মুগ্ধতা ব্লাড ব্যাংকে আপনার দেওয়া তথ্য বাঁচাতে পারে একটি জীবন। আপনার তথ্য দিন, প্রয়োজনে রক্ত খুঁজুন এখানে।

আমি ক্ষমাপ্রার্থী-৩

জাকির আহমদ

২১ মার্চ, ২০২০ , ১২:৪৭ অপরাহ্ণ

আমি ক্ষমাপ্রার্থী

(পর্ব – ৩)

পরদিন ভোরবেলা পুকুর পাড়ে এসে সেখানে অজু করে ফজরের নামাজ পড়ে অপেক্ষা করছে ছেলেটি। তবে প্রকাশ্যে নয়, গাছের আড়ালে থেকে। অত্যন্ত সতর্ক আছে সে। পুকুর পাড়ের আশপাশে মেয়েটির সাড়া-শব্দ পেলে সে এখান থেকে দ্রুত চুপিসারে সরে পড়বে। সে জন্য সে প্রস্তুত আছে।

সূর্য উঠেছে। সকালে পূর্ব দিকের সূর্যের রক্তিম আভা পুকুরের পানিতে অপরূপ দৃশ্যের অবতারণা ঘটিয়েছে। আরো কিছুক্ষণ কেটে গেল। ছেলেটি পুকুরের পূর্ব ধারের উত্তর পাশে দাঁড়িয়ে আছে গাছের সঙ্গে গা ঠেকিয়ে। এক সময় পশ্চিম পাড়ে গাছপালার আড়ালে মানুষের নড়াচড়ার আভাস পেয়ে ছেলেটি আরো সতর্ক হয়ে পেছনে পেছাতে লাগল।

এখন পর্যন্ত মেয়েটি পুকুরটি দেখেনি। আর অল্প বাকি। এ অবস্থায় চলে যেতে ছেলেটির বিবেকে বাধল। মেয়েটির দিকে বিশেষ তাকাচ্ছে না ছেলেটি, তবে খেয়াল রাখছে সে পুকুর পাড়ে পৌঁছল কিনা? সে পুকুর পাড়ে পৌঁছেছে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হলেই সে চলে যাবে তার কাজে। এপাশ-ওপাশ তাকাতে তাকাতে একসময় পুকুর পাড়ে এসে দাঁড়াল মেয়েটি। আনন্দে হতবাক হয়ে গেল। আর দাঁড়াল না ছেলেটি। ঘুরে উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করল। মেয়েটির কাছে দাঁড়িয়ে থাকলে শুনতে পেত এমন কিছু কথা, যা বাকি জীবন স্মরণ রাখার মতো।

মেয়েটি আর কালবিলম্ব না করে পানির কিনারে এসে দুহাতে আঁজলা ভরে পানি মুখে দিল। এই দ্বীপেও এ পানি মধুর মতো মিষ্টি মনে হলো। কয়েকদিন পর স্বাদু পানি মুখে পড়ল যে। পানির ঝাপটা চোখে-মুখে দিতেই দারুণ একটা পুলক অনুভূত হলো। হঠাৎ খেয়াল হলো সমুদ্র থেকে ওঠার পর আজ পর্যন্ত গোসল করেনি। আর সমুদ্রের পানিতে গায়ের চামড়া খসখসে হয়ে গেছে। এই পানি গোসলের উপযোগী। গোসল করার জন্য কাপড় খুলতে হবে। তাই কাপড় খোলার জন্য জামার বোতামে হাত দিল।

হঠাৎ করেই খেয়াল হলো, ছেলেটি যখন এ পুকুরের সংবাদ তাকে দিয়েছে তখন ছেলেটি আশপাশে থাকতে পারে এবং তা স্বাভাবিক। তাহলে তো কাপড় খুলে এই দিনের বেলায় গোসল অসম্ভব। কাপড় পরেও গোসল করা যায়। সে ক্ষেত্রে ওপরের কালো পাঞ্জাবিটা দ্রুত শুকালেও নীচের জিন্সের প্যান্টটা শুকাতে কয়েক ঘণ্টা লাগবে। অতক্ষণ ভেজা প্যান্ট পরে থাকলে জ্বর-সর্দি হতে পারে। এ জনহীন দ্বীপে এ জ্বর কঠিন অসুখ। তার ওপর যদি সেবা করার কেউ না থাকে…। ঝুঁকি নিয়ে গোসল করল না। শুধু হাত-মুখ-পা ভালোভাবে ধুয়ে ফিরে চলল। আপাতত এ দ্বীপের একমাত্র খাদ্যদ্রব্য নারকেল সংগ্রহ করতে চলল। তারপর দিনের বাকি সময়টা চোখ রাখবে সাগরের ওপর।

দুপুরের আগে পূর্ব দিক দেখা শেষ করে পুকুড়ের পাড়ে সতর্কতার সঙ্গে এসে দাঁড়াল। মেয়েটি নেই দেখে হাঁফ ছাড়ল। এর আগে পুকুরের চারপাশ ভালোভাবে দেখা হয়নি। তার চারপাশটা ভালোভাবে দেখতে দেখতে মেয়েটা যে পথে এসেছিল তার পাশে কয়েকটা বুনো বাদামের গাছ দেখতে পেল। এ দ্বিতীয় আবিষ্কারে মনটা আনন্দে ভরে গেল। ‘বিসমিল্লাহ’ বলে বাদাম গাছ থেকে কিছু বাদাম ছিঁড়ে নিয়ে খোসা ছাড়িয়ে মুখে পুরল। খেতে খারাপ লাগলেও কয়েকদিন পর নারকেলের পরিবর্তে বাদাম মুখে দিয়ে ভালো লাগছে। আলাদা স্বাদে মুখটা ভরে গেল। নারকেল দিয়ে ক্ষুধাও মিটত না, তার ওপর অরুচি ধরে গিয়েছিল।

মেয়েটা কি এ বাদামের খোঁজ পেয়েছে? না পেয়ে থাকলে পাওয়ার ব্যবস্থা হিসেবে বেশকিছু বাদাম পুকুরের যে ধারে মেয়েটি এসেছিল, সেখানে ছড়িয়ে দিল। আর আবাসস্থানে যাওয়ার আগে কয়েক ঝোপা বাদাম নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। তারপর পুকুর পাড়ে ফিরে এলো গোসল করার জন্য। তার পরনে কাপড় বলতে ওপরে হাতাওয়ালা গেঞ্জি ও নীচে সাদা পায়জামা। কাপড় না খুলেই গোসল করতে নামল। কারণ তার কাপড় খুব মোটা নয়। এই দুপুরে গোসল করে রোদে কিছুক্ষণ দাঁড়ালেই শুকিয়ে যাবে। গোসল করতে নেমে বুঝল এখন পানি কম। তবে বর্ষাকালে পানি আরো বেশি হয়। গোসল সেরে রোদে দাঁড়িয়ে বাদাম খেতে খেতে কাপড় শুকিয়ে গেল। তারপর অজু করে নামাজ পড়ে বাদামের ঝোপা হাতে নিয়ে আবাসস্থানের দিকে ফিরে চলল।

পরদিন খুব ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই পুকুর পাড়ে চলে এলো মেয়েটি গোসল করার জন্য। এর চেয়ে গোসল করার ভালো সময় আর নেই। সন্ধ্যার পরপরই গাঢ় অন্ধকার নামে। গোসল করে অন্ধকারে গুহায় ফেরা অসম্ভব চাঁদ না ওঠা পর্যন্ত। আর এখন ভোরবেলা একদম অন্ধকার না হলেও গাছপালার জন্য আঁধার একটু প্রকট হয়ে উঠেছে। ফলে একদম কাছ থেকে ছাড়া তাকে দেখা যাবে না। আর খুব সম্ভব এ দ্বীপের একমাত্র ব্যক্তি ওই ছেলেটি হয়তো এ সময় ঘুমিয়ে আছে। সে ছেলে মানুষ দিনেও গোসল করতে পারে। এসব ভেবেচিন্তে এখন গোসল করার জন্য এসেছে।

আসার সময় মোটা ডালের তৈরি লাঠিটা হাতে করে নিয়ে এসেছে বন্য প্রাণীর ভয়ে। গত বিকেলে গাছ থেকে ডালটি ভেঙে নিয়েছিল। তবে পথে খরগোশ, পাখপাখালি ছাড়া অন্যকিছু চোখে পড়েনি। সময় কম। কিছুক্ষণের মধ্যে আকাশ বেশ ফর্সা হবে। তাই তাড়াতাড়ি পরিধেয় কাপড় খুলে পুকুরে নেমে পড়ল। এদিক-ওদিক তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল।

এদিকে ভোরবেলা অজু করার জন্য ধীর পদক্ষেপে ছেলেটি পুকুরের দিকে এগিয়ে আসছে। এই পানির সন্ধান পাওয়ার পর থেকে সমুদ্রের পানিতে অজু করা বাদ দিয়েছে। পুকুর থেকে খানিক দূরে থাকতেই আবছাভাবে একজনকে পানিতে গোসল করতে দেখল। মুহূর্তে বুঝে গেল কে গোসল করছে। সঙ্গে সঙ্গে দুচোখ সেদিক থেকে ফিরিয়ে নিল। অন্যদিকে তাকিয়ে ভাবল, কখন গোসল করতে নেমেছে? কখন শেষ হবে তা সে জানে না। হয়তো আকাশ ভালোভাবে পরিষ্কার হওয়ার আগেই শেষ হবে। এখানে অজু করাও সম্ভব না। অগত্যা সিদ্ধান্ত নিয়ে অনেকটা নিঃশব্দে কিছুটা পিছিয়ে সমুদ্রের দিকে দৌড় দিল অজু করার জন্য।

মেয়েটি কাপড় পরে চলে যেতে উদ্যত হতেই তার পথে ছড়ানো বাদাম দেখতে পেল। একটু খুঁজতেই বাদামের গাছগুলো খুঁজে পেতেই আনন্দে নাচতে শুরু করল অনেকদিন পর বিকল্প খাদ্য পেয়ে। বাদাম ছড়িয়ে দেয়ার কাজটা যে ছেলেটি করে থাকতে পারে এটা সে সময় তার মাথায় এলো না। কয়েক ঝোপা বাদাম নিয়ে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে ফিরে চলল গুহার দিকে।

ছেলেটি সেদিনের বাকি অংশ উত্তর দিক ঘুরে দেখে কাটিয়ে দিল আর মেয়েটি কয়েকটি নারকেল সংগ্রহ করে সমুদ্রের দিকে নজর রেখে পার করে দিল। রাত হলে গত রাতের ঘটনার কথা মনে হতেই শিউরে উঠল। পরক্ষণেই ভাবল ছেলেটি ভয় ধরিয়ে দিলেও এক বড় ধরনের উপকার করেছে। আরো আশ্বস্ত হলো এই ভেবে যে, সে বন-জঙ্গল ঘুরে-ফিরে দেখছে উদ্ধারের পথের সন্ধানে। আরো অনেক কিছু ভাবতে ভাবতে এক সময় চোখ বুজে এলো। পরদিন ভোরবেলাও মেয়েটি গোসল করতে নেমেছে। আজকে একটু তাড়াতাড়ি এসেছে।

এদিকে ছেলেটিও মেয়েটি আসার আগেই অজু করে নেবে ভেবে তাড়াতাড়ি এসেছে। এসে দেখে আজ কেবল মেয়েটি পুকুর পাড়ে পৌঁছেছে। এখনো গায়ে কাপড় আছে। আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না সে, ঘুরে চলল সমুদ্রের দিকে। মেয়েটি প্রতিদিন ভোরবেলা গোসল করতে পারে ভেবে এরপর থেকে ভোরবেলা এখানে অজু করতে না এসে সৈকতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। সমুদ্র থেকে পুকুরটির দূরত্ব কম। তারপরও বাধ্য হয়েই সমুদ্র সৈকতে যেতে হবে। তবে গুহা থেকে পুকুরটি বেশ দূর। এরপর তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা ছাড়াই আরো দুদিন কেটে গেল।

দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যার পর থেকে আকাশ ঘন কালো মেঘে আবৃত হতে লাগল। বাতাস বইতে লাগল শোঁ শোঁ শব্দে। মেঘের আনাগোনা দেখে ছেলেটি বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ল। এমনিতে রাতের ঠান্ডা একদম অসহ্য ঠেকে; তার ওপর বৃষ্টি হলে আর সেই হিমশীতল পানিতে ভিজলে অসুখ হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। এ জনবিরল দ্বীপে অসুখ হলে ওষুধ কোথায়? সেবা-শুশ্রƒষাইবা করবে কে? দিনের বেলা মেঘ দেখা গেলে না হয় বৃষ্টি থেকে পরিত্রাণের একটা পথের সন্ধান করা যেত। কিন্তু সন্ধ্যার পর এমনিতেই আঁধার নামে, তার ওপর আজ ঘন কালো মেঘের কারণে অন্ধকার আরো প্রকট হয়ে উঠেছে। পাঁচ হাত সামনে কিছুই দেখা যায় না।

