মুগ্ধতা ব্লাড ব্যাংকে আপনার দেওয়া তথ্য বাঁচাতে পারে একটি জীবন। আপনার তথ্য দিন, প্রয়োজনে রক্ত খুঁজুন এখানে।

আমি ক্ষমাপ্রার্থী-৭

জাকির আহমদ

১৭ এপ্রিল, ২০২০ , ১২:০৭ অপরাহ্ণ

(পর্ব-৭)

‘হয়তো পারব। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়ায় ক্লান্তি, দুর্বলতা অনেকটা কেটে গেছে’, জবাব দিল মেয়েটি।

কোনো কিছু না বলে রাইফেলে ভর দিয়ে উঠতে গেল ছেলেটি। ছেলেটির দিকে এগিয়ে এলো আগন্তুক।

‘আপনি আমাদের ধরে উঠুন।’

‘যখন প্রয়োজন হবে, আমি নিজেই বলব’, ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে সে।

নৌকাটা কাছে আনার জন্য চলে গেল আগন্তুক। রাইফেলে ভর দিয়ে সমুদ্রের দিকে এগোচ্ছে ছেলেটি। তার একটু দূর দিয়ে হাঁটছে মেয়েটি।

নৌকা এগিয়ে চলেছে সমুদ্রে ঢেউয়ে দুলতে দুলতে। নৌকার পেছনে বসে দাঁড় বাইছে আগন্তুক। স্বল্প পরিসরে পাটাতনে দূরত্ব বজায় রেখে বসেছে দুজনে। নৌকার গায়ে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে ছেলেটি। মেয়েটি সোজা হয়ে বসে আছে। ‘আপনি আমাদের দেখতে পেলেন কীভাবে?’ হঠাৎ করেই আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল মেয়েটি। সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ছিল সে। ডানদিক থেকে মুখ ফেরাল আগন্তুক। ‘মৎস্য শিকার আমার পেশা। সারাদিন সমুদ্রে থাকতে হয়, সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরি। আজ ওদিক থেকে ফিরছিলাম’, বলে যেদিকে তারা যাচ্ছে তার উল্টো দিক দেখাল লোকটি। ‘সন্ধ্যার আবছা আলোয় হঠাৎ আপনাদের অস্পষ্ট দেখতে পেলাম। সাধারণত ওই জায়গার আশপাশে কেউ যায় না।’

‘কেন কেউ যায় না?’ লোকটির কথার মধ্যে প্রশ্ন করল মেয়েটি।

‘কোনো কারণ নেই, এমনিতেই কেউ ওদিকে সহজে যায় না। ওই জায়গাটা সব সময় নির্জন দেখি, তাই দূর থেকে মানুষ দেখে কৌতূহলী হয়ে উঠলাম। আমি আবার বরাবরই কৌতূহলী। সৈকতে নেমে পড়লাম, তারপরই তো প্রথম ওনার সঙ্গে দেখা’, বলে ছেলেটির দিকে ইঙ্গিত করল লোকটি।

পাশে একটা ঝুড়িতে মাছ চোখে পড়ল মেয়েটির। ঝুড়ির অর্ধেকটা কয়েক ধরনের সামুদ্রিক মাছে ভর্তি। ছেলেটির মতো সেও হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করল। একসময় পথ ফুরিয়ে গেল। নৌকা থেকে সবাই নামল। লোকটি নৌকাটিকে ডাঙায় তুলে রাখল, যাতে সমুদ্রের ঢেউয়ে পানিতে নৌকাটি ভেসে না যায়। আশপাশে আরো দুটো নৌকা আছে।

মাথায় মাছের ঝুড়িটি নিয়ে সামনে এগিয়ে চলল লোকটি। পেছনে দূরত্ব বজায় রেখে পাশাপাশি লোকটির পেছন পেছন চলছে দুজনে। ছেলেটি মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটছে।

‘আমাদের আবার ধরিয়ে দেবে না তো?’ বাংলায় জিজ্ঞেস করল মেয়েটি।

‘আল্লাহই ভালো জানেন, দেখা যাক কী হয়।’ দুর্বল কণ্ঠে জবাব দিল ছেলেটি। আর কিছু না বলে হাঁটায় মন দিল। নৌকায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়েছিল বলে এখন হাঁটতে পারছে। তা না হলে হয়তো পারত না। মাঝে মধ্যে পেছনে ঘুরে তাদের দেখছে লোকটি। আর কতদূরে যেতে হবে ভাবছে ছেলেটি। রাইফেলে ভর দিয়ে আর এগোতে পারছে না। মুখ তুলে তাকিয়ে দেখল সামনে একটা বাড়ির ভেতর থেকে আলো আসছে। বাড়িটার খুব কাছাকাছি আর কোনো বাড়ি চোখে পড়ল না। যেগুলো আছে সেগুলো একটু তফাতে।

কী মনে হতেই যতদূর সম্ভব দ্রুত এগিয়ে লোকটির পাশে গিয়ে বলল মেয়েটি, ‘আমাদের কথা আপনার বাড়ির বাইরে যাতে না যায়, সে জন্য ব্যবস্থা করবেন।’

‘তা আমাকে বলতে হবে না’, হেসে বলল লোকটি।

প্রথমে দুজনকে একটা ঘরে এনে বসাল। এরপর তাদের হাত-মুখ ধোয়ার ব্যবস্থা করে দিল।

হাত-মুখ ধুয়ে উভয়ে কেবল ঘরে গিয়ে বসেছে, এমনি সময় লোকটি একটা ছোট টিনের কৌটা হাতে ঘরে ঢুকল।

‘আপনি নাকি পায়ে আঘাত পেয়েছেন? খুব ব্যথা হচ্ছে, তাই না?’

মাথা ঝাঁকিয়ে তার কথায় সায় দিল ছেলেটি।

‘এই মালিশটা লাগান, আধা ঘণ্টার মধ্যে ব্যথা একদম কমে যাবে, পা ফেলে হাঁটতে পারবেন। যাওয়ার সময় এটি হাতে নিয়ে যাবেন। কিছুক্ষণের মধ্যে আমার ছোট ছেলে খাবার নিয়ে আসবে, খেয়ে নেবেন। আমি সারাদিন সমুদ্রে ছিলাম, তাই গোসল করব।’ ‘গুডলাক’ বলে লোকটি চলে গেল।

ততক্ষণে কৌটাটির ঢাকনা খুলে ফেলেছে ছেলেটি। মালিশ লাগাতে শুরু করল।

কিছুক্ষণের মধ্যে একটা ছোট ছেলে গমের আটার গরম গরম রুটি, সেই সঙ্গে গরম আলু ভাজি নিয়ে এলো।

খাবার দেখে দুজনে তাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। দীর্ঘক্ষণ ক্ষুধার্ত থাকায় কেউই বেশি খেতে পারল না। খাওয়া শেষে কিছুক্ষণ পর ঘরে ঢুকল লোকটি।

‘কি, ভালোভাবে খেয়েছেন তো?’

মাথা কাত করে জবাব দিল দুজনেই।

‘আমি আপনাদের পালানোর ব্যবস্থা করছি, আপনারা ততক্ষণে বিশ্রাম নিন’, বলে চলে গেল লোকটি। মেয়েটি চুপচাপ বিশ্রাম নিতে লাগল। আর ছেলেটি তার পায়ের পরিচর্যায় ব্যস্ত হয়ে গেল। তারপর এশার নামাজ পড়ে বিশ্রাম নিতে বসল। এদিকে সময় বয়ে চলল তার আপন গতিতে।

অনেকক্ষণ পর ঘরে ঢুকল লোকটি। তার আগমনের শব্দ পেয়ে দুজনেই মুখ তুলে তাকাল। মেয়েটির তন্দ্রাভাব এসেছিল। লোকটির কথা শুনে তা কেটে গেল।

‘আপনাদের পালানোর জন্য আপাতত নৌকা ছাড়া আর কিছু পাওয়া যাবে না। তাই নৌকাই জোগাড় করেছি’, বলে একমুহূর্ত থামল লোকটি।

‘তাই যথেষ্ট’, বলল ছেলেটি।

‘কিন্তু একটু সমস্যা আছে।’

‘কী সমস্যা?’ এবার মেয়েটি জানতে চাইল।

‘আমি বা আর কেউ তো আপনাদের সঙ্গে যাবে না, নৌকা চালাবে কে?’ কাঁচুমাচু করে বলল লোকটি। যেন সে যাবে না বলে লজ্জিত হয়েছে।

‘নদীমাতৃক বাংলাদেশের মাটিতে জন্ম আমার। আমি শখ করে পদ্মায় নৌকা চালিয়েছি। হয়তো সমুদ্রে নৌকা চালাতে খুব বেগ পেতে হবে না’, বলল ছেলেটি।

আপনি নৌকা চালাতে পারেন? মেয়েটিকে উদ্দেশ করে বলল ছেলেটি।

‘না, কখনো চালাইনি, তবে অনেকবার নৌকায় চড়েছি।’

‘তাহলে আর দেরি কেন, উঠে পড়ি। কাল সূর্য ওঠার আগেই এ দ্বীপ ছেড়ে অনেক দূরে যাওয়া উচিত’, বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল ছেলেটি। এর মধ্যে পায়ের ব্যথাটাও প্রায় উধাও হয়ে গেছে। মালিশের কৌটাটা রেখেই দুপায়ে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে বের হয়ে এলো। কাঁধে রাইফেল, গায়ে চাদরটি জড়িয়ে নিচ্ছে। বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়াল তারা।

‘আমার অতিরিক্ত কাপড় থাকলে আপনাকে দিতাম।’ বলেই মুখ নীচু করে ফেলল লোকটি। ছেলেটির গায়ে তেমন কাপড় নেই, তা আগেই দেখেছে লোকটি।

‘না, না, ঠিক আছে, আমার আর কাপড়ের প্রয়োজন নেই’, লোকটির লজ্জিত ভাব দেখে তাড়াতাড়ি বলল ছেলেটি। লোকটির স্ত্রী, তিন ছেলে ও এক মেয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসতে দুজনেরই খুব খারাপ লাগল। এই বিপদগ্রস্ত অবস্থায় এই অল্প সময়ে তারা তাদের জন্য যে আতিথেয়তা করেছে তা সত্যিই স্মরণীয়। যখন তারা বাড়ি থেকে বের হয়ে আসে, তখন সবাই চুপ করে ছিল। সবাইকে ভারি ক্লান্ত মনে হয়েছিল মেয়েটির।

