মুগ্ধতা ব্লাড ব্যাংকে আপনার দেওয়া তথ্য বাঁচাতে পারে একটি জীবন। আপনার তথ্য দিন, প্রয়োজনে রক্ত খুঁজুন এখানে।

ইতর

মাসুম মোরশেদ

১০ জুলাই, ২০২১ , ৪:৩২ অপরাহ্ণ ;

গল্প - ইতর - মাসুম মোরশেদ

১.

উপায় নেই, এই করোনাক্রান্তিকালে সন্তানদের জন্য শেষ পর্যন্ত ঈদের মার্কেটে যেতে হয়েছে শান্তনুসহ। প্রতিটি দোকানে প্রচণ্ড ভীড়। আসলে মানুষের আয় রোজগার বেড়েছে প্রচুর। কেউ টাকায় হারছে না। যত দামই হোক একটু দরদাম করেই পছন্দের জিনিসটি ঠিকই কিনছে। আর যাদের অবস্থা খুব ভাল, স্বচ্ছন্দে চলাফেরা করে তাদের বেশিরভাগই অনলাইনে কিনছেন বা একদরের দোকানগুলোতে কিনছেন। ধনাঢ্য, শিল্পপতিসহ সেলিব্রেটিরা দেশে শপিংটপিং করেন না, বিদেশবিভুঁইয়ে শপিং করে থাকেন।

বিভাগীয় শহর বলে এখানে এখন প্রচুর শপিংমল, সুপারসপ, বিভিন্ন ব্রাণ্ডের দোকান, যা আগে ছিল ঢাকা, চিটাগাং, এসব কিছু এখন আমাদের শহরে অনায়াসে মিলছে। ঈদের মার্কেটে স্বাস্থ্যবিধি মানার কোন বালাই নেই।সর্বত্র লোক গিজগিজ করছে। কেউ করোনাকে পরোয়া করছে না। শান্তনুর পীড়াপীড়িতে ছেলে দু’টির জন্য শেষ পর্যন্ত বের হয়েছি। আমি বিধি মানার চেষ্টা করলেও সে মানছে না। মেয়েদের গা ঘেঁষে, স্পর্শকাতর জায়গা ছোঁয়াটেপার বদখাসলত তার আছে। কারণ সে জন্মগত ইতর। তারই সাথে পুরোজীবন কাটাতে হবে আমাকে। যাকে ভালবেসে জীবন কাটাতে চেয়েছিলাম, সে টাকার লোভে তার এক কাছের আত্মীয়কে বিয়ে করেছে। ভেবেছিলাম, আর কোনোদিন কোনো ছেলের পাল্লায় পড়ব না।এমনকি সংসারেও জড়াব না। কিন্তু কোন বাবা-মা চায় না তার মেয়ে পরিত্যক্তার মতো ঘরে পড়ে থাক। গ্রামের মেয়ে হিসেবে মাস্টার্স করতে গিয়ে বয়সটাও ততদিনে গ্রামে মানানসই থাকেনি। শেষে এই শুয়োরটার সাথে জোড়া মিলেছে। সেও আমার গ্রামের মানুষ, আমরা একই গ্রামের বাসিন্দা হলেও কোনোদিন কেউ কাউকে দেখিনি। আমার মামা শ্বশুর বাবার বন্ধু।তিনি এটা জুড়ে দিয়েছিলেন। বিয়ে করতে আমাদের বাড়িতে এসে বাড়িতে আগত আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে কমবয়সী শালীদের সুযোগ বুঝে কায়দা করে আকারে ইঙ্গিতে অকথা, কুকথা বলেছেন। কানাঘুষা সারাবাড়িময়।তাদের কেউ কেউ সে কথা তখনই আমাকে বলেছেন। ভেবেছিলাম, রসিক বোধহয়। অন্যরা নতুন বর আর প্রভাবশালী পরিবার বিধায় কেউ কিছু বলেনি। আর কেউ চায় না বিয়ে বাড়িতে কোন গণ্ডগোল বা বিপত্তি। বিশেষ করে আমাদের মতো গরীব বাড়িতে বাবা-মারা তটস্ত থাকেন যাতে বাজে কোন পরিস্থিতি তৈরি না হয়।

২.

