মুগ্ধতা ব্লাড ব্যাংকে আপনার দেওয়া তথ্য বাঁচাতে পারে একটি জীবন। আপনার তথ্য দিন, প্রয়োজনে রক্ত খুঁজুন এখানে।

কবি সোহানুর রহমান শাহীন এর জন্মদিনে বিশেষ আয়োজন

মুগ্ধতা.কম

২২ নভেম্বর, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কবি সোহানুর রহমান শাহীন এর জন্মদিনে বিশেষ আয়োজন

কবি সোহানুর রহমান শাহীন। ১৯৭৪ সালের ২২ নভেম্বর রংপুর শহরের কামারপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।
৮ ভাইবোনের মধ্য পঞ্চম এবং ভাইদের মধ্যে বড়ো।

১৯৯০ সালে মঞ্চ নাটকে মাধ্যমে সংস্কৃতি অঙ্গনে প্রবেশ করলেও অল্পদিনেই শুরু করেন কবিতা লেখা।
বাবার তালাবন্দী বইয়ের বাক্সে অবাধ সাধুপনার বিচ্যুতি ঘটিয়ে পাঠাভ্যাস সূচনা করেন ছাত্র কালেই। তারপর থেকেই রাত জেগে নতুন করে কিছু লিখাবার চেষ্টা, লেখা না হলে পুরোনো খসড়াকে ভাঙা আবেগের তুলি দিয়ে নতুন করে ঘষেমেজে কবিতাকে সারিয়ে তোলা এক প্রকার পাগলামীতে রূপ পায় তাঁর। সংসার, স্ত্রী-সন্তান ব্যবসা আর কবিতা নিয়ে চলমান জীবনের সমাপ্তি হলেও দোষের তেমন কিছু খুঁজে পান না এ কবি।

সাংগঠনিকভাবে ছান্দসিক সাহিত্য সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, রংপুর এর সাধারণ সম্পাদক, বিভাগীয় লেখক পরিষদ রংপুর এর আজীবন সদস্যসহ বিভিন্ন সাহিত্য-সংস্কৃতি, সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে রেখেছেন নিজেকে।


সোহানুর রহমান শাহীনের কবিতা: ‘নৈঃশব্দে ঘিরে থাকা জল’

মজনুর রহমান


তার কবিতাগুলো যেন ঠিক কথা নয় বরং চুপ করে থাকা। মানুষ চুপ করে বসে থাকলে তার শব্দ পাওয়া যায় না কিন্তু সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা তখনই তার বলা হয়ে যায়, ভাবা হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে কবিতাকে চুপ করে থাকাকালীন কথার মতো মনে হওয়া কারও কাছে অত্যুক্তি মনে হতে পারে, কিন্তু আমার কাছে সেটাই স্বাভাবিক মনে হয়। এর কারণ হলো, কিছু কবিতা পড়লে আপনার মনে হবে শোরগোল হচ্ছে, মানে আপনি অনুভব করবেন আরকি। কিছু কবিতা পড়লে আপনার অসুস্থতা বেড়ে যাবে। কিন্তু এই বৈরি জীবন-বাস্তবতায় আপনার দরকার উপশম। সেই উপশম আপনার পাশে বসে থাকা মানুষটির নিঃশব্দ সঙ্গের উষ্ণতা হতে পারে আবার কবিতার চুপচাপ ভাষাভঙ্গীও হতে পারে। কার সঙ্গ আপনার ভালো লাগবে সেটা আপনি ঠিক করে নিন। আমি বলব আপনি সোহানুর রহমান শাহীনের কবিতা পড়ুন! কী দরকার মানুষের সঙ্গ পেতে গিয়ে দুঃখে ঝুলি ভরিয়ে আনার, তারচেয়ে কবিতা পড়ুন, সোহানুর রহমান শাহীনের কবিতা পড়ুন।

তার নিঃসঙ্গতার কবিতাগুলোই আপনাকে বেশি করে সঙ্গ দেবে। তার কবিতায় সবচেয়ে বড়ো শক্তি হলো উপমা আর অনুপ্রাসের শক্তি। ‘তার সাথে আর কথা হয় কার/ যার কথা ভেবে বারবার কাঁধে উঠে ভার’-এরকম উপমা আর অনুপ্রাসের চমৎকার ব্যবহারে কবিতাগুলো হয়ে ওঠে সুখপাঠ্য। বক্তব্যের সংহত বিন্যাস শাহীনের কবিতার আরেকটি দিক। সব মিলিয়ে ব্যক্তিগতভাবে সোহানুর রহমান শাহীন আমার অন্যতম প্রিয় কবি, আন্ডাররেটেড কবি। তার কবিতা আমার উপশম হয়ে ওঠে।

শুভ জন্মদিন শাহীন ভাই!