লোকটির পাশে হেঁটে চলেছে ছেলেটি। বেশ দূরত্ব বজায় রেখে তাদের পাশাপাশি এগোচ্ছে মেয়েটি। লোকটি তাদের জানাল, সে ও তার দুই ছেলে সমুদ্রে মাছ ধরে। তাদের তিনজনের তিনটা নৌকা। তার মধ্যে বড় ছেলেটির নৌকা তুলনামূলকভাবে বেশি মজবুত ও বড়। সেটাই তাদের দেয়া হয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে ছেলেটির হাতে একটা টর্চ ও বল্লম ধরিয়ে দিল। আরো জানাল, তারা যদি পশ্চিম দিকে নৌকা চালিয়ে যায়, তবে উত্তর আমেরিকা মহাদেশের কোনো উপকূলে পৌঁছে যাবে। পথ ফুরিয়ে গেল। নৌকার কাছে এসে পৌঁছাল তারা।

‘নৌকার পাটাতনে দুই টিন বিস্কুট, বেশ কিছু রুটি, সাত-আটটা নারকেল, একটা বড় পাত্রে খাওয়ার পানি, সেই সঙ্গে আপনার পায়ের মালিশের কৌটা রাখা আছে। এসব হিসাব করে খরচ করবেন’, বলে থামল লোকটি।

‘আপনি যে আমাদের পালানোর সাহায্য করলেন, ক্যাপ্টেন জানতে পারলে আপনাদের ওপর অত্যাচার করবে না তো?’ জিজ্ঞেস করল ছেলেটি।

‘সে বিষয়ে আমরা সতর্ক থাকব।’

‘আপনারা নৌকায় উঠুন’, বলল লোকটি।

এগিয়ে এলো মেয়েটি। ‘প্লিজ, হাত বাড়ান।’ বলে হাতের মুঠো খুলে ধরল সে। হাতের তালুতে রাখা স্বর্ণের চেনে হীরার কাজ করা। রাতের আলোতেও হীরা থেকে জ্যোতি বের হচ্ছে। লোকটি একবার সেদিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল।

‘আমার আর দরকার নেই তো, নেই, নেব না। যে অবস্থায় আছি, তাতেই সন্তুষ্ট।’

‘আমার বাবা আমার ১৫তম জন্মদিনে এটা আমাকে উপহার দিয়েছেন। আপনি আমাদের উপকার করেছেন, তার বিনিময় হিসেবে নয়, বরং আপনাকে আমি এটা উপহার হিসেবে দিচ্ছি’, বলে দেয়ার জন্য হাত বাড়াল মেয়েটি।

‘নিন’, হাত বাড়াচ্ছে না দেখে আবার বলল, ‘হাত বাড়ান, প্লিজ নিন।’

কাঁপা কাঁপা হাত বাড়াল লোকটি। হাতে নিয়ে পকেটে রেখে দিল সেটা। আর দেরি না করে দুজনেই নৌকায় উঠে বসল। নৌকার নোঙরের বাঁধন খুলে দিয়ে নৌকাটা ঠেলে পানিতে নামানোর জন্য লোকটি নৌকায় হাত দিল।

‘আমি জানি আপনাদের এ দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়ার জন্য এ ডিঙ্গি নৌকা মোটেও উপযোগী নয়। তারপরও দিলাম। কারণ এর চেয়ে ভালো নৌকার ব্যবস্থা করে দেয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। ঈশ্বর আপনাদের সহায় হোন’, বলল লোকটি। ‘আমাদের জন্য অনেক কষ্ট করলেন। আপনাদের কথা আমরা কোনোদিন ভুলতে পারব না।’ লোকটির কথা শেষ হলে বলল ছেলেটি। কিছু না বলে লোকটি ঠেলে নৌকাটি কোমর সমান পানিতে নামিয়ে দিল। ছেলেটি হাতে বৈঠা তুলে নিল।

তীর থেকে ধীরে ধীরে সরে আসছে নৌকা। পালওয়ালা ছোট ডিঙ্গি নৌকা। খুব জোর আট-দশজনের মতো জায়গা হবে। পাটাতনে মাত্র একজনের শোয়ার জায়গা হবে। তবে নৌকাটি বেশ মজবুত বলে ছেলেটির মনে হলো। একটু পর পাল তুলে দিল সে। পালে বাতাস লাগতেই বৈঠা রেখে হাল ধরল। বাতাস পড়ে গেলে বৈঠা কাজে লাগাবে। কাজটা এমনিতেই কঠিন, তার ওপর সে নৌকা চালানোয় আনাড়ি। নৌকা সামলানো তার কাছে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে সে চ্যালেঞ্জটা গ্রহণও করেছে। তীর থেকে তারা বেশ দূরে সরে এসেছে। অর্থাৎ লোকটি তাদের বিদায় দিয়ে অনেকক্ষণ তীরে দাঁড়িয়ে ছিল। মুখ ফেরাল। নৌকা সামলানোয় মন দিল। বড় বড় ঢেউ নৌকাটিকে যেন ভেঙে চুরমার করে দেয়ার জন্য এগিয়ে আসছে। একটু এদিক-ওদিক হলে উল্টে যাবে নৌকা।

এ বিপদ থেকে উত্তরণের জন্য মহান আল্লাহর দরবারে মনে মনে প্রার্থনা করছে সে, ‘হে আল্লাহ! অনিশ্চিত এক দীর্ঘ যাত্রা শুরু করেছি। তুমি আমাদের যাত্রা নিশ্চিত করো।’ এক পাখিডাকা ভোরে আমাদের কোনো এক তীরে পৌঁছে দিও…।’

নৌকা সমুদ্রে ভাসার পর হাত নেড়ে লোকটিকে বিদায় জানিয়েছিল মেয়েটি। তারপর নৌকার পাটাতনে সাজিয়ে রাখা জিনিসগুলো দেখায় মন দিয়েছিল। লোকটি যা বলেছিল তার সবই, তার মধ্যে একটি জিনিস বেশি দিয়েছে, কিন্তু তাদের বলেনি। হয়তো বলতে ভুলে গিয়েছিল। তা হলো এক বাক্স দিয়াশলাই। এ দিয়াশলাই তাদের কী কাজে আসবে তা বুঝতে পারল না সে। বোঝার জন্য মাথাও ঘামাল না। এখন ছেলেটিকে সাহায্য করা দরকার।

‘লোকটি দিয়াশলাইও দিয়েছে’, বলতে বলতে ছেলেটির দিকে ঘুরে তাকাল সে।

ভালোই হয়েছে’, বলে আবার নৌকা সামলানোয় মন দিল। পাশে রাখা বৈঠাটা হাতে তুলে নিল মেয়েটি।

‘বৈঠাটা রেখে এখন ঘুমিয়ে নিন। এক সঙ্গে দুজনে ক্লান্ত হয়ে পড়লে চলবে না। যখন আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ব, তখন আপনি আমার জায়গায় আসবেন’, মেয়েটিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে একবারে বলে থামল ছেলেটি।

ভেবে দেখল, ছেলেটি ঠিকই বলেছে। বৈঠাটা জায়গামতো রেখে পাটাতনে শুয়ে পড়ল। গায়ে টেনে দিল চাদর।

আকাশে চাঁদ নেই। তবে অসংখ্য তারা আছে। তারাগুলো রাতের অন্ধকারকে কিছুটা হলেও ম্লান করে দিয়েছে। রাতের আকাশের অপূর্ব সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভাবছে অনেক কথা। কী ভাবছে সে?

তীর থেকে নৌকা অনেকদূর সরে এসেছে। এখন নৌকার গতিপথ ঠিক করা দরকার। তারা পশ্চিম দিকে যাবে। টর্চের আলোয় কম্পাস দেখে দিক নির্ণয় করে নৌকার গলুই পশ্চিম দিকে ঘুরিয়ে দিল। দেখা গেল তারা মূল দ্বীপের পাশ দিয়েই যাচ্ছে। মাঝেমধ্যেই বড় বড় ঢেউয়ের মাথায় উঠে যাচ্ছে তারা, আবার পরক্ষণেই নীচে নেমে আসছে। ঢেউগুলোর সঙ্গে যুদ্ধ করে নৌকা ঠিক রাখাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে।

‘আচ্ছা, কী পুরস্কার ঘোষণা হতে পারে?’ হঠাৎই জিজ্ঞেস করল ছেলেটি।

‘তা তো বলতে পারব না, এমন কোনো আভাস ওই লোক দুটোর কাছে পাইনি। তারা শুধু বলেছে পুরস্কার ঘোষণা করা হবে’, পরিষ্কারভাবে উত্তর দিল মেয়েটি। এখনো সে ঘুমায়নি। এক মুহূর্ত ভেবে, ‘আপনার স্বর্ণের চেনের মূল্য কত?’ আবার প্রশ্ন করল মেয়েটিকে।

‘তিনশ পনের ডলার’, জবাব দিল মেয়েটি। ‘এসব জিজ্ঞেস করছেন কেন?’

‘এমনি’, অন্যমনস্কভাবে বলল ছেলেটি।

নীরব হয়ে গেল দুজনেই। কিছুক্ষণের মধ্যে মেয়েটি ঘুমিয়ে পড়ল। সময় কেটে গেছে অনেকক্ষণ। কত রাত হয়েছে আন্দাজ করতে পারছে না ছেলেটি। কাল সূর্য ওঠার আগেই এ দ্বীপ থেকে তারা নাগালের বাইরে চলে যেতে পারবে তো! এখন পর্যন্ত তেমন বিপদ ছাড়াই এসেছে। হাই উঠেছে। মুখে হাত দিয়ে হাই বন্ধ করছে। খেয়াল হলো- ‘হাই শয়তানের পক্ষ থেকে আসে, আর হাঁচি আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে।’ হাই উঠলে শরীর নিস্তেজ হয়ে আসে; ঘুম ঘুম ভাব আসে। ইতোমধ্যে তারও ঘুম ঘুম ভাব এসে গেছে। মেয়েটি কি জেগেই আছে! তাকে ডাকবে কি না ভাবছে। চিন্তা করল, মেয়েটি অনেক পরিশ্রম করেছে। হয়তো এতক্ষণ ঘুমিয়ে পড়েছে। এখন থাক, যখন একদম পারবে না তখন ডাকবে। চোখ ডলে ঘুম দূর করার চেষ্টা চালাল। তারপর চাদরটা গায়ে ভালোভাবে জড়িয়ে নিল। হিমশীতল বাতাস মাঝেমধ্যেই তার কাঁপুনি তুলে দিচ্ছে। বাঁ দিকে মূল দ্বীপ রেখে এগিয়ে চলেছে। দূর থেকে দ্বীপটাকে ভুতুড়ে মনে হচ্ছে তার।