আর এই দ্বীপে আপাতত থাকার উপযুক্ত জায়গা বলতে ওই গুহাটা ছাড়া পাহাড়ে আর কোনো গুহা দৃষ্টিগোচর হয়নি। বনের মধ্যেও তেমন কিছু নজরে পড়েনি। এ পরিস্থিতিতে মেয়েটির গুহায় গিয়ে আশ্রয় নেয়া উচিত। খুব কষ্টে ধীরে ধীরে হয়তো গুহায় পৌঁছা যাবে। কিন্তু সেখানে যেতে মন কিছুতেই সায় দিচ্ছে না। অগত্যা গাছতলায় বসে থাকার জন্য মনস্থির করল। এসব ভাবতে অনেক সময় গড়িয়ে গেছে। ছেলেটি অনুমান করে দেখল, চাঁদ ওঠার সময় হয়ে গেছে। তবে ঘন মেঘের কারণে তা দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। বাতাস বইছে। মাঝে মধ্যে আকাশের বুক চিরে আলোর ঝলকানি চারদিক উদ্ভাসিত করে তুলছে। সে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মেঘের গুরুগম্ভীর তীব্র গর্জন বিদ্যুৎ চমকানোর পরপরই চারদিকে এমন অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে যেন এক হাত সামনে কী আছে তাই দেখা যাচ্ছে না। তার ওপর প্রচণ্ড গর্জন যেন কানে তালা সেঁটে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।

কানের ভেতরে আঙুল দিয়ে শব্দ কানের ভেতরে কম ঢুকানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। বাতাসের শোঁ শোঁ আর মেঘের গর্জন ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। এ ধরণীর সবকিছু যেন পাগল হয়ে গেছে। সবমিলে এক ভয়ঙ্কর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। ভয় খুব একটা পাচ্ছে না সে; তবে প্রচণ্ড ঠান্ডায় ঠক ঠক করে কেঁপে উঠছে। ঠান্ডা নিবারণের কোনো সামগ্রী তার কাছে নেই। একসময় বাতাসের প্রচণ্ড প্রকোপ কমে গেল। চমকানো আর মেঘের গর্জন ছাড়া সবকিছুই যেন মুহূর্তে থমকে দাঁড়াল। তার কিছু পরই আকাশ ভেঙে বৃষ্টির ফোঁটা পড়া শুরু হলো। প্রতিটি বৃষ্টির ফোঁটা যেন গায়ে ঠান্ডার হুল ফুটিয়ে দিচ্ছে, তার ওপর আছে হিমশীতল মৃদু বাতাস। ঠান্ডাটা একদম অসহ্য ঠেকছে ছেলেটির। ঠান্ডায় কেঁপেই চলেছে একনাগাড়ে। বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণ নেই, পড়ছে তো পড়ছেই।

সন্ধ্যার পরও বাইরে বসে আছে মেয়েটি। সামনের বনভূমির দিকে তাকিয়ে নানান কথা ভাবছে। এখন পর্যন্ত একটা জাহাজ বা বোটের দেখা মিলল না। আদৌ মিলবে কিনা কে জানে। যদি দেখা না-ই মেলে তবে চূড়ায় বসে নজর রাখা একদম অহেতুক হবে। আমি তো নজর রাখা ছাড়া আর কোনো ব্যবস্থার দিকে নজর দিচ্ছি না। আচ্ছা, ছেলেটি কী করছে? দুদিন আগে পর্যন্ত যে সে এ দ্বীপেই ছিল, তা নিশ্চিত। তারপর থেকে তার আর কোনো সাড়াশব্দ নেই। ছেলেটি হয়তো আমার ভালোই চায়। তা না হলে পুকুরের সন্ধান দেবে কেন? তবে আমি কি ছেলেটিকে ভুল বুঝেছি?

হঠাৎ করে মাথায় চিন্তাটি ঢুকল। আচ্ছা, ছেলেটির সঙ্গে সমঝোতায় এসে সম্মিলিতভাবে উদ্ধার পাওয়ার চেষ্টা করা যায় না? তাই হয়তো সবচেয়ে ভালো হবে। একাই উদ্ধারের ব্যবস্থা করা হয়তো অসম্ভব হবে। হঠাৎ আলোর ঝলকানি দৃষ্টিগোচর হতেই আত্মমগ্নতায় বাধা পড়ল মেয়েটির। এতক্ষণ খেয়াল করেনি বলে প্রথমে বুঝতে পারেনি, পরের বার বুঝতে পারল। ছোটবেলায় বিদ্যুৎ চমকানো দেখে ভয় পেত। তখন বাবা-মা বা অন্য কেউ পাশে থাকত। তখন আর ততটা ভয় পেত না। আজ পাশে কেউ নেই। আজই প্রথম নিজেকে বড় নিঃসঙ্গ মনে হলো তার।

চারদিকে আর একবার তাকাতেই পেটের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল। বাইরে আর না থেকে তাড়াতাড়ি গুহায় প্রবেশ করল। গুহার ভেতর বাতাস তেমন অনুভূত হয় না। তবে শোঁ শোঁ শোনা যায়, বিদ্যুৎ চমকানো দেখা যায়। প্রতিবারই চোখ বন্ধ করে কোনো আঙুল দিতে হচ্ছে। প্রচণ্ড বাতাসের দাপটে গাছপালা নুয়ে পড়ছে। অনেক গাছের ডালপালা ভেঙে যাচ্ছে। গাছ থেকে নারকেল ছিঁড়ে উড়ে যাচ্ছে। রীতিমতো ঝড় শুরু হয়ে গেছে। একসময় বাতাসের বেগ মন্থর হয়ে গেল। তার কিছুক্ষণ পরই বৃষ্টি শুরু হলো। বৃষ্টির হিমশীতল ফোঁটা গায়ে পড়ছে না। তবে প্রচণ্ড ঠান্ডা আবহাওয়ার পরশ গুহা পর্যন্ত পৌঁছেছে। তাতে শরীরের এমন কাঁপুনি শুরু হয়ে গেছে যে, তার দাঁতে দাঁত ঠেকে ঠক ঠক শব্দ করছে।

ভোরবেলা পুকুরের পানিতে গোসল করলে পানির ঠান্ডাতে কাঁপুনি ধরলেও তা মুখ বুজে সহ্য করা যায়। কিন্তু এ ঠান্ডা আর সহ্য করা যাচ্ছে না। এ ঠান্ডা থেকে আর একটু নিষ্কৃতির জন্য গুহার আরো ভেতরে প্রবেশ করে দেয়ালে হেলান দিয়ে থাকল। হাতের তালু দিয়ে দুহাত-পায়ের পাতা, মুখমণ্ডল ঘষে গরম রাখার চেষ্টা করল। তাতে কিছুটা আরাম বোধ করল। ঠান্ডা থেকে যৎসামান্য নিষ্কৃতি পেতেই ছেলেটির কথা খেয়াল হলো। সে গুহার মধ্যে থেকেও ঠান্ডায় অস্থির। আর ছেলেটি কোথায় আছে? খোলা আকাশের নীচে আছে, না তার মতো কোনো সুন্দর আশ্রয়ের সন্ধান পেয়েছে?

তার এ আশ্রয় স্থানকে এ দ্বীপের এ আবহাওয়ায় সুন্দর ও উৎকৃষ্ট না বললে অন্যায় হবে। তার এ গুহা ছাড়া আর কোনো গুহা নেই। অর্থাৎ এ পাহাড়ে আশ্রয় নেয়ার মতো আর জায়গা নেই। বনের মধ্যে আছে কিনা তা তার জানা নেই। সন্ধান না পেয়ে থাকলে নির্ঘাত ছেলেটি বৃষ্টিতে ভিজছে। এ মুহূর্তে ছেলেটির অবস্থা কল্পনা করে শিউরে উঠল মেয়েটি। সত্যিই যদি সে খোলা আকাশের নীচে থাকে, তবে তার অবস্থা করুণ হয়েছে। ঠান্ডায় আমার চেয়ে হয়তো তিনগুণ বেশি কাঁপছে। এ ঠান্ডায় অজ্ঞান হওয়া অস্বাভাবিক নয়। অসুখও হতে পারে। ছেলেটি হয়তো তার গুহা দেখেছে। তারপরও এলো না কেন? এবারে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল সে, বৃষ্টি থামলে ছেলেটির সন্ধান বের করে দুজনে মিলে এ নির্জন মৃত্যুপুরী থেকে উদ্ধারের চেষ্টা করবে। আরো নানান কথা ভাবতে ভাবতে এ সময় না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল মেয়েটি।

মেয়েটির কথা মাথায় আসতেই এ ভেবে স্বস্তি পেল যে, সে গুহায় কমপক্ষে এ হুল ফোঁটানো বৃষ্টি থেকে রক্ষা পাচ্ছে, পরমুহূর্তে সে এ ভেবে আতঙ্কিত হয়ে পড়ল যে, বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচলেও ঠান্ডার হাত থেকে হয়তো পুরোপুরি বাঁচতে পারছে না। এ ঠান্ডা জ্বর, সর্দি, কাশি ধরার জন্য যথেষ্ট। তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যে কেমন তা সে জানে না। তবে নিজের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি; সহজে সে রোগাক্রান্ত হয় না। হলেও সামান্য সেবা-যত্নে ধীরে ধীরে ভালো হতে পারে। এশার নামাজ পড়ে ফেলেছে এ ঝড়-বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে। প্রচণ্ড ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচার জন্য রীতিমতো যুদ্ধ করে যাচ্ছে সে। আর দুহাঁটু বুকের সঙ্গে দুহাতে চেপে ধরেছে। মুখ দুহাঁটুর ওপরে রেখেছে। ঠান্ডা একটু কমছে বলে মনে হয় না। ঘুমও ধরছে না। অনেক চিন্তাভাবনা করে নামাজে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিল।

অজু আছে। কয়েক মুহূর্ত পরই সে ডুবে গেল আল্লাহর প্রেমে। ভোরবেলা পর্যন্ত একটানা বৃষ্টি হচ্ছে। এ বৃষ্টিতে পুকুর পাড়ে মেয়েটি আসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তারপরও তুলনামূলকভাবে দূর সমুদ্র থেকে অজু করে এসে ফজরের নামাজ আদায় করল ছেলেটি। রাতে কয়েকবার মাত্র ঝিমুনি এসেছে। কোনো ঘুম ধরেনি। তাই খুব খারাপ লাগছে। নারকেল, বাদাম দিয়ে আহার সেরে দুপুর পর্যন্ত গাছের গায়ে হেলান দিয়ে কাটিয়ে দিল। মাঝে মধ্যে বৃষ্টি কমলেও একদম থামেনি। টিপটিপ করে পড়ছে, আবার কখনো মুষলধারে। বিকেল বেলা গা-টা গরম অনুভব করল সে। জ্বর আসছে। সন্ধ্যার দিকে বৃষ্টির মাত্রা কমে এলেও অন্ধকার নামার পর একদম থেমে গেল। আকাশও পরিষ্কার হয়ে গেছে।

মধ্য রাতের পর থেকে জ্বরের মাত্রা বেড়ে গেল, সেই সঙ্গে শুরু হয়েছে প্রচণ্ড মাথাব্যথা; কাশি তো আছেই। নড়াচড়ার শক্তি ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছে। এসব সহ্য করছে অতি কষ্টে। সে সহ্য ক্ষমতাও যেন একসময় নিঃশেষ হয়ে এলো। বুঝতে পারছে, সে কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান হারাবে। তারপর আর কখনো জ্ঞান ফিরে পাবে কিনা জানে না। তাহলে তো আর সেই পরম করুণাময়ের কাছে ক্ষমা নেয়ার, তাঁকে ডাকার সুযোগ নাও হতে পারে। তাই তাঁকে প্রাণ খুলে ডাকতে লাগল। ক্ষমা প্রার্থনা করতে লাগল তাঁর মহান দরবারে। কখন জ্ঞান হারাল বুঝতে পারল না সে।

