(পর্ব – ৬)
‘তার মানে?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল মেয়েটি। ছেলেটি কিছু বলতে যাবে, তার আগেই বলে উঠল মেয়েটি, ‘ও! বুঝেছি। এ কাপড়ের গন্ধে কুকুর খুব তাড়াতাড়ি আমাদের খুঁজে বের করবে।’
ওপরে-নীচে মাথা দোলাল ছেলেটি। সত্যি, মেয়েটির বুদ্ধি আছে।
‘বাথরুমে ঢুকে কাপড় বদলাই।’ বলল মেয়েটি।
‘আমিই বাথরুমে ঢুকছি, আপনি এখানে কাপড় বদলান। কাপড় বদলানো হলে দরজায় দুবার টোকা দেবেন।’ বলেই বাথরুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল ছেলেটি। ছেলেটি বাথরুমে ঢুকতেই বাথরুমের দরজার দিকে তাকাল মেয়েটি। এপাশ থেকে দরজা লক করার কোনো ব্যবস্থা নেই। তবে স্প্রিংয়ের সাহায্যে দরজা সবসময় বন্ধ থাকে। শুধু ভেতর থেকে লাগানো যায়। এক মুহূর্ত ভেবে বারান্দা থেকে তার নিজের কাপড় এনে ঘরের বাতি নিভিয়ে অন্ধকারে কাপড় বদলাতে শুরু করল। দরজায় টোকা পড়ার একটু পরে বাথরুম থেকে বের হয়ে এলো ছেলেটি। চোখ পড়ল দেয়াল ঘড়িতে। পেন্ডুলাম তার আপন নিয়মে দোল খাচ্ছে। দেখল, ঘড়ির কাঁটা দুটো ছুঁই ছুঁই করছে। সামনে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটি তার আগের পোশাকে।
‘সঙ্গে নেয়ার মতো আর কাপড় আছে কি?’
মাথা নাড়ল মেয়েটি।
‘চলুন তাহলে।’
প্রথমে ছেলেটি ফাঁক গলে বের হয়ে গ্রিল ধরে ঝুলে পড়ল। তারপর কোমরে প্যাঁচানো কাপড়ের দড়িটা খুলে গ্রিলের একটা মোটা কাঠের সঙ্গে বেঁধে নীচে ঝুলিয়ে দিল। দেখল, নীচের প্রান্ত মাটি ছুঁই ছুঁই করছে। এরপর মেয়েটিকে বেরিয়ে আসার ইঙ্গিত করল।
ছেলেটির মতো মেয়েটিও বাইরে বেরিয়ে এলো। প্রথমে গ্রিল ধরে ওপরে উঠেছে, তারপর টালির ছাদে দুহাত দিয়ে হাতের ওপর ভর দিয়ে নিজেকে বাইরে বের করে এনেছে। তারপর গ্রিলে ঝুলে পড়া কোনো সমস্যা হয়নি।
‘এখন ঝুলে নীচে নামতে পারবেন?’
‘পারব।’ জবাব দিল মেয়েটি। হয়তো বাইরের ঠান্ডা বাতাসে তার গলা কেঁপে গেল।
‘ঠিক আছে, সাবধানে নামুন। তারপর আমি নামব।’
এক মুহূর্ত দ্বিধা করে দুই হাতে দড়ি ধরে ঝুলে পড়ল। তারপর কাঠের দেয়ালে পা ঠেকিয়ে ধীরে ধীরে নেমে এলো নীচে। মেয়েটি মাটিতে পা রাখতেই গ্রিল থেকে কাপড়ের দড়ির বাঁধন খুলে দিল ছেলেটি। তারপর লাফ দিয়ে নীচে। মাটিতে পা পড়তেই বসে পড়ল। পতনের শব্দটা বেশ জোরেই হলো। কাপড়ের রশি গুছিয়ে নিয়েছে ছেলেটি। এমন সময় মাথার ওপর সশব্দে জানালা খুলে গেল। জানালা থেকে প্রায় তিন হাত দূরে আবছা অন্ধকারে মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। জানালা খুলে যেতে দেখে তার মুখ শুকিয়ে গেল। ভীত হরিণীর মতো তাকাল ছেলেটির দিকে।
হঠাৎ ‘মেঁও ও’ ডাক শুনে আশপাশে তাকিয়ে কোনো বিড়াল দেখতে পেল না মেয়েটি। বুঝল এটা ছেলেটির কাজ।
‘ধ্যুত!’ বলেই জানালাটা সশব্দে বন্ধ করে দিল অজ্ঞাত লোকটি। মনে মনে ছেলেটির উপস্থিত বুদ্ধির প্রশংসা করল মেয়েটি। আরো কয়েক মুহূর্ত যে যার যার জায়গায় স্থির হয়ে রইল। তারপর ছেলেটি কাপড়ের দড়ির বান্ডিলটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াতেই নড়ে উঠল মেয়েটি। বিনাবাক্যে পিছু নিল ছেলেটির। অল্পের জন্য বেঁচে গেল। তা না হলে বন্দী হতো দুজনেই। গাছপালার মাঝে ঢুকে পড়েছে। বাংলো এখনো চোখে পড়ে। অন্ধকারে বেশি দূরে দৃষ্টি যায় না।
চোখে অন্ধকার সয়ে এসেছে। মাঝেমধ্যে সমুদ্র থেকে ভেসে আসা হিম শীতল বাতাসে গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। খালি গায়ে ঠকঠক করে কাঁপছে। বাংলো থেকে আর একটু দূরে সরে গিয়ে বিছানার চাদরের টুকরো ও পর্দার কাপড়ের গিট খুলে সেগুলো গায়ে জড়িয়ে ঠান্ডা কিছুটা নিবারণ করা যাবে। একটা ঠান্ডা দমকা হাওয়ায় দাঁতে দাঁতে বাড়ি লেগে ঠকঠক শব্দ করে উঠল ছেলেটির। সঙ্গে সঙ্গে খেয়াল হলো, ওই লোকটিও তো খালি গায়ে মাটিতে পড়ে আছে। সেও নিশ্চয়ই তার মতোই কাঁপছে। নাহ, লোকটিকে এভাবে রেখে যাওয়া ঠিক হবে না। সে অহেতুক ঠান্ডায় কষ্ট পাবে। লোকটির জন্য সে কী করতে পারে তা নতুন করে ভাবার দরকার হলো না। বাংলো থেকে বেশি দূরে আসেনি তারা। এখন ফিরে যাওয়া ঝুঁকিবহুল হলেও লোকটিকে ওভাবে ফেলে যেতে মন সায় দিল না ছেলেটির। দাঁড়িয়ে পড়ল।
‘আমার একটু কাজ আছে, দয়া করে এখানে কিছুক্ষণ দাঁড়ান। আমি একটু পরেই ফিরে আসব। আর আমার বিপদ হয়েছে বুঝতে পারলে, আপনি চলে যাবেন।’ এক নিঃশ্বাসে বলে থামল ছেলেটি।
‘কী কাজ?’
‘আপনার না শুনলেও চলবে।’
‘আমার একা থাকতে ভয় লাগবে।’
হেসে ফেলল ছেলেটি। ‘চালাকি, না! আচ্ছা, আসুন আমার সঙ্গে।’ আবার গম্ভীর হয়ে গেল সে।
পৌঁছে গেল লোকটির কাছে। লোকটিকে এ অবস্থায় দেখে যা বোঝার বুুঝে নিল মেয়েটি। একবার লোকটির দিকে, আর একবার ছেলেটির দিকে তাকাচ্ছে। সে বুঝতে পারছে না, ছেলেটি তার ওই জখমওয়ালা দুর্বল শরীর নিয়ে কীভাবে এ লোকটিকে বন্দী করেছে? আবর এ লোকটির কাছে ফিরেইবা এলো কেন?
কারো আসার শব্দে চোখ মেলল লোকটি। ছেলেটির সঙ্গে মেয়েটিকে দেখে খুব অবাক হয়েছে। কিন্তু কিছু বলতে পারল না। তাকে কি আরো কষ্ট দেয়ার জন্য ছেলেটি আবার এসেছে?
ছেলেটির কাজ দেখে মেয়েটি। গিট খুলে পর্দা, চাদরের টুকরো আলাদা করে ফেলল। এক মুহূর্ত থামল। হয়তো কিছু ভাবল। তারপর একটা দরজার পর্দা মাটিতে বিছিয়ে দিল। উঠে লোকটির কাছে এসে ‘ম্যাডাম, আমাকে একটু সাহায্য করুন।’ বলে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল কী করতে হবে। এক মুহূর্ত আবাক হয়ে মেয়েটি তাকিয়ে থাকল তার দিকে।
দুজনে মিলে ধরাধরি করে লোকটিকে কাপড়ের পর্দার ওপর শুইয়ে দিল। আর একটা পর্দা দিয়ে লোকটিকে ঢেকে দিতে যাবে, এমন সময় যেন তাদের দুজনকে চমকে দিয়ে ভেসে এলো কণ্ঠটি।
‘ও দোস্ত, বেরিয়ে আস, মাফ করো, আসতে দেরি হয়ে গেল।’ এক মুহূর্ত থামল।
‘কী ব্যাপার বেরিয়ে এসো, এখন আমার পালা, যাও ঘুমিয়ে পড়।’
কথা কানে আসতেই প্রথমে স্থির হয়ে গেল দুজনেই। বিমূঢ় ভাবটি প্রথমে ছেলেটিই কাটিয়ে উঠল। কথা বলার সময়, সুযোগ কোনোটাই নেই। লোকটি কাছেই আছে। এদিকেই আসছে।
‘এদিকে আসুন।’ চাপা গলায় বলে ছেলেটি একটা বড় গাছের নীচে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটিও তার পাশে এসে দাঁড়াল। ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে।
‘কোনো শব্দ করবেন না’, বলল ছেলেটি। চোখ পড়েছে একটু দূরে থাকা রাইফেলটির ওপর। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল দ্রুত। পা টিপে টিপে দ্রুত সেখানে পৌঁছে গেল। রাইফেল হাতে নিয়ে একটি গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। তার একটু পাশ দিয়ে লোকটি চলে গেল। কিন্তু সামনে নজর থাকায় তাকে দেখতে পায়নি। এগোতে এগোতেই বলছে, ‘আরে দোস্ত, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পাহারা দেয়া হচ্ছে নাকি?’