হঠাৎ ডান দিকে দূরে কিছু দেখতে পেল। মনে হলো কোনো কিছুর অবয়ব। ভালোভাবে তাকাতেই বুুঝল, একটা দ্বীপ। দ্বীপটাতে হয়তো ছোট পাহাড়-টিলা আছে। রাতের ম্লান আলোতে ছেলেটির তাই মনে হলো। দ্বীপের দিক থেকে সরিয়ে নৌকা। বেশ কিছুক্ষণ আগে ডানে যে দ্বীপটা দেখে ছিল তা এখন পাশে রেখে এগিয়ে চলেছে। দুই দ্বীপের মাঝ দিয়ে চলেছে। ডানদিকের দ্বীপটার দিকে মূল দ্বীপটাই তাদের আছে। দুই দ্বীপের মাঝখান থেকে বেরিয়ে এলো। দূরে মূল দ্বীপের বাতিগুলোর আলো দেখা যাচ্ছে। এসব দেখতে এগিয়ে চলছে ছেলেটি।

এখন খরস্রোতা নদীতে খেলনা নৌকা যেমন, এই মহাসাগরে তাদের ডিঙি নৌকাটিও তেমন। পরিষ্কার বুঝতে পারল এ ঢেউয়ের প্রবল ধাক্কা তাদের এ নৌকা সামলাতে পারবে কিনা। এ সময় তার পক্ষে কী করা সম্ভব তা মাথায় ঢুকল না।

সামনে বিপদ দেখে মস্তিষ্ক যেন অসাড় হয়ে পড়েছে। কিন্তু সময় কারো জন্য থেমে থাকে না। ঢেউটি আঘাত হানল নৌকাটির গায়ে। মুহূর্তে উল্টে গেল নৌকাটি। অবশ্য তার আগেই ছেলেটি ছিটকে খোলা সমুদ্রে গিয়ে পড়েছে। নিজেকে সামলে নিয়েই ঘুরে তাকাল। দেখল, নৌকাটি উল্টে গেছে। নৌকার তলাটি ওপরে এসেছে। গায়ে চাদর জড়িয়ে থাকায় ভেসে থাকতে তার অসুবিধা হচ্ছে, তাই খুলে পানিতে ফেলে দিল। চাদরটা যে পরে কাজে লাগতে পারে তা এ সময় তার খেয়ালই হলো না। ডুবে গেল চাদরটি।

আশপাশে কোথাও মেয়েটিকে দেখতে পেল না। তবে কি…. আর ভাবতে চাইল না সে। মেয়েটির জন্য শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। কীভাবে তাকে খুঁজে পাওয়া যায় তা বুঝতে পারল না। নিজেকে ধমক দিল নিজেইÑ ‘তুমি অহেতুক মাথা গরম করছ, পদে পদে মাথা গরম করলে লাভ না হয়ে বরং ক্ষতি হয়, মাথা ঠান্ডা রেখে চিন্তা কর।’

ঘুমিয়ে পড়েছিল মেয়েটি। ঢেউয়ের আঘাতে যখন নৌকা বাঁ দিকে হেলে গিয়েছিল, তখন সেও বাঁ দিকে গড়িয়ে পড়ার সময় ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। যখন তাকেসহ নৌকাটি উল্টে যায়, তখনো সে কিছু বুঝে উঠতে পারছিল না। শুধু এতটুকু বুঝেছিল, কোনো কারণবশত তাকে নিয়ে নৌকাটি উল্টে যাচ্ছে। উল্টে গেল নৌকা। সে পানির মধ্যে ডুবে গেল। নৌকাটি তাকে ঢেকে ধরল। মেয়েটি বুঝতে পারলে, তার ওপর নৌকাটি আছে। সমুদ্রের লবণাক্ত পানি যাতে না ঢোকে সেজন্য চোখ বন্ধ করে ফেলল, বাঁ হাতে নাক টিপে ধরল। এ অবস্থায় যে কোনো দিকে ডুব দিয়ে কিছুদূর গিয়ে ভেসে উঠতে হবে। সে ডুব-সাঁতারও দিতে পারে। দম ফুরিয়ে আসছে, দ্রুত বের হতে হবে। যখন সে পানিতে পড়ে যাচ্ছিল, তখন গা থেকে চাদরটা সরিয়ে ফেলেছিল। ডুব দিয়ে এগোতে শুরু করল। মাথায় চোট লাগল নৌকার গায়ে। দম প্রায় শেষ। শ্বাস নেয়ার জন্য মৃদু অস্থির হয়ে উঠেছে সে। বেশি নীচে ডোবার সময় নেই। সামান্য একটু নীচে নেমে আবার এগোতে লাগল। কতটুকু ডুবে ছিল বলতে পারবে না। তবে এগোতে গিয়ে বুঝল তার ঘাড়ের ওপরে জামার গলায় কী যেন আটকে গেল। সেদিকে মন দেয়ার সময় নেই। শ্বাস নেয়ার জন্য পাগল হয়ে উঠেছে। সর্বশক্তি প্রয়োগ করে সামনে এগোল। একসময় বের হয়ে এলো খোলা সাগরে। বুক ভরে সমুদ্রের তাজা বাতাসে শ্বাস নিল। এই প্রথম খেয়াল হলো তার গায়ে জামা নেই। ওপরের অংশ একেবারে অনাবৃত। থমকে গেল সে। বুঝতে পারল নৌকার তলা থেকে বের হওয়ার সময় নৌকার কোনো বর্ধিত কাঠের সঙ্গে আটকে গিয়ে ছিঁড়ে গেছে তার জামাটি। তারপর তা গা থেকে এমনিতেই খুলে গেছে। পানির ওপরে ভেসে ওঠার চেষ্টায় ব্যস্ত থাকায় তা সে খেয়াল করেনি। এখনো কি ছেঁড়া জামাটা পাওয়া যাবে? ঝট করে ঘুরে গেল নৌকার দিকে। দেখল, নৌকাটি ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি নৌকার কাছে সরে এলো সে। পানির ওপর জামাটি নেই। তবে কি একদম ডুবে গেছে, নাকি নৌকার গায়ে আটকে আছে? যে দিক দিয়ে বের হয়েছে সে জায়গায় ডুব দিয়ে নৌকার গায়ে খুঁজল, কিন্তু পেল না। দম ফুরিয়ে যাওয়ায় ভেসে উঠল। বুঝল, পাওয়া যাবে না। অনর্থক মরীচিকার পেছনে ছুটে লাভ নেই।

হঠাৎ ছেলেটির কথার খেয়াল হতেই চারদিকে তাকিয়ে কোথাও তাকে দেখতে পেল না। ছেলেটি কি তাহলে… ভাবনাটা শেষ হওয়ার আগেই ছেলেটিকে ভুশ করে পানির ওপরে ভেসে উঠতে দেখল সে।

সাগরে নিমজ্জিত হচ্ছে নৌকাটি। মাথা ঠান্ডা রেখে দ্রুত চিন্তার জগতে প্রবেশ করল ছেলেটি। অবশ্য এ রকম পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রাখা দুরূহ কাজ। মেয়েটি তখন পাটাতনে ঘুমিয়ে ছিল। তার এখন নৌকার নীচে থাকার সম্ভাবনাই বেশি। তাহলে… যেই ভাবা সেই কাজ। কিন্তু হাত দিয়ে দেখল, এভাবে পানিতে ভেসে থেকে নৌকা উল্টিয়ে সোজা করা তার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। এদিকে সময় ব্যয় না করে অন্য উপায় বের করে ফেলল। প্রথমে নৌকার গা ধরে ডুব দিল লবণাক্ত পানির মধ্যে। তারপর ঝুঁকি নিয়ে নৌকার তলায় ঢুকে পড়ল। এখানে মেয়েটিকে পেলে তাকে কীভাবে সাহায্য করবে এখনো তা নিয়ে চিন্তা করেনি। আগে তাকে তো খুঁজে পেতে হবে। দম ফুরিয়ে আসছে। ছোট নৌকার ভেতরটা খুঁজতে বেশি সময় লাগল না। সে অনেকক্ষণ দম ধরে রাখতে পারে। তাই একেবারে খোঁজা শেষ করে বের হয়ে এলো। দম নেয়ার জন্য ভেসে উঠতে এক অজানা ভয়ানক আশঙ্কায় কেঁপে উঠল ছেলেটি। তবে কি সত্যিই মেয়েটি নৌকায় প্রচণ্ড বাড়ি খেয়ে অজ্ঞান হয়ে সমুদ্রে ডুবে গেছে? এখন সে কী করবে? নিজে বাঁচার চেষ্টা করবে নাকি আর কিছুক্ষণ মেয়েটির জন্য অপেক্ষা করবে? উত্তর ঠিক করার আগে ভেসে উঠে দম নিয়ে চোখ মেলল।

‘আমি এখানে।’ বলে উঠল মেয়েটি নৌকার অপর দিক থেকে।

মেয়েটির গলার আওয়াজ শুনে চমকে ঘুরে তাকাল ছেলেটি। মেয়েটিকে চোখে পড়তেই দৃষ্টি সরিয়ে নিল। মাথা থেকে যেন এক বিরাট বোঝা সরে গেল। মনে মনে বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ।’

এবার কোন দিকে যাবে সে ভাবনায় ডুবে গেল ছেলেটি। বাম দিকে মূল দ্বীপ কাছে হলেও এখন আবার সেদিকে যাওয়া হবে চরম বোকামি। অতএব, ‘আমরা সামনের ওই দ্বীপে উঠব ইনশাআল্লাহ।’ হাতের ইশারায় দেখিয়ে দিল ছেলেটি। ‘আপনি সাঁতার কাটতে পারবেন তো?’ মেয়েটি যাতে দূর থেকে তার কথা শুনতে পায় সে জন্য চেঁচিয়ে কথা বলছে ছেলেটি।

‘পারব।’ জবাব দিল মেয়েটি।

‘তাহলে এগোনো যাক।’ বলে আল্লাহর নাম নিয়ে এগোতে শুরু করল। মেয়েটি কিছু না বলে সারা শরীর পানির নীচে ডুবিয়ে শুধু মাথাটা ভাসিয়ে রেখে সাঁতরাতে শুরু করল। নদীতে সাঁতার কাটার চেয়ে সমুদ্রের সাঁতার কাটা সহজ। নদীর পানিতে পানিই প্রধান উপাদান হওয়ায় নদীর প্লাবতা কম। ফলে নদীর পানিতে ভেসে থেকে সাঁতার কাটা কষ্টকর। অপরদিকে সমুদ্রের পানিতে নানা ধরনের উপাদান দ্রবীভূত থাকায় সমুদ্রের পানির প্লাবতা বেশি হওয়ায় সমুদ্রের পানিতে ভেসে তাকা সহজ বলে সাঁতার কাটাও সহজ। সমুদ্রের পানি থেকে নদীর পানির প্লাবতা কম হওয়ার কারণে যখন কোনো জাহাজ সমুদ্র থেকে নদীতে প্রবেশ করে তখন সে জাহাজ থেকে কিছু মালপত্র সরিয়ে ফেলা হয়।

বেশ দূরত্ব বজায় রেখে দুজনে নীরবে এগিয়ে চলেছে। পানিতে ঠান্ডায় দুজনেই জমে যাওয়ার উপক্রম। দ্রুত সাঁতার কেটে শরীর গরম রাখার ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছে উভয়ে। যতই দ্বীপের কাছে হচ্ছে, ততই দ্বীপের অবয়ব স্পষ্ট হয়ে উঠছে। দ্বীপে পৌঁছতে এখনো অনেক সময় লাগবে। মেয়েটি ভাবছে, শেষ অবধি পারবে তো তারা দ্বীপে পৌঁছতে? যদি দ্বীপে পৌঁছে যায়, তারপরে তার কী হবে?