অনেক চিন্তা-ভাবনা করার পরও ছেলেটিকে দ্রুত খুঁজে বের করার তেমন কোনো সূত্র বের করতে পারল না মেয়েটি। তবে এতটুকু বের করতে পারল যে, সে ওই পুকুরের কাছেই থাকবে। যুগে যুগে মানুষ পানির উৎসের কাছে তার বাসস্থান গড়ে তুলেছে, সেটাই স্বাভাবিক। তাই কী করবে তা স্থির করে নিয়ে গুহা থেকে বের হয়ে এলো। পাহাড়ের ওপরে উঠল অনেক কষ্টে। চূড়ায় ওঠার চেষ্টা করতে পারল না পিচ্ছিল হয়ে আছে বলে। চারদিকে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল না। তবে বাতাসে দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া ডাল-লতাপাতা দেখতে পেল। দুই হাত মুখের কাছে এনে চোঙ্গের মতো করে হাঁক ছাড়ল মেয়েটি, ‘আপনি কোথায়? প্লিজ, যেখানেই থাকুন না কেন একটু সাড়া দিন।’ এভাবে পাহাড়ে দাঁড়িয়ে কয়েকবার হাঁক ছেড়ে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে নীচে নেমে পুকুর পাড়ের দিকে চলল।

এর মধ্যে সূর্য বেশ খানিকটা উঠেছে। পরিষ্কার আকাশে ঝলমল করছে। আজ আকাশের দিকে তাকিয়ে বোঝাই যাবে না গত দিনে কী ঘটে গেছে। পুকুর পাড়ে পৌঁছে আগের মতো করে চারদিকে কয়েকবার হাঁক-ডাক করেও যখন কোনো সাড়া মিলল না, তখন পুকুর পাড়কে কেন্দ্র করে চারদিকে চক্রাকারে ঘুরে ঘুরে ডাকতে লাগল। ধীরে ধীরে সরে যেতে যেতে ছড়িয়ে পড়ল বনভূমির গভীরে। প্রথম চক্করের পর দ্বিতীয় চক্কর একটু দূর দিয়ে হয়। প্রতিটা জায়গা তন্নতন্ন করে খুঁজে বের করা অসম্ভব। তাছাড়া সে তো ডেকেই চলেছে। ডাক অনেক দূর পর্যন্ত শোনা যাবে।

মাঝখানে দুবার বিশ্রাম নিয়েছে। দুপুর হতে বেশি বাকি নেই। পুকুরের পূর্ব দিকে আছে সে। পাশেই সমুদ্র। গর্জন শোনা যাচ্ছে স্রোতের। তৃতীয়বারের মতো বিশ্রাম নেয়ার জন্য একটা গাছের গায়ে পশ্চিমমুখী হয়ে হেলান দিয়ে বসেছে। ভাবছে, এত খোঁজার পরও যখন পাওয়া গেল না, তবে সে কোথায় এখন? নাকি আশপাশেই কোথাও অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে, সে জন্য ডাক শোনেনি? নাকি ইচ্ছে করেই জবাব দেয়নি? এসব ভাবতে ভাবতেই আকাশের দিকে তাকাল মেয়েটি।

পশ্চিম দিকে বনের অনেক ওপরে এক জায়গায় কয়েকটি বড় পাখি উড়তে দেখল। এত দূর থেকে পাখিগুলোকে চিনতে পারল না। আবার ওভাবে তাদের ওড়ার কারণও বুঝতে পারল না। হঠাৎ মনে হলো, এগুলো শকুন নাকি? এ কথা সে জানে, মৃত প্রাণী দেখলে শকুন উড়ে বেড়ায়। কিন্তু নীচে নামছে না কেন? মুহূর্তে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দৌড় দিল সেদিকে। দৌড়াতে দৌড়াতে ভাবছে, তবে কি ছেলেটি মরে গেছে? অসুখ হয়েছে, নাকি অন্য কোনো কারণে মরল? কখন মারা গেছে? আমিও কি এভাবেই এ দ্বীপে শেষ পর্যন্ত মারা যাব? আমাকেও কি শকুন ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে? পাখিগুলোর দিকে লক্ষ্য রেখে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়েই চলেছে।

হঠাৎ মনে হলো মারাই যদি গেছে তবে দেখে মন খারাপ করার দরকার কী? কেন জানি মনটা খারাপ হয়ে গেল। যেমন করেই হোক, এ দ্বীপে সে ছাড়া একজনই তো মানুষ ছিল, এখন সে একাই এ দ্বীপের বাসিন্দা। এখন পর্যন্ত তো সে তার কোনো ক্ষতি করেনি, বরং উপকারই করেছে। অজানা কারণে একই গতিতে দৌড়ে চলেছে।

গিয়ে কী অবস্থায় দেখতে পাবে! অর্ধেক খেয়ে ফেলেছে, বিচ্ছিন্ন হয়ে বাকি অংশ পড়ে আছে! তার সৎকার করতে হবে। কীভাবে করতে হয় জানে না। মাটিচাপা দিতে হবে। মাটি কাটার যন্ত্র কোথায়? নানা কথা ভাবতে ভাবতেই পৌঁছে গেল গন্তব্যে। সামনে ছিন্নভিন্ন কোনো দেহ দেখতে পেল না। দেখল ছেলেটি স্যাঁতসেঁতে মাটির ওপর হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছে। নড়ছে না। মাথায় টুপি, পরনে সাদা গেঞ্জি ও মোটা কাপড়ের সাদা পায়জামা ধূলি-ধূসরিত। কয়েক হাত তফাতে দাঁড়িয়ে দেখছে মেয়েটি।

নিজের অজান্তে পা পা করে ছেলেটির পাশে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে তাকাল তার মুখের দিকে। একটা মানুষের মুখের মধ্যেই যেন অনেক কিছু লুকিয়ে থকে। ছেলেটির মুখ দেখে বুঝতে চাচ্ছে মেয়েটি কী হয়েছে তার। হঠাৎ মনে হলো ছেলেটি যেন নিঃশ্বাস নিচ্ছে। চট করে বুকের দিকে তাকিয়ে দেখল নিয়মিত ওঠা-নামা করছে তার বুক। মনে হলো ছেলেটি মরেনি, ঘুমিয়ে আছে। ছেলেটির ডান হাতখানি এক মুহূর্তে দ্বিধা না করে নিজের হতে তুলে নিয়েই বুঝল সে প্রচণ্ড জ্বরে ভুগছে। একশ পাঁচ-ছয় হতে পারে। পালস দেখল। খুব ধীরে শ্বাস নিচ্ছে।

ছেলেটি বেঁচে আছে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতেই আনন্দে নাচতে ইচ্ছে করল মেয়েটির। কিন্তু এখন নাচার সময় নয়। প্রচণ্ড জ্বরের কারণেই ছেলেটি অজ্ঞান হয়ে আছে। দ্রুত সেবা-শুশ্রƒষা করতে না পারলে হয়তো মরেই যাবে। কিছুতেই তা হতে দেয়া যাবে না। কিন্তু কী করবে তা দ্রুত ঠিক করতে পারল না। সে তো ডাক্তার নয়। জ্বরের জন্য যে ওষুধ লাগে তা সে জানে। কিন্তু এখানে ওষুধ পাবে কোথায়? খেয়াল হলো কপালে পট্টি বা মাথায় পানি দেয়া যেতে পারে। মাথায় দেয়ার জন্য পানি আনার পাত্র নেই। ছেলেটিকে সে একাই পুকুর পাড়ে বা সমুদ্র তীরে বয়ে নিয়ে যেতে পারবে না। টেনে নিয়ে যেতে পারবে কিন্তু ছেলেটির হাত-পা ছিড়ে যাবে। বরং তাতে কষ্টই বাড়বে। অবশেষে মাথায় পট্টি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিল।

পট্টি দেয়ার জন্য নরম সুতি কাপড় হলে ভালো হয়। ছেলেটির সুতি গেঞ্জিটি ছেঁড়ার জন্য হাত বাড়িয়েও ফিরিয়ে নিল। এমনিতেই তার জন্য সে তার জামা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করেছে, আবার সেও তার কাপড় ছিঁড়বে! তা হয় না। মেয়েটি তার কালো পাঞ্জাবির নীচে পরা সাদা সুতির টেপের বেশ খানিকটা অংশ ছিঁড়ে ফেলল। সে না হয় সামান্য একটি অংশই ছিঁড়ল। এখন দরকার পানি। ছেলেটির আশপাশেই নারকেলের পরিত্যক্ত শক্ত অংশ দেখতে পেল। সেটা নিয়েই দৌড় দিল পুকুরের দিকে। হাঁপিয়ে উঠেছে। তারপরও নিজেকে বিশ্রাম না দিয়ে পানি নিয়ে দৌড়ে এসে বসল ছেলেটির মাথার পেছনে।

কাপড় পানিতে ভিজিয়ে হালকাভাবে চিপে নিয়ে ভাঁজ করে ছেলেটির কপালে চেপে ধরল। এভাবে কয়েকবার দেয়ার পর দেখল এই একটা কাপড়ে চলবে না। মধ্যের কিছু সময় তার কপাল ফাঁকা থাকে। কাপড়ের অভাব পূরণের জন্য আবার একই জায়গা থেকে আর এক টুকরো কাপড় ছিঁড়ে নিয়ে পট্টি বানাল। এখন একটা কাপড় কপালে লাগিয়ে আর একটা কাপড় পানিতে ভিজিয়ে চিপে তৈরি করতে করতে কপালেরটা গরম হয়ে যায়। তখন সেটা নামিয়ে তৈরি করাটা কপালে চেপে ধরে অন্যটা তৈরি করে। এভাবে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল।

দুপুরে কিছু পেটে যায়নি। ক্ষুধা লাগলেও পাত্তা দিচ্ছে না। হঠাৎ করে ছেলেটি নড়ে উঠল। ধীরে ধীরে চোখ মেলল। চোখ পিট পিট করল কিছুক্ষণ। চোখে কিছুই ভালোভাবে দেখতে পাচ্ছে না। সব ঝাপসা লাগছে। চোখ আবার বন্ধ করল ছেলেটি। বুঝতে পারছে কে যেন তার কপালে শীতল কী যেন দিচ্ছে। তবে কে, কী দিচ্ছে তা বুঝতে পারছে না। এতই দুর্বল হয়ে পড়েছে যে মাথা কাজ করতে চাইছে না।

এর মধ্যে মেয়েটি পাঁচবার দৌড়ে গিয়ে পানি বদলে এনেছে। পানি গরম হয়ে গিয়েছিল। তৃতীয়বার পানি এনে বসার কিছুক্ষণ পরই জ্ঞান ফিরে পেল ছেলেটি। পট্টি দেয়ায় জ্বর অনেকটা কমে গেলেও সে অনুপাতে মাথাব্যথা কমেনি। বেশ ব্যথা হচ্ছে। গায়েও ব্যথা অনুভব হচ্ছে। ছেলেটা নিঃসাড় পড়ে থেকে অবস্থা বোঝার চেষ্টা করছে। ভালোভাবে বুঝতে পারছে না। দ্বিতীয়বার চোখ খুলে বন্ধ করতে ইচ্ছে করলেও করল না। অনেক কষ্টে চোখ খুলে রাখল। ধীরে ধীরে ঝাপসা ভাবটা কেটে গেল। এখন পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে। মাথাও একটু একটু কাজ করছে, তবে পুরোপুরি নয়।

ওপরে তাকিয়ে দেখল, পরিষ্কার নীলাকাশ, গাছপালা। কপালে কে শীতল কিছু দিচ্ছে তা দেখার জন্য ডানে-বাঁয়ে চোখ ঘুরিয়েও কাউকে দেখতে পেল না। দেখার জন্য উঠে বসতে গিয়ে পড়ে গেল। মাটিতে মাথা ঠুকে গেলে আবার অজ্ঞান হয়ে যেত, কিন্তু মাথা ঠুকে যাওয়ার আগেই মেয়েটি ধরে ফেলল। বলল, ‘এমনিতে খুব দুর্বল আছেন, উঠে বসার দরকার নেই, শুয়ে থাকুন।’

ছেলেটি এখনো মেয়েটিকে দেখেনি। তবে গলা শুনে বুঝল, সেই মেয়েটি। প্রথমে বুঝতেই পারল না কীভাবে মেয়েটি তার খোঁজ পেল। কেনইবা তার সাহায্যে এগিয়ে এলো সময়মতো।

‘আর পট্টি দেয়ার দরকার নেই’ বলল ছেলেটি। ‘প্লিজ আর দেবেন না।’ ছেলেটির গলায় এমন কিছু ছিল যাতে মেয়েটি পট্টি দেয়া বন্ধ করল। কিছুক্ষণ ভাবনা-চিন্তা বাদ দিয়ে মস্তিষ্ককে বিশ্রাম দেয়ার জন্য চুপ থাকল। ছেলেটির মনে পড়ে গেল সব।

‘কবে বৃষ্টি থেমেছে?’ জিজ্ঞেস করল ছেলেটি।

‘গতকাল রাতে।’

