ছোট বেলায় আমাদের খু্ব ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হতো, বিশেষ করে শীতের সকালের পরিবেশটা মনে দাগ কাটার মতো।বাড়ির সামনে রাস্তা ধরে লাইন করে গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়ি থেকেই ছোট ছেলে মেয়েরা কায়দা, কুরআন শরীফ দু’হাতে বুকে চেপে হেঁটে চলতো মক্তবের উদ্দেশ্যে, নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলেরা বাবা বা বড় ভাইয়ে লুঙ্গি আর মেয়েরা মায়ের শাড়ি পড়েই মক্তবে যেতো। আমাদের বাড়িটা মক্তবের কাছাকাছি হওয়ায় আমাদের মক্তব ফাঁকি দেয়ার সুযোগ হতো না।
অতীত আমার কাছে খুব আদরের মনে হয়, মনে হয় আর একবার যদি ছুঁয়ে দেখার সুযোগ পেতাম জীবনে। হাজার স্মৃতির রঙ মেশানো অতীত। আজ কমলার কথা বলবো। কমলা, আমার গ্রামেই বাড়ি তার, দারুণ বুদ্ধিদীপ্ত কথায় আকৃষ্ট করতে পারতো মানুষকে, সেই মক্তব পড়ার সময় যখন রাস্তা ধরে মক্তবের দিকে হেঁটে যেতাম তখন প্রায় দিনই কমলার সাথে দেখা হতো আমার, খুব দ্রুত হেঁটে চলতো শহরের দিকে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে কমলা যে কোনো টাকা স্পর্শ করেই বলে দিতে পারতো কত টাকার নোট। অথচ কমলা চোখে দেখতো না, কারো সাথে কথা বললে পরবর্তীতে আবার কখনো দেখা হলে গলার স্বর শুনেই সে পরিচয় বলে দিতে পারতো, কমলা চোখে দেখতো, ছোট বেলায় জল বসন্ত নাকি তার দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছে।
গরীব ঘরের সন্তান হওয়ায় চিকিৎসা জোটেনি তেমন। ধীরে ধীরে বড় হয় কমলা, অন্ধ হয়েও কমলা তার ভাইয়ের সংসারের সব কাজ করতো নিঁখুত ভাবে, এবং বাকি সময় সে শহরে যেতো ভিক্ষা করতে। আমার শৈশব পেরিয়ে যখন আমি কলেজে পড়ি তখনো কমলা নিয়ম মাফিক শহরে ছোটে ভিক্ষার উদ্দেশ্যে। একবার কুরবানির ঈদে কমলা আমাদের বাড়িতে আসে তার শাড়ির আঁচলে লুকানো তিনটা তিন কেজি জিরার প্যাকেট নিয়ে। বিষয়টা আমাকে অবাক করে। জানতে চাই, – তুমি এসব কোথা পেলে? উত্তরে কমলা বলে কিনে রেখেছি ঘরে, ঈদের সময় দাম বাড়ে কিছুটা লাভ হয়, আমি কমলার কাছে জানতে চাই, তুমি তো চোখে দেখো না কি করে এসব করো? রাস্তায় চলতে সমস্যা হয় না, আর এসব করে কী হবে তোমার? তোমার তো স্বামী সংসার, সন্তান কেউ নেই, কমলা আমার কথায় হাসে, বলে, -কে বলে আমার সংসার নাই, আমার ভাইয়ের ছেলে মেয়ে ওরাই তো আমার সন্তান, ওরাই আমার সংসার। বললাম তুমি এসব করো তাহলে তোমার ভাই কী করে? কমলা আদুরে গলায় বলে, -ভাইটা ছোট বেশি খাটলে কষ্ট হয়, শরীর খারাপ করে। আমি তো আছি ওর পোলাপাইনরে আমিই মানুষ করমু, হেরা বড় অইলে আর কষ্ট নাই। কথাগুলো বলতেই অন্ধ কমলার চোখে মুখে প্রশান্তির ছায়া খেলা করে।
কমলা ভিক্ষার পাশাপাশি ছোট খাটো স্টক বিজনেস করে ভাস্তির বিয়ে দেয়, ভাস্তাদের কলেজে পড়ায়, এখন সবাই সংসারী হয়েছে, এত বছর পর আবার কমলার দেখা পেলাম, কমলা এখনো ভিক্ষা করছে পেটের আহার যোগাতে। জানতে চাইলাম, -এখনো ভিক্ষা করো কেনো? তোমার ভাস্তা ভাই তোমাকে দেখে না? কমলা হেসে উত্তর দেয়, – দিতে চায় পারে না। থাক হেরায় তো ভালা আছে এইটাই আমার সুখ। আমার আর কী আছে জীবনে, মরার সময় হইছে, ভাস্তাগোরে মানুষ করছি মরলে কবরে তো নামাইবো আমারে, আর কিছু চাই না আমি। কমলা মিষ্টি হেসে আমার নাম ধরে ডাকে, আমার বাবার নাম বলে আমি তার মেয়ে সেটাও পরিস্কার জানায়, আমি অবাক হই তার মেধার প্রখরতায়। আমাকে দোয়া করে পা বাড়ায় শহরের উদ্দেশ্যে পেটের আহারের সন্ধানে। কমলার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে হাজার প্রশ্নের উত্তাপে পুড়ে যাই আমি —