কয়েক কদম এগিয়েই দাঁড়িয়ে পড়ল আগন্তুক। আন্দাজ করে ফেলেছে কী ঘটেছে। ঘুরে দাঁড়াতে যাবে, কিন্তু তার আগেই রাইফেলের নল পিঠে ঠেকে গেল এবং শুনল, ‘হাত দুটো মাথার ওপরে তুলুন, ঝামেলা বাধালে গুলি করতে দ্বিধা করব না।’ শীতল গলায় বলল ছেলেটি। সঙ্গে সঙ্গে হুকুম পালন হলো। হাত তুলে স্থির হয়ে দাঁড়াল আগন্তুক।
‘প্রথমে বসে পড়ুন, তারপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ুন’, নির্দেশ করল ছেলেটি। নির্দেশ পালন করতে করতে কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল লোকটি, ‘কে আপনি, কেন আমার সঙ্গে এমন করছেন?’
‘যাকে আজ বিকেলে বনে নির্বাসন দিয়েছিলেন’, জবাব দিল ছেলেটি।
‘আপনি!’ অবাক হয়েছে লোকটি। ‘এ কী করে সম্ভব?’ উত্তেজনায় আওয়াজ একটু উঁচুই হয়ে গেল।
রাইফেলের নল পিঠে একটু বেশি চেপে ধরে, ‘আস্তে, কোনো চালাকির চেষ্টা করলে মরতে হবে।’
উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েছে লোকটি।
‘ম্যাডাম, একটু এদিকে আসুন’, নীচু গলায় ডাকল ছেলেটি।
এতক্ষণ তন্ময় হয়ে গাছের আড়ালে থেকে সব দেখছিল মেয়েটি। লোকটি যখন এগিয়ে আসছিল, তখন ঘুরে দৌড় দেয়ার ইচ্ছেটা অনেক কষ্টে দমন করেছিল। ডাকতেই কাছে গিয়ে দাঁড়াল মেয়েটি।
‘এটা ধরুন, নড়াচড়ার চেষ্টা করলেই টিপে দেবেন ট্রিগার। এটা এখন সেমিতে আছে।’ বলে মেয়েটির হাতে রাইফেল ধরিয়ে দিয়ে কাজে গেল। প্রথমে একটা জানালার পর্দা টুকরো টুকরো করে আগের লোকটির মতো এ লোকটারও হাত-পা বাঁধল। বাধা দিল না লোকটা।
‘আপনাদের ভাগ্য বড়ই ভালো যে, সকাল ছ’টায় আমার ডিউটি শেষ। তার আগে এদিকে হয়তো কেউ আসবে না। আর ও রাতে কোয়ার্টারে না ফিরলেও কেউ তা পাত্তা দেবে না।’ ছেলেটি তার হাত-পা বাঁধতে বাঁধতে বলল লোকটি।
তার ক্যাপ্টেনের পকেট থেকে রুমাল বের করে তার মুখে গুঁজে দিয়ে মুখ বেঁধে দিল। তারপর মেয়েটির হাত থেকে রাইফেল নিয়ে পাশে রাখল। আর একট পর্দার কাপড় আছে, তা বিছিয়ে এ লোকটিকেও আগের মতো একজন সামনে আর একজন পেছনে ধরে তার ওপর শুইয়ে দিল। এ আগন্তুকের কাপড় পরাই আছে, তাই অবশিষ্ট দুটো জানালার পর্দা দিয়ে প্রথম লোকটিকে ভালোভাবে ঢেকে দিল। মুখ বাইরে রাখল। কী মনে হতে আগন্তুকের রাইফেলের ম্যাগাজিন খুলে নিয়ে মাটিতে পড়ে থাকা পর্দার ছেঁড়া এক অংশ দিয়ে তা প্রথম পাহারাদারের রাইফেলের সঙ্গে ভালোভাবে বেঁধে নিল। আগন্তুকের হাত বাঁধার আগেই তার কাঁধ থেকে রাইফেল খুলে রেখেছিল।
মখমলের চাদরের একাংশ নিজের গায়ে পেঁচিয়ে নিল। অপর অংশ মেয়েটিকে। তারপর কাঁধে রাইফেল ফেলে এগোতে যাবে এমন সময় প্রথম পাহারাদারের গ্যাস লাইটারটার কথা স্মরণ হলো। বেঁচে থাকার জন্য পানির মতো আগুনও প্রয়োজন। যেখানে প্রথম লোকটার শার্ট ছিঁড়ে ছিল, সেখানে এখনো সিগারেটের প্যাকেট ও লাইটার পড়ে আছে। লাইটারটা হাতে নিয়ে তার মালিকের কাছে এলো ছেলেটি। মাথা নামিয়ে আনল নীচে লোকটির জবাব পাওয়ার আশায়। ‘আমি কি এই লাইটারটা নিয়ে যেতে পারি?’ লোকটার কাত করা মুখের দিকে তাকিয়ে বলল ছেলেটি। ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নাড়ল লোকটি। আবছা অন্ধকারেও লোকটির চোখের পানি দেখতে পেল ছেলেটি। পাশে এসে দাঁড়িয়েছে মেয়েটি।
‘আপনি কাঁদছেন? আপনার কি খুব কষ্ট হচ্ছে?’ উদ্বিগ্ন হয়ে বলল ছেলেটি।
এবার ‘না’ বোধক মাথা নাড়ল সে।
‘ওনার এ কান্না কৃতজ্ঞতার’, বলল মেয়েটি। যেন মেয়েটির কথার সমর্থনে আবার মাথা নাড়ল লোকটি।
হঠাৎ করেই মনটা কেমন বিষণ্ন হয়ে গেল ছেলেটির। উঠে দাঁড়াল। একবার দুজনের দিকে তাকিয়ে ‘ম্যাডাম, এটা আপনার কাছে রাখুন’, বলে লাইটার বাড়িয়ে ধরল তার দিকে। তাকিয়ে আছে অন্যদিকে। মেয়েটি লাইটারটা হাতে নিতেই কাঁধে রাইফেল ভালোভাবে ঝুলিয়ে নিয়ে হাঁটা শুরু করল। পিছু নিল মেয়েটি।
সময় বয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে দুজনে নীচে নেমে চলেছে। অনুমান আর দুই-আড়াই ঘণ্টা পর সূর্য উঠবে। পূর্বাকাশ ফর্সা হবে তারও আগে। সময় খুব কম। তার আগেই পৌঁছাতে হবে। দূরত্ব কখনো কমে যাচ্ছে পাহাড়িয়া অচেনা পথের কারণে। তার ওপর আবার আঁধার রাত্রি। আকাশের তারকারাজির আলোয় এ অন্ধকার দূর হচ্ছে না। বনে নানারকম কীটপতঙ্গের একটানা কর্কশ শব্দ। পেছনে নিরাপদ দূরত্বে তাকে অনুসরণ করছে মেয়েটি। একটু পিছিয়ে পড়লেই জানিয়ে দিচ্ছে। তখন দাঁড়িয়ে দূরত্বটা কমিয়ে আনছে ছেলেটি পেছনে না তাকিয়েই। হাঁটছে আর ভাবছে মেয়েটি। এই অল্প সময়েই বুঝতে পেরেছে যে ছেলেটি সত্যিই অদ্ভুত। আচ্ছা, কোথায় চলেছে ছেলেটি?
‘সমুদ্রের দিকে’, হাঁটতে হাঁটতেই জবাব দিল ছেলেটি।
‘কেন?’
‘আমার মনে হয় আজ রাতে না হলেও কাল সকালেই কুকুরের সাহায্যে আমাদের পিছু ধাওয়া করা হবে।’
‘তাতে কী? সৈকতে কি নৌকা পাওয়া যাবে?’