‘তারপর আজ আর বৃষ্টি হয়নি?’ আবার জিজ্ঞেস করল ছেলেটি।

‘না, আর হয়নি। যখন দেখলেন যে আকাশে মেঘ জমেছে, বৃষ্টি আসবে, তখন গুহায় চলে গেলেই তো পারতেন। অহেতুক বৃষ্টিতে ভেজার কোনো দরকার ছিল না। জ্বরও আসত না’ কোমল গলায় বলল মেয়েটি।

‘ম্যাডাম, আমার যা ঘটার তা তো ঘটেই গেছে, দয়া করে আপনি সাবধান হোন। প্রতিদিন খুব ভোরবেলা যে পুকুরে গোসল করেন, তখন পানি তো খুব ঠান্ডা থাকে, আপনারও জ্বর আসতে পারে।’ বলল ছেলেটি কোনোরকমে।

মেয়েটি রাগে যেন মুহূর্তে অন্ধ হয়ে গেল।

‘আপনি… আপনি পানির সন্ধান দেয়ার নামে আমার গোসল করার তামাশা দেখেছেন? আপনি জানতেন, ওই পানির খোঁজ পেলে আমি গোসল করতে যাব। আপনি উপকারীর মুখোশ পরে আমার সব শেষ করেছেন, ছি! আপনি এত খারাপ, হীন, নীচ! আপনার সঙ্গে কথা বলতে আমার ঘৃণা হচ্ছে, ঘৃণা, আপনাকে আমি ঘৃণা করি।’ বলতে বলতে উঠে দাঁড়িয়ে ছেলেটির পাশে দুহাত তফাত দাঁড়াল মেয়েটি।

এতক্ষণে ছেলেটি তাকে দেখতে পেল। দেখল, তার সুন্দর মুখখানায় রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা, দুঃখ, অপমান সব একসঙ্গে ঝরে পড়েছে। দৃষ্টি খোলা আকাশের দিকে ফিরিয়ে নিল ছেলেটি। উঠে দাঁড়ানোর সময় এক মুহূর্ত বিরতি দিয়ে আবার শুরু করল মেয়েটি। ‘আপনি বিবেকহীন পশুর সমান, আপনি যা খুশি তাই করতে পারেন। রাগে-ঘৃণায় গলাটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। ‘আমি আপনাকে সুস্থ করে আমার গুহায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম, বৃষ্টি হলে ভিজতেন না, আর একসঙ্গে উদ্ধারের চেষ্টা করা যেত। কিন্তু একজন মানুষের সঙ্গে একজন পশু থাকতে পারে না। কারণ পশুর কাছে ভালো আচরণ আশা করা যায় না’ একনাগাড়ে বলে থামল মেয়েটি।

ছেলেটি বুঝতে পেরেছে মেয়েটির কথাগুলো। এসবের একটা জবাব দেয়া দরকার বলে মনে করল। কিন্তু মাথায় উত্তরের কথাগুলো এ দুর্বল অবস্থায় তৈরি করতে পারছে না।

‘আমার বেঁচে থাকার চিন্তা না করে আর সবার মতো বিমানে থাকাই সবচেয়ে ভালো ছিল।’ এক মুহূর্ত থেমে বলল মেয়েটি। এ কথা বলে আর দাঁড়াল না। দুহাতে মুখ ঢেকে রওনা হলো পাহাড়ের দিকে। দ্রুত গাছের আড়ালে চলে গেল।

মেয়েটি যখন ঘুরে হাঁটতে শুরু করল, তখন ছেলেটি তার হাত তুলে ডাকার জন্য মুখ খুলল। মেয়েটিকে কিছু বলা দরকার। কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হলো না। কে যেন গলা টিপে ধরেছে। হাত নামিয়ে নিল। ততক্ষণে মেয়েটি অদৃশ্য হয়ে গেছে। কয়েক মুহূর্ত শুয়ে থেকে বুঝল, তার জ্বর অনেক কমে গেছে। মাথাব্যথাও কমেছে। তবে শরীর অত্যন্ত দুর্বল।

মেয়েটি অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পর চিন্তা করে দেখল তার ফজর আর জোহরের নামাজ কাজা হয়েছে। পরে পড়ে নিতে হবে। তারপরই খেয়াল হলো আসরের নামাজের সময় কম। তাড়াতাড়ি উঠে বসতে গিয়ে পড়ে গেল। কয়েক মুহূর্ত বিশ্রাম নিয়ে দুহাতে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে উঠে বসল। বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে নিতে চিন্তা করল, বর্তমানে যে রকম অসুস্থ তাতে অজু করলে তেমন সমস্যা নেই। তাইয়াম্মুম করা যাবে না। আর পানিও খুব বেশি দূরে নয়।

সিদ্ধান্ত নিয়ে খুব ধীরে উঠে দাঁড়াল ছেলেটি। দাঁড়িয়ে থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছে। এখন কষ্টকে পাত্তা দিলে চলবে না। তাই গাছ ধরে ধীরে ধীরে পুকুরের দিকে হাঁটতে শুরু করল। কিছুদূর হাঁটার পর হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল ছেলেটি। বুঝতে পারল দাঁড়িয়ে গাছ ধরে ঘরে হেঁটে যাওয়াও তার পক্ষে অসম্ভব। কারণ সে দাঁড়িয়েই থাকতে পারছে না। সময়ও কম। তাই ছোট বাচ্চার মতো হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যেতে লাগল। শরীর চলতেই চায় না। তারপরও সর্বশক্তি প্রয়োগ করে এগিয়ে চলছে। কয়েক হাত এগিয়ে কয়েক মুহূর্ত বিশ্রাম নিয়ে আবার এগিয়ে যাচ্ছে।

একসময় ছেলেটি পুকুরের পানির কাছে পৌঁছল। তাড়াহুড়ো করলে পানিতে পড়ে যেতে পারে, আর সাঁতার দেয়ার মতো শক্তিও তার নেই। তাই ধীরে ধীরে অজু শেষ করে পুকুর পাড়ের শুকনো জায়গায় নামাজ পড়ার সিদ্ধান্ত নিল। দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ার খুব ইচ্ছে। জানে দাঁড়াতে পারবে না। তারপরও চেষ্টা করে যখন দাঁড়াতে পারল না তখন বসেই নামাজ পড়া শুরু করল। সূর্যাস্তের আর বেশি দেরি নেই।

আসর শেষেও কিছুক্ষণ পশ্চিমাকাশে ঝুলে রইল। কাজা নামাজ পড়ার সময় আছে। তবে সূর্যাস্তের সময় নামাজ পড়া যায় না, তাই বসে বিশ্রাম নিল। মাগরিবের পর কাজা নামাজ পড়ে, এশা পড়ে আজ ঘুমিয়ে পড়বে বলে ঠিক করল। তার আস্তানায় যেতে পারবে না। শক্তি নেই। এই দ্বীপে তো হিংস্র প্রাণীও নেই যে পুকুরে পানি খেতে আসবে। পুকুর পাড়েই শুয়ে পড়া যায়। এশার নামাজ পড়ে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ল।

ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই পুকুর পাড়ে চলে এলো মেয়েটি। আজ আর গোসল করার জন্য নয়, হাত-মুখ ধোয়ার জন্য। গুহা থেকে বেশ দূরে হওয়ার কারণে দিনে একবারই এখানে আসে। পুকুরের পানির ধারে বসল মেয়েটি। পানিতে হাত দেয়ার জন্য হাত বাড়িয়েছে, হঠাৎ পুকুরের ওই পাড়ে একজন মানুষকে পড়ে থাকতে দেখল। এখনো আঁধার আছে বটে কিন্তু পূর্বাকাশ ফর্সা হয়ে গেছে। তাতে আবছাভাবে দেখা যায়।

কী মনে হতে উঠে দাঁড়িয়ে ধীরপায়ে এগিয়ে গেল ছেলেটির দিকে। কাছে গিয়ে দেখার দরকার নেই। প্রথম দর্শনেই চিনে ফেলেছে। বুঝেও ফেলেছে যে ঘুমাচ্ছে। কাছে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে দেখল, সত্যিই শান্তিতে ঘুমাচ্ছে সে। শ্বাস নিচ্ছে নিয়মিত। আবার জ্বর বেশি হলো কিনা জানার জন্য আলতোভাবে কপালে হাত রাখল। চিত হয়ে শুয়ে থাকায় তার জন্য গায়ে হাত রাখায় সুবিধাই হলো। হাত রেখেই বুঝল গা স্বাভাবিক গরম। জ্বর প্রায় নেই। সঙ্গে সঙ্গেই হাত সরিয়ে নিল।

চোখ মেলল ছেলেটি। ঘুম ভেঙে গেছে কপালে কোনো কিছুর স্পর্শ পেয়ে। ক্লান্তিতে স্বাভাবিকভাবে আগেই ঘুম ভেঙেছিল। তাকিয়ে খোলা আকাশ দেখতে পেল। মেয়েটি মাথার পেছনে আছে বলে প্রথমে দেখতে পেল না। তাড়াতাড়ি করে উঠে বসল ছেলেটি। ছেলেটিকে চোখ খুলতে দেখে ঝট করে বনের দিকে দৌড় দিল মেয়েটি। শব্দ শুনে ঘুরে তাকাল ছেলেটি। আন্দাজ করে নিল কী ঘটেছে।

ছেলেটি হাত বাড়িয়ে ডাকল, ‘এই যে, শুনুন। আমি এ পুকুরে আর আসব না, আপনি যখন খুশি এসে গোসল করতে পারেন, আপনি চলে যাবেন না, আমি একটু পরই এখান থেকে চলে যাব, আপনি থামুন।’ কিন্তু থামল না মেয়েটি। দ্রুত হারিয়ে গেল গাছপালার আড়ালে।

মেয়েটি মনে করেছিল, তাকে ছেলেটি ধাওয়া করবে। কিন্তু পেছনে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে কৌতূহলবশে দাঁড়িয়ে গেল। কী মনে করে খুব সাবধানে পা টিপে টিপে পুকুরের কাছে এসে একটা বড় গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল, ছেলেটি কী করে। এদিকে বুক ঢিব ঢিব করছে।

কিছুক্ষণ পরই সূর্য উঠবে। তাই তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে অজু করতে শুরু করল ছেলেটি। কপালে হাত দিয়ে দেখল, জ্বর বলতে গেলে নেই। মাথাব্যথা দূর হয়ে গেছে। তবে গলাটা খুশখুশ করছে। মাঝেমধ্যে কাশ উঠছে। ভাবল এটাও ইনশাআল্লাহ সেরে যাবে। গা একটু ব্যথা করলেও দুর্বলতা অনেকটা কমে গেছে। অজু শেষ করেই নামাজে দাঁড়িয়ে গেল। মোনাজাত শেষ করে আর অপেক্ষা করল না। আস্তানায় চলে যেতে উদ্যত হলো। যাওয়ার আগে একবার পুকুরের দিকে তাকিয়ে জোরেই বলল, ‘বিদায়, আর হয়তো আসব না, চলি।’ আর দাঁড়াল না, হাঁটতে শুরু করল।

মেয়েটি সব দেখল ও শুনল। কেন যেন এখন আর ছেলেটিকে খারাপ ভাবতে পারছে না। ছেলেটি হয়তো ভালোই। তারই বুঝি কোথাও ভুল হচ্ছে। আসলে ছেলেটি তো ঠিকই বলেছে, অত ভোরে গোসল করলে ঠান্ডায় তারও তো জ্বর হতে পারে। ঠিক করল, আর প্রতিদিন গোসল করবে না। বেশ কয়েকদিন পরপর যখন খারাপ লাগবে, তখন রাতের অন্ধকারে গোসল করবে। সমুদ্রে চোখ রাখতে হবে, তাই দেরি না করে হাত-মুখ ধুয়ে চলল পাহাড়ের দিকে।

দুই রাত এক দিন পানি ছাড়া কিছুই পেটে যায়নি ছেলেটির। খিদেয় পেট জ্বলে যাচ্ছে। দুটি নারকেল, কিছু বাদাম এখনো আছে। আস্তানায় পৌঁছে তাই খেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিল। দুপুরের পর দুর্বল শরীর নিয়ে ঘুরে দেখতে বের হলো। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। শরীর চলতে চায় না। তাও বসে না থেকে ধীরে ধীরে ঘুরে দেখছে। বৃষ্টির আগের দুদিন উত্তর-পূর্ব দিক ঘুরে দেখেছে। দ্বীপের আগের জায়গাগুলোর মতোই গাছ-পালা, পশু-পাখি আছে। মাঝে মধ্যে গাছপালা ঘন আবার কোনোখানে পাতলা। উদ্ধারে কাজে লাগবে এমন কিছু পায়নি। আজ খুঁজতে বের হয়েছে উত্তর-পশ্চিম দিকে।

