মুগ্ধতা ব্লাড ব্যাংকে আপনার দেওয়া তথ্য বাঁচাতে পারে একটি জীবন। আপনার তথ্য দিন, প্রয়োজনে রক্ত খুঁজুন এখানে।

একাত্তরের উত্তাল মার্চ: রংপুরের দিনগুলোগল্পের ছলে ইতিহাসের অনন্য পাঠ

মজনুর রহমান

১ জুলাই, ২০২১ , ১০:৫১ অপরাহ্ণ

একাত্তরের উত্তাল মার্চ রংপুরের দিনগুলো গল্পের ছলে ইতিহাসের অনন্য পাঠ.png

১৯৭১ এর মার্চ মাস মুক্তিযুদ্ধের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এর মধ্যে বিরাট এক অংশজুড়ে আছে রংপুর। এই রংপুরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে প্রথম গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান কিশোর শঙ্কু। এই রংপুরে ২৪ মার্চ সেনাবাহিনীর দুর্ধর্ষ এক ইউনিটকে প্রতিরোধ করেছিল দেশপ্রেমী জনতা এবং এখানেই ২৮ মার্চ সংঘটিত হয় আরেক অবিস্মরণীয় ইতিহাস।

এদিন তির-ধনুক লাঠিসোটা নিয়ে রংপুর ক্যান্টনমেন্টের মতো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক দুর্গম ঘাঁটি আক্রমণ করেছিল বীর জনতা। এমন নানা ঘটনা ছড়িয়ে আছে ইতিহাসের পড়তে পড়তে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তাই রংপুরের ইতিহাসকে বাদ দিয়ে কোন মতেই সম্ভব না।

অন্যদিকে রংপুরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বেশকিছু গবেষণাধর্মী লেখা লিখিত হলেও শুধু মার্চ মাসের রংপুরের ইতিহাস নিয়ে ব্যাপক ভিত্তিক কোন কাজ চোখে পড়ে না।

এদিক দিয়ে একটি অনন্যসাধারণ কাজ করেছেন লেখক রানা মাসুদ।

বইটির নাম ‘একাত্তরের উত্তাল মার্চ: রংপুরের দিনগুলো’। না প্রবন্ধ না উপন্যাস-এমনই এক অদ্ভুত ঢঙে ইতিহাসের গল্প বলা যায় তা আগে তেমন একটা চোখে পড়েনি।

বইটির কেন্দ্রীয় চরিত্রে দেখা যায় ফারজানা ও রিয়াদ আনোয়ার শুভ নামে দুই তরুণ-তরুণীকে।

এই দুজন এখানে মূলত ইতিহাসের সুযোগ সন্ধানী দুটি চরিত্র, যারা দেশকে ভালোবেসে বিশেষত রংপুরকে ভালোবেসে ইতিহাসের নানান অলিগলি ঘুরতে পছন্দ করে। এদের মুখেই লেখক বর্ণনা করেছেন মুক্তিযুদ্ধের শুরুর একটি মাসের ইতিহাস।

পহেলা মার্চ থেকে শুরু করে ক্রমান্বয়ে ঘটনাক্রম এগিয়ে গেছে ৪ এপ্রিল ১৯৭১ পর্যন্ত।

ফারজানা তার বাবার একটি ডায়েরি পায়। তার বাবা মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ঢাকা থেকে রংপুরে তার পৈতৃক বাড়িতে এসে আটকা পড়ে যান। আটকাবস্থায় রংপুর শহরের কেন্দ্রস্থলে বসবাস করে তিনি এই অঞ্চলের বিভিন্ন ঘটনা নিজস্ব অনুভূতি তার ডায়েরিতে তুলে ধরেন। এই ডায়েরি খুঁজে পাওয়ার পরে ফারজানা সিদ্ধান্ত নেয় সে তার বাবার ডায়েরির পাশাপাশি রংপুরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিজেও তুলে ধরবে একটি গ্রন্থে। রংপুরে এসে সে সাহায্য চায় আরেক ইতিহাসপোকা রিয়াদ আনোয়ার শুভর কাছে। এরপর নানান ঘটনায় বিভিন্ন স্থানে গিয়ে গিয়ে দুজনে অথবা বিভিন্ন বই ঘেঁটে ঘেঁটে মার্চ মাসের ১ তারিখ থেকে ঘটনাপঞ্জি সাজাতে শুরু করে ফারজানা।

প্রত্যেক তারিখে আলাদা আলাদা করে রংপুরের ঘটনাক্রম সাজানো হয়েছে, ফলে পাঠকের বুঝতে কোনোরকম অসুবিধা হয় না কবে কোথায় কী ঘটল।