সময় প্রবাহের সঙ্গে তাল মিলিয়ে একটু দূর দিয়ে প্রায় সমান গতিতে এগোচ্ছে দুজনেই। একটু পরপর মেয়েটি ডানে তাকিয়ে দেখছে, ছেলেটি আছে কিনা। ছেলেটিও দেখছে, তবে প্রথমত অনেকক্ষণ পরপর, দ্বিতীয়ত একবার তাকিয়েই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিচ্ছে।

যদিওবা এ এলাকা থেকে সরে যাওয়ার মতো একটা নৌকা পেল, তাও তো ডুবে গেল। এখন মূল দ্বীপের অদূরেই আরেকটি দ্বীপে উঠতে যাচ্ছে তারা। কাল দিনে অনুসন্ধানীরা এ দ্বীপে হানা দেবে না তো! দিলেইবা কী করার আছে! লোকটি নৌকায় যা যা তুলে দিয়েছিল, সব ডুবে গেছে। তার একমাত্র অস্ত্র রাইফেলটা পাটাতনে রাখা ছিল, তাও ডুবে গেছে। এমনকি তাকে দেয়া টর্চ, কম্পাসটাও। এ দুটো সে তার পাশেই রেখেছিল। তারা একরকম নিঃস্ব হয়ে গেছে। মাথার ওপর দিয়ে একটা অ্যালবাট্রোস উড়ে যেতেই ভাবনায় ছেদ পড়ল ছেলেটির। অ্যালবাট্রোস একটা সামুদ্রিক পাখি। প্রাচীন যুগের নাবিকরা এ পাখিকে তাদের সৌভাগ্যের প্রতীক মনে করত। সাঁতার কাটায় মনোনিবেশ করল ছেলেটি। ধীরে ধীরে হাঁপিয়ে উঠছে দুজনেই। এখনো বেশ কিছুদূর সাঁতরাতে হবে। তীরের কাছে এসে পড়েছে। ফিরতি ঢেউ ভেঙে এগোতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। সব কষ্টের অবসান ঘটিয়ে একসময় পৌঁছে গেল তীরে।

তারার আলোয় রাতের আঁধার ফিকে হয়ে গেছে। তাছাড়া অন্ধকারে থাকতে থাকতে এখন বেশ দূরেও দেখা যায়। চার হাতে-পায়ে ভর দিয়ে পানির নাগালের বাইরে সৈকতে পা ছড়িয়ে বসে চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগল ছেলেটি। একটু পর চোখ খুলে আশপাশে কোথাও মেয়েটিকে দেখতে পেল না। তার সঙ্গেই তো তীরে এসে পৌঁছল। তাহলে গেল কোথায়? সমুদ্রের দিকে তাকাতেই তাকে দেখতে পেল ছেলেটি। তীর থেকে দূরে একটা পাথর ধরে পানিতে ভাসছে মেয়েটি। শুধু মাথাটা দেখা যাচ্ছে। মেয়েটির এ ধরনের আচরণের মর্ম বুঝতে পারল না সে। তীরে গিয়ে দাঁড়াল। একটু দূরে মেয়েটিকে সারা শরীর পানিতে ডুবিয়ে শুধু মাথা ভাসিয়ে মাথা নীচু করে থাকতে দেখল সে।

‘আপনি এখনো পানি থেকে উঠে আসেননি কেন?’

এ অবস্থায় কী করা যায় তাই ভাবছিল মেয়েটি। ছেলেটির সাড়া পেয়ে চমকে উঠল। দেখল ছেলেটি বেশ দূরে আছে। কী উত্তর দেবে তা ভেবে পাচ্ছে না।

‘কী ব্যাপার, চুপ করে আছেন কেন? ঠান্ডা লাগবে, তাড়াতাড়ি উঠে আসুন’, মেয়েটির কোনোরকম সাড়া না পেয়ে বলল ছেলেটি।

মেয়েটি ঠিক করল, লজ্জা ফেলে সত্যটাই প্রকাশ করবে। এছাড়া তো কোনো উপায় তার জানা নেই। এখন পর্যন্ত ছেলেটিকে দেখে যা মনে হয়েছে তাতে যে সে তার কোনো ক্ষতি করবে না এ বিষয়ে সে নিশ্চিত। কিন্তু কীভাবে বলবে, এক মুহূর্ত ভেবে সরাসরি বলে ফেলল, ‘আমার শরীরের ওপরের দিকে অনাবৃত’, বলেই থেমে গেল।

‘তার মানে?’ বুঝতে না পেরে বলল ছেলেটি।

‘নৌকার তল থেকে বের হতে গিয়ে হয়তো কোনো কিছুতে লেগে…’, বলেই থেমে গেল মেয়েটি। আর বলতে পারল না। ঠান্ডায় গা থরথর করে কাঁপছে।

মেয়েটি থামতেই, ‘থাক, আর বলতে হবে না, বুঝেছি। এখন কী করা যায়, হুম’ বলে কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ ভাবল। ‘আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে সামনে এগোচ্ছি। আপনি পানি থেকে উঠে আমার পেছনে পেছনে আসবেন। সাবধানে এগোবেন যেন কোনো বিপদে জড়িয়ে না পড়েন। আর কোনো অসুবিধা হলে আমাকে সঙ্গে সঙ্গে জানাবেন, তখন দেখা যাবে।’ মেয়েটির উদ্দেশ্য দীর্ঘ এ বক্তৃতা দিয়ে ঘুরে একটু সামনে এগিয়ে দাঁড়াল ছেলেটি। মেয়েটির সাড়া পাওয়ার অপেক্ষায় আছে। বোকামি করে চাদরটি পানিতে ফেলে দেয়ার জন্য মনে মনে নিজেকে একশত একটা জুতোর বাড়ি মারল ছেলেটি।

ছেলেটির কথায় আশ্বস্ত হলো মেয়েটি। উঠে এসে ছেলেটির বেশ পেছনে দাঁড়াল।

‘উঠে এসেছি।’ এ অবস্থায় খোলা আকাশের নীচে দাঁড়াতে অস্বস্তি বোধ হচ্ছে তার। লক্ষ্য রেখেছে ছেলেটির দিকে।

সামনে এগোচ্ছে ছেলেটি। হাঁটতে হাঁটতেই নিজেকে আদেশ করছে সেÑ ‘তোমাকে এ অবস্থায় আগের চেয়ে অনেক বেশি সতর্ক হতে হবে। তোমাকে এ দুনিয়ায় পরীক্ষা দেয়ার জন্য পাঠানো হয়েছে। তোমাকে অবশ্যই পাস করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে। হে আল্লাহ্, আমাকে তৌফিক দাও।’

দ্বীপটা কত বড় তা রাতের বেলায় আন্দাজ করা গেল না। এ দ্বীপে ছোট আকারের অনেক পাহাড়-টিলা আছে। তবে গাছপালার সংখ্যা খুবই নগণ্য। দ্বীপে বসতি আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। লাগাতার প্রচণ্ড পরিশ্রমে শরীর অবসন্ন হয়ে এসেছে। এ অবস্থায় কমপক্ষে এক পক্ষের বিশ্রাম প্রয়োজন। পা দুটো আর চলতে চাইছে না। সৈকতেই বসে পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে ছেলেটির; কিন্তু এখানে ঠান্ডা বেশি লাগবে। তার চেয়ে পাহাড়ের মধ্যে কোথাও আশ্রয় নিলে ঠান্ডা কম লাগবে। তীর থেকে বেশ দূরে দুটি টিলার মধ্যে পথ ঢুকে গেছে। পথ তো নয়, পথের মতো। সেদিকে তারা ঢুকে পড়ল। ছেলেটির কী পরিমাণ ঠান্ডা লাগছে তা নিজেকে দিয়ে বুঝতে পারল মেয়েটি। তার তো জিন্সের প্যান্ট পরা আছে। ছেলেটির পাজামা নিশ্চয়ই এ জিন্সের মতো নয়। অবশ্য তার প্যান্টটা ভেজা বলে খুবই ঠান্ডা লাগছে। একটু পরপরই দাঁতে দাঁতে বাড়ি লেগে ঠক ঠক করে কেঁপে উঠছে সে। হঠাৎ খেয়াল হলো তার প্যান্টের পকেটে গ্যাস লাইটার আছে। ডালপাতা জোগাড় করে পাহাড়ের ভেতরে আগুন জ্বালালে কারো চোখে পড়বে না। সে আগুনে শীত অনেকটা নিবারণ করা যাবে। তারপরই স্মরণ হলো, সে আগুনের সামনে বসতে পারবে না। তাহলে… তাহলে ছেলেটিকে গ্যাস লাইটারটা দিয়ে দেবে। আগুনে তার শীত নিবারণ হলেও চলবে।

এক জায়গায় দাঁড়িয়ে গেল ছেলেটি। যেখানে দাঁড়িয়েছে তার চারদিকে পাহাড়-টিলায় ঘেরা। মাঝে অল্প পরিসরের সমতল জায়গা। এখানেই রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নিল। ‘আমরা এখানেই বিশ্রাম নেব, আপনি কী বলেন?’ সামনে তাকিয়েই কথা বলছে ছেলেটি।

‘আমার আপত্তি নেই’, বলতে গলাটা কেঁপে উঠল মেয়েটির। দাঁতে দাঁতে বাড়ি লেগে ঠক ঠক শব্দ ছেলেটির কান অব্দি পৌঁছাল।

‘আপনার কি খুবই ঠান্ডা লাগছে?’ নিজেই কাঁপা কাঁপা গলায় বলল ছেলেটি। বেশ কিছুদিন থেকে খালি গায়ে থেকে ঠান্ডা সহ্য করার ক্ষমতা অনেক বেড়েছে তার। তারপরও সে ঠান্ডায় মৃদু কেঁপে চলেছে। সমুদ্রের তীরে খোলা সৈকতে থাকলে আরো বেশি ঠান্ডা লাগত।

‘লাগছে, তবে সহ্য করতে পারব’, সত্য কথাটাই ক্লান্ত গলায় বলল মেয়েটি।

একটু ভাবল ছেলেটি। ‘আপনার কাছে লাইটারটা আছে?’