প্রচুর থ্রি-হুইলার রিক্সা, ভ্যান, টেম্পু শহরটা ছেয়ে গেছে। ফুটপাথও বেদখলে। পায়ে হাঁটার সুযোগ একদম নেই। কষ্ট করে করে ফাঁক ফোকর বের করে চলছে সবার নিত্য বাজার, ঈদের কেনাকাটাসহ প্রয়োজনীয় সব কাজ। পাঁচ বছর আগেও এটা ছিল সাদামাটা টাউন।

সুপার মার্কেটের গেটে শান্তনু তার কলেজ জীবনের এক বান্ধবীকে পেয়ে গেটের এককোণায় সরে গিয়ে গল্প জুড়ে দিয়েছে। এই ভীড়ে কেউ গল্প জুড়ে? পুরুষ জাতটাই এমন!মেয়ে মানুষ পেলে সুযোগ খোঁজে। দেখে মনে হয় জীবনে কোন মেয়ের সঙ্গ পায়নি বা মেয়ে মানুষ দেখেনি।

চাচ্ছিলাম, সাধারণ সৌজন্যতা দেখিয়ে কেটে পড়তে। কিন্তু শান্তনুই আগবাড়িয়ে ঢলে পড়ে কথা বাড়াচ্ছে। বাসায় ছেলে দুটিকে রেখে এসেছি। সে দুটোয় প্রচুর গলায় গলায় ভাব আবার প্রচুর মারামারিও করে। সারাক্ষণ তাদের দুজনের নালিশ। বিরক্ত লাগে কখনও। কিন্তু বেশ ভাল লাগে তাদের এসব। ওরাই আমার সব। ওদের জন্য এখানে পড়ে আছি। নইলে লাত্থি দিয়ে চলে আসতাম। একটা কাজ জুটিয়ে একা একা চলতাম।

সংসারের সব আমাকেই দেখতে হয়। কাজের মেয়ে আজিনা বাসায় আসার পর কাজ একটু কমেছে। রান্নাবান্না ধোয়ামোছার কাজ বেশিরভাগ সে-ই করে এখন। যদিও আমার কাজের লোকের একদম দরকার ছিল না।শান্তুনুই তার গ্রামের বাড়ি থেকে আমার কাজ করার কথা বলে এনেছে। আমার কাজের চাপ কমলেও শান্তিটাও ক্রমশ কমছে।

বললাম, আপু, ঈদে ছেলেমেয়ে, ভাইসহ বেড়াতে আসুন। এই কাছেই বাসা…

আচ্ছা আচ্ছা, বলে মোটাসোটা নাদুসনুদুস শ্যামলা সেই ভদ্রমহিলা কোমর দুলিয়ে হনহন করে চলে গেলেন। বয়স তার চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ হবে হয়ত। কিন্তু শরীরে এখনও পেলবতা আছে।প্লাজো পরেছেন আর সাদা কামিজ ফুঁড়ে লাল ব্রাটা পিছন থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল দূর থেকেও, বুকের দিকে ওড়না পরিপাটির কারণে সামনে থেকে সেটি বোঝা যায়নি।

শান্তনু কানের কাছে মুখ করে বলল, তোমার জন্য একটা লাল ব্রা নিও। সেই বিয়ের প্রথমে দেখেছি, অনেকদিন দেখি না।

কথা না বাড়িয়ে বললাম, আচ্ছা, চল।

সুপার মার্কেটেই ছেলেমেয়েদের কেনাকাটা শেষ হল।

ফেরার পালা।

বের হচ্ছি।

শান্তনু বলল, কি হল, ব্রা নিলে না যে? বললাম যে লাল ব্রা নাও।

-না, লাগবে না।সেসব আমি পড়ি না এখন, জানো।

-প্লিজ, নাও না। প্লিজ বিনয়ের সাথে বলল না সে এবং সেটাই তার স্বভাব।

বুঝলাম, সেই মোটাসোটা নাদুসনুদুস শ্যামলা মহিলা তার মাথায় ঘুরছে।

বললাম, চল, উপরে চল। ঐ পশ্চিমের কোণার দিকে কয়েকটা দোকান আছে।

৩.