গত ঘটনাগুলোর কারণে মন খারাপ হয়ে গেছে ছেলেটির। মেয়েটি তার কথা শুনতেই চাচ্ছে না। মনে মনে ঠিক করল, আর বলবেই না আসল ঘটনা। ভুল বোঝে বুঝুক। আস্তানা থেকে খুব দূরে আসেনি। প্রতিদিন ফিরে যেতে ইচ্ছে করে কিন্তু আজ করছে না। একটা গাছের গায়ে হেলান দিয়ে রাতটা কাটিয়ে দিল। পরদিন সকালে ঠিক করল বাকি অঞ্চলটা দেখে তারপর আস্তানায় ফিরবে।

সারাদিন চূড়ায় বসে থেকে কোনো লাভ হলো না। সারা সমুদ্রজুড়ে শুধু পানি আর পানি ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়েনি। শুধু দুপুরে গুহায় গিয়ে খেয়ে এসেছে। সন্ধ্যার আগেই খাওয়ার জন্য বসেছে। নারকেল, বাদাম আর খেতে ইচ্ছে করছে না, এক প্লেট ভাত, এক বাটি গোস্ত বা মাছের জন্য মনটা আনচান করে উঠছে। কিন্তু এসব না খেয়ে যে উপায় নেই, বাঁচার জন্য খেতেই হচ্ছে। তবে এসব খেয়ে ক্ষুধা কোনোরকমে মিটলেও শরীর ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে আসছে পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে। খেয়ে-দেয়ে দেয়ালে হেলান দিল। একসময় শুয়ে পড়ল মেঝেতে। তারপরও ঘুম আসছে না। নানা কথাই মনের মধ্যে উঁকি মারছে। মন-মানসিকতার অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। আগে অনেক কিছুই ঠান্ডা মাথায় ভাবতে পারত, সহজেই অনেক কিছু মেনে নিতে পারত। এখন পারছে না। এভাবে ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল।

শেষ রাতে হঠাৎ চিৎকার দিয়ে তাড়াতাড়ি উঠে বসল মেয়েটি। ভয়ঙ্কর এক স্বপ্ন দেখেছে। শুয়ে একটু একটু করে কাঁপছেও। গুহার ভেতরে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল না। তারপরও ভয়টা কাটতে চাচ্ছে না। গভীর ঘুমে অচেতন ছিল।

স্বপ্নে দেখেছে, ছেলেটি তাকে ধরতে আসছে। সে ধরা দেবে না, তাই পালিয়ে যাচ্ছে। সে হাঁপিয়ে উঠেছে। আর দৌড়াতে পারছে না। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। তারপরও দৌড়ে চলেছে। একসময় কিসে যেন পা বেঁধে আছড়ে পড়ল মাটিতে। পেছনে ছেলেটির এগিয়ে আসার শব্দ পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছে। সাহায্যের আশায় চিৎকার করে উঠেছে। সেই চিৎকার গলায় ফুটে উঠতেই ঘুম ভেঙে গেছে তার।

ভয়ে আর শুতে পারছে না। আরো কিছুক্ষণ বসে থাকার পর ভয় কিছুটা কেটে যেতেই বাইরে বের হলো মেয়েটি অতি সতর্কতার সঙ্গে। কাউকেই দেখতে পেল না। আজ শেষ রাতে চাঁদ উঠেছে। দিন কয়েক পর আকাশে আর চাঁদ দেখা যাবে না। বাইরে ঠান্ডা লাগছে, তাই ভেতরে চলে গেল। আবার ঘুমে তলিয়ে গেল। ঘুম ভাঙল বেলা ওঠার অনেক পর। পুকুর পাড়ে এসে হাত-মুখ ধুতে শুরু করল। পুকুরের পানিতে নিজের অবয়ব ফুটে উঠতেই গত রাতের স্বপ্নের কথা মনে পড়ল মেয়েটির। সঙ্গে সঙ্গে যেন ভয়ে কুঁকড়ে গেল। ভয়ে ভয়ে চারদিকে তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে ভাবল স্বপ্ন স্বপ্নই, তাতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তাড়াহুড়ো করে হাত-মুখ ধোয়ার কাজ শেষ করে হাতে বাদামের বোঝা নিয়ে চলল পাহাড়ের দিকে। গুহায় নারকেল আছে। বাকি দিন কাটিয়ে দিল চূড়ায় বসে।

পরের দিন দুপুর পর্যন্ত কেটে গেল ছেলেটির। আগের দিনগুলো থেকে গত দুদিনে একটু ব্যতিক্রম পেল, ঝড়-বৃষ্টিতে গাছের ডালপালা ভেঙে গেছে। কোনো গাছ উপড়ে পড়ে আছে। আগে দ্বীপের উত্তর-পূর্ব দিকে বাদাম গাছ পেয়েছিল। এদিকেও পেয়েছে। পার্থক্য তেমন নেই। জোহরের নামাজের পর আগের আস্তানায় ফিরে চলেছে পশ্চিমাংশের সমুদ্রসৈকত ধরে। হতাশা চেপে ধরতে চাইছে; তবে পাত্তা দিচ্ছে না। সে তো সেই মহান আল্লাহর ওপর ভরসা করে চলেছে। তিনিই সব সমাধান করে দেবেন।

এখনো দুর্বলতা পুরোপুরি কাটেনি। কিছুদূর চলার পরপরই হাঁপিয়ে ওঠার কারণে বিশ্রাম নিচ্ছে। বিকেলও গড়িয়ে গেছে, সন্ধ্যা সমাগত। মাগরিবের নামাজের আগেই পৌঁছে যাবে ইনশাআল্লাহ্। সমুদ্রের দিকেই বার বার তাকাচ্ছে একটি জাহাজ দেখার আশায়। একবারও সে আশা পূরণ হয়নি। মাঝেমধ্যে সৈকতের ধারের গাছপালার দিকেও তাকিয়ে এগিয়ে চলেছে। হাঁটতে হাঁটতেই নারকেল বাগানে দুটি নারকেল গাছের গোড়া ভেঙে পড়ে থাকতে দেখল। অনেক গাছেরই আগা ভেঙে গেছে। বুদ্ধিটা যেন আকস্মিকভাবেই মাথায় ধরা দিল। হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল মুখ। এর আগেও অনেক এমনি গাছ ছাড়াও নারকেল গাছ পড়ে থাকতে দেখেছে। তখন বুদ্ধিটা মাথায় আসেনি। ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল সে।

পরের দিনও সমুদ্রের ওপর নজর রেখে সন্ধ্যার একটু আগে চূড়া থেকে নেমেছে। গুহায় ঢুকে খেয়াল হলো, নারকেল-বাদাম কিছুই নেই। আজ খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেছে। অত ভোরে পুকুর পাড়ে যাওয়ার সাহস হয়নি। সমুদ্র থেকে হাত-মুখ ধুয়ে চারটা নারকেলের মধ্যে দুটো খেয়ে যা বাদাম ছিল, তাও শেষ করে খুব সকালে চূড়ায় উঠেছে। বাকি দুটো নারকেল চূড়ার গোড়ায় রেখে উঠেছিল। দুপুরে নেমে খেয়েই আবার উঠেছে। পরে নারকেল ও বাদাম সংগ্রহের কথা ভুলে গিয়েছিল। ক্ষুধা লেগেছে, ক্ষুধা নিয়ে রাতে ঘুমও ভালো হবে না। অন্ধকার নামার আগেই নারকেল নিয়ে ফিরতে পারবে মনে করে বেরিয়ে পড়ল। বাদাম কালকে সংগ্রহ করবে। এ রকম এর আগেও একদিন হয়েছিল।

মাগরিবের নামাজ শেষে ছেলেটি ছুটল গুহার দিকে। মেয়েটিকে সব বুঝিয়ে বলে তার মাথায় কী বুদ্ধি এসেছে জানাবে; যেন কাল সকাল থেকেই কাজ শুরু করতে পারে। যত তাড়াতাড়ি এ দ্বীপ থেকে চলে যাওয়া যায় ততই মঙ্গল। নিচ থেকে গুহার বাইরে মেয়েটিকে দেখতে পেল না। গুহার কাছে উঠে খুব জোরে কেশে উঠল ইচ্ছে করেই। কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে আস্তে করে গুহায় উঁকি দিয়ে দেখল গুহা ফাঁকা। ভাবল, মেয়েটি কি আরো দেরি করে ফেরে, নাকি বিপদে পড়েছে? আঁধার নামা পর্যন্ত অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে গুহার সামনেই বসে পড়ল। বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর পদশব্দ শুনে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল।

মেয়েটি নীচের দিকে তাকিয়ে দ্রুত হেঁটে গুহায় ফিরছে। সামনে কারো নড়াচড়ার আভাস পেয়ে ঝট করে চোখ তুলে তাকাতেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। তাহলে স্বপ্নটাই সত্যি হতে চলেছে। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে হাত থেকে নারকেল চারটি পড়ে গেল। এর মধ্যে ছেলেটি সামলে নিয়ে চোখ নীচের দিকে করে ধীরে এগোতে শুরু করল। নারকেল পড়ার শব্দ হতেই সম্বিত ফিরে পেল মেয়েটি। ঘুরে দৌড় শুরু করল। ছেলেটি হাত তুলে ডাকল, ‘এই যে, আপনি পালিয়ে যাবেন না, আগে আমার কথা শুনুন। ’

মেয়েটি থামল না দেখে ছেলেটিও তার পেছনে দৌড় জুড়ে দিল। যেভাবেই হোক মেয়েটির ভুল ভেঙে দিতে হবে। এখন ফিরে গেলেও ভয়ে আর রাতে ঘুম হবে না। দৌড়াতে দৌড়াতে আবারও ডাকল ছেলেটি, ‘এই যে, আপনি থামুন, আমি আপনার ক্ষতি করতে আসিনি।’ ছেলেটি কয়েক হাতের মধ্যে এসে গেছে। ইচ্ছে করলেই তার হাত ধরে থামাতে পারে। কিন্তু সে তা না করে তার সামনে গিয়ে থামাতে চাইছে। মেয়েটি ভাবল, তাকে ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করছে। তাই না থেমে আরো জোরে দৌড়াতে লাগল।

হাঁপিয়ে উঠেছে মেয়েটি। তার ওপর পাহাড়ের ওপর থেকে নীচে নামছে। হঠাৎ পা ফসকে গড়িয়ে পড়তে শুরু করল। এ দেখে আঁতকে উঠল ছেলেটি। মেয়েটির পতন রোধ করতে পারল না। সমতল ভূমিতে গিয়ে প্রথম থেমে গেল মেয়েটি। দুই সেকেন্ড পর তার পাশেই ছেলেটি থেমে তাড়াতাড়ি উঠে বসল। মেয়েটির কোথাও লেগেছে কিনা বুঝতে পারছে না। মেয়েটি তার আগে উঠে বসেনি।

কয়েক মুহূর্ত কেটে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে উঠে বসল মেয়েটি। তার চুলগুলো মুখের ওপর এসে পড়েছে। মুখে ধুলো লেগেছে। ভয়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে মুখটা। উ™£ান্তের মতো লাগছে তাকে। মুখ তুলে তাকিয়ে সামনে ছেলেটিকে হাতে ভর দিয়ে বসে থাকতে দেখল মেয়েটি। ছেলেটির আচরণে প্রচণ্ড রেগে গেছে সে। কোনো কিছু না ভেবেই ডান হাত দিয়ে প্রচণ্ড জোরে ছেলেটির বাম গালে থাপ্পড় মারল সে।

ছেলেটির কতটা লেগেছে জানে না মেয়েটি; তবে তার হাত ঝাঁ করে উঠল। দুহাত কচলাতে শুরু করল। মেয়েটি এখনো বুঝে উঠতে পারছে না, সে কী ঘটিয়ে ফেলেছে। পাঁচটা আঙুলের ছাপ যে গালে বসে লাল হয়ে গেছে তা ছেলেটি দেখতে পাচ্ছে না বটে, তবে দুহাতে গাল চেপে ধরে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল।

গাঢ় আঁধার এখনো ঘনিয়ে আসেনি। পশ্চিম আকাশে এখনো দিনের আলো বিদ্যমান। সেই আলোয় মেয়েটি ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল, বাম গাল দুহাতে চেপে ধরেছে। ফলে পাঁচ আঙুলের লাল ছাপ দেখতে না পেলেও তার দুচোখ দিয়ে অশ্রু গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে দেখল।

ততক্ষণে দাঁড়িয়ে পড়েছে ছেলেটি। গাল থেকে হাত সরিয়ে দুহাতে চোখ মুছল। এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে ঘুরে আস্তানার দিকে পা বাড়াল সে। মেয়েটি যখন তার কথা শুনতেই চায় না, তখন সে আর কিছুই জানাবে না।

