একটি মৃত্যুর পরপরই ঘটতে শুরু করলো যতসব অদ্ভুত ধরনের ঘটনাসমূহ। শহরের হৃদপিণ্ড ছেড়ে গহিনগ্রামে নেমে এলো যেন বিপুল বিবর্তন। বিবর্তনবাদীদের বিবেক যেন জেগে উঠলো অজস্র অশ্রুঅঞ্জলির পর।
যেখানে সামান্যতম স্বাস্থ্যসেবা পেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সুদীর্ঘ অপেক্ষায় ভাসিয়ে দিতো হতো স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কদর্য কড়িডোর। সেখানে উন্নত সাস্থ্যসেবার সমূহ সরঞ্জামাদির সৌন্দর্যে ভরে উঠতে থাকলো কড়িডোরের করুণ কদর্যতা ভেঙে।
যেখানে একজন এমবিবিএস ডাক্তারের জন্য রাতের পর রাত যন্ত্রণাদগ্ধ বিত্রস্ত চিৎকার শুয়ে থাকতো স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বিবর্ণ বেডে। সেখানে বিত্রস্ত চিৎকার চূর্ণ করতে বেডের বিবর্ণতার বাগানে নেমেছে যেন ডাক্তারবৃষ্টি। সেবিকা, স্টেথেস্কোপ, অক্সিজেনভর্তি সিলিন্ডার আর পর্যাপ্ত মেডিসিনে যেন সামান্যতম স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি হয়ে উঠেছে একটি নাগরিক হাসপাতাল।
যেখানে একজন জনপ্রতিনিধির সাক্ষাৎ পাওয়া মানে ছিলো ঈদের চাঁদ হাতে পাওয়া। যেখানে একজন সিভিল সার্জনের আগমনকে তুলনা করা হতো দূরের কোনো দেবদূতের উপস্থিতির সঙ্গে। সেখানে দল বেঁধে সমবেত হচ্ছেন জনপ্রতিনিধিগণ। সেখানে এসির হাওয়া হাঁকানো মাইক্রোবাস চেপে সুদূর রাজধানী থেকে আসছেন স্বনামধন্য সিভিল সার্জন মহোদয়।
এসব চুম্বকের মতো টেনে এনেছে ওই একটি মৃত্যুই। ওই একটি মৃত্যুর ঘূর্ণিঝড়ে যেন এতদিনের ধ্যান-ধারণা, ধর্ম-কর্ম আমূল বদলে যাচ্ছে।
মৃত্যুতে এত শক্তি থাকে! মৃত্যু কি খুবই শক্তিশালী! কোথায় থেকে পায় সে শক্তি? কেউ জানি না শক্তির সেই উৎস। কেবল টের পাই। কেবল নিজের ভেতরে উপলব্দি করতে পারি তার বলিষ্ঠতা, তার সক্ষমতা, তার উজ্জ্বলতা, তার উদার ঐশ্বর্য যেভাবে টের পেয়েছিলাম বায়ান্নে। যেভাবে উপলব্ধি করেছিলাম উনসত্তরে, একাত্তরে।
বায়ান্নে শুনেছি এই শক্তির পরাক্রমশীল চিৎকার। যার বদলে পেয়েছি কৃষ্ণচূড়ার মতো দুঃখিনী বর্ণমালা। একাত্তরে দেখেছি এই শক্তির প্রবল স্রোত। যার প্রবাহে পেয়েছি রক্তজবার মতো এই ভূখণ্ড।
কতো মহৎ ছিলো সেই মৃত্যুসমূহ। কতো প্রস্তুতি ছিলো সেই মৃত্যুর জন্য। কিন্তু এই মৃত্যুর জন্য সেভাবে কেউ প্রস্তুত ছিলাম না। এভাবে অনাকাঙ্খিতভাবে ধেয়ে আসবে একটা অচেনা দোটানার মৃত্যু, কেউ ভাবতেই পারি নি। কস্মিনকালেও না।
বিবিধ বিবর্তনে পুরো এলাকা যেন বদলে গেছে এই একটি মৃত্যুর ছোঁয়াচে আলোয়। হাঁচি-কাশি দিলেই রুমালে মুখ ঢাকছেন তারাই, যারা এতদিন এগুলো যৎসামান্যভেবে জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন যুগের যুগ। বারবার সাবান, সোডা বা ছাই দিয়ে হাত পরিস্কার করছেন তারাই, যারা গবাদি পশুর মলমূত্র নেড়ে হাত না ধুয়েই আহার করতো এতকাল। মসজিদে না আসতে নিষেধ করছেন তারাই, যারা মসজিদে আসার জন্য ওয়াজের ওজনে কানভারি করে তুলেছেন মুসলমানদের।