‘হয়তো যাবে না, কিন্তু আমরা সৈকতে হাঁটু পানি দিয়ে কিছুদূর হেঁটে আবার এ দ্বীপের কোথাও আপাতত লুকিয়ে থাকব। ফলে তারা কুকুরের সাহায্যে আর আমাদের পিছু নিতে পারবে না। আমাদের ট্রাক হারাবে, পরে সময়-সুযোগমতো আমরা এই দ্বীপ থেকে পালাব। আর ততদিন এই পাহাড়িয়া বনেই কোথাও লুকিয়ে থাকব।’ একনাগাড়ে বলে থামল মেয়েটি। ‘হ্যাঁ’ সত্যিই আপনার বুদ্ধি আছে।’ প্রশংসা না করে পারল না ছেলেটি। প্রশংসায় মেয়েটির সুন্দর গোলাপি ফর্সা মুখখানি লাল হয়ে উঠল। তা দেখার জন্য ঘুরে তাকাল না ছেলেটি। হেঁটে চলেছে একইভাবে।
প্রায়ই গাছের ডালপালা হাত দিয়ে সরিয়ে, ঝোপের পাশ দিয়ে, পাহাড়ের ধার দিয়ে, পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নীচে নেমে চলেছে দুজনে। কখনোবা অগভীর খাদে লাফিয়ে নামতে হচ্ছে। আঁকাবাঁকা দুর্গম পথে অন্ধকারে হাঁটতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে দুজনেই। তার ওপর যতই নীচে নামছে ততই গাছপালার ঘনত্ব কমে আসছে। এর ফলে সুবিধার চেয়ে অসুবিধার মাত্রাই বেশি। গাছপালার পরিমাণ কমে যাওয়ায় সমুদ্র থেকে ধেয়ে আসা হিমশীতল বাতাসের প্রকোপ বেশি হচ্ছে। একটু পরপর ঠান্ডায় কেঁপে উঠছে মেয়েটি। দাঁতে দাঁতে বাড়ি লেগে ঠকঠক শব্দ হচ্ছে। ঠান্ডাটা অসহ্য হয়ে উঠেছে। তার জিন্সের প্যান্ট ভেদ করে ঠান্ডা তেমন কাবু করছে না। তবে ওপরের অংশে জামার ওপর চাদর থাকার পরও তার ঠান্ডায় জমে যাওয়ার অবস্থা। হঠাৎ খেয়াল হলো ছেলেটির ওপরের অংশে চাদর জড়ানো ছাড়া আর কিছুই নেই; আর নীচে যে পায়জামাটা আছে তাও ঠান্ডা ঠেকানোর উপযোগী নয়। তাহলে তো ছেলেটির অবস্থা তার চেয়েও খারাপ।
একটি পাহাড়ের ধার বেয়ে নীচে নেমে গেল ছেলেটি। ব্যাপারটি তারও খেয়াল হয়েছে যে, যতই নীচে নামছে ঠান্ডার প্রকোপও বৃদ্ধি পাচ্ছে সেই হারে। নীচে নামা যদিও খুব পরিশ্রমের কাজ না, তারপরও এতক্ষণ একনাগাড়ে হাঁটতে যা পরিশ্রম হয়েছে তাতে মোটেও গা গরম হয়নি। বরং মরা মানুষের মতো গা ঠান্ডা আছে। ভাবছে, সমুদ্র আর কত দূরে? সূর্য ওঠার আগেই লুকিয়ে পড়তে পারবে তো! নাকি ধরা পড়ে যাবে শেষ পর্যন্ত। পথের দিকে মনোযোগ থাকায় সময়জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে সে। হয়তো হাতে সময় খুব কম।
‘শুনুন।’
শব্দটা কানে যেতেই থেমে ঘুরে দাঁড়াল ছেলেটি। দেখল গায়ের চাদর খুলছে মেয়েটি।
‘কী করছেন?’
‘আপনার চাদরের নীচে কোনো কাপড় নেই, হয়তো খুব ঠান্ডা লাগছে। আমার ততটা লাগছে না।’ বলতে বলতে চাদরের অংশটা বাড়িয়ে ধরল ছেলেটির দিকে।
‘এটা গায়ে জড়িয়ে নিন।’
মেয়েটিকে কী বলবে ঠিক করতে সময় লাগল তার। তার যে ঠান্ডা লাগছে তা সত্যি। তাই বলে মেয়েটির যে কম ঠান্ডা লাগছে তা নয়। হতে পারে মেয়েটি তার আসল অবস্থা ঢেকে রেখে তাকে চাদরটি দিতে হচ্ছে। হাত বাড়াল না ছেলেটি। ‘লাগবে না, ধন্যবাদ।’
‘নিন’, আবার বলল সে। ‘আপনার ঠান্ডা লাগলে অসুখ হবে’, মেয়েটির কণ্ঠে আকুতি। এমন সময় দমকা হাওয়া বয়ে গেল। কেঁপে উঠল ছেলেটি। গায়ে চাদর না থাকায় মেয়েটি তার চেয়েও আরো বেশি কেঁপে উঠল, তা পরিষ্কার দেখল ছেলেটি।
‘এটা আমাকে দিলে আপনার আমার চেয়ে বেশি ঠান্ডা লাগবে, আর আপনি অসুস্থ হলে আমাদের পালানো কঠিন হবে। অতএব…’
কথা শেষ করতে দিল না মেয়েটি। ‘আমার গায়ে যে কাপড় আছে, তাতেই ঠান্ডা কেটে যাবে, নিন এটা’, বলে আরো বাড়িয়ে ধরল চাদরটি।
‘আপনি একটু আগে যেভাবে কেঁপে উঠেছিলেন, চাদরটি গায়ে থাকলে কি ওভাবে কেঁপে উঠতেন?’
‘না’, মাথা নীচু করে সত্য জবাব দিল।
‘তাহলে, ওটা আমার বদলে আপনি গায়ে জড়িয়ে নিন, সময় খুব কম।’
মেয়েটি গায়ে আবার চাদরটি জড়িয়ে নিল একরকম বাধ্য হয়ে। কারণ সে তর্কে হেরে গেছে।
দুজনেই নীচে নেমে চলেছে। হাঁপিয়ে উঠেছে দুজনেই, বিশ্রাম নেয়ার সময় নেই, তাই থামছে না। তবে ছেলেটির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পা বাড়াতে হিমশিম খাচ্ছে মেয়েটি। কারো মুখে কোনো কথা নেই। দুজনেই ভাবছে নানা কথা।
একটা ঢাল বেয়ে অতি সাবধানে নীচে নামছে। হেঁটে নামার গতি বজায় রাখতে হিমশিম খাচ্ছে দুজনেই। এ রকম আরো কয়েকটা বিপজ্জনক ঢাল বেয়ে নেমেছে। হঠাৎ করেই ঢালের একটা গর্তে পা দিয়ে ফেলল ছেলেটি। আগে দেখতে পায়নি। ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে গেল ঢালের রপর। কাঁধ থেকে ছিটকে পড়ল ভারী রাইফেল। গড়িয়ে নীচে নামতে লাগল ছেলেটি।
অকস্মাৎ ছেলেটিকে পড়ে যেতে দেখে দিশা হারিয়ে ফেলল মেয়েটি। ভুলেই গেল, ঢালু জায়গায় দৌড় দেয়া কতটা বিপজ্জনক। ছেলেটির সাহায্যে দৌড়ে এগোতে গেল সে। কিন্তু এক মুহূর্ত পর সেও গড়িয়ে নীচে নামতে লাগল। নীচে একটি টিলার গোড়ায় পৌঁছে থেমে গেল ছেলেটি। গড়িয়ে নামার সময় বুঝতে পেরেছিল, তার পেছন পেছন মেয়েটিও গড়িয়ে নামছে। এক মুহূর্ত দেরি না করে সেখান থেকে লাফিয়ে সরে গেল। কয়েক মুহূর্ত পর মেয়েটিও একই জায়গায় এসে টিলার গোড়ায় মৃদু ধাক্কা খেয়ে থেমে গেল। নিথর হয়ে পড়ে রইল মেয়েটি। ছেলেটির দিকে তাকিয়ে আছে অদ্ভুত দৃষ্টিতে। উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল ছেলেটি।
‘আপনি ঠিক আছেন তো, নাকি আঘাত পেয়েছেন?’ কথা কানে যেতেই ধীরে ধীরে উঠে বসল মেয়েটি। মুখের ওপরে এসে পড়া চুলগুলো সরিয়ে তাকাল। একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটি। দৃষ্টি যে নীচের দিকে তা এ আঁধার রাতেও বোঝা যায়। তাছাড়া আশপাশটা ফাঁকা বলে তারকারাজি কিছুটা হলেও আঁধার দূরীভূত করেছে।
‘আপনি কি আঘাত পেয়েছেন?’ জবাব না পেয়ে এবার তার দিকে তাকিয়ে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল।
‘না’, কোনোমতে উচ্চারণ করতে পারল মেয়েটি। এখনো কাঁপছে।
‘আলহামদুলিল্লাহ’, কী যেন ভাবল ছেলেটি।
‘ঢালে রাইফেলটা পড়ে আছে, নিয়ে আসি। আপনি ততক্ষণে বিশ্রাম নিন’, বলেই আর দাঁড়াল না সে।
সব বুঝে ফেলেছে মেয়েটি এরই মধ্যে। এত সুন্দর মন-মানসিকতার, এত সুন্দর চরিত্রের, এত আদর্শবান কি আসলেই কেউ হতে পারে! নিজের প্রশ্নের উত্তর দিল মনে মনে, ‘হ্যাঁ পারে, তার প্রমাণ এ ছেলেটি। এ ছেলেটি তাকে বিমানবন্দরের লাউঞ্জের দরজায় ধাক্কা দেয়নি, দিতে পারে না। হয়তো ওটা কোনো দুর্ঘটনা ছিল। ছেলেটির সম্পর্কে তার ভুল ধারণা আজ সত্যি ভেঙে গেল।