মেয়েটি ছেলেটির চোখের পানি দেখেই যেন নিজের ভুল বুঝতে পারল। সে তাকে কিছু একটা বলার জন্য থামতে বলেছিল। অথচ তার কোনো কথা না শুনে তাকে মেরেছি। এছাড়াও কথা হলো ছেলেটি আসলেই তার কোনো ক্ষতি করেনি। সে ছেলেটির ভালো-মন্দ যাচাই না করেই তাকে মন্দ ভেবে তার ওপর হাত তুলেছে। ইচ্ছে করলেই ছেলেটি তাকে এখন যা খুশি তাই শাস্তি দিতে পারত। তা না করে সে চলে যাচ্ছে। এটাই কি ছেলেটির ভালো হওয়ার সবচেয়ে বড় নিদর্শন নয়? আর কয়েক হাত পরই ছেলেটি বনের ভেতরে হারিয়ে যাবে। ছেলেটিকে ডাকার জন্য হাত তুললেও মুখ থেকে কোনো আওয়াজ বের হলো না। একসময় হারিয়ে গেল ছেলেটি গাছপালার আড়ালে।

সূর্যাস্তের পরপরই গাছপালার কারণে বনভূমি আঁধারে ঢেকে যায়। ভালোভাবে কোনো কিছুই দেখা যায় না। পরিচিত পথেও অত্যন্ত সাবধানে পথ চলতে হয়, তা না হলে দিক ভুল হওয়া স্বাভাবিক। মেয়েটির আচরণে ছেলেটির এতই মন খারাপ হয়েছে যে, সে অসতর্ককার কারণে চার-চারবার গাছের গোড়ায় পা আটকে পড়ে গেল। একসময় দ্বীপের পশ্চিম পাশের সমুদ্র তীরে পৌঁছে গেল। বুঝতে পারল, সে দিক ভুল করে ফেলেছে। এখনো দিক ঠিক করে আস্তানায় ফিরতে পারে কিন্তু ফিরতে ইচ্ছে করল না।

এর মধ্যে অন্ধকার গাঢ় হয়ে গেছে। আকাশ পরিষ্কার, তাই চাঁদ না থাকলেও আকাশে তারার মেলা বসেছে। তারার স্নিগ্ধ আলোয় যেন রাতের আঁধার অনেকখানি কমে গেছে। এ পরিবেশ উপভোগ করার মতো হলেও তার ভালো লাগছে না। সবকিছুই অসহ্য লাগছে। রাতটা আশপাশের কোনো গাছের নীচে কাটিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিল।

মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেছে মেয়েটির। উঠে তারার আলোয় আলোকিত আকাশের নীচে ধীর পদক্ষেপে গুহার দিকে হাঁটতে লাগল। হাঁটতে হাঁটতে ভাবল, ছেলেটির সঙ্গে আপস করাই ভালো। আর কী সে বলতে চেয়েছিল তাও শোনা দরকার। ঠিক করল কাল দিনে খুঁজে বের করে তার সঙ্গে বলবে। একসময় পৌঁছে গেল গুহার কাছে।

পরদিন সকালবেলা একাই কাজে লেগে গেল ছেলেটি। যে কাজ তা একা করা কষ্টসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। দুজনে মিলে করতে পারলে অনেক সহজ হতো। প্রথমে দুহাত দিয়ে নারকেল গাছের ডালপাতা ছিঁড়তে শুরু করতে লাগল। এত হাতের চামড়া ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যাচ্ছে। সেদিকে খেয়াল না করে কাজ করেই চলেছে একমনে। ভাবছে, যত কষ্ট হোক, যত সময়ই লাগুক না কেন সে একাই সব কাজ শেষ করবে। তারপর কিছু নারকেল, বাদাম সংগ্রহ করে যেভাবেই হোক মেয়েটিকে জলযানের কথা জানিয়ে তাকে তার সঙ্গে যাওয়ার জন্য রাজি করাবে। একান্তই তার সঙ্গে যেতে রাজি না হলে প্রথম জলযানে তাকে যেতে দেবে। তারপর নিজের জন্য অন্য একটি তৈরি করে তাতে ভাসবে। প্রথমটা যেহেতু দুজনের জন্য বানাচ্ছে তাই তা বড় ও মজবুত হতে হবে। পরেও যদি একটা বানাতে হয়, সেটি তার একার জন্য বলে খুব বড় বানাতে হবে না; তখন সময় কম লাগবে। কিছুতেই সে মেয়েটিকে এ নির্জন দ্বীপে ফেলে পালাবে না। কাজ করতে করতে তার মন ভালো হয়ে যাচ্ছে। দুপুরের আগেই এ কাজ শেষ হয়ে গেল। দুপুরের পর থেকে মাথা মুণ্ডিত নারকেল গাছটাকে সমুদ্রের ধারে নেয়ার কাজ শুরু করল।

রাতে গাছের গায়ে হেলান দিয়ে তারকা উজ্জ্বল খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছে, এখনো একটা গাছই তীরে নিয়ে যেতে পারেনি আজ সারাদিন। এখনো কমপক্ষে আর দুটো গাছকে তীরে আনতে হবে। জঙ্গল থেকে মোটা লতা সংগ্রহ করতে হবে, কাঁচির যে এক অংশ আছে তা দিয়ে গাছের বাকল কেটে দড়ি তৈরি করতে হবে। তারপর লতা, বাকলের দড়ি দিয়ে নারকেল গাছগুলোকে একত্রে শক্ত করে বেঁধে ভেলা বানাতে হবে। তারপর নারকেল, বাদাম নিয়ে অজানার উদ্দেশে ভেসে পড়া।

স্রোতের টানে ভেলা যেদিকে গিয়ে ঠেকবে, সেদিকেই গিয়ে উঠতে হবে, পথিমধ্যে যদি কোনো বিরূপ পরিস্থিতির শিকার হতে না হয়, আর যদি কোনো জাহাজের দেখা পাওয়া যায় তবে তো হয়েই গেল। তবে এ ভেলায় ভেসে আবার লোকালয়ে ফেরার সম্ভাবনা বেশি নেই। তারপরও এমন দ্বীপে তিলে তিলে মৃত্যুর চেয়ে বাঁচার সংগ্রামে মৃত্যুই শ্রেয়।

পরিশ্রমের ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসতে চাইছে। আগের আশ্রয়স্থলের চেয়ে এখানে খোলা সমুদ্রের একদম ধারে হওয়ায় ঠান্ডা বেশি। তারপরও সেখানে ফিরতে ইচ্ছে হলো না। মনে মনে ঠিক করল বাকি যে কদিন লাগবে কাজ শেষ করতে, সে কদিন বেঁচে থাকলে এখানেই রাত কাটিয়ে দেবে। আরো অনেক পরে চোখ মুদল।

পরদিন সকালে পুকুরপাড় থেকে হাত-মুখ ধুয়ে এসে খেয়ে-দেয়ে আবার ছেলেটিকে খুঁজতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো। কিন্তু কেন জানি এক অস্বস্তি চেপে ধরল। মনে হলো সে ছেলেটির সামনে দাঁড়াতে পারবে না। ভেতর থেকে অস্বস্তি আর অপরাধবোধই যেন কোনোভাবেই দূর করতে পারল না। শেষে ঠিক করল এরপর যদি কোনো কারণে ছেলেটি আবারো আসে, তবে আর সে কখনোই আগের ভুল করবে না। যদিও তার আবার আসার সম্ভাবনা খুব কম। ঠিক করল, আগামী তিন-চার দিনের মধ্যে যদি না আসে তবে সে যে কোনো কিছুর বিনিময়ে হোক তার সামনে দাঁড়াবেই। সে কামনা করছে এর মধ্যে যেন তার অস্বস্তি কেটে যায়। সেও যেন আবার আসে। তাহলে খুঁজে বের করতে হবে না। তারপর উঠতে শুরু করল চূড়ার ওপর।

পরদিন খুব সকালে প্রথমে গাছটিকে তীরে রেখে অন্য একটা নারকেল গাছ নিয়ে কাজে লেগে গেল। হাতের চামড়া ছড়ে গেছে বলে কাজ দ্রুত এগোনো যাচ্ছে না। মেয়েটা থাকলে এক-তৃতীয়াংশ সময় কম লাগত। কী আর করার আছে? হঠাৎ দূর থেকে নারী কণ্ঠের হাঁকডাক শুনতে পেল। অস্পষ্ট আওয়াজ কানে আসছে। সঙ্গে সঙ্গে সজাগ হয়ে উঠল ছেলেটি। ঘুরে দক্ষিণে পাহাড়ের চূড়ার দিকে তাকাল। এখান থেকে বেশ দূর, তাই কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কাজ ফেলে তড়িঘড়ি করে সেদিকে যাওয়া শুরু করল। মেয়েটি কী ধরনের বিপদে পড়েছে বুঝতে পারছে না সে। দুবার হোঁচট খেয়ে দৌড়ের গতি কমে যাওয়ায় সতর্ক হয়ে দৌড়ানোর প্রয়োজন অনুভব করল।

যতই পাহাড়ের কাছে আসছে, ততই চিৎকার জোরালো হচ্ছে। ওপরের দিকে না তাকিয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে দ্রুত দৌড়ে চলেছে। কাছে আসতেই শোনা গেল, মেয়েটি কী বলে চিৎকার করছে। বুঝতে পারল হয়তো কোনো জাহাজের দেখা পেয়েছে। একসময় ফাঁকা জায়গায় এসে দাঁড়াল ছেলেটি। তাকিয়ে দেখল মেয়েটি সাদা পতাকা হাতে নিয়ে যেন জংলী নৃত্য জুড়েছে।

পরের দিন খুব সকালেই চূড়ায় উঠে বসেছে মেয়েটি। চমৎকার রৌদ্রোজ্জ্বল দিন। বারবার মাথা ঘুরিয়ে পূর্ব, পশ্চিম, দক্ষিণ দিক দেখছে। উত্তর দিক বনাঞ্চল বলে দেখার দরকার নেই। তারপরও মাঝে-মধ্যে তাকাচ্ছে। বার বার তাকিয়ে প্রতিবারই নিরাশ হচ্ছে। এত দিন যখন উদ্ধারের কোনো পথ বের হলো না, তখন আগামীতে বের হবে কিনা কে জানে? এখানে তো তাও থাকার জন্য সুন্দর গুহা পেয়েছে, পানের যোগ্য সুপেয় পানি পাওয়া গেছে, ক্ষুধা নিবারণের জন্য নারকেল, বাদাম পাওয়া গেছে। এসব খেয়ে যদিও ধীরে ধীরে মানসিক, দৈহিক মলিনতা শুরু হয়েছে, তারপরও বস্ত্র তো আর কিছুদিনের মধ্যে ছিঁড়ে যাবে। তার পাঞ্জাবিটা সুতির বলে এমনিতেই অনেক জায়গায় নরম হয়ে ফেঁসে গেছে। কোনোদিন যে কোথায় লেগে সম্পূর্ণ ছিঁড়ে যায়, তার ঠিক কী আছে? যার জন্য ছেলেটিকে সে অপমান করেছে, সেও কি তাই ঘটতে চলেছে? তার কি এমন এক সময় আসবে, যখন আদিম যুগের মানুষের মতো তাকে পাতার পোশাক পরতে হবে? এসব ভাবতে ভাবতে দক্ষিণ দিকে তাকাল একবার। তার নজরে কী যেন ভেসে উঠল। চোখ কচলে আবারো তাকাল। সত্যিই কি সে দূর দিয়ে একটি জাহাজ যেতে দেখছে? হ্যাঁ, সত্যি, আনন্দে যেন উন্মাদ হয়ে গেল। ধেই ধেই করে নাচতে লাগল চূড়ার স্বল্প পরিসর জায়গায় দাঁড়িয়ে। ওপর থেকে নীচে পড়ে যেতে পারে, তা সে ভাবছেই না। কেটে গেল বেশ কয়েক মুহূর্ত। তারপরই খেয়াল হলো সে দেখলেও তাকে যদি জাহাজের লোক না দেখে থাকে, তবে এ আনন্দের কোনো মূল্য নেই। সঙ্গে সঙ্গে তার পরিকল্পনার কথা স্মরণ হলো। কালবিলম্ব না করে মুহূর্তে পাঞ্জাবি একটু ওপরে তুলে নীচে পড়া সাদা রংয়ের টেপটা একটান দিয়ে ছিঁড়ে বের করল। তা পাশে রাখা লাঠির মাথায় দ্রুত অনেকটা পতাকার মতো করে যত তাড়াতাড়ি পারে বেঁধে ফেলল। তারপর তা মাথার ওপর তুলে জোরে জোরে নাড়াতে লাগল।

