বসেছে টেরই পায়নি সে। মেয়েটি খেতে খেতেই ঠিক করে রেখেছে, যেভাবেই হোক ছেলেটিকে বলতে হবে। সময় শেষ হয়ে আসছে।
‘আপনি ঘুমাচ্ছেন?’ দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে বলল মেয়েটি।
কাছেই মেয়েটির গলার আওয়াজ পেয়ে চমকে উঠে চোখ খুলে তাকাল ছেলেটি। তার থেকে তিন-চার হাত সামনে বসে আছে মেয়েটি।
‘আপনাকে কিন্তু আমাদের নিউ ইয়র্কের বাসায় যেতে হবে’, এভাবেই শুরু করতে চাইল মেয়েটি।
‘কেন, আপনি একাইবা ওনাকে নিয়ে বাসায় পৌঁছতে পারবেন না?’ ইঙ্গিতে ইঞ্জিনিয়ারকে দেখাল ছেলেটি।
একটু ঘুরিয়ে জবাব দিল মেয়েটি। ‘আমি একাই যেতে পারব, তবে আপনাদের দুজনকেও আমাদের বাসায় যেতে হবে।’
কিছু না বলে মৃদু হাসল ছেলেটি।
এবার কী বলবে ভেবে পেল না মেয়েটি। হার্ট-বিট বেড়ে গেছে। বুক কাঁপছে। এমনকি শরীরটাও যেন থরথর করে কাঁপছে। আগেও এ ধরনের অবস্থা হওয়ায় বলতে পারেনি। এবার তাকে যে বলতেই হবে।
লাজ-লজ্জা সব ফেলে এবার সরাসরি বলার জন্য প্রস্তুত হলো মেয়েটি। অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত রেখে ‘আপনি কি কাউকে মানে কোনো মেয়েকে পছন্দ করেন?’ জিজ্ঞেস করল মেয়েটি নীচের দিকে তাকিয়ে। রাঙা হয়ে উঠেছে মুখ।
হতভম্ব হয়ে গেল ছেলেটি। মেয়েটি যে হঠাৎ এ ধরনের প্রশ্ন করবে তা কল্পনাও করেনি সে। সেই সঙ্গে সতর্কও হয়ে উঠল। কেটে গেল এক সেকেন্ড।
‘না’, সত্য কথাটাই বলল ছেলেটি। ‘হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন?’
থমকে গেল মেয়েটি। ছেলেটি যে তাকে পাল্টা প্রশ্ন করবে, তার জন্য প্রস্তুত ছিল না সে।
‘না, এমনি জিজ্ঞেস করলাম’, হঠাৎ মুখ দিয়ে বলে ফেলল মেয়েটি।
ঝট করে উঠে দাঁড়াল ছেলেটি ‘চলুন, রওনা দেই, সময় কম’, এগোলো ইঞ্জিনিয়ারের দিকে।
ছেলেটিকে বসে পড়ার জন্য বলবে মেয়েটি। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারল না। সূর্য অনেকটা পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে। এগিয়ে চলেছে বোট। বোটে সবাই বসে আছে আগের মতোই। সবাই যেন বড় বেশি চুপচাপ আছে। দূরে একটা জাহাজ দেখা যাচ্ছে। খুব ছোট।
চোখে দুরবিন লাগাল ইঞ্জিনিয়ার। ‘একটা আমেরিকায় কোস্টাল ডেস্ট্রয়ার, আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছে।’
‘আমাদের কাছে তো পাসপোর্ট, ভিসা নেই, এখন কী হবে?’ বলল মেয়েটি। দীর্ঘক্ষণ পর মুখ খুলল সে।
‘দেখা যাক, কী হয়’, জবাব দিল ইঞ্জিনিয়ার।
বোট এখন জাহাজটার দিকে ছুটছে। দুটো জলযান দ্রুত কাছাকাছি হচ্ছে। একসময় জাহাজ থেকে একটা স্পিডবোট তাদের দিকে রওনা দিয়েছে। ইঞ্জিনিয়ার বোটের ইঞ্জিন চালু রেখেই বোট থামিয়ে দিয়েছে।
স্পিডবোটটাও দূরেই ইঞ্জিন থামিয়ে ধীরে ধীরে তাদের পাশে এসে থামল। স্পিডবোটে একজন অফিসার, একজন ড্রাইভার ছাড়াও দুজন অস্ত্রধারী আছে। বোটে এসে উঠল অফিসার ‘আপনারা কে, কোথা থেকে আসছেন?’