‘আছে’, কোনোরকমে জবাব দিল। তার অনাবৃত শরীরে রাতের ঠান্ডা বাতাস যেন হুল ফুটিয়ে দিচ্ছে। খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলল, ‘আপনি আপাতত ওই পাথরটির আড়ালে জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকুন, আমি আসছি’, বলেই মেয়েটিকে কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে যে পথে তারা এসেছিল সে পথে পা বাড়াল ছেলেটি। সে কী করতে যাচ্ছে তা মেয়েটি বুঝে ফেলল। তাকে থামানোর জন্য হাত বাড়িয়ে ডাকতে গেল। কিন্তু ঠান্ডায় মুখ দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হলো না। অদৃশ্য হয়ে গেল ছেলেটি। অগত্যা ছেলেটির কথামতো বড় পাথরটির পেছনে গুটিসুটি হয়ে বসল। একটু পরেই বুঝতে পারল, পাথরটির পেছনে থাকায় একদিকে তার সামনে পাথরটি পর্দা হিসেবে কাজ করছে, অন্যদিকে ঠান্ডাও একটু কম লাগছে।

যাওয়ার সময় পথের ধারে একটা মৃত গাছ চোখে পড়েছিল। সেটার কাছে এসে দাঁড়াল ছেলেটি। গাছটা ছোট। দাঁড়িয়েই হাতে ভাঙার মতো সব ডাল ভেঙে একত্রে বোঝা করে ফিরল সে। ছেলেটির দেরি দেখে চিন্তিত হয়ে পড়েছিল মেয়েটি। কোনো ধরনের বিপদে পড়েনি তো? ছেলেটিকে ফিরতে দেখে খুশি হয়ে উঠল সে। মেয়েটিকে যেখানে বসতে বলেছে, সেখান থেকে বেশ দূরে বোঝাটি রাখল।

‘আপনি কোথায় আছেন?’ উচ্চস্বরে জিজ্ঞেস করল ছেলেটি।

‘এখানে’, পাথরের পেছন থেকে সাড়া দিল মেয়েটি।

‘শুনুন, আমি কিছুক্ষণের জন্য এখান থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। আপনি এখানে এসে লাইটার দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে নিজেকে গরম করে নিন। ডালগুলোতে হয়তো সহজে আগুন ধরবে না। আমি যতক্ষণ না ফিরব ততক্ষণ আপনি আগুনের পাশেই থাকবেন। আমি ফিরলে বুঝতে পারবেন। অহেতুক অস্বস্তিতে থাকার দরকার নেই।’ মেয়েটিকে উদ্দেশ করে দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়ে থামল ছেলেটি। যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই মেয়েটির কথায় থামতে হলো।

‘আমার দরকার নেই। লাইটার দিচ্ছি, আপনিই আগুনের পাশে বসে বিশ্রাম নিন’, বলতে বলতে লাইটার বের করার জন্য পকেটে হাত ঢুকাল। উল্টো দিকে ঘুরে আছে ছেলেটি। ‘এদিকে ঘুরুন, আমি লাইটার ছুড়ে দিচ্ছি। আমার চেয়ে আপনার অনেক বেশি ঠান্ডা লেগেছে।

উল্টো দিক থেকেই বলছে ছেলেটি, ‘প্লিজ জেদ করে কথা বাড়াবেন না। আপনি আগে…’, বলে আর দাঁড়াল না সে। দ্রুত সরে যেতে লাগল সেখান থেকে।

জানে, ছেলেটিকে ডেকে কোনো লাভ হবে না, তাই আর ডাকল না মেয়েটি। ঠান্ডায় কাঁপছে সে। তারপরও উঠতে দ্বিধা করছে। এ অবস্থায় সে কীভাবে আগুনের আলোয় বসবে! ছেলেটিকে সে অবিশ্বাস করছে না। তারপরও এক অজানা অস্বস্তি তাকে চেপে ধরেছে। অবশেষে ঠান্ডা সহ্য করতে না পেরে সমস্ত দ্বিধা-অস্বস্তি ঝেড়ে ফেলে উঠল। প্রথমে শুকনো ডালগুলোকে দুভাগ করে লাইটার দিয়ে একটা সরু ডালে আগুন ধরানোর চেষ্টা শুরু করল। অনেকক্ষণ পর ডালটাতে আগুন ধরাল। তারপর বাকি ডালগুলোতে আগুন ধরিয়ে অগ্নিকুণ্ড বানাতে খুব বেশি সময় লাগল না। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠল। আগুনের আলোয় চারদিক উদ্ভাসিত হয়ে গেল। ধীরে ধীরে গরম হয়ে উঠছে শরীর। আগুনের পাশে বসে থাকতে খুবই ভালো লাগছে তার। শরীরটা যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পেল। ঠান্ডা দূর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্লান্তিও অনেকটা দূর হয়ে গেল। সে এখন পর্যন্ত ছেলেটিকে যতটুকু দেখেছে তাতে তার দৃঢ়বিশ্বাস জন্মেছে যে, ছেলেটি এখান থেকে অনেক দূরে আছে, আর দূর থেকে এদিকে তাকিয়েও নেই। তাকে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি অবাক করেছে তা হলোÑ সে এ দ্বীপে উঠে আসার পর থেকে ছেলেটি তার দিকে ফেরেনি, আর তার দিকে তাকানোর তো প্রশ্নই উঠে না। এর আগেও নিত্যন্ত প্রয়োজন ছাড়া সে তার দিকে চোখ তোলেনি। অথচ এ পর্যন্ত কত ছেলেই না তার পেছনে ধরনা দিয়েছে। আর ক্যাপ্টেন তো তার জন্য একরকম পাগল হয়েছে বলে তার মনে হয়। নাহ, ছেলেটি সত্যি বড়ই অদ্ভুত। এ ধরনের মানুষের কাছে সর্বাবস্থায় যে কোনো মানুষ নিরাপদ, ছেলেটির সম্পর্কে তার এমনই ধারণা জন্মেছে। ডালগুলো ধীরে ধীরে পুড়ছে। পট পট শব্দে ডাল ফুটছে। সেই সঙ্গে আগুনের তেজও কমে আসছে। একসময় আগুন নিভু নিভু পর্যায়ে চলে এলো। বাকি অর্ধেক ডাল ছেলেটির জন্য রাখল।

উঠে আগের জায়গায় গিয়ে আগের মতো পাথরটির আড়ালে বসে পড়ল। হঠাৎ খেয়াল হলোÑ এখন তো রাত। পাথরের আড়ালে গুটিসুটি মেরে থাকাই যথেষ্ট। কিন্তু কাল দিনে সে কোথায় লুকাবে? দূরে আবছার মতো কিছু এদিকে আসতে দেখে ভালোভাবে তাকাল। আরো কাছে এলে ছেলেটির কাণ্ড দেখে একটু আগের ভাবনার কথা বেমালুম ভুলে গেল। ছেলেটি যে রীতিমতো উল্টো দিকে হাঁটছে।

পাহাড়-টিলায় পরিবেষ্টিত জায়গাটি থেকে ছেলেটি দূরে চলে এসেছে। সৈকতের যেখানে তারা উঠেছে, সেখানে পৌঁছে গেছে। সমুদ্রের দিক থেকে বয়ে আসা হিমশীতল বাতাসে ঠক ঠক করে কাঁপছে। খানিকক্ষণ চিন্তা-ভাবনা করে সৈকত ধরে পা বাড়াল। নৌকা থেকে দ্বীপটাকে তেমন বড় মনে হয়নি। তাকে আগে জানতে হবে এ দ্বীপে জনবসতি আছে কিনা। যেহেতু এ দ্বীপটা পাহাড়-টিলায় ভরপুর তাই তা জানার সহজ উপায় বের হলো দ্বীপের সৈকত ধরে চতুর্দিক ঘুরে দেখা। এখানে বাড়িঘর থাকলে তা সৈকতের পাশে হওয়াই যুক্তিযুক্ত। তানা হলে তীরে কমপক্ষে একটা হলেও মূলদ্বীপে যাতায়ের জন্য নৌকা থাকবে। দ্বীপের জনবসতি সম্পর্কে খোঁজখবরটা বিশ্রাম নিয়ে পরে করলেও হতো, তাকে যখন ওখান থেকে সরে আসতেই হয়েছে, তখন একেবারেই খোঁজা শেষ করে ফিরবে।

ক্লান্ত অবসন্ন শরীর নিয়ে কোনোমতে দ্রুত এগোনোর চেষ্টা করছে ছেলেটি। কত সময় গত হয়েছে জানে না। তবে দ্বীপের সৈকত ধরে হেঁটে হেঁটে একসময় যেখানে বিশ্রাম নিয়েছিল সেখানে পৌঁছে গেল। মধ্যে দুবার খানিক বিশ্রাম নিয়েছিল। না, এ দ্বীপে জনবসতির কোনো চিহ্ন পেল না।