বেশ কিছুক্ষণ লাঠি নাড়ার পরও যখন ওই পক্ষের কোনো সাড়া পেল না, তখন কী করবে প্রথমে বুঝতে পারল না। সে জানে, অত দূর থেকে তার ডাক শুনতে পাবে না তারা। তারপরও সে চেঁচিয়ে ডাকতে লাগল, ‘আমরা খুব বিপদে আছি, ফিরে এসে আমাদের ছেড়ে চলে যেও না।’ তারপরই তা ইংরেজিতে অনুবাদ করছে। নিজের অজান্তেই জংলী নৃত্য জুড়েছে। বাঁ হাত দিয়ে ইশারা করে ডাকছে। ডান হাতে লাঠি ধরা।

কেটে গেল আরো অনেকক্ষণ। এতকিছুর পরও তাদের দৃষ্টিতে পড়তে পারেনি বলে নিজের ওপর রাগে-দুঃখে যেন কেঁদে ফেলবে এমন অবস্থা। এখনো জাহাজের কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এত দিন পর জাহাজের খোঁজ পেয়েও হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে দেখে নৃত্যের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিল। হঠাৎ তাল সামলাতে না পেরে নীচে পড়ে গেলে যে হাত-পা নির্ঘাত ভাঙবে সেদিকে তার কোনো খেয়ালই নেই। জাহাজটি ইতোমধ্যে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে চলে গেছে। আর আশা নেই। হাঁপিয়ে উঠেছে, হতাশ হয়ে বসে পড়ল। তবে সাদা পতাকা সংবলিত লাঠিখানা দুহাত দিয়ে দাঁড় করিয়ে ধরে রইল। এই সময় ছেলেটির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করল। সে থাকলে হয়তো কোনো উপায় বের করে ফেলত। অনেকক্ষণ পর করুণ দৃষ্টি তুলে তাকাল মেয়েটি। যা দেখল, তাতে নিজেই অবাক হয়ে গেল। জাহাজটি এদিকেই আসছে। ‘তবে কি শেষ পর্যন্ত দেখতে পেয়েছে? যা-ই হোক, আবার আনন্দে মন ভরে গেল।’

প্রায় আধা ঘণ্টা পর সৈকতের অদূরে নোঙ্গর ফেলল জাহাজটি। মেয়েটি তখনো চূড়ায় আছে। নৌকা নামিয়ে তিনজন লোককে দাঁড় বেয়ে এদিকে আসতে দেখেই নীচে নামার প্রয়োজনীয়তা বোধ করল। সাদা কাপড় বাঁধা লাঠি নিয়ে নামতে বিলম্ব হবে মনে করে তা চূড়ায় রেখেই দ্রুত নীচে নেমে সৈকতের দিকে দৌড় দিল।

সৈকতে পৌঁছার একটু পরই ঘ্যাঁচ করে নৌকার তলা বালিতে আটকে গেল। নৌকা থেকে লাফ দিয়ে হাঁটু পানিতে নেমে শুকনো বালুতে দাঁড়ানো মেয়েটির সামনে সবাই। ইংরেজিতেই প্রথম শুরু করল তিনজনের মধ্যে পাতলা লম্বা লোকটি। দেখেই বোঝা যায়, বয়স বেশি নয়। তিনজনকেই ইংরেজের মতো লাগল মেয়েটির।

‘আপনার পরিচয়?’ সংক্ষেপে জিজ্ঞেস করল লোকটি। কথায় কড়া বিদেশি টান। মুখে মধুর হাসি।

‘আমরা বিমানে নিউ ইয়র্কে যাচ্ছিলাম। বিমান ক্র্যাশ হওয়ায় সাঁতরিয়ে এ দ্বীপে উঠেছি। তারপর থেকেই এখান থেকে উদ্ধার পাওয়ার চেষ্টা করছি। আপনারা সঙ্গে নিলে বেঁচে যাই এ যাত্রা।’ একনাগাড়ে উত্তর দিয়ে থামল মেয়েটি। মনে মনে স্বস্তি বোধ করল যে, লোকগুলো বাংলায় কথা বলছে। বাংলা ছাড়া আর অন্য ভাষায় বললে আকার-ইঙ্গিতে বোঝানো ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। লোকটি কিছু না বলে তার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

‘কি, আপনারা আমাদেরকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন?’ লোকটি কিছু বলছে না দেখে জিজ্ঞেস করল। এটা জিজ্ঞেস করার কোনো দরকার নেই। কোনো মানুষই এ অবস্থায় তাদের রেখে যাবে না।

‘হ্যাঁ’ অবশ্যই নিয়ে যাব, আসেন।’ লোকটিকে হাঁটতে দেখে বলল মেয়েটি।

সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে দাঁড়িয়ে আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল লোকটি, ‘সেও কি মেয়ে?’

‘না, ছেলে।’ জবাব দিল মেয়েটি। লোকটির কথায় একটু অবাক হয়েছে সে।

‘কোথায়?’ যেন আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে লোকটি।

‘এ দ্বীপেই আছে, একটু ডাকাডাকি করে খুঁজতে হবে।’

‘খোঁজাখুঁজির সময় নেই। সে থাক, আপনি চলেন।’ বলল লোকটি।

‘তা কী করে হয়, আপনি তাকে নেবেন না, কিন্তু আমাকে কেন নেবেন? ‘গলায় কৌতূহল প্রকাশ পেল মেয়েটির। কিছুই বুঝতে পারছে না সে।

কথা না বাড়িয়ে দুপাশে দাঁড়ানো হোমরা-চোমরা লোক দুটোর দিকে কী যেন ইঙ্গিত করতেই দুজনে মেয়েটির হাত ভদ্রভাবে ধরে নৌকার দিকে টেনে নিয়ে চলল।

‘এই হাত ছাড়ুন, খুব লাগছে, আমি বুঝেছি আপনারা ভালো লোক না, আমি আপনাদের সঙ্গে যেতে চাই না। আমায় এখানেই রেখে যান।’ বলে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড়ে পালানোর জন্য ধস্তাধস্তি শুরু করল। কিন্তু কিছুতেই ছাড়াতে না পেরে চারদিকে মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে ছেলেটির সন্ধান করতে লাগল। কিন্তু কোথাও তাকে দেখতে পেল না। নিরাশ হয়ে পড়ল মেয়েটি। তারপরও ধস্তাধস্তি চলল। লোক দুজন জোর করে টেনেহিঁচড়ে নৌকায় তুলে ফেলল তাকে। পাটাতনে শুইয়ে দিল মেয়েটিকে যেন ঝাঁপ দিয়ে পানিতে না পড়ে বা ধস্তাধস্তিতে নৌকা উল্টিয়ে না ফেলে।

‘যদি এরপর বাধা দেন, তবে ওই দুজন পা দিয়ে আপনাকে চেপে ধরবে। অতএব, সাবধান।’ বলল আগের লোকটি। ভয় দেখাতে চাইছে সে।

মেয়েটি বুঝে ফেলেছে তার অবস্থা। এরা যা বলবে তা-ই করবে ভেবে শান্ত হয়ে গেল। ছেলেটিকে ফেলেই চলে যাচ্ছে বলে নিজেকে অপরাধী ভাবতে লাগল। তার সঙ্গে আর মীমাংসার সুযোগ হলো না। এরপর কী ঘটতে পারে, ভাবতেই হাত-পা ঠান্ডায় হিম হয়ে গেল। একটু পরই জাহাজের গায়ে নৌকা ভিড়ল। জাহাজের দুজন লোক টেনে তুলল মেয়েটিকে। আরো দশ মিনিট পর নোঙ্গর তুলে চলতে শুরু করল জাহাজ।

এদিকে, ছেলেটি ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলেও নাচানাচির সময় মেয়েটি তাকে দেখতে পায়নি। ব্যাপারটা পরিষ্কার বোঝার জন্য সতর্কতার সঙ্গে পাহাড়ের আড়ালে এসে অবস্থান নিল, যা দেখল তাতে তার আনন্দে মন ভরে গেল। শুকরিয়া জানাল আল্লাহর কাছে। যে জায়গায় ছেলেটি দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে মেয়েটি খুব জোর একশত গজ দূরে আছে। মেয়েটির সঙ্গে তাদের সব কথোপকথন শুনতে পেল। পরের কথাগুলো শুনে ছেলেটি শঙ্কিত হয়ে পড়ল।

সবশেষে মেয়েটিকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে দেখে ছেলেটি কী করবে প্রথমে ভেবে পেল না। মাথা গরম করলে মেয়েটির বিপদ আরো বাড়তে পারে ভেবে মাথা ঠান্ডা রেখে চিন্তা-ভাবনা শুরু করল।

ছেলেটি পরিষ্কার বুঝতে পারল, লোকগুলো উদ্ধারের জন্য নয় বরং জাহাজ থেকে দুরবিন দিয়ে মেয়েটিকে দেখে শুধু তাকে নেয়ার জন্যই এসেছে। সে বের হলেও তাকে তারা খুব সম্ভব নেবে না। কিন্তু সে মেয়েটির জোরপূর্বক নিয়ে যাওয়ায় বাধা দিতে পারে। তারা হয়তো কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে তাকে নিয়ে যাবে। নিয়ে যাওয়ার আগেই ঝুঁকি নিয়ে এ তিনজনের সঙ্গে লড়ার জন্য ঠিক করল। নিয়ে গেলে তো তার কিছুই করার থাকবে না।

বাইরে বের হয়ে দৌড়াতে গিয়ে আবারো লুকিয়ে পড়ল সে। দেখল, মেয়েটিকে টেনেহিঁচড়ে নৌকায় তুলে শুইয়ে দিল। তারপরই লোকটির কথা শুনে তার শরীর হিম হয়ে গেল। নিজেকে ধমক দিল আবার মাথা গরম করার জন্য। চিন্তা করল লোকগুলোর কথাবার্তায় এবং সর্বশেষ আচরণে বোঝা যায় এটা অপহরণ এবং তারা এ কাজে পেশাদার। তাদের সঙ্গে অস্ত্র থাকা স্বাভাবিক। এছাড়া জাহাজে নিশ্চয়ই আরো লোক আছে। সুতরাং তাদের সঙ্গে খালি হাতে একাই লড়তে যাওয়া হবে বোকামি। কারণ তারা খুব ঝামেলায় না গিয়ে এ নির্জন দ্বীপে একটা বুলেট খরচ করতে হয়তো সামান্যতম দ্বিধা করবে না।

ততক্ষণে জাহাজের গায়ে নৌকা ভিড়েছে। ঠিক করল, তাদের কাছ থেকে বোকার মতো মেয়েটিকে কেড়ে নেয়ার চেষ্টা না করে তাকে নিয়ে কৌশলে পালাতে হবে। কিন্তু তা এ মুহূর্তে একদম অসম্ভব। আর এক মুহূর্ত ভেবে ঠিক করল কী করবে? যা আছে কপালে হবে। তারপর কালবিলম্ব না করে সৈকত পার হয়ে যতদূর পারা যায় নিঃশব্দে সমুদ্রে লাফিয়ে নেমে ডুব-সাঁতার দিয়ে এগোতে লাগল জাহাজের দিকে। সে কীভাবে এ ডাঙ্গা এত দ্রুত পার হয়েছে বলতে পারবে না।

মেয়েটিকে অন্য দুজন করিডোর দিয়ে জাহাজের সামনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। জাহাজের নীচে হেঁটে যাওয়ার সময় একটা বন্ধ দরজার ওপাশের ঘর থেকে অনেক নারীর মৃদু গলার স্বর ভেসে এলো। শুধু এতটুকু বুঝতে পারল, তারাও একই পরিস্থিতির শিকার। আরো কয়েকটা ঘর পার করে তাকে একটা ঘরের ভেতরে দিল। দরজার চৌকাঠে পা আটকে নিজেকে সামলাতে না পেরে কাঠের মেঝের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল মেয়েটি। উঠে বসার আগেই ওপাশে সশব্দে দরজা বন্ধ হয়ে গেল। খিরকি লাগানোর স্পষ্ট শব্দ হলো। স্তব্ধ হয়ে গেল মেয়েটি।