স্টিয়ারিংয়ের পেছন থেকেই অফিসারকে বলল ইঞ্জিনিয়ার, ‘আমরা আমেরিকান, একটু বেরিয়েছিলাম।’
ইঞ্জিনিয়ারের কথা শুনতে শুনতে সবার মুখের দিকে একবার করে তাকাল অফিসার। ‘আপনারা তীর থেকে অনেক দূরে আছেনÑ সন্দেহজনক, আপনাদের পরিচয়পত্র?’ ভদ্রভাবেই বলল অফিসার।
‘এদিকে’, বলে ইঞ্জিনিয়ার তার পরিচয়পত্রটা বের করে ধরল।
পরিচয়পত্রটা হাতে নিয়ে চোখ বোলাতে লাগল অফিসার। ধীরে ধীরে মুখের ভাব বদলে গেল। হাসি ফুটে উঠল মুখে, ‘আপনিই নিউ ইয়র্ক টাইমস ও ওয়াশিংটন পোস্টের সেই ফ্রিল্যান্স রাইটার? দেড় বছর আগে আপনার এক ক্রাইম রিপোর্ট রীতিমতো আলোড়ন তুলেছিল।’ পরিচয়পত্রটা ফেরত দিতে দিতে উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বলল অফিসার।
‘জি’, শান্ত স্বরে জবাব দিল ইঞ্জিনিয়ার।
‘আপনার প্রায় সব লেখাই পড়েছি’, জানাল অফিসার। ‘আপনাদের জাহাজে নিয়ে গিয়ে অহেতুক হয়রানি করতে চাই না, আপনারা চলে যান’, বলেই স্পিডবোটে ওঠার জন্য ঘুরল অফিসার।
‘শুনুন’, ডাকল ইঞ্জিনিয়ার। ‘যেতে যেতে একটু দূরেই চলে গিয়েছিলাম, তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে, তাই আমাদের যেন আর কোথাও না থামায় তার জন্য যদি…’
শেষ করতে দিল না অফিসার ‘ঠিক আছে, আমি সে ব্যবস্থা করব’, বলেই স্পিডবোটে লাফিয়ে নামল অফিসার। স্টার্ট দিল স্পিডবোট। ‘গুডবাই’, বলে চলে গেল তারা।
বিকেল হয়ে এসেছে। চারদিকে শুধু পানি আর পানি। আকাশে নানা রঙের মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে মাথার ওপর দিয়ে। সবাই আগের মতোই নির্বাক হয়ে বসে আছে। অথচ প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু বলার আছে। অবশেষে মহান আল্লাহ তাদের বিপদ থেকে উদ্ধার করেছেন। তারা এখন আমেরিকার ভূ-খণ্ডের নিকটবর্তী। আমেরিকায় পৌঁছার পর প্রথমেই ভাইয়াকে সংবাদ দিতে হবে ফোনের মাধ্যমে লসঅ্যাঞ্জেলেসে। তারপর কী কী করতে হতে তা ঠিক করে নিল। আর কয়েক ঘণ্টা পর সহযাত্রী দুজনের কাছ থেকে সে পৃথক হয়ে যাবে। ইঞ্জিনিয়ার তাদের জন্য যা করেছে তা সত্যিই অতুলনীয়। লোকটি চমৎকার। লোকটির সঙ্গে তার ভাব হয়ে গেছে। তাকে ছেড়ে যেতে তার খুবই খারাপ লাগবে।
আর মেয়েটি? মেয়েটির সঙ্গে সে দীর্ঘদিন ছিল। মেয়েটি অত্যন্ত ভালো ছিল। সে তাকে যথেষ্ট সহযোগিতা করেছে। মেয়েটিকে সে বোনের মতো দেখেছে। তার নিজের এক ছোট বোন ছিল। সে রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। এ মেয়েটিকে সে কোনো দিন ভুলতে পারবে না, তা সম্ভব নয়।
বোটের গায়ে হেলান দিয়ে বসেছে মেয়েটি। তাকিয়ে আছে নীল আকাশের দিকে। শুরু করেও তাকে বলতে পারল না। সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। এখন বলবে, নাহ, এখন পারবে না। দুজনকেই সে তাদের বাসায় নিয়ে যাবে। তারপর সুযোগ মতো বলবে ছেলেটিকে। সামনাসামনি বলতে না পারলেও নাম-ঠিকানা জেনে নিয়ে যোগাযোগ করবে।
একটা জিনিস কিছুতেই তার মাথায় ঢুকছে না। তা হলো ছেলেটির সঙ্গে সে অনেক দিন ছিল। অনেক কথাও বলেছে, অবশ্য প্রয়োজনীয়। তারপরও তাদের মধ্যে যে বিশাল ব্যবধান রয়ে গেছে। ছেলেটিকে তার মনের কথা বলতে না পারার কি এটাই কারণ? শেষ পর্যন্ত তাকে জানাতে পারবে তো?