শান্তনুর সারামুখে হাসি। চোখ দুটো তার অন্ধকারে দেখা কুত্তার মতো পিটপিট করে জ্বলছে। প্রথমেই একটা বড়সড় সেসবের দোকান। পুরুষ মানুষ ভিতরে। শান্তুনু পেছালো সেখান থেকে। আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল তার পরে ছোট্ট দোকানটাতে। প্রচুর কালেকশন তার। শোকেস, র্যাকে প্রচুর ব্রা,প্যাণ্টি, ব্লাউজ।মহিলা বিক্রেতা সেটাতে। শান্তনুই আগ বাড়িয়ে আঙ্গুলে দেখিয়ে বলল, লাল দিন, ম্যাডাম, আটত্রিশ।

কয়েকটা এগিয়ে দিল ভদ্র মহিলা। সব নেড়েচেড়ে দেখছে সে পুলকিত মনে।

সে আমার মাপ জানে। মনে মনে সে সবার মাপে, জানি। তুলনাও করে। কিছু বলি না।বলতে পারি না। তাই সেসব কথা তার নিত্য বাড়ে। গত সপ্তাহে বিছানায় সে তার ছোট খালার কথা বলেছিল। ছি, বলে লজ্জায় ঘৃনায় একদলা থুতু একটু হেলে জানালার গ্লাস সরিয়ে ওয়াক থু বলে ফেলেছি। সে আমার ঘেন্নাটা বুঝেছিল। পরে হাত মুখ ধুয়ে এসে বলে,খুব রাগ তোমার না? আর কোনদিন এমন করলে খুব খারাপ হবে, বুঝলে? মজা নাও, মজা দাও, বুঝলে বলে আমাকে কড়া শাসানী দিয়ে শুয়ে নাক ডাকতে শুরু করল। ইচ্ছে করছিল রান্নাঘর থেকে বটি এনে গলায় বসিয়ে দিই।

শুয়োর একটা!

ইতর একটা!

ম্যাডাম, দিন প্যাকেট করে।

শান্তনু বলল। বলে দাম চুকিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে বলল সে, দেখছ দোকানে সেলসওম্যানকে? বুকে কিছু নেই। বয়স কত আর হবে, খুব জোর ত্রিশ, পঁয়ত্রিশ। হয়ত বিয়ে হয়নি বা বর কোথাও চলে গেছে ছেড়ে। বর বা বয়ফ্রেণ্ডের হাত পড়েনি নিশ্চয়। বেচারী, জীবনের কিছুই পেল না। বলে সে আফসোস করতে লাগল। হুম বলে মাথা নেড়ে সায় দিলাম।

৪.

একদিন ঝড়ের রাতে মোবাইলে পর্ণ দেখছিল সে। আমি ঘুমে বেঘোর। সে জবরদস্তি ডেকে তুলল। ভাবলাম, তার শরীর বোধহয় খারাপ।তার কপাল নেড়ে দেখলাম, সব ঠিক আছে। সে রাগ হয়ে বলল, শুইলেই লাশ হও নাকি?

-কেন, কী হল?

-না, কিছু না।বলে হো হো করে হাসতে লাগল সে। পাগল হল নাকি, ভাবছি।

-দেখ, দেখ, বলে ফোনসেটটা এগিয়ে দিলো সে।দেখি লম্বা চওড়া এক সাদা মেয়ে, বুক বসে যাওয়ার মত। অতবড় মেয়ে কিন্তু বুকটা বসে যাওয়া।ছুঁড়ে দিয়ে বললাম, ছি, এসব আমাকে দেখাচ্ছো কেন? এসবে কোনদিন আগ্রহ দেখিয়েছি? যাও, সেসব মেয়ের কাছে। বাড়িয়ে দাওগে। বলে, শুয়ে পড়লাম। ঘৃণায় ইচ্ছে করছিল তার গায়ে বমি করে দিই।

পারি না।

আমি অসহায়।

জানি, ঘর আর বাজার সবখানে তার মাথায় এক। প্রতিকারও করতে পারবো না। মেনে নিয়ে চলছি সব।

৫.