রাইফেল নিয়ে ফিরে এলো ছেলেটি। তারপর আবার পা ফেলা শুরু হলো। সুবহে সাদিকের কিছু আগে সমুদ্রের গর্জন শুনে বিনাবাক্যে খুশি হয়ে উঠল দুজনেই। এক সময় সৈকতে এসে পৌঁছল। ঢেউ আসছে, ফিরে যাচ্ছে, আবার আসছে। বিরামহীনভাবে চলছে এ খেলা। কোনো কোনো ঢেউ সৈকতের অনেক ওপরে উঠে যাচ্ছে, আবার নেমে যাচ্ছে দ্রুত। হাঁটু পানি দিয়ে এগিয়ে চলল পূর্ব দিকে। দুজনেরই হাঁটু পর্যন্ত কাপড় ভিজে গেছে। পানি যেন বরফ শীতল। ঠান্ডায় দুজনেই ঠকঠক করে কেঁপে চলেছে। কোনো কোনো ঢেউ হাঁটুর ওপরেও খানিক ভিজিয়ে দিচ্ছে। ডানে সমুদ্র। বাঁয়ে কিছুদূর বালিয়াড়ি, তারপর পাহাড়, গাছপালার শুরু। বেশ কিছুদূর হেঁটে এসেছে। সামনে পথরোধ করে দাঁড়িয়ে আছে কিছু টিলা। সেগুলো যেন সমুদ্র থেকেই উঠে দাঁড়িয়ে। ওপাশে গেলে সাঁতরিয়ে যেতে হবে। টিলাগুলোর কাছে এসে থামল ছেলেটি। আর কিছুক্ষণ পরই সূর্য উঠবে।
ছেলেটি দাঁড়িয়ে গেল ফজরের নামাজে। একটু দূরে বসে পড়ল মেয়েটি। মুখে ক্লান্তির ছাপ।
‘এখন কোনদিকে যাওয়া যায়?’ খোলা সাগরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল ছেলেটি। সকালের সোনালি রোদের সোনালি রং যেন সাগরের মধ্যেও ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
‘বুঝতে পারছি না, কোনদিকে যাওয়া যায়’, একমুহূর্ত ভেবে বলল মেয়েটি।
‘সময় কম, আর কিছুক্ষণের মধ্যে কোথাও লুকিয়ে পড়তে না পারলে ধরা পড়ে যেতে পারি। একটা উপায় বের করতেই হবে’, বলল ছেলেটি। ঝরনার দিকে লুকানোটা বোকামি হবে ভাবল ছেলেটি। ওদিকেই প্রথম খুঁজবে একটু পর।
‘আবার জঙ্গলে ঢুকে পড়া ছাড়া তো কোনো উপায় দেখছি না’, মুখ খুলল মেয়েটি।
‘এছাড়া আপাতত আমিও কোনো উপায় দেখছি না’, বলল মেয়েটি।
‘তাহলে উঠে পড়ি।’
একটু পরই যেখান থেকে পাহাড় শুরু হয়েছে, সেখানে পৌঁছে গেল ওরা। উঠতে শুরু করল ওপরের দিকে। নামা যত সহজ ছিল, ওঠা ততই কঠিন হয়ে দাঁড়াল। সৈকত থেকে একটা ছোট্ট টিলায় উঠতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠল দুজনেই। এখনো তারা জায়গায় আছে। দূর থেকে যে কেউ দেখতে পাবে। একটু ওপর থেকে গাছপালা-জঙ্গল শুরু হয়েছে। সেখানে পৌঁছলে নিজেকে কোনোমতে লুকানো যাবে। ভালোভাবে লুকাতে হলে আরো অনেক ওপরে উঠতে হবে। তবে সে জন্য গায়ে শক্তি দরকার। এরই মধ্যে অনেকটা নিস্তেজ হয়ে পড়েছে তার। ক্ষুধায় কাতর দুজনেই। ছেলেটি গতদিন দুপুরে কয়েকটা রুটি খেয়েছে মাত্র। তারপর থেকে পানি ছাড়া আর কিছুই পেটে যায়নি। আর মেয়েটি গত রাতে খেলেও দুশ্চিন্তার কারণে পেট ভরে খায়নি। তারপর আর কিছুই খায়নি। বাঁচার তাগিদে দুর্বল শরীর নিয়েই পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ওপরে উঠছে। আগে আছে ছেলেটি। কয়েক হাত পেছনে আছে মেয়েটি। একসময় গাছপালার ভেতরে ঢুকে পড়ল। এদিকে গাছপালা কম। আরো ওপরে উঠতে হবে। মেয়েটির সঙ্গে অন্য কোনো বোঝা নেই। কিন্তু ছেলেটির রাইফেলটি বয়ে নিয়ে উঠতে দ্বিগুণ কষ্ট হচ্ছে। ভাবছে, রাইফেলটি সঙ্গে রেখে কী হবে? সে অকারণে মানুষের ক্ষতি করতে চায় না। দু-একজনকে ঠেকানোর জন্য রাইফেল ব্যবহার করতে গেলে যে বিকট শব্দ হবে তাতে বাকি সবাই তাকে ঘিরে ফেলবে। তাছাড়া হয়তো এটার প্রয়োজন নাও হতে পারে। কারণ যারা তার পেছনে লাগবে তারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। আর কয়েকজন তাদের ঘিরে ধরলে বন্দুক চালিয়ে কী হবে? তারাও খালি হাতে থাকবে না। এসব যুক্তি দিয়েও রাইফেলটি ফেলে যেতে ইচ্ছে হলো না। হাতে একটা অস্ত্র তো আছে!
আচ্ছা, মেয়েটিও কি তার মতো কিছু নিয়ে ভাবছে? কী নিয়ে ভাবছে? ধ্যুত! এসব কী সে ভাবছে? সে কী ভাবে ভাবুক। ক্ষুধায় পেট মোচড় দিচ্ছে মেয়েটির। অথচ খাবার পাওয়ার বিষয়টা অনিশ্চিত। ক্ষুধা নিবারণের কি কোনো ব্যবস্থা করা যায় না? এ ব্যাপারে সে কি ছেলেটিকে কিছু বলবে? না থাক, ছেলেটিরও হয়তো আমার মতো অবস্থা হয়েছে।
ছেলেটি যে থেমে দাঁড়িয়েছে তা আগে দেখতে পায়নি সে। যখন দেখতে পেল তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তবে শেষ পর্যন্ত নিজেকে সামলাতে পারল। তা না হলে ছেলেটির গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ত। তা হতো এক লজ্জাজনক ঘটনা। কী জন্য ছেলেটি দাঁড়িয়েছে এতক্ষণে দেখতে পেল সে। তিন হাত সামনে দিয়ে চওড়া এক খাদ ডানে-বাঁয়ে চলে গেছে। কতদূর গেছে দেখা যায় না। কোনো কথা না বলে একটু ডানে সরে গেল ছেলেটি। খাদটি দেখল। আশপাশের তুলনায় এ জায়গাটার চওড়া কম, লাফিয়ে পার হওয়া যবে। আগে আমি পার হচ্ছি, তারপর আপনি।
ওপাশে পৌঁছে দাঁড়াল ছেলেটি। লাফ দিতে দ্বিধা করছে মেয়েটি। ছেলেটি কোনোমতে পার হয়েছে। আর মেয়েটি কম গভীরতা নেই বরং বেশি আছে। আর খাদ কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে তা খুঁজে বের করার সময়ও নেই।
‘আমাকে তোলার ব্যবস্থা করুন’, কেঁপে গেল তার কণ্ঠ।
ছেলেটি হাত বাড়িয়ে তাকে তুলে আনতে পারে। এটাই সবচেয়ে সহজ। কিন্তু কিছুতেই বিবেক সায় দিচ্ছে না। জোর চেষ্টা চালাচ্ছে অন্য কোনো উপায় বের করার। খাদের কিনারে বসে খাদের অপর পাড়ের দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটির কথা কানে যেতেই যেন বাস্তবে ফিরে এলো ছেলেটি।
‘ওহ! কিছু বললেন?’
মেয়েটি ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। ছেলেটির কথা শুনে অবাক হয়ে তাকাল তার দিকে।
‘আমাকে ওপরে তোলার কথা বলেছিলাম।’
‘আমিও এতক্ষণ সে কথাই ভাবছিলাম’, বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল ছেলেটি।
‘এখানে ভাবার কী আছে?’ ছেলেটির কথা বুঝতে পারল না সে।
সূর্য অনেক ওপরে উঠেছে। উঠে দাঁড়াতে যেতেই গা থেকে চাদরের একাংশ পড়ে গেল। হঠাৎই যেন উপায়টা বের হয়ে এলো। ফলে মেয়েটির কথা তার কানে ঢুকেও ঢুকল না। চাদরের একাংশ নামিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘এটা ধরে ওপরে উঠতে পারবেন না?’ ‘পারব।’
‘তাহলে উঠে আসুন’, বলে চাদরের অপর মাথা শক্ত করে ধরে খাদের কিনার থেকে একটু দূরে সরে দাঁড়াল, যেন মেয়েটিকে তুলতে গিয়ে সেও না পড়ে। ওপরে উঠে এলো মেয়েটি। দুটি চাদরই দুজনের ঘাড়ে শোভা পাচ্ছে। নীরবে এগিয়ে চলছে দুজনে। এর মধ্যে মাত্র দুবার বিশ্রাম নিয়েছে। ওপরে উঠছে বলে দ্রুত হাঁপিয়ে উঠছে। তৃতীয়বারের মতো বিশ্রাম নিতে থেমেছে। একটা গাছের গায়ে হেলান দিয়েছে ছেলেটি। বুকের ওপর মাথা নামিয়ে এনেছে। খানিক দূরে একটি বড় পাথরের গায়ে হেলান দিয়ে বসেছে মেয়েটি।
মাথা তুলল ছেলেটি। ‘আপনার কি খুব ক্ষিদে লেগেছে?’