স্টিয়ারিং ধরে খোলা সাগরের দিকে তাকিয়ে আছে ইঞ্জিনিয়ার। পশ্চিম দিকে এগোচ্ছে বোট। সামনে বসে থাকা দুজনের দিকেই একবার করে তাকাল। মেয়েটি খুবই সহজ, সরল, ভদ্র, মিশুক, তার সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্যই সে নিয়েছে। আর এখন পর্যন্ত ছেলেটির নামটি পর্যন্ত জানতে পারেনি। বড়ই অদ্ভুত ব্যাপার। আসলে ছেলেটিই অদ্ভুত। সে কিছুতেই তার সম্পর্কে তথ্য জোগাড় করতে পারেনি। ছেলেটি তো পরিবেশ সৃষ্টিরই সুযোগ দেয়নি। তারপরও তিন-চারবার তার নাম জিজ্ঞেস করেছিল। আর সে কী করেছিলÑ উত্তর দেয়ার বদলে এমন প্রসঙ্গ তুলে তাকে তার প্রশ্নের কথা একটু পরে বেমালুম ভুলিয়ে দিয়েছিল। এরূপ তার আগে কখনো হয়নি। এখন সে বোট সামলানোতে ব্যস্ত। সে তো পালাচ্ছে না। নিউ ইয়র্কে পৌঁছে সব জেনে নেবে। তা না হলে… চিন্তায় ছেদ পড়ল। একটা বিশাল ঢেউ তেড়ে আসছে। শক্ত করে ধরল স্টিয়ারিং। অনেক আগেই সূর্য অস্ত গেছে। বোটেই নামাজ আদায় করে নিয়েছে ছেলেটি। রাত সাড়ে আটটা বাজে। চমৎকার জ্যোৎস্নায় ভরে গেছে চারদিক; কিন্তু চাঁদের এই নির্মল স্নিগ্ধ আলো অনেকটা ম্লান হয়ে পড়েছে দূরে নিউ ইয়র্ক মহানগরীর আলোকসজ্জার কাছে। তারপরও সেসব চাঁদের আলোর মতো নয়। আর কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে যাবে নিউ ইয়র্ক পোর্টে। বহির্নোঙ্গরে রাখা জাহাজগুলোর পাশ দিয়ে এগিয়ে চলেছে তাদের ক্ষুদে জলযান।
কিছুক্ষণ পর নোঙর করা বড় বড় জাহাজের পাশ দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে জেটির গায়ে এসে ভিড়ল তাদের বোট। আশপাশে লোকে লোকারণ্য। বোটটা জেটির সঙ্গে বেঁধে রেখে লাগেজ নিয়ে নামল তিনজনে। ট্যাক্সিতে করে ছুটছে তিনজনে। ছেলেটি ড্রাইভারের পাশের সিটে বসেছে। ঠিক তার পেছনে বসেছে মেয়েটি। তার থেকে একহাত তফাতে জানালার ধারে বসেছে ইঞ্জিনিয়ার।
ইঞ্জিনিয়ার বলল, ‘ম্যাডাম, আমি সামনে নেমে পড়ব, আজ ওনাকে বাসায় নিয়ে যান, কাল সকালেই আমি আপনাদের বাসায় আসব।’
‘না, আপনাকেও যেতে হবে’, দৃঢ় কণ্ঠে বলল মেয়েটি।
‘ঠিক আছে’, রাজি হলো ইঞ্জিনিয়ার।
কিছুক্ষণ নীরব রইল সবাই। গাড়ি ছুটে চলেছে ব্যস্ত সড়ক ধরে। ডানে-বাঁয়ে শুধু গাড়ি আর গাড়ি। চারধারে আকাশচুম্বী ভবনগুলোর কারণে ভালোভাবে আকাশ চোখে পড়ছে না। চারদিকে নানা ধরনের বাতির আলোয় আলোকিত সামনে কোথাও টেলিফোন বুথের থামবেন’, ড্রাইভারকে বলল মেয়েটি।
‘কেন?’ প্রশ্ন করল ইঞ্জিনিয়ার।
‘বাবা-মা, ভাই-ভাবি ওরা আগের অ্যাপার্টমেন্টে আছে কি না জেনে নিই, তা নাহলে এক ঘণ্টা ছুটেও কোনো লাভ হবে না।’