জাহাজের পেছনে মধ্যখানে সবেগে প্রপেলার ঘুরে পানি কেটে এগিয়ে চলেছে গুঞ্জন তুলে। ছেলেটি জাহাজের পেছনে বাঁ পাশে বের হয়ে থাকা আধ হাত কাঠ ধরে জাহাজের সঙ্গে সঙ্গে ভেসে চলেছে। হাত দুটোর ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়েছে, ছিঁড়ে যেতে চাচ্ছে দেহ থেকে। তার ওপর হাতের চামড়া ছিলে  যাওয়ায় কাঠখণ্ডটি ধরে থাকাতে যথেষ্ট কষ্ট হচ্ছে। তারপরও সর্বশক্তি প্রয়োগ করে ধরে আছে। কারণ সে জানে কাঠটি ছেড়ে দিয়ে কখনোই সাঁতার কেটে জাহাজের সঙ্গে পাল্লা দেয়া সম্ভব নয়। তাহলে প্রথমত সে মেয়েটিকে হারিয়ে ফেলবে। হয়তো একসময় ডুবে মরে যাবে যদি সাঁতার কাটতে না পারে।

খুব শক্ত করে ধরে আছে কাঠটি। কারণ স্রোতের ধাক্কায় হাত ফসকে ডানে সরে গেলে ঘূর্ণায়মান প্রপেলারে মুহূর্তে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে তার দেহ। নাকে, মুখে, চোখে লবণাক্ত পানি ঢুকে জ্বালা শুরু করে দিয়েছে। নাক পরিষ্কার বা চোখ মুছে জ্বালা দূর করতে পারছে না। কারণ এক হাত খুললে যদি অপর হাতও খুলে যায়, তাহলেই সব শেষ। নাকে পানি ঢোকার কারণে বারবার হাঁচি আসছে। প্রতিবার ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলছে। হাঁচির কারণে শরীরের জড়তা দূর হয়ে যাচ্ছে। হাঁচি আসার আগেও অত্যন্ত সতর্ক হয়ে থাকছে যেন হাঁচির ধাক্কায় হাত খুলে না যায়।

ধীরে ধীরে উঠে বসল মেয়েটি। ঘরের চারদিকে তাকাল। এ ঘরে একটি জানালা আছে। মোটা গরাদ লাগানো। জানালাটা বন্ধ। জানালার সঙ্গে একটা সিঙ্গেল খাট। বিছানা পাতা। ডান দিকে বাথরুমের দরজাটা অর্ধ খোলা। এছাড়া বাঁয়ে দেয়াল ঘেঁষে আছে একটা চেয়ার ও একটা টেবিল। ঘরের আসবাবপত্র বলতে এই। চিন্তা করছে, তাকে কী জন্য এরা ধরে নিয়ে এলো, তাকে নিয়ে তারা কী করবে? তবে কি সে বাঁচার চেষ্টা করতে গিয়ে মৃত্যু ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছে? মেঝেতেই শুয়ে পড়ল সে। সময় কেটে যাচ্ছে তার নিজস্ব গতিতে।

প্রচণ্ড জোরে হাঁচি দিয়ে নীচু স্বরে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলল ছেলেটি।

‘বাঃ, দারুণ ব্যাপার তো, ক্যাপ্টেন দেখে যান।’ ওপর থেকে বলল এক লোক।

মুখ তুলে ওপরে তাকাল ছেলেটি। হয়তো তার হাঁচির শব্দ শুনে ফেলেছে। বিপদ আসছে।

তার পাশে এসে দাঁড়াল ক্যাপ্টেন। এ লোকটিই দ্বীপে গিয়ে মেয়েটির সঙ্গে কথা বলেছিল। লোকটা তাকে দেখেই গম্ভীর হয়ে গেল। বলল, ‘এই সেই দ্বিতীয় ব্যক্তি। বাঃ, মেয়েটি তো ভালোই একজনকে জোগাড় করেছে।’

‘হ্যাঁ, ক্যাপ্টেন। ক্যাপ্টেনের কথায় সায় জানাল লোকটি।

ছেলেটি ভাবল, তাকে যখন দেখেই ফেলল, তখন এভাবে কষ্ট করে লাভ কী? তাই বলল, ‘আমাকে তুলে নিন।’

‘শখ কত!’ মুচকি হেসে জবাব দিল ক্যাপ্টেন।

‘ভাগ্য ভালো।’ আবার শুরু করল। ‘দ্বীপে আমার সামনে পড়নি। তাহলে আর এভাবে চুরি করে এতক্ষণ ভেসে বেড়াতে হতো না।’ লোকটির হাতে বেরিয়ে এসেছে একটি কালো পিস্তল।

পিস্তলের শব্দ শুনে চমকে উঠে নিজেকে দ্রুত সামলে নিল ছেলেটি তার কোথাও লাগেনি দেখে।

‘ভয়ের কিছু নেই, দ্বীপে তোমার ওপর যে বুলেটটা খরচ হতো, তা খরচ করলাম তোমার পেছনে ধাবমান ছোট এক হাঙ্গরের ওপর। তবে তা তোমার কাছে আসতে পারত না প্রপেলারের কারণে। কারণ তাতে পানিতে প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি হচ্ছে। তা ছাড়াও এ এলাকায় তেমন হাঙ্গর নেই।’

 

তবে ভালো কথা, এ কাঠখণ্ড ছেড়ে দেয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে তলিয়ে যাবে সে আটলান্টিকের বুকে। কারণ কাঠখণ্ড ছেড়ে দেয়ার পর তাকে ভেসে থাকার জন্য যে হাত-পা ছুড়তে হবে, সে শক্তি তার শেষ হয়ে গেছে। সর্বশেষে ভেসে থাকতেই মহান আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করে দোয়া-দরুদ পড়তে লাগল। সেই সঙ্গে দোয়া করতে লাগল আল্লাহর কাছে, যেন আল্লাহতায়ালা মেয়েটিকে যে কোনোভাবে এ নরপশুদের হাত থেকে উদ্ধার করে লোকালয়ে ফেরার ব্যবস্থা করেন।

কেটে গেল আরো কিছুক্ষণ। আর টিকতে পারছে না সে। যে কোনো মুহূর্তে ডুবে যেতে পারে হাত ছুটে গিয়ে। হঠাৎ তার ওপর টর্চের আলো পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে ওপরে তাকিয়েই চোখ বন্ধ করে ফেলল। তীব্র আলো সহ্য করতে পারছে না চোখ। এক মুহূর্ত স্থির থেকেই নিভে গেল। চোখ অনেকক্ষণ কিছুই দেখতে পেল না, কিছু বুঝতেও পারল না কে কেন আলো ফেলে তাকে দেখল। তবে কেন যেন মনে আশার আলো সঞ্চার হলো। তারপরের কয়েক মুহূর্তেও কিছু ঘটল না দেখে নিরাশ হয়ে পড়ল। কিন্তু মনের ভেতর ব্যাপারটা খচ খচ করতে লাগল। হঠাৎই যেন তার সামনে নাইলনের রশির ফাঁস নেমে এলো। ছেলেটি ভয় পেয়ে গেল। পর মুহূর্তে আসল ব্যাপারটা বুঝে ফেলল। মনে বল ফিরে পেলেও দেহে পাচ্ছে না।

একহাতে রশিটা টেনে পরীক্ষা করার জন্য ডান হাত খুলে রশির ফাঁসটা ধরতেই বাম হাত কাঠ থেকে ছুটে গেল। তখনো রশির ফাঁসটা পুরোপুরি ধরতে পারেনি। তাই সেটিও হাতছাড়া হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে তীব্র টর্চের আলো আবার তার গায়ে এসে পড়ল। অতি কষ্টে সাঁতার কেটে জাহাজের পেছনে লেগে থাকার চেষ্টা চালাল। হঠাৎ করেই ফাঁসটা ওপরে উঠে গেল। এর মধ্যে দশ-বারো হাত পিছিয়ে গেল ছেলেটি। টর্চ জ্বেলেই রেখেছে অদৃশ্য ব্যক্তিটি। ভেসে থাকতে রীতিমতো নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হচ্ছে ছেলেটিকে। সামনে আবার রশিটিকে পড়তে দেখল। এটাই বাঁচার সর্বশেষ সুযোগ। যে কোনো কারণেই এ সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। ‘আল্লাহু আকবর’ বলে পানিতেই লাফ দিয়ে দুহাতে রশির ফাঁসটি আঁকড়ে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে টর্চের আলো নিভে গেল। চারদিকে নেমে এলো যেন অমানিশার অন্ধকার।

রশির সাহায্যে কিছুক্ষণ ভেসে শক্তি সঞ্চয়ের চেষ্টা চালাল। বুঝল, এভাবে শক্তি সঞ্চয়ের চেষ্টা করলে যেটুকু শক্তি আছে, তাও নিঃশেষ হয়ে যাবে। অতএব, যা অবশিষ্ট আছে তাই খরচ করে ওপরে ওঠার সিদ্ধান্ত নিল। দুহাতের সাহায্যে রশি পেঁচিয়ে অতি ধীরে ধীরে জাহাজের দিকে এগোতে লাগল। অত্যন্ত সতর্ক আছে যাতে ডানে সরে গিয়ে প্রপেলারে ছিন্নভিন্ন না হয়ে যায়। যে শক্তি অবশিষ্ট আছে, তাতে জাহাজে উঠতে পারবে কিনা তা যথেষ্ট চিন্তায় ফেলে দিয়েছে তাকে। সর্বশেষে মহান আল্লাহর ওপর ভরসা করে রশিতে ঝুলে পড়ে দুই পা জাহাজের গায়ে ঠেকিয়ে রশি দুহাতে ধীরে ধীরে পেঁচিয়ে দুই পা বেয়ে অনেকটা উঠে এলো। হঠাৎ পা পিছলে পানিতে ধপাস করে পড়ে গেল। তবে হাতে ফাঁস থাকায় চিন্তামুক্ত থেকে মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করল। এখন মাথা গরম করলে সব গণ্ডগোল হয়ে যাবে।

কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে আবার উঠতে শুরু করল। এবার অত্যন্ত সতর্ক আছে যেন পা পিছলে না যায়। অবশেষে জাহাজের ওপরে উঠে এলো ছেলেটি। গা থেকে টপটপ করে পানি ঝরছে। যে জায়গাটায় সে দাঁড়িয়ে আছে, সে জায়গাটা অন্ধকার, কাউকেই দেখতে পেল না। অথচ ছেলেটি তার সামনে কাউকে আশা করেছিল। কাউকে দেখতে না পেয়ে বুঝে নিল, যে তার উদ্ধারের বন্দোবস্ত করছে, সে গোপন থাকতে চেয়েছে। তাই সে তার হাতে রশি ধরার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়ে সরে পড়েছে। হঠাৎ খেয়াল হলো রশিটা সরিয়ে ফেলা দরকার। একটু খুঁজতেই জাহাজের গায়ে লাগানো একটি শক্ত হুকের সঙ্গে রশির অপর মাথা পেল ভালোভাবে বাঁধা অবস্থায়। অন্ধকারে বাঁধন খুলতে একটু বেগ পেতে হলো।

রশিটা লুকিয়ে না ফেললে যে কেউ আসল ব্যাপারটা জেনে যেতে পারে। রশিটা লুকিয়ে ফেলার মতো অন্ধকারে তেমন কোনো জায়গাই দেখতে পেল না। অগত্যা একবার দ্বিধা করে সমুদ্রে ফেলে দিল। শেষ পর্যন্ত জাহাজে উঠতে পেরে মহান আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করল। বসে পড়ল পাটাতনের ওপর। এখন বিশ্রাম নেয়ার সময় নেই। তাড়াতাড়ি মেয়েটিকে খুঁজে বের করতে হবে। সে জানে না কোথায় রাখা হয়েছে মেয়েটিকে। এত বড় জাহাজের সবখানে তার এ দুর্বল শরীর নিয়ে খুঁজে দেখা অসম্ভব। তার ওপর ধরা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। তবুও তাকে খুঁজতেই হবে।

 

আমি ক্ষমাপ্রার্থী, পর্ব- ১ 

আমি ক্ষমাপ্রার্থী, পর্ব – ২ 

আমি ক্ষমাপ্রার্থী, পর্ব – ৪ 

আমি ক্ষমাপ্রার্থী, পর্ব – ৫ 

আমি ক্ষমাপ্রার্থী, পর্ব – ৬ 

আমি ক্ষমাপ্রার্থী, পর্ব – ৭ 

আমি ক্ষমাপ্রার্থী, পর্ব – ৮ 

আমি ক্ষমাপ্রার্থী, পর্ব – ৯

আমি ক্ষমাপ্রার্থী, শেষ পর্ব

 

 

 

 

 

 

ঘোষণা- ‘আমি ক্ষমাপ্রার্থী’ উপন্যাসটির ১০ টি পর্ব শেষ হলে পুরো উপন্যাস থেকে একটি প্রশ্নোত্তর প্রতিযোগিতা হবে। অংশগ্রহণকারী পাঠকদের সর্বোচ্চ সঠিক উত্তরদাতাকে পুরস্কৃত করা হবে।

-নির্বাহী সম্পাদক

 

জাকির আহমদ
Latest posts by জাকির আহমদ (see all)