পর্ব-৩
নীল সাপ
নীচের লন্ড্রিতে কাজ করছিল উষা। হঠাৎ জেমির আওয়াজ পেয়েই দৌড়ে উঠে গেল। কোথায় ছেলেটা? মা মা করেই যাচ্ছে। তার মনে হলে আওয়াজটা উপর থেকে আসছে। তাকিয়ে দেখল আসলেই তো। সিলিংয়ের কাছের সবচেয়ে উপরের কাবার্ডটায় ঝুলে আছে জেমি। মাথার খুব কাছে একটা অসম্ভব সুন্দর সাপ। সাপ এতো সুন্দর হয় কী করে? সমুদ্রের নীল রঙের মাঝে সাদা ছোপ ছোপ! সে কি ঠিক দেখছে? শরীরে একটা গাঢ় হিম শীতল কিছু বয়ে গেল। হাত-পা ভীষণ কাঁপছে। ব্রেনের কোন তলানি যেন পাচ্ছে না, আছে কি নেই। বাচ্চাটাকে সে বাঁচাবে কী করে? ছেলেটা কান্না করে মা মা বলেই যাচ্ছে। হঠাৎ হাতের কাছে জেমির বলটা পেয়ে গেল। সাপের দিকে ছুঁড়ে দিয়েই, এক লাফ দিয়ে ছেলেকে কোলে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে এক দৌড়। ভীষণ হাঁফাচ্ছে সে। ছেলেটা এঁটে জড়িয়ে ধরে আছে। এতো ভয় সে জীবনেও পায়নি। রাস্তায় কোন লোক নেই। উষা কী করবে বুঝতে পারছে না। মোবাইল, চাবি, ব্যাগ কিছুই নেয়ার কথা মাথায় আসেনি। উপায়ও ছিল না। এমন সাপ কখনোই দেখেনি সে। অস্ট্রেলিয়ার বেশ কিছু শহরে সাপ আছে তবে এই শহরে সাপের কথা শুনেনি কখনো। বাসার কাছেই দাঁড়িয়ে আছে সে, সান যদি চলে আসতো এই সময়!
প্রায় ঘন্টাখানেক পরে সে শুনতে পায়-তোমরা এখানে কেন? কী হয়েছে?
সত্যি সত্যিই সান চলে এসেছে কাকতালীয়ভাবে। সানকে কেমন করে যেন ওদের বিপদ, সমস্যাগুলি তাড়া করে। এর আগে একবার উষা হঠাৎ করেই খুব অসুস্থ হয়ে গেল। জেমি তখন দুই বছরের। প্রেসার হঠাৎ করে লো হয়ে পড়ে গেল। মোবাইল নেয়ার মতো অবস্থা নেই। বাসায় আর কেউ নেই। বাচ্চাটা আরেক ঘরে খেলছিল। ঠিক আধা ঘন্টার মধ্যে সান বাসায়। একটা ফাইল ছেড়ে গিয়েছিল। ঠিক সে সময় না হলেও চলতো। কিন্তু তার নাকি কেমন ধরণের একটা অনুভূতি হচ্ছিল, যেটাকে ইংরেজিতে গাট ফিলিংস বলে, মানে মানসিক কোন চাপে পেটে মোচড়ের ফিলিংস! সানকে ঘটনা বললো উষা। ভয়ে, অনিশ্চয়তায় ওদেরকে জড়িয়ে ধরে রাখল বেশ কিছুক্ষণ। তারও বুক ধড়ফড় করছে। কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না, সাপ কোথা থেকে এলো আর কী করার আছে তাদের এখন। বাচ্চাটা বাবাকে ধরে এতাক্ষণে কথা বলে উঠলো।
-বাবা, সাপ, আ জায়েন্ট স্নেক!
-হ্যাঁ বাবা। আমরা ওটাকে তাড়িয়ে ফেলব। অনেক ভয় পেয়েছ?
মাথা নাড়িয়ে আবার কোলে ঢুকে গেল। এরমধ্যেই ট্র্যাগাসের উফ্ উফ্ শুনতে পেল তারা। জেলান খুব কাছেই আছে। সানকে বললো,
-ট্র্যাগাসের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছ?
-হ্যাঁ তাইতো। জেলান কাছেই আছে তাহলে, ওইদিকটায় মনে হচ্ছে। ভদ্রমহিলা খুব বিচক্ষণ আর সাহসী, ভালোও। ওর সাথে আলাপ করে দেখা যায়, কোন পরামর্শ পাওয়া যেতে পারে।
-তুমি জেলানকে চেনো?
-হ্যাঁ। তোমার জন্মদিনে সকালে ফুল কিনতে বের হলাম, ফেরার পথে জেলেনের সাথে দেখা। খুব আন্তরিক সে। নিজেই আমার সাথে কথা বলে পরিচিত হলো। ট্র্যাগাসও ঘুর ঘুর করছিল আমার চারদিকে। জেমির সাথে খুব খাতির হয়েছে বললো।
উষা এখন ধরতে পারল ঐদিন জেলেন কী করে তার জন্মদিন জেনে শুভেচ্ছা জানিয়েছিল।
জেলেনকে দেখা যাচ্ছে। কাছে আসতেই শুভেচ্ছা বিনিময় হলো। আজ একটা সাদা জামা পড়েছে সে। জেমি ট্র্যাগাসকে পেয়ে খেলতে শুরু করে দিয়েছে। যাক বাচ্চাকে একটু ভয়টা থেকে বেরিয়ে আসুক।
সব শুনল জেলেন। আপত্তি না থাকলে ওর বাসায় যাওয়ার জন্য বললো। ‘স্নেক রেসকিউয়ার’কে ফোন করে আসতে বললো। ওর বাসা খুব কাছেই। ওরা আসতে আসতে একটু রিলাক্স করার জন্য জেলেনের বাসায় গেল ওরা।
প্রায় আধা ঘন্টা পর কল এলো। বাসা খোলা ছিল । স্নেক রেসকিউ থেকে তিনজন এসেছে। অনুমতি লাগবে। আরও আধা ঘন্টা পর কল দিলে বাসার সামনে গেল ওরা। কোন সাপ খুঁজে পায়নি। তবে একটা নীল রঙ্গের খোলস খুঁজে পেয়েছে। সেটার আকার দেখে ওরাও খুব অবাক। সাপের জাতি বর্ণ সম্পর্কে কোন ধারণা করতে পারছে না। গবেষণার জন্য নিয়ে যাবে বললো। সুরক্ষার জন্য কিছু পাউডার, স্প্রে, ওষুধ দিলো। সাপটা দেখতে পেলে কল দিতে বললো। এখানকার মানুষগুলির জন্য এটা আতংকের বিষয় না। ছোটবেলা থেকে স্কুলিংই সাপ সম্পর্কে জেনে নানান সময় কোলের মধ্যে নেওয়ার অভ্যাস হয়ে যায় এদের। কিন্তু উষা ও সান কেমন করে বোঝায়, হাজার কিছু জয় করার সাহস বাঙালীর থাকলেও সাপের ভয় জয় করার নেই। দুজনেই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলো শুধু। এই বাসায় তো তারা আর ঘুমাতে পারবে না ভয়ে। এই কথাটা কেউ বলতে পারল না। দুজনই একসাথে বেচারা জেলেনের দিকেই তাকালো। ট্র্যাগাস আর জেমি চুপটি করে ভদ্র বাচ্চার মতো বসে আছে।
(চলবে)