‘আগের অ্যাপার্টমেন্টে না থাকলে?’ আবার প্রশ্ন করল ইঞ্জিনিয়ার।
‘সে ক্ষেত্রে আমার দুই চাচা ও এক খালু এই নিউ ইয়র্কে থাকে, একই সঙ্গে সবাই অ্যাপার্টমেন্ট বদলাবে না, তাদের কাছে চলে যাব।’
‘আপনি যে সশরীরে ফিরেছেন এটা তাদের জানাবেন না, কৌশলে জেনে নেবেন, নিজে তাদের সামনে হাজির হয়ে একটা দারুণ সারপ্রাইজ দেবেন’, হেসে বলল ইঞ্জিনিয়ার। কথাটা মনে ধরল মেয়েটির।
একটু পরই রাস্তার ধারে পার্কিং করল ড্রাইভার। প্রায় দুশো গজ দূরে বুথটা।
‘আপনি নামবেন না?’ ছেলেটিকে গাড়িতে বসে থাকতে দেখে নামতে নামতে বলল মেয়েটি।
‘আপনারা যান, তাড়াতাড়ি ফিরে আসুন।’
ইঞ্জিনিয়ারও নামল, তাকেও এক জায়গায় ফোন করতে হবে। লোকের ভিড়ে হারিয়ে গেল দুজনই। ড্রাইভারও গাড়ি থেকে নেমে একটু দূরে এক ম্যাগাজিন শপের দিকে গেল।
ট্যাক্সিতে চড়ার পর থেকে ভাবনার ঝড় বয়ে গেছে ছেলেটির মাথায়। সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলেছে। দ্রুত নেমে পড়ল গাড়ি থেকে। দ্বীপে মেয়েটি তাকে কী বলতে চেয়েছে তা সে অনুমান করে নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে এখনই তার সরে পড়া উচিত। তবে কি সে মেয়েটির প্রতি প্রতিশোধ নিচ্ছে, তার সঙ্গে আগে খারাপ ব্যবহার করার জন্য? না, তা নয়, তার চেয়ে অনেক অনেক গুণ খারাপ ব্যবহার ক্যাপ্টেন করেছিল, তাকেও মাফ করে দিয়েছে। আর মেয়েটির প্রতি তার কোনো অভিযোগ ছিল না।
তার জন্য পরবর্তী সময়ে যা করেছে তা তো অতুলনীয়। মেয়েটির কাছে সে ঋণী, যা কখনো শোধ করার মতো নয়। তাহলে মেয়েটির হৃদয়ে আঘাত দিয়ে সে গোপনে সরে পড়বে কেন? কারণ… এমন সময় ট্যাক্সিতে মেয়েটি কথা বলে ওঠায় তার ভাবনায় বাধা পড়ল। গাড়ি থামার আগমুহূর্ত পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তাকে পালাতে হবে চোরের মতো। যদিও তা তার কাছে খুবই খারাপ লাগবে। অবশ্যই তাদের কাছ থেকে সে বিদায় নেবে। তবে অন্যভাবে বলবে কিন্তু সে শুনবে না।
খালি হাতে ফিরে এলো। দোকান খুঁজে পেতে দেরি হয়েছিল। প্রায় পনের মিনিট পর ছেলেটি এলো। তবে তার পকেটে আছে একটা কলম আর একটা হলুদ খাম তার ভেতর একটা ভাঁজ করা কাগজ। দোকানে বসে দ্রুত লিখেছে। সে কীভাবে সরে পড়বে তার পরিকল্পনাও করে ফেলেছে। গাড়ির কাছে এসে দেখল ড্রাইভারসহ তিনজনেই উদ্বিগ্ন হয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছে। বেশি অস্থির হয়ে পড়েছে মেয়েটি। তাকে কিছু বলার সুযোগ দিল না ছেলেটি। ‘আপনার বাবা-মা কি আগের অ্যাপার্টমেন্টেই আছে?’
‘জানা হয়নি, ফোনটা নাকি আজই সন্ধ্যার পর বিকল হয়ে গেছে’, জবাব দিল মেয়েটি। অস্থিরতা এর মধ্যেই কেটে গেছে তার। প্ল্যান বদলে ফেলেছে ছেলেটি।
একটু পরই আবার গাড়ি থামল। এবারো পেছনের দুজন নেমে গেল। দূরে টেলিফোন বুথটার দিকে এগোলো তারা, তবে ড্রাইভার নামল না।
‘শুনুন’, ড্রাইভারকে বলল ছেলেটি। ইংরেজিতে। ঘুরে তাকাল ড্রাইভার, ‘আমরা অনেক দূর থেকে এসেছি, ক্ষুধা পেয়েছে, এখন নেমে খাওয়ার মতো সময় নেই।’ বলতে বলতে পকেটে হাত ঢুকাল ছেলেটি ‘আপনি দয়া করে, তিনটা ভালো স্যান্ডউইচ নিয়ে আসুন’, বলে ডলার ড্রাইভারের হাতে ধরিয়ে দিল। ‘গাড়িতে বসেই খাব, আর সেই সঙ্গে তিন বোতল সফট ড্রিংকস।’
একটু অবাক হলেও কিছু বলল না ড্রাইভার। নেমে গেল গাড়ি থেকে। কালবিলম্ব না করে নিজের ব্যাগটা নিয়ে ঝট করে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল ছেলেটি। তারও দুই মামা এই নিউ ইয়র্কে থাকে। আগে তাদের কাছে যাবে। ঠিক করেছে, আর আমেরিকায় পড়বে না, দেশে চলে যাবে। কিছুক্ষণ পরই ফিরে এলো দুজনে। এবারো বাকি দুজনের কাউকেই কাছে-পিঠে পাওয়া গেল না। দুই মিনিট পরই ফিরে এলো ড্রাইভার। হাতে ছোট একটা খাবারের প্যাকেট।
‘স্যার, পাঠিয়েছিল’, যেন কৈফিয়ত দিল সে।
‘প্যাকেটে কী?’ জিজ্ঞেস করল ইঞ্জিনিয়ার।
‘তিনটা বার্গার, তিনটা সফট ড্রিংকস।’
ইঞ্জিনিয়ারও একটু অবাক হলো। মনে মনে ভাবল, ড্রাইভারকে বাদ রেখে খাওয়ার ব্যবস্থা করা উচিত হয়নি ছেলেটির। কিন্তু মেয়েটির এদিকে কোনো খেয়াল নেই। সে চারদিকে তাকিয়ে ছেলেটিকে খুঁজছে।
প্যাকেট রাখার জন্য গাড়ির ভেতরের লাইট জ্বালাল ড্রাইভার। হঠাৎ পেছনের সিটে যেখানে মেয়েটি বসে ছিল, সেখানে হলুদ কী যেন পড়ে থাকতে দেখল। তুলে নিল।
‘একটা খাম’, বলে মেয়েটির দিকে সেটি এগিয়ে ধরল ড্রাইভার।
‘এটা আপনার সিটে পড়ে ছিল।’
রোবটের মতো হলুদ খামটা নিয়ে ছিঁড়ে ফেলল। অনুমানও করতে পারছে না। এর ভেতর কী আছে? এক ভাঁজ করা কাগজটা বের করে আনল। স্ট্রিট লাইটের উজ্জ্বল আলোয় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। একটি চিরকুট। ইংরেজিতে লেখা। রুদ্ধশ্বাসে পড়তে শুরু করল মেয়েটি। একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে বাকি দুজন।
‘আপনাদের কাছ থেকে চোরের মতো এভাবে পালানোর জন্য আমি লজ্জিত ও ক্ষমাপ্রার্থী। বিদায় বেলা আমার বিশেষ কিছু বলার নেই। আমাদের চরম বিপদে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব আমাদের পাশে এসে দাঁড়ানোর জন্য আমি তার প্রতি চিরকৃতজ্ঞ। আর আপনি বিপদের দিনগুলোতে আমার জন্য যা করেছেন, তার জন্য আমি চিরঋণী। ধন্যবাদ দিয়ে আপনাদের ছোট করতে চাই না। আপনাদের সঙ্গে বিশেষ করে আপনার সঙ্গে যদি কোনোরকম অন্যায় করে থাকি, তবে নিজগুণে ক্ষমা করে দেবেন। আর এ অধমকে ভুলে গেলেই ভালো করবেন।’
চিরকুটটা পড়া শেষ হতেই কাঁপা হাতে তা এগিয়ে ধরল ইঞ্জিনিয়ারের দিকে। অনেক আগেই গাল বেয়ে অশ্রু ঝরা শুরু হয়েছিল। এখন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সারা দেহে যেন তার ঝড় শুরু হয়ে গেছে। নিজের পতন ঠেকানোর জন্য গাড়িতে হেলান দিল মেয়েটি। কান্না থামানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে।
ইঞ্জিনিয়ার চিরকুটটা মেয়েটিকে নীরবে ফেরত দিল। সেও অস্বাভাবিক গম্ভীর হয়ে গেছে। মাথাটা নীচু করে রেখেছে। সেও হয়তো চোখের পানি লুকাচ্ছে। ড্রাইভার এতটুকু বুঝে নিয়েছে যে, ছেলেটি তাদের দুজনকে ফেলে চলে গেছে। তাই তাকে তিনটা বার্গার আনতে বলেছে। সেও নীরবে দাঁড়িয়ে আছে।
‘মনে হয় এতক্ষণে সে বেশি দূরে যায়নি, চারদিকে খুঁজে দেখা যায় না?’ নীরবতা ভাঙল কান্নাজড়িত কণ্ঠে মেয়েটি। ভঙ্গিতে আকুলতা।
মাথা তুলল ইঞ্জিনিয়ার। ‘এত লোকের ভিড়ে কোথায় খুঁজব, আর কোন দিকেইবা খুঁজব?’ বলে থামল। সেও চারদিকে তাকিয়ে খুঁজছে।
‘আর কোনোভাবে তার খোঁজ করা যায় না?’ মরিয়া হয়ে বলল মেয়েটি।
‘সে কোনো অপরাধী নয় যে পুলিশের সাহায্য নেব, তার কোনো ছবিও নেই যে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেব, বড় কথা হলো এত দিনে নাম-ঠিকানা পর্যন্ত জানা হয়নি।’
এ বিশাল আমেরিকার কোন শহরে সে থাকবে, তাও জানি না যে একটা বা দুটো নির্দিষ্ট শহরে খুঁজব, তাকে আমারো দরকার। নাহ, তাকে আর খুঁজে পাওয়ার কোনো পথ নেই’, বলে থামল ইঞ্জিনিয়ার। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
‘আমি তাকে প্রথমদিকে ভুল বুঝেছি, তার সঙ্গে খুব দুর্ব্যবহার করেছি। সে যদি কমপক্ষে আমাকে তার কাছে যেসব দুর্ব্যবহারের জন্য মাফ চাওয়ার সুযোগ দিত, আসলেÑ আসলে আমি এখনো তাকে মানুষ হিসেবেই চিনতে পারিনি’, বলে থামল মেয়েটি।
‘আপনি শান্ত হোন’, বলল ইঞ্জিনিয়ার। ‘তাকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করুন, কারণ হয়তো তাকে আর কোনোদিন খুঁজে পাবেন না, অন্তত আমার তাই বিশ্বাস।’
‘আমিও জানি তাকে আর কখনোই খুঁজে পাব না, তারপরও তাকে আমি কোনোদিন ভুলতে পারব না’, বলেই দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল মেয়েটি।
‘দেরি হয়ে যাচ্ছে, চলুন রওনা হওয়া যাক’, কেশে বলল ড্রাইভার। মেয়েটিকে অন্যমনস্ক করার চেষ্টা চালাল। যেন ড্রাইভারের কথা মেয়েটির কানেই ঢোকেনি। ‘আমার এক কাজিন আমাকে ছোটবেলা থেকেই খুবই পছন্দ করত, অবশ্য আমিও তাকে কিছুটা পছন্দ করতাম, এবার বাংলাদেশে যাওয়ার আগে সে আমাকে প্রথম তার কথা জানায়, ফিরে এসে তাকে উত্তর দেয়ার কথা, হ্যাঁ-সূচক উত্তর দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।