ক্ষিদেয় নাড়িভুঁড়ি সব হজম হওয়ার উপক্রম। তারপরও মাথা দুলিয়ে ‘না’ সূচক জবাব দিল মেয়েটি।
‘আমার কিন্তু খুব ক্ষিদে লেগেছে, আপনারও হয়তো লেগেছে, কিন্তু তবুও অস্বীকার করলেন।’
‘লেগেছে, তবে এখন পর্যন্ত তো কোনো খাদের সন্ধান পাওয়া গেল না।’
‘পেটে কিছু না পড়লে তো আর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই সব শক্তি ফুরিয়ে যাবে’, আশপাশে তাকাতে তাকাতে বলল ছেলেটি।
‘আচ্ছা, আর ওপরে না যেয়ে এখানে থেকে গেলে হয় না?’ বলল মেয়েটি।
‘এখানে আশপাশে ঘন জঙ্গল নেই। ঘন জঙ্গলে গা ঢাকা দিয়ে থাকতে হবে, আরো কিছু ওপরে ঘন জঙ্গল আছে।
‘কেন? নীচেও তো ঘন জঙ্গল থাকতে পারে।’
‘তাহলে অনেক খুঁজতে হবে। আর আমার মনে হয় নীচের দিকেই ওরা বেশি খুঁজবে। আমরা যে ওদের কাছেই যাব এমনটা হয়তো ওরা চিন্তাও করবে না।’
‘তাহলে ওঠা যাক।’ বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল মেয়েটি। দুজনেই মুখ বুজে ক্ষিদে সহ্য করছে। উভয়েই খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে। ছেলেটির ইচ্ছে হচ্ছে এখানেই থেকে পড়ে। কিন্তু বুঝতে পারছে এখানে থামলে আত্মঘাতীর শামিল। সে নিজেই যখন অনেকদূর পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে, তখন এখানে থামা বোকামি হবে। সে যতটুকু জানে আরো ওপরে লুকানোর মতো গাছপালা-পাহাড়ের আড়াল পাবে। যে কোনো কিছুর বিনিময়ে হোক তাদের সেখানে পৌঁছতেই হবে। তাহলে পুনরায় ধরা পড়ার আশঙ্কা কম থাকবে।
কোনদিক দিয়ে গেলে তুলনামূলকভাবে সহজে ওপরে ওঠা যাবে তা দেখার জন্য আশপাশে দেখতে দেখতে পা ফেলছে ছেলেটি। পেছনে আছে মেয়েটি। একটু দূর দিয়ে একটি বড় গাছ অতিক্রম করছে। মাটির ওপরে থাকা গাছটির মোটা শিকড়ে পা বেঁধে গেল ছেলেটির। আছড়ে পড়ল মাটিতে।
দৌড়ে পাশে এসে বসল মেয়েটি। উৎকণ্ঠিত হয়ে তাকিয়ে আছে ছেলেটির দিকে। কী করবে বুঝতে পারছে না। এখনো মুখ থুবড়ে পড়ে আছে।
‘আপনার কি খুব লেগেছে?’
মুখের জবাব পাওয়া না গেলেও ততক্ষণে নড়ে উঠেছে। উঠে বসল। নীরবে উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটতে লাগল।
ছেলেটি কিছুই বলল না। মুখ দেখেও কিছু বোঝা গেল না। ছেলেটি খুব ব্যথা পেয়ে থাকলে যাত্রায় এখানেই ইতি। পাশে এসে আবার জিজ্ঞেস করল মেয়েটিÑ ‘আপনি খুব ব্যথা পেয়েছেন?’ চেষ্টা করেও মুখে উৎকণ্ঠার স্বরটা লুকাতে পারল না। অনেক কষ্টে মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলল ছেলেটি। সামনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘খুব একটা পাইনি।’ মেয়েটিকে আশ্বস্ত করার চেষ্টাটা বলা চলে এখানেই হলো। খানিকটা আশ্বস্ত হয়ে ছেলেটির কাছ থেকে দূরে সরে গেল।
একটু এগিয়েই ছেলেটি বুঝতে পারল বাম পায়ে সে ভালোই আঘাত পেয়েছে। ব্যথায় মাটিতে পা ফেলাই দায় হয়ে পড়েছে। পা-টা ধীরে ধীরে ফুলে যাচ্ছে। নাহ, আর পারছে না সে। বসে পড়ল মাটিতে। দুই পা ছড়িয়ে বসল সামনে। তাকে হঠাৎ বসতে দেখে মেয়েটিও একটু দূরে হাঁটু গেড়ে বসল। ছেলেটির দিকে একবার তাকিয়েই বুঝতে পারল, সে খুব কষ্টে ব্যথা সহ্য করছে। দুহাত দিয়ে তার বাম পায়ের গোড়ালি চেপে ধরেছে।
‘আপনি তো খুবই আঘাত পেয়েছেন, ভেঙে যায়নি তো?’
আবারও মেয়েটিকে আশ্বস্ত করার জন্য অনেক কষ্টে মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলল, তবে হাসিটা বড়ই বিষণ্ন দেখাল। মুখে বলল ‘মনে হয় ভাঙেনি।’
‘আমরা তবে আপাতত এখানেই থামব?’
‘না। কারণ হয়তো এতক্ষণে আমাদের বিশেষ করে আপনাকে ধরার জন্য ক্যাপ্টেন তার দলবল মাঠে নামিয়েছে। এ রকম ফাঁকা জায়গায় থামাতো দূরের কথা, হাঁটাও নিরাপদ নয়।’
‘আপনি কি এ অবস্থায় হাঁটতে পারবেন?’
মাথা দুলিয়ে ‘না’ সূচক জবাব দিল ছেলেটি।
‘তবে কীভাবে এগোবেন?’ এক মুহূর্ত থামল মেয়েটি।
‘যদি কিছু মনে না করেন তবে একটা কথা বলি।’ বলে থামল মেয়েটি।
‘বলুন’, মাথা নীচু করে রেখেছে ছেলেটি।
‘আপনি আমার কাঁধে ভর দিয়ে হাঁটতে পারেন।’
ধন্যবাদ দিয়ে তাকে ছোট করতে চাইল না ছেলেটি।
‘তার হয়তো দরকার হবে না, আমি এ রাইফেলে ভর দিয়ে হাঁটতে পারব। মেয়েটি কিছু বলতে যাবে, তার আগেই রাইফেলে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াতে শুরু করছে সে।
রাইফেলে ভর দিয়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠতে যে কী রকম কষ্ট হচ্ছে, তা মেয়েটি ভালোই বুঝতে পারছে। সে এর মধ্যে বুঝে ফেলেছে, ছেলেটি সাধারণ আর দশটা ছেলে থেকে একদম ভিন্ন। ছেলেটি তাকে খাদ থেকে হাত বাড়িয়ে সহজে তুলতে পারত। তাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু তা না করে সে তাকে স্পর্শ না করেই তোলার উপায় বের করার জন্য ভাবনায় ডুবে গিয়েছিল। ছেলেটি যে রকম ব্যথা পেয়েছে, তাতে রাইফেলে ভর দিয়ে হাঁটার চেয়ে তার সাহায্যে হাঁটলে অনেক কম কষ্ট পেত। কিন্তু ছেলেটি যে কিছুতেই তা করবে না তা সে ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে। বলে কোনো লাভ হবে না, তাই বলছেও না। তাছাড়া ছেলেটির সামনে সে খুবই অস্বস্তি বোধ করে। সে যে ছেলেটির ব্যথায় ব্যথিত। তারও যেন কষ্ট হচ্ছে। ছেলেটি যে বিপজ্জকভাবে ওপরে উঠছে তাতে তার ভয়ই হচ্ছে, কখন যে ছেলেটি গড়িয়ে পড়ে। ছেলেটি অচল হলে সে না পারবে পালাতে, না পারবে ছেলেটির তেমন উপকারে আসতে। আশ্চর্যের বিষয় যে ছেলেটি ডান পা আর রাইফেলের ওপর ভর দিয়ে বাম পা ঝুলিয়ে ওপরের দিকে উঠে চলেছে, উঠেই চলেছে। তবে গতি শামুকের মতো মন্থর।
সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে। অনেক ওপরে উঠে এসেছে তারা। এর মধ্যে ঘন গাছপালার এলাকায় ঢুকে পড়েছে। পাহাড়-টিলার সংখ্যাও অনেক। প্রায় সমতল এক জায়গায় বসে পড়ল ছেলেটি। অনেক আগেই হাঁটায় বিরতি দিত সে। পায়ে আঘাত লাগার পর থেকে নিজের ওপর একরকম অত্যাচার করে এতদূর এসেছে। সে একা হলে অনেক আগেই থামত। কিন্তু মেয়েটির জন্যই থামেনি। ধরা পড়লে তার নিজের চেয়ে যেন মেয়েটির শাস্তি বেশি হবে। মেয়েটির শাস্তি তার বাকি জীবন। পায়ে আঘাত পাওয়ার পর থেকে চারবার বিশ্রাম নিয়েছে তারা। ক্লান্তির শেষসীমায় পৌঁছে গেছে দুজনেই।