সোহানুর রহমান শাহীন এর কবিতা

বধূময় মুখ


বিভ্রান্ত বিকেলে আনমনা হেঁটে যেতে
যেতে তোমাদের নতুন পাড়া—গাঁ’য়
রক্তিম সূর্যের হেলে পড়া দৃশ্য দেখে আঁতকে উঠি;
বিষণ্ণ সন্ধ্যায়, শুরু হয় আলো কমানো চোখের অনুনয়।
ধরে নাও আজো আর দেখা হবার সম্ভাবনা নেই।
আজ ফিরে যেতে হবে, আসতে পথে রেখে আসা ঘ্রাণ শুঁকে শুঁকে অথবা ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দের পাশ ঘেঁষে
আঁকাবাঁকা সড়ক অতিক্রম করে।
যদিও বৃক্ষশাখা ছুঁয়ে যাওয়া অভিজ্ঞতা ভিতু করে রেখেছে!
তোমাদের নতুন পাড়ায় সন্ধ্যা নামার ভয়ে দেখা হয়না বহুদিন।
হাজারো স্বপ্নে বোনা ভালোবাসার একপাক্ষিক শূন্যতা ঘিরে,
ধীরে ধীরে এমনিতর সন্ধ্যার যন্ত্রণা যদি দিনের আলোকে অন্ধকার করে নেমে আসে অমাবস্যা,
তবে সূর্যের আঁচ ফুরানোর আগেই একবার দেখে নিতে চাই—
নতুন গাঁয়ে বরণ করা বধূময় মুখ।


আলোহীন ল্যাম্পপোস্ট


হঠাৎ বৃষ্টিতে যদি নগর ডুবে যায়
যদি আর ফিরে দেখার সুযোগ না হয়—
ধ্বংসস্তুপে ভেসে যাওয়া প্রিয় দেহখানি,

যদি ভাসতে ভাসতে চলে যেতে থাকে যাবতীয় সৃষ্টিকর্ম। নন্দিত কারুকাজ।

স্রোতের কাছে মিনতি করে, কে ফেরাবে!

সভ্য নগরীর বুক চিরে ধীরে ধীরে আড়াল হয়ে আছেন আপনই প্রেরিত বিরূপ বিষাদে!


অবসরে এসো


আজ নয়, যদি হয় বেদনার নীলে
মিলেমিশে থাকা অভিনয়ের
সিদ্ধান্ত অবধি অপেক্ষা;
ক্রোধের অনলে পোড়া ক্ষতের
শিল্পীত চিরকুট ফেলে—
অবসরে এসো।
সিঁদূর রাঙা ঠোঁটের কোণে
একরাশ হাসির ঝলক ঝুলে,
ঠিকরে পড়া মেঘের আড়ালে
বিপন্ন হতাশা ঢেকে।


র’ এর গল্প


তার সাথে আর কথা হয় কার, যার
কথা ভেবে বারবার কাঁধে উঠে ভার
ভাবনায় যতবার সে ছিল আমার
তার চেয়ে বেশি তার সাজের বাহার
সাঁঝের বেলায় অবেলার সাথী তার
সঙ্গী হয়ে আসে কাছে পেলে অবসর,
আমি তার ভুলের ভেজানো দরজার
ওপারে পড়ে থাকি কিছুটা অগোচর।

ফিরবার যার নেই আর তাড়াতাড়ি
তার সাথে কেন খায়ালের বাড়াবাড়ি
সে এখন যার থাক ভেসে তার, হার
জিতের জীবন হোক তুচ্ছ আহামরি।

আমি আর তার প্রেম না হবার জ্বর
নিয়ে অবসর খুঁজবার আশা ছাড়ি
প্ররোচনার কবল থেকে পেছনের
সময়ের কথা ভুলে ফিরে যাই বাড়ি।


ইচ্ছের ক্রীতদাস


ফিরে পেয়েই সব পাওয়া নয় নন্দিনী;
গড়ে ওঠা স্বপ্নের ইমারত ধ্বসে চুন
সুরকি খসে বিচূর্ণ দালান আজ
কতটা গাথুঁনিতে মেলাবে।

কতটা গল্প তৈরীর ফুসরতে
চৈত্রের খরান দুপুরে ফিরে আসবার
আশ্বাস টুকুন ধারণ করেছো
কিঞ্চিৎ বাসনার তাড়নায়,

অনিহার অগ্নিবানে আবদ্ধ করে যেদিন
শেষ পাড়া গাঁ`র উঠোন মাড়ালে মেঠোপথ ধরে
শত ইচ্ছের ক্রীতদাস হয়ে
শীতার্ত রাতে উঞ্চতা তাপাতে !