কতদিন এসব পরি না। ঈদের দিন বিকেলে শান্তনুর অয়ারড্রব তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পেলাম না। কোথায় রেখেছি তবে? না, স্পষ্ট মনে আছে ইতরটার অয়ারড্রবের নিচের চেম্বারে রেখেছি। এসব আমার অয়ারড্রবে রাখবো না, জানি।আমার অয়ারড্রবের চারটি চেম্বার তন্ন তন্ন করলাম।

না, পেলাম না।

ভুলে ছেলেদের অয়ারড্রবে রাখিনিতো?

ছি,ছি, আমার কি মাথা খারাপ হয়েছে নাকি? না, সেটা কখনও করবো না, জানি।

তবে?

আবার খুঁজলাম ইতরটার ভয়ে।

বুক ঢিপ ঢিপ করছে।

গা কাঁপছে।

জ্বর আসবে বোধহয়। খুব গরমে ঠাণ্ডা হিমহিম লাগছে। ফ্রেস হতে ছাদে গেলাম। এপাশ-ওপাশের সবুজ প্রকৃতি দেখছি। সবখানে আনন্দ, চতুর্দিকে আনন্দ।

ঈদ, আজ ঈদ।

শুধু আমি ভয়ে সেঁটে আছি। চেনাশোনা সে অত্যাচারের ভয়ে আগাম কুঁকড়ে পড়ছি।

সিঁড়ি বেয়ে নামব হঠাৎ ছাদের কাপড় শুকানোর তারে দেখি, লাল ব্রা-টা ঝুলছে। ওপরতলার ভাড়াটিয়ারা ঈদের ছুটিতে তাদের গ্রামের বাড়িতে গেছে আজ চারদিন হল। সেটা নেড়েচেড়ে দেখি, সেই সাইজ।জ্বরটা দ্রুত কমছে।শরীরটা নেতিয়ে পড়ছে। ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামছি।

মাথা টলকাচ্ছে।

পড়ে যাবো হয়ত।

ভাবছি, সেই ভাল। পড়ে যাই, মরে যাই। কিন্তু ছেলে দুটোর মুখ চোখেমনে ভাসছে। প্রার্থনা করি, ছেলে দুটো যেন বাবার মত না হয়। অন্তত বিবেকবোধসম্পন্ন মানবিক মানুষ হয়। আল্লাহ কবুল কর।

কবুল কর।

কবুল কর।

কাজের মেয়েটি দেখতে পেয়ে দ্রুত তার বুক ঝাঁকিয়ে ছুটে আসছে সিঁড়ি বেয়ে উপরে আমাকে ধরবে সে।

আম্মা, আম্মা বলে ডাকছে আর আমার দিকে দৌড়ে আসছে।আচ্ছা, এই মেয়েটিরও সাইজ কি আটত্রিশ হল?

আহা, কী পোড়া কপালী তুই রে!

দুমুঠো ভাত তোর বাবা-মা যোগাড় করতে না পেরে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিয়েছে।কোনদিন হয়ত শান্তনু গৃহপালিত একটা বর যোগাড় করে দিবে।যে তোর দায়িত্ব নিতে পারবে না। রাত বিরাতে ঠিক তোর মাংস খুবলে খাবে দুই মানুষে।

একটা খচ্চর, বজ্জাত হতে পারে।

আর একটা ইতর!

একটা ঘরের, একটা পরের।

কী পোড়া কপাল তোর!

মনে মনে কত কী ভাবছি মেয়েটার জন্য।তাড়াতে পারলে ভালো লাগত আমার। ঘরের কাজ সে সেরে নিতে পারতাম, সমস্যা হতো না।কীভাবে তাড়াবো, কোথায় যাবে সে?

ইতররাতো তো সর্বত্র।

Latest posts by মাসুম মোরশেদ (see all)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *