কোভিড-১৯ সারা বিশ্বে মহামারি আকার ধারণ করেছে। ক্ষুদ্র ভাইরাসের কাছে পরাজিত গোটা বিশ্ব এত এত উন্নত প্রযুক্তি একের পর এক গবেষণা তবুও কোন সমাধান খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে অনিশ্চয়তা, আতঙ্ক, ভয় উদ্বেগ মানুষকে আরও চেপে ধরেছে। মানুষ সামাজিক দূরত্ব, আইসোলেশন, কোয়ারেন্টাইন, অর্থনৈতিক দ্বন্দ্বে হাঁফিয়ে উঠেছে দিনের পর দিন। ফলে এইসব মানসিক চাপ, ভয় বা অনিশ্চয়তা মোকাবেলা করতে না পেরে কেউ কেউ বেছে নিচ্ছে আত্মহত্যার পথ। বিগত মহামারিগুলোর (যেমন সার্স, প্লেগ) দিকে তাকালে দেখা যায়, আত্মহত্যার সাথে এর একটা সম্পর্ক রয়েছে। মহামারি বাড়লে বাড়ে। কোভিড-১৯ মাহামারিতেও বেশ কিছু আত্মহত্যার ঘটনা দেখা গিয়েছে।
জার্মানীর হোসে প্রদেশের অর্থমন্ত্রী থমাস শেফার, যুক্তরাষ্টের এমিলি এমনকি মাস দুয়েক আগে বাংলাদেশের গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার জাহিদুল আত্মহত্যা করে এই করোনার কারনে। মহামারিতে এমনিতেই মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেশি থাকে সেখানে যদি মানুষ আবার আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় তাহলে মহামারির অন্যান্য বিষয়গুলোর সাথে আত্মহত্যার বিষয়টিতেও গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিৎ। কেন মানুষ আত্মহত্যা করছে তার কারণগুলো জানা দরকার।
কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, করোনার এই দীর্ঘমেয়াদী অনিশ্চয়তা, ভয়, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, একঘেয়েমি ও বন্দি জীবন, বিনোদনের অভাব, মানুষের চাকুরি হারানোর ফলে বাড়তি মানসিক চাপ ও উদ্বেগের সাথে যখন মানুষের দ্বন্দ্ব দেখা যায় তখন এই ভয়াবহ প্রবণতা আসে। এছাড়া বিভিন্ন প্রকার মানসিক রোগ যেমন বিষন্নতা, সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার ডিসওর্ডার পারর্সনালিটি ডিসঅর্ডার, মাদক সেবন বেড়ে যায় ফলে আত্মহত্যার ঝুঁকিও বেড়ে যায়। আত্মহত্যা একদিনের ফল না। দীর্ঘদিনের বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনার ফলে মানুষ একমূহুর্ত এসে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। আত্মহত্যার কারণ জানার পাশাপাশি আত্মহত্যার জন্য কতগুলো পূর্ব সতর্কতামূলক চিহ্ন (ডধৎহরহম ঝরমহ) রয়েছে। তাই একজন মানুষ আত্মহত্যার ঝুঁকিতে আছে কিনা তা নিম্নলিখিত চিহ্ন বা আচরণ দ্বারা আগে থেকেই অনুমান করা যায়।
ক. নিজেকে শেষ করে দেয়ার অথবা নিজেকে হত্যা করার ইচ্ছা প্রকাশ করা।
খ. সবসময় হতাশ লাগছে বা ভীষণ একা লাগছে, বেঁচে থাকার কোন মানে নাই, মরে যাওয়াই ভালো এসব কথা বললে।
গ. নিজেকে শেষ করার পরিকল্পনা করা যেমন ওষুধ কিনে রাখা, দড়ি কিনে রাখা, ব্লেড সংগ্রহ করে রাখা