‘আর এগোনোর দরকার নেই, এখানেই থামব’, দুর্বল কণ্ঠে বলতে বলতে পাতায় ঢাকা মাটির ওপর বসে পড়ল ছেলেটি। ছেলেটির দিকে সামনে একটু দূরে গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসল মেয়েটি। চোখ বুজে ফেলল সে। বসেই ক্লান্তিতে ছেলেটিও চোখ বুজে ফেলেছিল। একটু পর চোখ খুলে কিছু দূরে মেয়েটিকে চোখ বন্ধ করে বসে থাকতে দেখল। চোখ ফেরাতে গেল কিন্তু পারল না। তাকিয়ে রইল মেয়েটির দিকে। ক্যাপ্টেন মেয়েটির জন্য কেন পাগল হয়েছে তা সে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারল। এত পরিশ্রমের পরও শান্ত, ক্লান্ত মুখটা যেন পূর্ণিমার চাঁদের মতো সমুজ্জ্বল। সত্যি! অনিন্দ্য সুন্দরী মেয়েটি। এর চেয়ে সুন্দর মেয়ে এর আগে চোখে পড়েছে কিনা স্মরণ করতে পারল না সে, হয়তো পড়েছে, হয়তো পড়েনি। কারণ সে সামনে বা আশপাশে মেয়ে আছে তা উপলব্ধি করতে পারলেই দৃষ্টি নীচু করে ফেলে। দুর্ঘটনাবশত অনেক মেয়ে তার চোখে পড়লেও এ মেয়েটির চেয়ে সুন্দরী যে তার চোখে পড়েনি তা সে নিশ্চিত। উ™£ান্ত চুলগুলো মেয়েটির মুখের ওপর এসে পড়েছে। তা যেন তার সৌন্দর্য কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এমন মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলে যে কেউ তার সমস্ত ব্যথা-বেদনা ভুলে যাবে।
দূরে নাম না জানা এক পাখির কর্কশ কণ্ঠ কানে ঢুকতেই কয়েক মুহূর্তের ঘোরভাবটা নিমিষে উবে গেল। সম্বিত ফিরে পেতেই বুঝতে পারল সে এতক্ষণ কোন দিকে তাকিয়ে ছিল আর কী ভাবছিল। নিজের ওপর প্রচণ্ড রেগে উঠল সে। মনে মনে নিজেকে কতবার যে লাথি মারল তার হিসাব নেই। নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগল। মেয়েটি না হয় চোখ বন্ধ করে আছে। কিন্তু মহান আল্লাহ তো চোখ বন্ধ করে নেই। তওবা করতে লাগল এ মহাজগৎ নিয়ন্তার মহাদরবারে। চোখের পানি মুছতে মুছতে তাকাল সূর্যের দিকে। জোহরের নামাজের সময় হয়ে গেছে। আশপাশে হয়তো পানিও নেই। এ অবস্থায় পানি সন্ধান করাও প্রায় অসম্ভব। তায়াম্মুম করে বসেই নামাজ আদায় করে নিল। তারপর শুয়ে পড়ল খোলা আকাশের নীচে। মেয়েটি অনেক আগেই ঘুমের জগতে বিচরণ করা শুরু করেছে।
কীভাবে ঘুমটা ভেঙে গেল বলতে পারবে না ছেলেটি। চোখ খুলেই বুঝল শেষ বিকেল উপনীত। আসরের নামাজ পড়ে বলে ঝট করে উঠে বসল। দাঁড়াতে যেতেই গোড়ালিটা ব্যথা করে উঠল। এতক্ষণ ব্যথাটার কথা ভুলে ছিল। বাধ্য হয়েই বসে পড়ল। তাকালো চারপাশে। কিন্তু কোথাও মেয়েটিকে দেখতে পেল না। কোথায় আছে মেয়েটি? হয়তো আশপাশে কোথায় আছে। জোহরের মতো আছরের নামাজও আদায় করে নিল। মোনাজাত শেষে ডানে কারো উপস্থিতি অনুভব করল। তাকিয়ে দেখল, মেয়েটি এসে দাঁড়িয়ে।
‘কীসের যেন আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল, উঠে দেখি আপনি শুয়ে ঘুমাচ্ছেন। অনেকক্ষণ ঘুমানোর ফলে শরীরটা ঝরঝরে লাগছিল। তাই আপনাকে বিরক্ত না করে আশপাশে খাদ্যের খোঁজে বেরিয়ে পড়েছিলাম’, যেন কৈফিয়ত দিচ্ছে মেয়েটি। ‘আপনি উঠে আমাকে খোঁজাখুঁজি করেননি তো?’
‘না, আমি ধরেই নিয়েছিলাম আপনি হয়তো আশপাশেই আছেন’, পায়ের দিকে তাকিয়ে কথা বলছে ছেলেটি।
‘খাবার না পেলেও লুকিয়ে থাকার মতো একটা গুহার সন্ধান পেয়েছি’, নিষ্প্রাণ কণ্ঠে বলল মেয়েটি। যেন গুহা খুঁজে পাওয়ায় সে তেমন খুশি নয়।
‘গুহা খুঁজে পেয়েছেন!’ বলতে বলতে আনন্দে দাঁড়াতে যেতেই ব্যথায় বসে পড়ে দুহাতে গোড়ালি চেপে ধরল।
‘এ রকম খোলা জায়গায় থাকার চেয়ে গুহায় থাকা নিরাপদ।’ হাসার চেষ্টা করল, কিন্তু ব্যথায় মুখটা বিকৃত হয়ে গেল।
‘আচ্ছ, গুহাটা কি বড়?’ অত ব্যথা সহ্য করে সে কীভাবে কথা বলছে তা বুঝতে পারছে না মেয়েটি।
‘হ্যাঁ, বেশ বড়।’ বিষণ্ন কণ্ঠে জবাব দিল সে। হাত দিয়ে দক্ষিণ দিক নির্দেশ করল মেয়েটি। মাথা নীচু করে থাকায় দেখতে পেল না ছেলেটি। সেটা বুঝতে পেরে মুখে বলল ‘দক্ষিণে।’
‘কত দূরে?’
‘বেশি না, সামান্য।’
‘তাহলে আর দেরি নয়, সূর্য ডোবার আগেই সেখানে পৌঁছা যাবে তো?’
‘হয়তো যাবে।’
রাইফেলের বাঁটে ভর দিয়ে কোনোরকমে উঠে দাঁড়াল ছেলেটি। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে লাগল। একটু দূর দিয়ে পাশে পাশে চলেছে মেয়েটি। যখন গুহায় পৌঁছল, তখন মাগরিবের নামাজের সময় হয়ে গেছে। রাতের আঁধার নেমেছে অনেক আগেই। তার ওপর অন্ধকার আরো প্রকট হয়েছে। গুহাটা পছন্দ হয়েছে ছেলেটির। গুহার মুখটি ছোট। গুহামুখের কাছে জঙ্গল আছে। কাছে না এলে গুহাটা কারো চোখে পড়বে না, যদি না তার আগে জানা থাকে। আর গুহার ভেতরটা বেশ বড়। মেঝে প্রায় সমতল। তবে ছাদ অত্যন্ত নীচু। পুরোপুরি দাঁড়ানো যায় না।
‘আমি গুহার বাইরে শোবো, আপনি ভেতরে শোবেন’, গুহাটা দেখে বলল ছেলেটি।
‘কেন?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল মেয়েটি।
‘আপনার ঠান্ডা লাগলে গোড়ালির ব্যথা বেশি হবে।’
‘হবে না, আমি বাইরেই ভালো থাকব’, বলল ছেলেটি।
‘তাহলে আমি বাইরে থাকি, আপনি ভেতরে থাকুন।’
‘তা হয় না’, বলল ছেলেটি।
‘তাহলে আপনিও ভেতরে থাকবেন’, বলে থামল মেয়েটি।
আর কথা বাড়াল না ছেলেটি।
চাদরটা বিছিয়ে শুয়ে আছে গুহামুখের কাছে। মেয়েটি তার কাছ থেকে বেশ দূরে আছে। ক্ষুধায়, ক্লান্তিতে জর্জরিত মেয়েটি এর মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে। ছেলেটি প্রচণ্ড ক্লান্তি অনুভব করছে, তবে ক্ষিদে অনুভব করছে না। তার ক্ষুধা অনুভূতি শক্তি লোপ পেয়েছে বিকেল থেকে, যা মোটেই ভালো লক্ষণ নয়। সে যেন অদ্ভুত এক ঘোরের মধ্যে আছে। চোখ দুটো এর মধ্যে বন্ধ হয়ে এসেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমের সাগরে ডুব দিল সে।
নানা জাতের, নানা ধরনের পাখির কলরবে ঘুম ভেঙে গেল ছেলেটির। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল। চোখ কচলিয়ে ঘুম দূর করার চেষ্টা করছে। বাম পায়ের ব্যথাটা এরই মধ্যে অনেকাংশে কমে এসেছে। তারপরও বাধ্য হয়ে হামাগুড়ি দিয়ে গুহার বাইরে বেরিয়ে এলো। ভোরের তরতাজা নির্মল হিমশীতল বাতাসে তায়াম্মুম করে ফজরের নামাজ পড়ে নিয়ে গুহায় এসে ঢুকল। বাইরে যে ঠান্ডা তাতে গায়ের চাদরে ঠান্ডার অর্ধেকও কাটে না। গুহায় ঢুকে দেখল মেয়েটি তখনো ঘুমিয়ে আছে। আবার শুয়ে পড়ল ছেলেটি তার জায়গায়।
ঘুম ভেঙে যাওয়ার পরও অনেকক্ষণ শুয়ে থাকল মেয়েটি। সে একই সঙ্গে দুটো বিষয় উপলব্ধি করতে পারছে, তা হলোÑ প্রথমত তার শরীরটা ঝরঝরে লাগছে। হয়তো লম্বা ঘুমের কারণেই। দ্বিতীয়টি হচ্ছে তার ক্ষুধা পাচ্ছে না। উঠে বসে দেখল ছেলেটি ঘুমিয়ে আছে। এবারো ছেলেটিকে বিরক্ত না করে পা টিপে টিপে ছেলেটির পাশ দিয়ে গুহার বাইরে বেরিয়ে এলো সে। দেখল, বেশ বেলা হয়েছে। আশপাশটা দেখার জন্য মেয়েটি পা বাড়াল।
কারো হাঁপানোর শব্দে ঘুম ভেঙে গেল ছেলেটির। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে দেখল, একটু দূরে বসে মেয়েটি হাঁপাচ্ছে। প্রথমে বুঝতে পারল না কী কারণে সে হাঁপাচ্ছে।
‘আপনি হাঁপাচ্ছেন কেন, কী হয়েছে?’