যততত্রভাবে চায়ের দোকানগুলো খোলা নেই। বাইরে বেরোলে মুখে মাস্ক পড়ে বেরোচ্ছেন মানুষজন। কতোটা সতর্কভাবে বেঁচে থাকার কৌশল খুঁজছেন, কতোটা কসরত করছেন শহরের হৃদপিণ্ড ছেড়ে গহিনগ্রামের অধিবাসীরা। ও মৃত্যুই যেন পরশ পাথরের মতো ফুটে উঠেছে গহিনের বুকে আজ।
বাবা এভাবে চলে যাবেন মানতেই পারছি না। বিশাল বটবৃক্ষের মতো ছায়ার সিনার ভেতর উনি আমাদের আগলে রেখেছিলেন। আমাদের মুখ ফসকে একটি ‘উঃ’ উদগত হলে উনি উচ্চকিত হয়ে পড়তেন। সেতুর কাজ শেষ হলেই শুভ কাজে হাত দিতে চেয়েছিলেন চায়না আপার। বাবা এভাবে চলে যাবেন মানতেই পারছি না। দশম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত কালো গোলাপের মতো শোকাচ্ছন্ন সহেলি বলেই মুখে ওড়না আওড়ায়।
সেতুর পাইলিংয়ের কাজ শেষে সেদিন বাবা সন্ধ্যায় ঘরে ফিরেই খুব অস্বস্তিবোধ করছিলেন। আস্তে আস্তে অচেনা অসুস্থবোধে বোধ হারাচ্ছিলেন। দিগন্তের বলয় থেকে রাতের রেখা মুছতে না মুছতেই এই অচেনা অসুস্থবোধের অশ্ব যেন আরও বিগড়ে গিয়েছিলো। ঘোরের খুর থেকে গোপন সংশয় ফেনায়িত শরু করলো আমাদের অস্থির অন্তরে। আমরা ওনার এ অস্বস্তি আর অসুস্থবোধের নাম দিলাম জ্বর। স্বাস্থ্যকেন্দ্রেও ওনাকে একই নামে ডাকা হলো। উনি গোঙানির ভেতর থেকে নমুনা পরীক্ষা করবার জন্য বারবার স্বাস্থ্যসেবিকার দিকে অনুরোধের আঙুল তুলছিলেন। আমরাও এগিয়ে এসেছিলাম নমুনা নিয়ে নম্রতায় নুতজানু হয়ে।
এই নাম আমাদের চেনাশোনা। এতে কোনো গুরুতর সমস্যা নেই। আপনি বাড়িতে যান। নিয়মিত ওষুধগুলো খান। আপনার সমস্ত অস্বস্তি আর অসুস্থবোধ বোধহীন হয়ে যাবে বধিরের মতো। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সেবিকা বলেছিলেন খুব আত্মবিশ্বাসের তরঙ্গে দুলতে দুলতে। কোথায় সে সেবিকা? কোথায় তার সেই আত্মবিশ্বাসের তরঙ্গ? খুব ক্রোধ আর ক্লেদাক্ত কণ্ঠে বলছিলো ঘোড়াশাল কলেজে সদ্য স্নাতকে ভর্তি হওয়া আয়মান নামক কোনো এক টগবগে তরুণ।
বাতাসের বাগান থেকে কেমন হুহু মাতমের গন্ধ ভেসে আসছিলো মৃতের বাড়িতে। সূর্যটা যেন নষ্ট ডিমের কুসুমের মতো মাথার উপর দিয়ে পশ্চিমে প্রবাহমান। বাইরের ধূসর আর ধূ-ধূময়তার ভেতর থেকে কয়েকজন সাংবাদিকের সংঘবদ্ধ পায়ের আওয়াজে তুমুল নৈঃশব্দ্যে ঢলে পড়া বাড়িটা যেন খানিক জিজ্ঞাসাবাদের কোলাহলে কলকলিয়ে ওঠে। আদিবার অনিদ্রিত মুখের দিকে তাকিয়ে পর্যায়ক্রমে প্রশ্ন ছুঁড়তে থাকলো প্রফেশনাল সন্দেহবাদিরা। আদিবা ঘটনার আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত বিরবির বিবৃতি দিতে দিতে হাঁফিয়ে উঠেছেন হয়রানির হাঁফরে।
সত্য বিবৃতিগুলো ক্রমেই মিথ্যের মিথস্ক্রিয়া ছড়াতে থাকে। হারাতে থাকে সত্যের সহিষ্ণু শক্তি। আমরা মৃতের রক্তের নমুনা পরীক্ষা করে জেনেছি যে, ওনার শরীরে ও ধরনের কোনো আলামত পাওয়া যায় নি। প্রথমে রোগত্বত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে জানানো হলো এই মিথ।