তবে বইটির গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য আলাদাভাবে উল্লেখ না করলেই নয়,

ফারজানা ও রিয়াদ আনোয়ার শুভ দুজনই বন্ধুত্বপূর্ণ একটি নিটোল সম্পর্কের মধ্যে মধ্য দিয়ে ইতিহাস ইতিহাসের নানান অলিগলিতে ভ্রমণ করে এবং ফারজানা সেগুলো তার পাণ্ডুলিপিতে লিখতে থাকে।

তারিখ অনুসারে ঘটনাপঞ্জি সাজাতে গিয়ে ফারজানা চরিত্রটি শুধু তার বাবার ডায়েরির মধ্যেই নির্ভরশীল থাকে না। বাস্তবিক অর্থেই সে রংপুরসহ সারাদেশের বিভিন্ন ইতিহাসগ্রন্থ ঘেঁটে সেগুলোর রেফারেন্সসহ সংশ্লিষ্ট দিনের ঘটনাপঞ্জী তুলে ধরে।

একইসাথে নির্দিষ্ট তারিখে সারাদেশের মধ্যে সংঘটিত অন্যান্য ঘটনাও ফারজানা তুলে ধরে ঘটনা পরম্পরা বুঝবার সুবিধার্থে।

এছাড়াও শুধু মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাই নয় ফারজানা এবং শুভ এই দুই চরিত্র রংপুর শহরের বিভিন্ন গলিতে গলিতে ঘুরতে ঘুরতে শহরের শহিদ মিনারসহ বিভিন্ন স্থাপনা এবং বধ্যভূমিগুলো সম্পর্কেও আলাপ করতে থাকে- যেগুলো পাঠক ফারজানার লেখায় দেখতে পায়।

এছাড়া বইটির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো, ঘটনার পরম্পরা বুঝবার সুবিধার্থে শুধু মার্চ মাস থেকেই ঘটনা শুরু করা হয়নি কিংবা শেষ করা হয়নি বরং ১৯৬৮ থেকে বাঙালির প্রতি পাকিস্তানিদের শোষণ-নির্যাতনের নানান ঘটনার বর্ণনা করতে করতে ধরিয়ে দেয়া হয় পহেলা মার্চের সূত্র এবং সেটিকে শেষ হয় চৌঠা এপ্রিলে। এই সময় পর্যন্ত প্রত্যেক তারিখের ঘটনাবলি বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে যত লেখক লিখেছেন তাদের বইয়ের নাম এবং পৃষ্ঠা নম্বরসহ হুবহু তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে মূল ঘটনা বোঝার পাশাপাশি বিচারের ভারও কিছুটা পাঠকের উপর থাকে।

 

সবচেয়ে মজার বিষয়টি হলো, এই গ্রন্থটির লেখক রানা মাসুদ কিন্তু তারই সৃষ্টি চরিত্র রিয়াদ আনোয়ার শুভ, ফারজানা এবং ফারজানার বাবা আকতার হোসেন নানামাত্রিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তুলে ধরে ইতিহাসের গভীর পাঠ। বুদ্ধিমান পাঠক বেশ খানিক পরে টের পাবেন, ইতিহাসের নানান দিক বর্ণনার পাশপাশি যে বিষয়গুলো হয়তো রেফারেন্স বইগুলোতে স্থান পায়নি সেগুলোই মূলত আকতার হোসেনের ডায়েরির মাধ্যমে তুলে ধরেছেন লেখক রানা মাসুদ নিজেই।

ঠিক এই জায়গাটিতে লেখকের সাফল্য। তিনি এমন এক ঘোর রচনা করে পাঠককে ইতিহাসের মোহে ঢুকিয়ে ফেলেন যে বইটি একসময়ে ইতিহাসের বই মনে হয় না। কখনও মনে হয় গল্প আবার কখনও ইতিহাস।

এমন অদ্ভুত বর্ণনাভঙ্গির ইতিহাস গ্রন্থ আমি আগে কখনও পাঠ করিনি এবং আমার জানামতে কেউ লিখেছেন এমনটাও না। বইটি নিঃসন্দেহে পাঠক সমাদৃত হবার দাবি রাখে।

আমি এর সর্বাঙ্গীন সাফল্য কামনা করি। বইটি প্রকাশ করেছে রংপুরের আইডিয়া প্রকাশন। পাওয়া যাচ্ছে আইডিয়া প্রকাশন, বইবাড়িসহ বিভিন্ন বইয়ের দোকানে।

 

মজনুর রহমান
Latest posts by মজনুর রহমান (see all)