দৌড়ে এসে গুহায় ঢুকেছে মেয়েটি। খুব বেশি দূর দৌড়ায়নি। গুহার কাছে এসে দৌড়ানো শুরু করেছে। তার আগে পা টিপে টিপে পালিয়ে এসেছে। যতটা না পরিশ্রম তার চেয়েও বেশি উত্তেজনায় হাঁপাচ্ছে সে। ছেলেটির গলার আওয়াজ কানে যেতেই মুখ তুলে তাকাল মেয়েটি।
‘ওরা আমাদের পাশেই আছে, খুঁজছে’, হাঁপাতে হাঁপাতে কোনোমতে বলল সে। চোখে-মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট।
‘একটু খুলে বললে ভালো হয়’, শান্ত স্বরে বলল ছেলেটি।
এক মুহূর্ত দম নিয়ে শুরু করল মেয়েটি।
‘ঘুম থেকে উঠে দেখলাম, আপনি ঘুমাচ্ছেন। আরো লক্ষ্য করলাম ক্ষিধে উড়ে গেছে। বুঝলাম দীর্ঘক্ষণ কিছু পেটে না দেয়ার ফল। লক্ষণ ভালো নয়, কিছু খেতে না পারলে এর ফলে ধীরে ধীরে মারাত্মক আকার ধারণ করবে। তাই খাবরের খোঁজে বের হয়েছিলাম। একসময় গুহার বাঁয়ে কিছু নীচে হঠাৎ কারো গলার আওয়াজ পেয়ে লুকিয়ে যাই। তাদের দেখেছিÑ দুজন লোক কাঁধে রাইফেল ফেলে একটা পায়ে চলা পথ ধরে দক্ষিণ দিকে যাচ্ছে, আর কী বিষয়ে যেন কথা বলছে। তার একটু কাছে আসতেই বুঝতে পারলাম, আমাদের নিয়েই কথা বলছে। শোনার জন্য লুকিয়ে লুকিয়ে তাদের কাছাকাছি চলতে লাগলাম। তাদের কথায় যা বুঝলাম, গতকাল আমাদের সমুদ্রের দিকে ও নীচের দিকে খোঁজা হয়েছে। আর আজকে এ দ্বীপের সব সম্ভাব্য জায়গায় হানা দেয়া হবে। আজকে সন্ধ্যা পর্যন্ত না পেলে সারা দ্বীপে আমাদের ধরিয়ে দেয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষণা দেয়া হবে। বোঝাই যাচ্ছে, আমাদের জন্য লর্ড কত সিরিয়াস হয়েছে’, বলে থামল মেয়েটি। এর মধ্যে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে সে।
‘আমার মনে হয়, লর্ড নয়। ক্যাপ্টেন সিরিয়াস হয়েছে বেশি, আপনার জন্য’, বলল ছেলেটি। এতক্ষণ মেয়েটির গোছানো কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনেছে সে। ‘মনে হয় আমাদের এ গুহাটিও সম্ভাব্য জায়গার অন্তর্ভুক্ত। এটার কথা ক্যাপ্টেনের বাহিনীর অজানা থাকার সম্ভাবনা খুব কম। অর্থাৎ যে কোনো সময় তারা এখানে হামলা চালাতে পারে’, বলে থামল ছেলেটি।
‘হ্যাঁ, তার মানে আমাদের এখনই এখান থেকে সরে পড়তে হবে।’ এক মুহূর্ত থেমে কী ভেবে, ‘হিসাবমতো আমাদের কাল সূর্য ওঠার আগেই এ দ্বীপ থেকে পালানো উচিত। কারণ সন্ধ্যার মধ্যে আমাদের না পেলে হয়তো আজ রাতেই বা কাল সকালে পুরস্কারের কথা ঘোষণা করা হবে। ফলে পুরস্কারের আশায় সারা দ্বীপের মানুষ আমাদের খোঁজে লেগে যাবে। তখন আমাদের পালানো প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। কারণ, একদল নৌকা নিয়ে সমুদ্রে যাবে, আর একদল সারা দ্বীপ চষে ফেলবে। আমরা ধরা পড়তে বাধ্য। এখনই আমাদের বেরিয়ে পড়া উচিত। আপনি কী বলেন?’ বলে থামল মেয়েটি।
এতক্ষণ প্রায় বুকের ওপর মাথা ঝুলিয়ে রেখেছিল ছেলেটি। মাথাটা একটু তুলে মাটির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমারও তাই মনে হয়।’
‘তাহলে এখনই বেরিয়ে পড়ি। আপনি কি হাঁটতে পারবেন?’ বলল মেয়েটি।
‘ইনশাআল্লাহ পারব’, বলেই ছেলেটি উঠে দাঁড়াল। পায়ের ব্যথাটা অনেক কমে গেছে। রাইফেলটা কাঁধে তুলে নিল। আর চাদরটা কোমরে জড়িয়ে নিল।
একটু পরেই গুহার বাইরে বেরিয়ে এলো তারা। পায়ে হাঁটতে খুব একটা অসুবিধা হচ্ছে না। পেটে খিদের অনুভূতি নেই, আর কী চাই! অত্যন্ত সতর্ক হয়ে নীচে নামছে তারা। যে কোনো সময় ক্যাপ্টেন বাহিনীর সামনে পড়ে যেতে পারে। ছেলেটি চাইছে যদি ওরা গুহায় খোঁজ করতে আসে তবে সঙ্গে যেন কুকুর নিয়ে না আসে, তাহলে তাদের পিছু নিতে পারবে না।
ছেলেটির পেছনে মেয়েটি নামছে। কখনোবা পাহাড়ের ঢাল বেয়ে, কখনো পাশ দিয়ে। গাছপালা, জঙ্গলের ভেতর দিয়ে তারা যাত্রা অব্যাহত রেখেছে। মেয়েটি ভাবছে, ছেলেটি যেন অচল হয়ে না পড়ে, পুনরায় আহত হয়ে না পড়ে। আর ক্যাপ্টেন বাহিনীর সম্মুখে না পড়েই যেন এই দ্বীপ ছেড়ে পালাতে পারে। তবে কীভাবে পালাবে এখনো তা ঠিক হয়নি। এমনকি উপায় পর্যন্ত বের হয়নি। যেন অজানা-অচেনার উদ্দেশে তারা পাড়ি জমিয়েছে। তাদের পরিণতি কী? ধরা পড়বে, নাকি শেষ পর্যন্ত এই ভয়ঙ্কর দ্বীপ থেকে পালাতে পারবে? এসব প্রশ্নের কোনো উত্তরই নিজেকে দিতে পারছে না মেয়েটি।
এতক্ষণ কষ্ট করে হেঁটেছে, আর পারছে না ছেলেটি। পায়ের ব্যথাটা ধীরে ধীরে বাড়ছে। তারপরও হেঁটে চলেছে। একসময় অসহ্য হয়ে উঠল ব্যথা। পা আর মাটিতে ফেলতে পারছে না। তাছাড়া এরই মধ্যে হাঁপিয়ে উঠেছে সে, শ্বাস নিচ্ছে বড় করে। বিশ্রাম নেয়ার জন্য দুই পাহাড়ের মধ্যে একটা গাছপালা আবৃত সমতল জায়গায় থামল দুজনে। খানিক বিশ্রাম নিয়ে রাইফেলে ভর দিয়ে ছেলেটি উঠে দাঁড়াল। কিছু বলল না মেয়েটি। ছেলেটির অবস্থা সে বুঝতে পারছে।
নীচে নামছে তো নামছেই। এ নামার যেন শেষ নেই। সময় বয়ে যাচ্ছে দ্রুত। রাইফেলে ভর দিয়ে নীচে নামা বিপজ্জনক। যে কোনো সময় ভারসাম্য হারিয়ে নীচে গড়িয়ে পড়তে পারে। এমনিতেই একটা পা প্রায় অচল। তাই সাবধানতার সঙ্গে ধীরে ধীরে নীচে নামছে। অবশ্য এখনো কোনো বিপদের সম্মুখীন হয়নি, তবে হতে কতক্ষণ।
এখন কিছুদূর যেতে না যেতেই দ্রুত হাঁপিয়ে উঠছে দুজনে। তাই বিশ্রাম নিতে হচ্ছে বারবার। এতে সময় বেশি যাচ্ছে। দ্বিপ্রহর হতে আর অল্প বাকি। বিশ্রাম নিচ্ছে দুজনেই। হঠাৎ দূরে রক্ত হিম করা কুকুরের ডাক ভেসে এলো। যেন আতঙ্কে পাথর হয়ে গেল দুজনেই। খোলা জায়গায় বেশ তফাতে বসে ছিল দুজনেই। প্রথমে ছেলেটি নড়ে উঠল। তার পরপরই মেয়েটি। একলাফে ঘন গাছপালার মাঝে ঢুকে পড়ল। আবার ডেকে উঠল কুকুর। গাছপালার ভেতর দিয়ে দেখল বেশ দূর দিয়ে তিনজন অস্ত্রধারী লোক একটা কুকুর সঙ্গে নিয়ে চারপাশে তাকাতে তাকাতে চলছে। একটা গাছের আড়ালে দুহাত তুলে হাঁটু গেড়ে বসল ছেলেটি, ‘হে মহান রক্ষাকারী, ত্রাণকর্তা, তুমি আমাদের এ বিপদ থেকে রক্ষা কর…।’
মেয়েটি অন্য একটি গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়েছে।
ধীরে ধীরে চার সদস্যের সন্ধানী দলটি চোখের আড়াল হয়ে গেল। আবার পা-বাড়ানো শুরু হলো। এক সময় দ্বিপ্রহর গড়িয়ে সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়ল। জোহরের নামাজ আদায় করে আবার মন্থর গতিতে যাত্রা শুরু হলো। ক্লান্ত দুর্বল শরীর নিয়ে পা ফেলা ধীরে ধীরে কঠিন হয়ে উঠছে। যতই এগোচ্ছে ধীরে ধীরে গতি ততই কমছে।
একসময় দূরে সমুদ্রের গর্জন শোনা গেল। অস্পষ্ট আওয়াজ। তার মানে সমুদ্র আর বেশি দূরে নয়। কিন্তু এর মধ্যে ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে পড়তে চাচ্ছে। দুজনেই পা ফেলার শক্তি প্রায় হারিয়ে ফেলেছে। শুয়ে চোখ বুজে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে। নিজের ওপর একরকম অত্যাচার করে মাতালের মতো ঢুলতে ঢুলতে পা ফেলছে দুজনেই। সমুদ্রের অস্পষ্ট গর্জন শুনে মনে আশার জোয়ার এলো। কিন্তু দেহে শক্তির জোয়ার এলো না। এগোতে তিনগুণ সময় লাগছে।
বিকেল হয়ে এসেছে। এখন সমুদ্রের গর্জন অনেকটা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। অর্থাৎ সমুদ্র কাছেই। আসরের নামাজ আদায় করে উঠে দাঁড়াতে যাবে ছেলেটি, কিন্তু পারল না।
মেয়েটি উঠে দাঁড়িয়েছে। ‘আপনি দাঁড়াতে পারবেন না?’