তাহলে মরে গেলেও অপরাধ পরীক্ষা করবার জন্য কেবল রক্তই যথেষ্ট। রোগত্বত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিবৃতি সম্প্রচারের পর অপরাধীদের ভেতর অদ্ভুত সন্দেহ জেগে উঠতে থাকে।
ওনার মৃত্যু স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হয়েছে। উনি দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিস, হেপাটাইটিস আর হৃদরোগসহ সমূহ রোগে ভুগছিলেন। তা ছাড়া বয়স ষাটের উর্ধ্বে হওয়ায় ওনার মৃত্যু হয়েছে। ওনার শরীরে ও ধরনের কোনো আলামত পাওয়া যায় নি, যে ধরনের আলামত আমরা অনুসন্ধান করছিলাম। আপনারা ভীত হবেন না বলেই সার্জন রুমালের রন্ধ্রে নাকের সুড়ঙ্গ বেয়ে উঠে আসা হাঁচিটাকে লুকোনোর চেষ্টা করেন। তখনও এসির হাওয়া হাঁকানো গাড়িতে বসে ড্রাইভার রাজধানীর উদ্দেশে সার্জনের জন্য অধীর অপেক্ষা করছিলেন।
অধিকাংশ রাষ্ট্র নেতাদের বয়সই তো ষাটের উর্ধ্বে। তাহলে আমাদের রাষ্ট্র হুমকির মুখে নয় কি! সিভিল সার্জনের বিবৃতি শোনার পর থেকেই এরকম মনে হতে থাকলো প্রত্যেক নাগরিকের।
সরকার আপানাদের পাশে আছেন। কোনো প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বেরোবেন না। সরকারি ত্রাণ তহবিল থেকে হত দরিদ্রদের মাঝে খাবার বিতরণ করা হবে। অজস্র অশ্রুমঞ্জরির প্রতি দানশীল আচরণ প্রদর্শন করতে করতে শ্লোগানে রাস্তায় নেমে পড়েন জনপ্রতিনিধিগণ ।
আপনারা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন। ঘরে থাকুন। প্রবাসফেরতরা হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকুন। গুরুতর লক্ষণ দেখা গেলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। প্রশাসন আপনাদের দায়িত্বশীল আচরণের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন এবং থাকবেন বলেই ইউএনও মহোদয় মাস্কের মহত্ত্বে মুখ ঢেকে মঞ্চ থেকে নেমে ব্যস্ত হয়ে পড়েন মৃতের দাফনে।
সাড়ে তিন হাতের শূন্যতা নিয়ে কী এক করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কোনো এক গর্তের গহিন। আস্তে আস্তে ক্রেনে করে নামানো হচ্ছে রাতারাতি সব বদলে দেওয়া সেই মহত্তর মরদেহ। অনার্য কোদালের কদর্য কোপের প্রতাপে ঝরছে মিহি মাটিমণ্ডল পৃথিবীর পিঞ্জর খসে খসে। আস্তে আস্তে তার প্রাচীন পালকে ঢেকে যাচ্ছে বিস্মৃত মুখমণ্ডল। সাড়ে তিন হাতের শূন্যতার সুড়ঙ্গে পতিত হচ্ছে সত্যের সৌকর্য। অন্ধকারে মুছে যাচ্ছে বিগত দিনের রেখাবলি। তারই অনন্ত আভা আর আস্তরণে আচড়ে পড়ছে অন্যান্য অন্ধকারও।
এই আশ্চর্য অন্ধকারে ফরিয়াদ করতে করতে পাখিগুলো ম্যাজিশিয়ানের মতো মিলে যায় সান্ধ্য মেঘমণ্ডল বিদীর্ণ করে কোনো এক দূরতমে…
রেজাউল ইসলাম হাসু
লেখক : তরুণ সাহিত্যিক।
প্রকাশিত বই দুইটা।
এক. ওকাবোকা তেলাপোকা (২০১৬) -শিশুতোষ
দুই. এলিয়েনের দেশ পেরিয়ে (২০১৭)-শিশুতোষ।