ঠান্ডায় তার অবস্থা শোচনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন বিরতিহীনভাবে সে কেঁপেই চলেছে। এখন গিয়ে আগুনের পাশে বসা দরকার। কিন্তু শরীর এতই দুর্বল হয়ে পড়েছে যে ফিরতে ইচ্ছে হচ্ছে না। নিজেকে বোঝাল, এখানে থাকার চেয়ে আগুনের পাশে গিয়ে বসাই ভালো হবে। ফিরতি পথ ধরল। ডানের পাহাড় পেরোলেই সে বিশ-পঁচিশ গজ দূরে মেয়েটিকে হয়তো আগুনের পাশে দেখতে পাবে। তাই ঘুরে পেছন দিক দিয়ে এগোতে লাগল। তবে ধীরে ধীরে, যেন কোনো কিছুতে হোঁচট খেয়ে না পড়ে। যেখানে আগুন জ্বালার কথা তা থেকে একটু দূরে থাকতেই বুঝতে পারল আগুন জ্বালা নেই। তাহলে হয়তো মেয়েটিও আশপাশে নেই। ঝট করে ঘুরে দাঁড়াল। দেখল, মেয়েটির জ্বালানো আগুন প্রায় নিভে এসেছে। তার মানে বেশ কিছুক্ষণ আগেও মেয়েটি এখানে ছিল। ভালোই হয়েছে, এখন নেই। বাকি কাঠগুলো দিয়ে আবার আগুন জ্বালিয়ে ফেলল। আগুনের আলোয় লাইটারটা কুড়িয়ে নিয়ে দেখল, তাতে গ্যাস প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। যা আছে, তা দিয়ে খুব জোর আর দুবার জ্বালানো যাবে। লাইটারটা মাটিতে রেখে দিয়ে নিজেকে উষ্ণ করার কাজে লেগে গেল। যখন সে মেয়েটির ওই অবস্থার কথা শুনেছে, তখন থেকেই ভাবছে, এর কী ব্যবস্থা করা যায়? এতক্ষণ ভালোভাবে ভাবার সুযোগ পায়নি। তবে এবার পেল। এখনতো অনেক রাত। দিনের আলো ফুটলে তার কী অবস্থা হবে। তার কাছ থেকে এমনিতে দূরে সরে থাকলেও কোনো প্রয়োজনে তার কাছে যেতে পারবে না। দিনে পালাতে হলে সে তার সঙ্গে পথ চলবে কীভাবে? তাছাড়াও বড় কথা হলো সন্ধানী দল এসে পড়লে তার কী অবস্থা হবে, একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন। অথচ তাকে দেয়ার মতো তার কোনো কাপড়ই নেই। অবশেষে অনেক চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিল, আবার সে মূল দ্বীপে ফিরে যাবে। জেলেকে বলে তার মাধ্যমে মেয়েটির কাপড়ের ব্যবস্থা করবে সেই সঙ্গে আর একটা নৌকা জোগাড়ের চেষ্টা করবে।

অনেকক্ষণ আগুনের পাশে থেকে বিশ্রাম নিয়ে অনেকটা ভালো লাগছে তার। দিনের বেলা দ্বীপে যাওয়াটা বোকামি হবে। দেরি না করে এখনই রওনা দেয়া উচিত। রাতের আর বেশি বাকি নেই। পূর্বদিকে তাকিয়ে দেখল সুবহে কাজিব শুরু হয়েছে। উঠতে গিয়েও কী ভেবে বসে পড়ল। মেয়েটিকে বলে যাওয়া দরকার। তা না হলে চিন্তা করবে। কারণ তার ফিরতে দেরি হতে পারে। হয়তো মেয়েটি গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। তার খুবই পরিশ্রম হয়েছে কিনা! তাকে না ডেকে বরং একটা সরু শক্ত ডাল নিয়ে মাটিতে লিখে উঠে দাঁড়াল।

যখন মূল দ্বীপে পৌঁছল তখন সূর্য ওঠার আর অল্প বাকি। ফজরের নামাজ আদায় করে নিল সৈকতে। এতক্ষণ সাঁতার কেটে আর এগোতে শক্তি পাচ্ছে না। তাছাড়া প্রচণ্ড ক্ষিধেও লেগেছে। কিন্তু এখানে পড়ে থাকলে চলবে না। পূর্বাকাশ থেকে টকটকে লাল সূর্যটা বেরিয়ে আসছে। তার এখান থেকে এখনই সরে পড়া দরকার। কারণ পাশেই গ্রাম। এতক্ষণে পুরস্কারের ঘোষণা করা হয়ে থাকলে তারা অল্প সময়ের মধ্যেই বেরিয়ে পড়বে। তার গা এখনো ভেজা আছে। ঠান্ডায় কাঁপছে। তাকে এখানে যে কেউ দেখলে সহজেই বুঝে ফেলবে যে, সে কোনো দ্বীপ থেকে এসেছে। তখন মেয়েটি পড়বে মহাবিপদে। তা ছাড়া ওই জেলের বাড়ি এখান থেকে দক্ষিণ দিকে। যত কষ্টই হোক এগোনো দরকার। অবশেষে নিস্তেজ শরীর নিয়ে এগোতে লাগল। গ্রামের পাশ থেকে অনেকদূর সরে গেছে। দ্বীপটাও পেছনে এসেছে। সূর্য আধ-বাঁশ পরিমাণ ওপরে উঠে গেছে। আরো বেলা হওয়ার আগেই তার জেলের বাড়িতে পৌঁছতে হবে। এখন সে মাতালের মতো পা ফেলছে। এক সময় অতি ক্লান্ত হয়ে ধপাস করে পড়ে গেল সৈকতের ওপর। চেষ্টা করেও উঠতে পারল না।

প্রচণ্ড পরিশ্রমের ফলে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল বলতে পারবে না সে। যখন ঘুম ভাঙল তখন অনেক ওপরে উঠে গেছে সূর্য। চোখ মেলে দেখল তার চারপাশে অনেক লোক। হয়তো তাদের কথায় তার ঘুম ভেঙে গেছে। হঠাৎই বুঝতে পারল যে সে বন্দী হয়ে গেছে। উঠে বসল সে। পালানোর চেষ্টা করল না। জানে, লাভ হবে না। চুপ থাকাই শ্রেয়। তাকে কেউ কিছু বলছেও না। তারা নিজেদের মধ্যেই তার ব্যাপারে নীচু গলায় কথা বলছে। চারদিকে তাকাতে গিয়ে চোখ পড়ল সেই জেলের ওপর। চুপ করে আছে। চোখাচোখি হতেই দুজনেই চোখ সরিয়ে নিল। তার চোখে-মুখে অবাক হওয়ার ছাপ। হয়তো সে ভাবছে এ ছেলে আবার ফিরে এলো কেন? মেয়েটিইবা কোথায়? তার গা এর মধ্যে শুকিয়ে গেছে বলে মনে মনে কিছুটা স্বস্তি পেল। লোকগুলোর কথায় বুঝল ছেলেটিÑ তাদের উভয়কে বা যে কোনো একজনকে ধরিয়ে দিতে পারলে তাকে একশত ডলার পুরস্কার দেয়া হবে। হেড কোয়ার্টারে সংবাদ দেয়া হয়েছে।

কিছুক্ষণের মধ্যে একটা জিপ এসে গেল। তাকে জিপের পেছনে তোলা হলো। জিপে সে ছাড়াও একজন ড্রাইভার, একজন অফিসার ও চারজন অস্ত্রধারী আছে। স্টার্ট নিল গাড়ি।

‘আমাকে সঙ্গে নিন, আমি ওকে আগে পেয়েছি’, বলতে বলতে একজন জিপের পাশে এসে দাঁড়াল।

‘আমি আগে দেখেছি’, বলে আর একজন এগিয়ে এলো।

‘থাম তোমরা’, ড্রাইভারের পাশের সিট থেকে ধমকে উঠল অফিসার। ‘আগে এর ব্যবস্থা হোক।’ হাত দিয়ে ছেলেটিকে দেখাল। ‘তারপর তোমাদের ব্যবস্থা হবে, এখন চেঁচামেচি করো না, যাও।’

আর কেউ এগিয়ে এলো না। চলতে শুরু করল গাড়ি। হেড কোয়ার্টারের সামনের চত্বরে পৌঁছে গেল। টেনেহিঁচড়ে ছেলেটিকে নামিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয়া হলো। সামনে একটা টি টেবিলের পেছনে চেয়ারে বসে আছে ক্যাপ্টেন শান্তভাবে। মুখ দেখে তার মানসিক অবস্থা বোঝার চেষ্টা করল ছেলেটি। কিন্তু তেমন কিছু বুঝতে পারল না। ক্যাপ্টেনের ডান দিকে রাখা একটা টুলের ওপর তাকে বসানো হলো। তার পেছনে স্থির হয়ে দাঁড়াল দুজন অস্ত্রধারী গার্ড।

‘তারপর কেমন আছেন হিরো সাহেব?’ নিষ্ঠুর হেসে ব্যঙ্গাত্মক স্বরে জিজ্ঞেস করল ক্যাপ্টেন।

‘আলহামদুলিল্লাহ।’

‘তার মানে?’

‘আল্লাহ যেভাবে রাখেন, তাতেই সন্তুষ্ট।’

‘ওহ, তার মানে তুমি পাক্কা মুসলমান!’ গম্ভীর হয়ে বলল ক্যাপ্টেন।

‘ভালোই জানেন দেখছি।’

‘একসময় ক্যামব্রিজের ছাত্র ছিলাম, যাক গে তো হিরোইন কেমন আছে?’

কিছু বলল না ছেলেটি।

‘এটার উত্তর না হয় নাই দিলে, এটার উত্তরÑ তা হলো, সে কোথায় আছে?’

এবারো কিছু বলল না ছেলেটি।

‘তুমি খুবই চালাক মানুষ।’

‘আমি চালাক নই।’ মুখের ওপর জবাব দিল ছেলেটি।

কিন্তু রেগে গেল না ক্যাপ্টেন। বরং অট্টহাসি দিয়ে উঠল। হাসি থামিয়ে বললÑ

‘দুঃখিত, আমারই বলতে ভুল হয়েছে। তুমি চালাক নও, চালাক হয় শিয়াল। তুমি শিয়াল নও অতি ভদ্র মানুষ। শেষ তিনটিতে ব্যঙ্গ ঝরে পড়ল।

‘ভদ্র মানুষ কখনো চালাক হয় না, হয় বুদ্ধিমান। সশব্দে হেসে উঠল।

তাই তুমি অতি বুদ্ধিমান। থামল।

‘তুমি শুধু অতি বুদ্ধিমান নও, ভয়ঙ্কর সাহসীও। আর এ ধরনের বুদ্ধিমান-সাহসীরা মাঝেমধ্যে ফাঁদে পড়ে যায়, তোমারও হয়েছে সেই অবস্থা। কি ঠিক বলেছি?