‘কিন্তু ছেলেটির সঙ্গে বাংলো থেকে পালানোর পর থেকে তার মাঝে আমি এমন কিছু আবিষ্কার করলাম, যা আগে কারো মাঝে খুঁজে পাইনি। তার চাল-চলন, আচার-ব্যবহার, কথাবার্তা সবকিছুই ছিল ব্যতিক্রম, তাকে বারবার নতুন দৃষ্টিতে আমাকে দেখতে হয়েছিল। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য, অনেকভাবে চেষ্টা করেও তাকে আমি এ ব্যাপারে কিছুই বলতে পারিনি।’ এর মধ্যে কান্না থেমে গেছে মেয়েটির। তবে মাঝেমধ্যে হিঁচকি উঠছে। একনাগাড়ে সে বলে চলেছে। ইঞ্জিনিয়ার আর ড্রাইভারও তার কথা আগ্রহ সহকারে শুনছে। আশপাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে মানুষ। তাদের তিনজনের সঙ্গে যেন তাদের কোনো সম্পর্কই নেই।
‘আমি চেয়েছিলাম আপনাদের দুজনকে আমাদের বাসায় নিয়ে গিয়ে আমার ভাবিকে দিয়ে তাকে আমার মনের কথা জানতাম। আমার প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস ছিল, সে আমাকে পছন্দ করে, যদিও কোনো লক্ষণ কখনো তার মাঝে দেখিনি। এখন বুঝতে পারছি এসব আমার স্রেফ কল্পনা ছিল, ছিল দিবাস্বপ্ন।’ আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সে। দুহাতে মুখ ঢাকল দ্রুত। ইঞ্জিনিয়ার তাকে সামলে নেয়ার সুযোগ দিল। দুহাতে চোখ মুছে, ‘সে আমাকে ফেলে চলে গেছে, এতে তার কোনো দোষ নেই, আসলে দোষটা এবারো আমার যে, আমি তাকে জানাতে পারিনি। আসলে এমন কিছু সহজ কথা আছে, যা কাউকে জানানো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়, কখনোবা অসম্ভব হয়ে দেখা দেয়।’
গাড়ি ছুটে চলছে ব্যস্ত সড়ক ধরে। বাতাসে চুলগুলো এলোমেলো হয়ে গেছে মেয়েটির। কতগুলো চুল মুখের ওপর এসে বিরক্ত করছে। কিন্তু সরানোর প্রয়োজন বোধ করল না সে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। তার চোখ এখন কেবল খুঁজে ফিরছে সেই সে যুবককে। যে কি না তার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। অথচ তারই সেই যুবকের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী হওয়ার কথা। এখন তার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে সে কেন আমিই ক্ষমাপ্রার্থী। আর হঠাৎই সে গেয়ে উঠল ‘পুবাল হাওয়া পাও যদি বন্ধুর দেখা বইলো তুমি তারে/ আমার মনের কথা হয়নি বলা হয়নি বলা তারে…
-সমাপ্ত-
ঘোষণা- ‘আমি ক্ষমাপ্রার্থী’ উপন্যাস থেকে একটি প্রশ্নোত্তর প্রতিযোগিতা হবে। অংশগ্রহণকারী পাঠকদের সর্বোচ্চ সঠিক উত্তরদাতাকে পুরস্কৃত করা হবে। আগামী শুক্রবার চোখ রাখুন মুগ্ধতা ডট কমে।
-নির্বাহী সম্পাদক