বঞ্চিত মানবতার নিষ্ফল সময়ে
ফিরে পেয়েই সব পাওয়া নয় নন্দিনী ;

পুরনো আসবাবপত্রের মতোই ঘূর্ণায়মান
লাটিম স্থির হলেও মৃত্তিকার বুকে ক্ষতচিহ্ন
অবিরত দাপিয়ে চলে এপাশ ওপাশ।


নতুবা শূন্যতা


উমাচরণ নিক্তিতে মনের ভাব বুঝতে
চেষ্টা করছো অযথা, তার`চে
দাবার ছকে আঁকো জীবনের দীপ্রতা।

স্বপ্নীল সরোবরে জ্যান্ত শকুন, হরিয়াল
ক্লান্তির সন্তরণে চড়ুই—এর বাসার মধ্যে
অদৃশ্য হয়! জেগে রয় লোকালয়;
ব্যবচ্ছেদ হয় ঝিঁঝিঁ পোকার সতর্ক সঙ্গীতে।

দ্বিধার করুণ ধ্বনির নিশ্চয়তা জেনে
ইচ্ছেমৃত্যুর স্বপ্নে ভেসো না, অনুক্ত ব্যথার
লাবন্য নিয়ে গাও গোধূলীর রাগে।


নির্বাচন. ..


চাচা খালু আলু থালু মামা ফুপু বড়’বা
বোন ভাবী আপা খালা মামী নানী ছোট’বা।

ভোট এলে জোট করে ডাকে তারা এভাবে
হাত ধরে বুকে পড়ে মাথা ঠোকে স্বভাবে।

পথ ঘাট হাট দিবে গম দিবে পকেটে
মাঠে মাঠে নদী দিবে পার হতে রকেটে।

দিনে বাতি জ্বেলে দেবে রাত হলে আর কি
রাজপথে অটো দেবে জ্যাম হলে কার কি।

ভোট এলে খিল খুলে নেমে পড়ে রাস্তায়।
ভাবে তারা কাছে গেলে মিলে ভোট সস্তায়


অতঃপর কাতরতা


তপ্ত উনুন, আঁচের কিনারা ঘেঁষে
মফস্বলী পৌষে শিশিরসিক্ত ঘাসের
বাড়ন্ত ডগা সিদ্ধ হতে হতে
এক পাক্ষিক কাতরতায় সন্ধ্যা নামে।
আঁচ ফুরানো উনুনের বেওয়ারিশ ধোঁয়া
উড়ে উড়ে দুর্দান্ত কুন্ডুলী হয়ে
দুর্ভিক্ষের চিত্রে এসে থামে।


বহুমনা মন


যদি ডিঙি ভিড়াও মাঝিরঘাটে
মন ভিড়াবে কোন হাটে!
অনেক বেচা কেনার আশায়
দল ভিড়াবে কার মাঠে।

কার মাঠেতে তুলবে ফসল
কার মঠেতে তুলবে
কার ভিড়ানো নাওয়ে উঠে
উতাল হাওয়ায় দুলবে।

দুলবে যদি বিন্দু ঘামে
দুলবে ভীষণ দুলবে
কোন আকাশের পানে চেয়ে
কার ছবি আজ ভুলবে।


জ্যোতির্ময় অবয়ব


কবিতার ভেতর তোমাকে খুঁজে পাই,
অসম্ভব সুন্দরের দিকে হেঁটে যাও
বর্ণনাময় অবয়বে তুমি কবিতা হও
তুমি স্নিগ্ধ রাতের ধ্রুব তারকারাজি।

তুমি বন্ধু।

ক্ষণিকের দেখা তিল যুগল উঁকি দেয়,
আলো ছড়িয়ে মোহনীয় করে কবিতার পঙক্তি। তুমি অনন্যা, প্রীতিময় প্রভাত
তুমি সু—শোভিত দীঘলকেশী সুখলতা।

এসো কবিতার ভেতর
এসো কবিতার চরণে
এসো কবিতার কাননে
তুমি এসো কবির জন্য।

তোমাকে খুঁজে যাই
কবিতার ভেতর।


প্রিয়ার নতুন ঠিকানা


এভাবেই চলে যেতে হয়, বড়ো ভয়
যাকে রেখে গেলে ছলেবলে কৌশলে
আছে কী তার?
শূন্য তো নয়!
যদি বয় পুবের বাতাসে ঘুর্ণি তুফান
যদি হয় বৈকালি বাঁধনে শৈত্য সমন
যদি না ফেরায়, নূপুর পায়ে নৃত্য অমন
যদি সূর্য হারায় ডালিমফাটা সুপ্ত যতন!