ছেলেটি চুপ করেই থাকল।

মেয়েটিকে যে কাপড় পরতে দেয়া হয়েছিল, তাতে এক ধরনের সেন্ট দেয়া হয়েছিল। সে কোনোভাবে পালালেও যেন তাকে কুকুরের সাহায্যে দ্রুত ধরা যায়, মেয়েটি সে কাপড় পরেও ছিল। কিন্তু পালানোর সময় সেটি খুলে নিজের জামাটি পরে পালিয়েছে। নিজের জামাটি পরে পালানোর কথা নিশ্চয়ই তুমি তাকে বলেছ। কি, ঠিক বলেছি? জবাব দাও। এবারো কোনো জবাব দিল না ছেলেটি। তবে ক্যাপ্টেনের ক্ষমতা দেখে সে রীতিমতো আশ্চর্য হলো।

ঠিক আছে। জবাব দেয়ার দরকার নেই। কারণ জবাবটা আমার জানা। তবে সেন্ট ব্যবহারের ব্যাপারটা ধরতে পারা বেশ কঠিন ছিল।

ছেলেটি বুঝতে পারছে, তাকে নরম করার জন্য ক্যাপ্টেন চেষ্টা চালাচ্ছে। সতর্ক হয়ে গেল সে।

সকাল বেলা জানা গেল, মেয়েটি পালিয়েছে, বাংলোর পেছনে দুজন গার্ড বন্দী। তারপর দ্রুত খোঁজ নিয়ে জানা গেল তুমিও পালিয়েছ। দুয়ে দুয়ে চার মেলাতে কষ্ট হলো না। তারপর কুকুর নিয়ে সমুদ্রের কাছে পৌঁছেই আমাদের থামতে হলো। কারণ, কুকুর তোমাদের ট্রাস হারিয়ে ফেলেছে। এরপর অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তোমাদের ট্রাস পাওয়া যায়নি। তারপর বাধ্য হলাম, পুরস্কার ঘোষণা করতে। আজ সকালে সংবাদ পেলাম, তোমাকে সৈকতে ঘুমন্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে। যাক গে, এখন আসল কথায় আসি। বলে থামল ক্যাপ্টেন।

মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে গেল ছেলেটি যে কোনো পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার জন্য।

মেয়েটি কোথায়? চিবিয়ে বলল ক্যাপ্টেন। মুখের ভাবও পরিবর্তিত হলো।

জবাব দিল না ছেলেটি।

বুদ্ধিমানেরা জেনে-শুনে ভুল করে না, তাড়াতাড়ি বল। বলল ক্যাপ্টেন। এর মধ্যে সকালের নাশতা নিয়ে এলো একজন। আগে খেয়ে পরে কথা হবে। গলার স্বর নরম হয়ে এলো।

এতক্ষণে খেয়াল হলো, সে খুবই ক্ষুধার্ত। হাত ধুয়ে হাত বাড়াল ট্রের দিকে। তাকে যত্ন সহকারে বানানো গমের আটার পাঁচটি রুটি, কয়েক টুকরো পনির, কমলা ও আঙুর খেতে দেয়া হয়েছে। তৃপ্তি সহকারে খেল ছেলেটি।

পেট ঠান্ডা হলে নাকি মাথাও ঠান্ডা হয়। তো এবার মাথা ঠান্ডা করে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। এক মুহূর্ত থামল ক্যাপ্টেন।

মেয়েটি কোথায়, এবার উত্তর দাও। এবার শীতল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল।

ছেলেটির কাছ থেকে এবারও কোনো জবাব না পেয়ে ধৈর্যচ্যুত হলো ক্যাপ্টেন।

জবাব দাও। চমকে গার্ড দুজন একহাত পিছিয়ে গেল।

আমি বলব না। ছেলেটির কণ্ঠে এমন কিছু যা ক্যাপ্টেনকে স্তব্ধ করে দিল।

আর একবার ভেবে দেখ।

‘ভেবে দেখেছি।’

পেছনের গার্ড দুজনকে কী যেন ইশারা করল ক্যাপ্টেন। দুজনই এগিয়ে এলো। একজন চুল ধরে দাঁড় করাল ছেলেটিকে। অনেকদিন থেকে চুল না কাটানোর ফলে অনেক বড় হয়েছে। ধরতে সুবিধাই হয়েছে লোকটির। ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠতে গিয়েও চেঁচাল না। সহ্য করার চেষ্টা চালাল।

টেনেহিঁচড়ে তাকে সেই দুই খুঁটির মাঝে দাঁড় করাল। দুই হাত খুঁটির সঙ্গে বাঁধল শক্ত করে। বুঝতে পারছে সে তার ওপর কী ধরনের নির্যাতন চালানো হবে।

ছেলেটির সামনে এসে দাঁড়াল ক্যাপ্টেন। হাতে চাবুক। চুল খামচে ধরে ঝটকা দিয়ে মাথাটা সোজা করে ধরল ছেলেটির। এখনো সময় আছে, মুখ খোল, বল মেয়েটি কোথায়। মুখ কুঁচকে বলল ক্যাপ্টেন।

কোনো জবাব দিল না ছেলেটি।

বুঝেছি, সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না। বলেই শপাৎ করে চাবুক কষল ক্যাপ্টেন ছেলেটির গায়ে।

প্রচণ্ড আঘাত, কোনো রকমে সহ্য করল। মাথা ঝুলে পড়েছে। দ্বিতীয় আঘাতটা কোনোরকমে নীরবে ঠোঁট কামড়ে সহ্য করল। আল্লাহর কাজে এ নির্যাতন সহ্য করার ক্ষমতা প্রার্থনা করছে। তা না হলে জ্ঞান হারাতে চাচ্ছে। পরপর দশ-বারোটা চাবুকের ঘা গায়ে পড়তেই জ্ঞান হারাল ছেলেটি।

চাবুক মারা থামাল ক্যাপ্টেন। নিজেও খানিকটা হাঁফিয়ে উঠেছে। ইশারা করতেই চেয়ার এসে গেল। ছেলেটির সামনে চেয়ার নিয়ে বসল। চোখে-মুখে পানি দিয়ে জ্ঞান ফেরানো হলো তার। অনেকক্ষণ পর চোখ খুলে ক্যাপ্টেনের দিকে তাকাল।

কি, এবার মুখ খুলবে?

মাথা এপাশ-ওপাশ করে জবাব দিল ছেলেটি।

তুমি হয়তো জানো না, আমি যত শক্ত তত নরম। আমি তোমাকে শেষবারের মতো ঠান্ডা মাথায় ভাবার জন্য অবকাশ দিচ্ছি। আমি ইচ্ছা করলে তোমার কাছ থেকে কথা আদায় করার জন্য নানা ধরনের নির্যাতন করতে পারি। শুনবে, সেসবের বর্ণনা? থাক সে সব। তুমি অতি বুদ্ধিমান মানুষ, সামান্য একটা মেয়েকে পাওয়ার জন্য নিজের মৃত্যু ঘটাতে চাইবে না, বলে থামল ক্যাপ্টেন।

তার মনে? ক্যাপ্টেনের কথায় অবাক হয়েছে ছেলেটি।

তার মানে খুব সোজা। এখন সাড়ে বারোটা বাজে। তোমার সময় আজ বিকেল চারটা পর্যন্ত। এর মধ্যে মুখ খুলতে রাজি হলে বেঁচে গেলে, তা না হলে আজ বিকেলে তোমার সাড়ে বারোটা বাজানো হবে। তোমার পেছনে দেয়ার মতো সময় নেই, তাই আজই তোমার ঝামেলা মেটাতে চাই। কারণ তোমাকে ছাড়াও আমরা তাকে খুঁজে পাব। বলতে বলতে চেয়ার থেকে উঠে ছেলেটির সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল ক্যাপ্টেন। কথা শেষ করে একটু দূরে দাঁড়াল। তিনজন গার্ডের দিকে তাকিয়ে নিয়ে যাওয়ার ইশারা করল। হাতের বাঁধন খুলে দেয়া হলো। দুজন গার্ডের কাঁধে ভর দিয়ে এগোতে লাগল। পেছনে আছে একজন। যেসব জায়গায় চাবুকের ঘা পড়েছে, সেসব জায়গায় প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয়েছে। রক্ত জমে গেছে, ফেটে বের হলে ভালোই হতো।

বাংলোর নীচতলায় একটা ঘরে এনে ঢুকাল তাকে। একাই রেখে চলে গেল তিন গার্ড। বাইরে থেকে লাগিয়ে দেয়া হলো দরজা। দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। বসে মেঝেতেই। চারদিকে তাকাল। এই কামরায় ওপাশে বারান্দা নেই। জানালা আছে, লোহার মোটা শিক লাগানো। দরজা খোলা থাকায় বাথরুমের অংশবিশেষ দেখা যাচ্ছে। এছাড়া এ ঘরে আছে একটা খাট, একটা করে টেবিল-চেয়ার; ঘরের আসবাবপত্র বলতে এই। আর আছে একটা দেয়াল ঘড়ি। মেঝেতে অনেকক্ষণ পর বসে থেকে বিশ্রাম নিল। ঘড়িতে একটা বাজার এলার্ম বাজতেই উঠে পড়ল। বাথরুমে পানি আছে। অনেকক্ষণ পর বের হয়ে এলো বাথরুম থেকে। ঠান্ডা পানিতে গোসল করে ব্যথা, ক্লান্তি, দুর্বলতা অনেকখানি কমে গেছে। জোহরের নামাজ পড়ে শোয়ার জন্য কেবল বিছানায় চড়েছে, এমন সময় দরজা খুলে গেল। দুজন ভেতরে ঢুকল।

একজন খাবার ট্রে হাতে, অন্যজন গার্ড। কাঁধে রাইফেল।

মাছ দিয়ে ভাত দিয়েছে, সেই সঙ্গে আছে শাকসবজি। মাছটা সামুদ্রিক চেনে ছেলেটি। কিন্তু নামটা খেয়াল করতে পারল না। ওয়েটার ও গার্ড পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। তাদেরও জিজ্ঞেস করল না। খাওয়া শেষে ট্রে নিয়ে বিদেয় হলো দুজন। দরজা ওপাশ থেকে লাগানোর পর জানালার কাছে এসে দাঁড়াল ছেলেটি। তাকিয়ে দেখল বাইরে দুজন গার্ড এলএমজি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সে এই প্রথম এদের কাছে এলএমজি দেখল।

বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল। চোখ বন্ধ হয়ে গেল একসময়। দরজা খোলার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। উঠে বসল। ঘড়িতে দেখল, চারটা পাঁচ বাজে। বাথরুমে ঢুকে পড়ল। বাধা দিল না গার্ড তিনজন। প্রত্যেকের হাতে রাইফেল। বাথরুমে থেকে বেরিয়েই আছরের নামাজ আদায় করে নিল। চারটা বিশে ঘর থেকে বের হয়ে এলো। দুজন দুপাশে, একজন পেছনে। একবার তাকিয়ে দেখল, পেছনের গার্ড তার অস্ত্র বাগিয়ে ধরে রেখেছে। সকালের মতোই টি-টেবিলের ওপাশে একটা চেয়ারে বসে আছে ক্যাপ্টেন। তবে এবার তার জন্য টুলের বদলে চেয়ার রাখা হয়েছে। কেউ বসতে বলবে তার অপেক্ষা না করে বসে পড়ল ছেলেটি।