ঘ. কোন সমস্যায় পড়লে সমাধান খুঁজে না পাওয়া
ঙ. অন্যদের ওপর বোঝা হয়ে গেছি এমন বললে
চ. প্রায়ই মাদক বা অন্য কোন নেশাজাতীয় দ্রব্য বেশি পরিমানণ সেবন করলে
ছ. সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিলে।
জ. উত্তেজিত বা উদ্বিগ্ন আচরণ করলে।
ঝ. সবার কাছ থেকে বিদায় নিলে।
ঞ. নিজের পছন্দনীয় জিনিস বা সম্পদ অস্বাভাবিকভাবে অন্যদের দান করলে।
ট. অল্পকিছুতেই আত্মহত্যার চেষ্টা করলে।
ঠ. প্রায়ই মরার কথা বললে।
ড. খাওয়া বা ঘুমে বড় ধরনের পরিবর্তন আসলে।
আত্মহত্যা প্রতিরোধে সমন্বিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে পরিবার, বন্ধু, সমাজ সবাইকে। করোনা পরিস্থিতিতে বেশিরভাগ মানুষ গৃহবন্দী এবং আতঙ্ক ও ভয় নিয়ে জীবন কাটাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে আত্মহত্যা প্রতিরোধে কতগুলো বিষয়ের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে।
» আত্মহত্যার ওয়ার্নিং সাইনগুলো সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হবে।
» সারাক্ষণ মোবাইল টিভি, পত্রিকায় করোনার খবর দেখা যাবে না এবং সব তথ্য বিশ্বাস করা যাবে না। গ্রহণযোগ্য মিডিয়া বা সোর্স এর প্রদানকৃত তথ্য বিশ্বাস করতে হবে।
» কারো মধ্যে আগে থেকে মানসিক সমস্যা থেকে থাকলে তাকে বাড়তি মনোযোগ দিতে হবে যে হঠাৎ তার আচরণের কোন পরিবর্তন হয় কি না। যদি হয় তাহলে ততক্ষণাৎ কোন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
» কারো মধ্যে হঠাৎ হতাশা, মন খারাপ দেখলে তাকে সময় দিতে হবে, তার সাথে কথা বলতে হবে এবং তার কথাগুলো মনযোগ দিয়ে শুনতে হবে।
» যেহেতু বেশিরভাগ সময় বাসায় কাটছে তাই সময়টাকে বিভিন্ন আনন্দদায়ক কাজে ব্যস্ত রাখতে হবে। যেমনঃ সিনেমা দেখা, গানশোনা, পরিবারের সবার সাথে গল্প করা, বাচ্চাদের সাথে নিয়ে সৃজনশীল কাজে ব্যস্ত রাখতে হবে অথবা খেলা করা, শখের কাজ করা, পশুপালন করা, রান্না করা।
» দূরের আত্মীয়-স্বজন বন্ধু বান্ধবদের সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ করা।
» টিভি/অনলাইনে শারীরিক ও মানসিক সাস্থ্যসেবা দিচ্ছে সেগুলো সম্পর্কে তথ্য গ্রহণ করা বা প্রয়োজনীয় নাম্বার সংগ্রহ করে রাখা।
» যদি কারো পূর্বেই আত্মহত্যার চেষ্টা করার রেকর্ড থাকে তবে তাদের প্রতি বাড়তি সতর্ক থাকা এবং বাসার ছুরি, দা, ব্লেড, দড়ি ওষুধ সরিয়ে রাখা।
» সবশেষ মহামারি সবসময় একটি মানসিক চাপ। তাই এই চাপে ভেঙে না পড়ে মানসিকভাবে শক্ত থাকার চেষ্টা করা।
আর এই কোভিড-১৯ এর জন্য যেহেতু এখন পর্যন্ত কোন কার্যকর চিকিৎসা নেই তাই শারীরিক শক্তি বাড়ানো পাশাপাশি মানসিক শক্তিও বাড়াতে হবে যাতে সব ধরনের আতঙ্ক, হতাশা ও আত্মহত্যার মতো বিষয় প্রতিহতো করা সম্ভব হয়।