‘না।’ কোনোমতে দুর্বল কণ্ঠে জবাব দিল ছেলেটি।
‘তাহলে এগোবেন কীভাবে?’
‘হামাগুড়ি দিয়ে।’
কিছু বলতে গিয়েও বলল না মেয়েটি। কারণ জানে বলে কোনো লাভ হবে না। এর মধ্যে ছেলেটি কাঁধে রাইফেল ঝুলিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে শুরু করেছে। কিছুদূর নীচে নামার পর মেয়েটিও ছেলেটির পেছনে হামাগুড়ি দিয়ে নামা শুরু করল। সেও আর হাঁটতে পারছে না।
মেয়েটি পেছনে আছে কিনা, কতটা পেছনে পড়েছে দেখার জন্য ঘুরে তাকাল। একনজর দেখেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল, সেও হামাগুড়ি দিয়ে নামছে। কিছুই বলল না। কিছু বলতেও ইচ্ছে হচ্ছে না। অবশেষে যেন দীর্ঘ একযুগ পর নীচে পৌঁছল। সামনে সৈকত। শেষ বিকেল। সূর্য অস্ত যেতে এখনো কিছু সময় বাকি। রক্তিম সূর্যের আলোয় সৈকতের বালিগুলো চিকচিক করছে। অপূর্ব দৃশ্য। কিন্তু সে দৃশ্য দেখার মতো মনমানসিকতা এখন কারোরই নেই। দুজনেই আশপাশে তাকাচ্ছে। না, কোথাও নারকেল গাছ দেখতে পেল না। এখন পেটে কিছু দিতে না পারলে হয়তো অজ্ঞান হয়ে যাবে। কমপক্ষে নড়াচড়ার ক্ষমতাটা হারিয়ে ফেলবে। এ অবস্থায় এ দ্বীপ থেকে পালানো তো দূরের কথা, আশপাশে কারো উপস্থিতি টের পেলে লুকাতে পর্যন্ত পারবে না। দুজনেই খোলা জায়গায় আছে। এখন ফিরে পাহাড়ের কোথাও আশ্রয় নেয়া উচিত। কিন্তু ফেরার মতো শক্তি নেই।
মেয়েটি বালির ওপরেই শুয়ে পড়েছে। ততক্ষণে সূর্য ডুবে গেছে। শরীরের সর্বশেষ শক্তি একত্রিত করে বসেই মাগরিবের নামাজ পড়ে নিল ছেলেটি। মেয়েটির থেকে বেশ দূরে যাবে, এমন সময় পেছনে কারো উপস্থিতি অনুভব হতেই ঝট করে ঘুরে তাকাল। দেখল, একজন মধ্যবয়স্ক লোক খালি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। পাশে রাখা রাইফেলের দিকে হাত বাড়াতে যাবে, তার আগেই লোকটি ইংরেজিতে বলে উঠল, ‘কে আপনারা?’
কী উত্তর দেবে প্রথমে ভেবে পেল না ছেলেটি। এক মুহূর্ত ভেবে বলল, ‘আমরা ক্ষুধার্ত, বিপদগ্রস্ত।’ কী মনে হতে রাইফেল থেকে হাত সরিয়ে নিল।
‘তার মানে?’ জিজ্ঞেস করল আগন্তুক। ‘খুলে বলুন।’
ততক্ষণে মেয়েটি উঠে বসেছে।
‘আমরা বিদেশি। ক্যাপ্টেন আমাদের বন্দী করেছিল। তার কবল থেকে মুক্ত হয়ে এখন আমরা পালানোর পথে। আমরা অত্যন্ত ক্ষুধার্ত, প্লিজ আমাদের কিছু খাবার দিন, সে সঙ্গে এ দ্বীপ থেকে পালানোর ব্যবস্থা করে দেবেন।’ কোনো কিছু লুকানোর চেষ্টা না করে অবলীলায় সত্য কথা বলে গেল ছেলেটি। সত্যই শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয়, আর মিথ্যা হয় ধ্বংস।
‘আপনি জানেন, ক্যাপ্টেন অত্যাচারী।’ দুর্বল কণ্ঠে যতদূর সম্ভব দৃঢ়তা ফুটিয়ে তুলে জবাব দিল ছেলেটি।
‘জানি।’ একবার দ্বিধা করে বলল আগন্তুক।
‘তাহলে কেন তার হাতে আমাদের তুলে দেবেন?’ এতক্ষণ পর এবার মেয়েটি মুখ খুলল।
‘আপনারও নিশ্চয়ই ছেলে-মেয়ে আছে।’ মেয়েটির কথার পিঠে বলল ছেলেটি।
‘আছে। আমরা গরিব মানুষ, দিন আনি দিন খাই, তোমাদের ধরিয়ে দিলে নিশ্চয়ই ক্যাপ্টেন কিছু পুরস্কার দেবে, এদিক থেকে ক্যাপ্টেন খুবই…।’
তাকে শেষ করতে দিল না মেয়েটি। ‘আমাদের খাবার ও পালানোর ব্যবস্থা করে দিলে আমরাও আপনাকে পুরস্কৃত করব।’
‘কী পুরস্কার?’ চট করে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল আগন্তুক। ছেলেটিও অবাক হয়েছে।
‘আমার গলায় দামি একটা স্বর্ণের চেন আছে, সেটা আপনাকে দিয়ে দেব। কি রাজি?’ বলল মেয়েটি।
‘দেখি।’
চেনটা খুলে হাতে নিয়ে দেখাল মেয়েটি। এক মুহূর্ত ভেবে মুখ খুলল আগন্তুক।
‘আমি রাজি।’ হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল তার মুখখানা।
‘আমি রাজি’, আবার বলল সে। ‘আমার বাড়িতে চলুন, খেয়ে বিশ্রাম নিয়ে সেখান থেকে আপনাদের পালানোর ব্যবস্থা করে দেব…।’
‘আমরা খুবই দুর্বল। হাঁটার শক্তি পর্যন্ত নেই। বিশেষ করে আমি প্রায় অচল। পায়ে আঘাত পেয়েছি’, লোকটির কথায় বাধা দিয়ে বলল ছেলেটি।
ছেলেটি থামতেই শুরু করল আগন্তুক, ‘আমার বাড়ি খুব বেশি দূরে নয়, এই পাহাড়ের মোড় ঘুরে ওই পাশে একটু দূরে, প্রায় সমুদ্রের ধারেই’, হাত দিয়ে দেখিয়ে দিল।
‘তাছাড়া আপনাদের নৌকায় করে নিয়ে যাব। ওই তো আমাদের নৌকা।’ দক্ষিণে একটু দূরে নোঙ্গর করা ডিঙি নৌকাটার দিকে ইশারা করল। তার ভাবে বোঝা গেল যে, সে ওই নৌকার মালিক হওয়ায় গর্বিত।
‘একটু কষ্ট করে নৌকায় উঠতে পারলে হয়। না পারলে আমি সাহায্য করব।’
এক মুহূর্ত ভেবে ‘আপনি নৌকায় উঠতে পারবেন?’ ছেলেটিকে উদ্দেশ করে বলল মেয়েটি।
‘আপনি পারবেন?’ দুর্বল কণ্ঠে পাল্টা প্রশ্ন করল ছেলেটি।
ঘোষণা- ‘আমি ক্ষমাপ্রার্থী’ উপন্যাসটির ১০ টি পর্ব শেষ হলে পুরো উপন্যাস থেকে একটি প্রশ্নোত্তর প্রতিযোগিতা হবে। অংশগ্রহণকারী পাঠকদের সর্বোচ্চ সঠিক উত্তরদাতাকে পুরস্কৃত করা হবে।
-নির্বাহী সম্পাদক