বিশ্রাম কেমন হলো? সহজ-সরলভাবে জিজ্ঞেস করল ক্যাপ্টেন।

ভালো। সংক্ষেপে জবাব দিল ছেলেটি।

চিন্তাভাবনা করার অনেক সময় পেয়েছ। এবার বল কী ঠিক করলে।

আমি মুখ খুলব না, ভেঙে ভেঙে জবাব দিল ছেলেটি।

কোনো ভাবান্তর ঘটল না ক্যাপ্টেনের। বরং হাসতে হাসতে বলল, দুদিনেরও বেশি সময় উভয়ে তো বেশ ভালোই কাটাল, দুদিন অনেক সময়, এবার তাকে আমার কাছে ফেরত দাও। বল এখন সে কোথায়…।

কথা শেষ করতে পারল না ক্যাপ্টেন। পাশেই বসে ছিল ছেলেটি। তার কথা সহ্য করতে না পেরে ঠাস করে চড় মেরে দিল ক্যাপ্টেনের গালে। মুহূর্তে মুখ থেকে হাসি উধাও হয়ে গেল ক্যাপ্টেনের। তবে ছেলেটিকে অবাক করে দিয়ে শান্ত হয়ে বসে থাকল। সঙ্গে সঙ্গে আঙুলের ছাপ বসে গেছে গালে।

লম্পট, নিজে যে মন-মানসিকতায় থাকে, অন্যকেও তাই ভাবে, নিজে চোর দেখে সবাইকে চোর ভাবে।

মিথ্যা অপবাদ দেয়ায় প্রচণ্ড রেগে গেছে ছেলেটি। দ্রুত রাগ দমিয়ে শান্ত হয়ে গেল।

ছেলেটিকে এভাবে শান্ত হতে দেখে ক্যাপ্টেনও অবাক হলো।

এখনো সময় আছে, ভেবে দেখ। মেয়েটির সন্ধান দিলে তোমাকে মুক্তি দেয়া হবে। তুমি যেখানে যেতে চাও, বহাল তবিয়তে সেখানেই তোমাকে পাঠানো হবে। ছেলেটি শান্ত হতেই তার দিকে শীতল দৃষ্টি হেনে বলল ক্যাপ্টেন।

এমনিতেই সে মেয়েটির সন্ধান দিত না। তার ওপর ক্যাপ্টেনকে থাপ্পড় মেরেছে, এখন মেয়েটির সন্ধান দিলেও তাকে সে ছাড়বে না। বরং তার অধীনস্থ গার্ডদের সামনে তাকে অপমান করার চরম প্রতিশোধ নেবে। এটা তার চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। চোখ তার প্রতিশোধের আগুনে ধিক ধিক করে জ্বলছে।

‘আবারও বলছি এখনো সময় আছে। সসম্মানে মুখ খোল’, এক মুহূর্ত থামল ক্যাপ্টেন।

তা না হলে আমার নব উদ্ভাবিত পন্থা তোমার ওপর প্রথম পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করব, মুখ খোলাব। এ ধরনের পন্থা হয়তো এর আগে আর কেউ আবিষ্কার করেনি। বলেই হো হো করে হেসে উঠল ক্যাপ্টেন। হাসি থামিয়ে বললÑ

সেটা অনেকেই এর মধ্যে জেনে গেছে, হয়তো এখানকার মধ্যে একমাত্র তুমিই জানো না, সেটা হবে তোমার জন্য চমৎকার এক সারপ্রাইজ, বলে আবার হেসে উঠল ক্যাপ্টেন।

কোনো কথাই বলছে না ছেলেটি।

শেষবারের মতো ভেবে দেখার পরামর্শ দিচ্ছি।

ধন্যবাদ, আমি বলব না।

তাহলে ভালোই হলো। তোমার ওপরই মুখ খোলার পন্থাটার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করব। গম্ভীর হয়ে গেল সে।

তুমি গাড়ি চালাতে জানো? প্রশ্নটা করল ক্যাপ্টেন।

ক্যাপ্টেনের হঠাৎ এ ব্যতিক্রমধর্মী প্রশ্নে বিপদের গন্ধ পেল ছেলেটি। সতর্ক হয়ে উঠল। সে কখনো মিথ্যে বলে না। হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলে হয়তো বিপদে পড়বে। কিন্তু সে গাড়ি চালাতে জানে। মিথ্যে বলবে কীভাবে? তবে কি সে এবার সত্য-মিথ্যার পরীক্ষায় নিপতিত হয়েছে! যা হওয়ার হবে, সত্যই বলবে।

‘কী হলো, জবাব দিচ্ছ না যে?’ ছেলেটির জবাব দিতে দেরি হচ্ছে দেখে বলল ক্যাপ্টেন।

‘হ্যাঁ, পারি’, সমস্ত দ্বিধা ঝেড়ে বলল ছেলেটি।

‘ঠবৎু মড়ড়ফ, ণড়ঁ ধৎব ধ ৎবধষু যড়হবংঃ সধহ, ঃযধহশং.’ আমার নব উদ্ভাবিত পন্থার এটাই একমাত্র দুর্বল দিক, অর্থাৎ কেউ যদি প্রশ্নের জবাবে বলে যে সে গাড়ি চালাতে জানে না, তবেই তার জন্য আমার এ পন্থা অচল। আসলে মানুষের সৃষ্টির মধ্যে একটা না একটা দুর্বল দিক থাকবেই, কিন্তু সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির মধ্যে দুর্বল দিক নেই’, বলে থামল ক্যাপ্টেন।

কোনো কিছু বলল না ছেলেটি। তাকিয়ে আছে একটু দূরে দাঁড় করিয়ে রাখা একটা ছাদ-দরজাবিহীন জিপের দিকে। জিপটা যে খুবই পুরনো তা দেখেই বোঝা যায়।

‘এবার শোন আমার নব উদ্ভাবিত মানুষের মুখ থেকে তথ্য বের করার পন্থাটা, এই পন্থা বেশ কিছুদিন আগেই আবিষ্কার করি এবং এর ওপর বেশকিছু দিন রিসার্চও করেছি, তবে প্রয়োগ করার সুযোগ এতদিন পাইনি, আজ তোমার ওপর প্রয়োগের সুযোগ পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করছি। এ তো গেল ভূমিকা, এখন আসল কথায় আস, বলে এক মুহূর্ত থামল ক্যাপ্টেন।

‘যেহেতু তুমি গিনিপিগ, এতএব তোমার জন্যই বলছি’, আবার থেমে শুরু করল।

‘এই যে পুরনো জিপটা দেখছ, ওটা সেকেলে আমলের হলে কী হবে, এখনো ভালোই চলে, তবে বর্তমানে ওটার ব্রেক ফাংশন ডাউন করে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ ওটা ব্রেকহীন জিপ, কী মজার তাই না?’

এতে ক্যাপ্টেন মজার কী পেল তা বুঝতে পারল না ছেলেটি।

‘তবে জিপটার অন্যান্য ফাংশন ঠিক আছে। আমি তোমার জন্য নিজেই চেক করেছি, চিন্তার কোনো কারণ নেই। এই জিপটাতে তুমি থাকবে এবং থাকবে একটা টাইম বোম।’

শেষের বাক্যটি শুনে ছেলেটি চমকে উঠল। ক্যাপ্টেনের কথা বিশ্বাস করতে তার কষ্ট হচ্ছে।

‘আরে ভয় পাওয়ার দরকার নেই, জিপে তোমাকে শুধু বসে থাকতে হবে না, তুমি জিপটা চালিয়ে এখান থেকে নীচে নামাবে।’

এবারের শেষ বাক্যটা শুনে ঘামাতে শুরু করল ছেলেটি। ব্রেকহীন গাড়ি নিয়ে সে কীভাবে পাহাড়ি পথ ধরে নীচে নামাবে! ‘নীচে নামার সময় তোমাকে জিপের ক্লাচ, গিয়ার ও এক্সিলেটরের সাহায্যে নামাতে হবে। তাও সন্ধ্যার পর, তোমাকে অবশ্যই গাড়ির সিটের সঙ্গে বেঁধে রাখা হবে এমনভাবে, যাতে তুমি গাড়ি থেকে নেমে যেতে না পারো।’ শান্তভাবে বলে চলেছে ক্যাপ্টেন, যেন ছোট বাচ্চাকে মিছেমিছি ভয় দেখাচ্ছে।

‘আর জিপে যে টাইম বোম থাকবে ওটার আরো একটা দিক আছে। সেটা হলো, বোমা বিস্ফোরণের যে সময়সীমা থাকবে তার অর্ধেকের মধ্যে যদি তোমার মতের পরিবর্তন হয়, তবে জিপে ওয়াকিটকি আছে, তার আছে, তার মাধ্যমে আমাকে জানাতে পারবে যে, তুমি মুখ খুলবে তাহলে……।’ বলে পকেট থেকে এন্টিনা লাগানো ছোট যন্ত্রটি বের করে আনল ক্যাপ্টেন।

আমি ক্ষমাপ্রার্থী, পর্ব- ১ 

আমি ক্ষমাপ্রার্থী, পর্ব – ২ 

আমি ক্ষমাপ্রার্থী, পর্ব – ৩ 

আমি ক্ষমাপ্রার্থী, পর্ব – ৪ 

আমি ক্ষমাপ্রার্থী, পর্ব – ৫ 

আমি ক্ষমাপ্রার্থী, পর্ব – ৬

আমি ক্ষমাপ্রার্থী, পর্ব – ৮

আমি ক্ষমাপ্রার্থী, পর্ব – ৯

আমি ক্ষমাপ্রার্থী, শেষ পর্ব

 

 

 

 

 

 

ঘোষণা- ‘আমি ক্ষমাপ্রার্থী’ উপন্যাসটির ১০ টি পর্ব শেষ হলে পুরো উপন্যাস থেকে একটি প্রশ্নোত্তর প্রতিযোগিতা হবে। অংশগ্রহণকারী পাঠকদের সর্বোচ্চ সঠিক উত্তরদাতাকে পুরস্কৃত করা হবে।

-নির্বাহী সম্পাদক

 

জাকির আহমদ
Latest posts by জাকির আহমদ (see all)