তবু নতুনের ঘ্রাণ, স্বপ্ন সমান, বাজে কলতান।
ক্ষয়—শুধু ক্ষয় ক্যালেন্ডারে দাগানো স্মৃতির স্নিগ্ধতায়।


শিরোনামহীন বসন্তের সুবোধ


চুমুর দাগে যেখানে গর্ভবতী হয়
ক্ষুধার্ত কুটুম, সেখান থেকে ভেসে আসে
পরনিন্দার বর্ণনায় শামুকের গান!
মানপতনের সনাক্তপত্র হাতে রেখে
বন্দনাবাক্য সাজাই
বৃত্তাকার আশ্রমের পোড়াঘরে।

আহা, মরা মাছিদের মহাসম্রাট,
বহুকালের অভ্যাসের দাসত্বে দাম্ভিক!

চেনা মানুষের শহর,
মনুষ্যত্ব বিকানো খোলস ভেঙে
নক্ষত্রের জ্বলজ্বলে আলোয়
পরিশুদ্ধ হও, ফিরতি পথে।


শিরোনামহীন পঙক্তি


দূষিত জলের কাছে শুদ্ধতা চেয়ে
একবার জলে নামতে চেয়েছিলাম

বন্দি জলের উঁচুপাড়ে দাঁড়িয়ে যখন
ভাবছিলাম তার গভীরতা নিয়ে,
তখন জল বলেছিল—
ঝড়ের তান্ডব আর ভয়াবহ কম্পনের
ক্ষতে যে গভীরতা সৃষ্টি হয়েছে
তার পরিমাপ হয় না।

নিঃসীম জলের বুকে নেই কুলের প্রকাশ।

নৈশব্দে ঘিরে থাকা সে জল—
পরিশুদ্ধ করে শ্মশানপ্রিয় শবদেহ।


বয়সী ঘ্রাণে নতজানু


বেঁকে গেছে হাড়
কী হবে আর শক্ত চেয়ালের;

যার যার আকাশ, তার
ছোঁয়া নিয়ে বারবার
কতবার উদাস হয় বয়সী আসর।
বাড়ে হাত বারে ভাত
কুলজাত এখন
ট্রেনের হুইসেলে বিরস পক্ষপাত।

হলুদ হলফনামায় বোটা খসে
অথবা লাল খামে চিঠি আসে
মৌন বিকেলে,
ডাকহরকারের থলে ভরে।


নয়া কইন্যা


নাকের নেচোত নথ কইন্যার
কানোত মাকড়ী—পাশা
কমরোত এখান বিছা পিন্দি
পুরাইল মনোত আশা।

মাতাত কইন্যা টিকলি দেছে
পায়োত আচে নূপুর
সোনার রুলী দুখ্যান হাতোত
দ্যাকে ঘুপুর ঘুপুর।

সোন্দোর এখান থ্যাবড়া মালা
থুইচে ঝুলি গালাত
নউগের গোড়াত আংটি আচে
মেন্দি হাতের তালাত।

সাজে কইন্যা বিয়্যার সাজোত
যাইবে শ্বশুর বাড়ি
সোউগ ফ্যালেয়া যাবান নাগে
বাপের ভিটা ছাড়ি।

মা’ক জড়েয়া ডুকরি কান্দে
কান্দে বাপের আগোত
এক বান্দোনোত হাঁটে কইন্যা
গাবরু হাঁটে সাথোত।


শিরোনামহীন পঙক্তি


দূষিত জলের কাছে শুদ্ধতা চেয়ে
একবার জলে নামতে চেয়েছিলাম

বন্দি জলের উঁচুপাড়ে দাঁড়িয়ে যখন
ভাবছিলাম তার গভীরতা নিয়ে,
তখন জল বলেছিল—
ঝড়ের তান্ডব আর ভয়াবহ কম্পনের
ক্ষতে যে গভীরতা সৃষ্টি হয়েছে
তার পরিমাপ হয় না।

নিঃসীম জলের বুকে নেই কুলের প্রকাশ।

নৈশব্দে ঘিরে থাকা সে জল—
পরিশুদ্ধ করে শ্মশানপ্রিয় শবদেহ।