যুক্তরাজ্য প্রবাসী বাংলাদেশি লেখক ও চিকিৎসক অপূর্ব চৌধুরী লিখেছেন মুগ্ধতা ডট কমে
শুক্রুবার, ২৪ এপ্রিল, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এক বিবৃতিতে বললেন,
“there is currently no evidence that people who have recovered from Covid-19 and have antibodies are protected from a second infection”.
“বর্তমানে কোভিড -১৯ থেকে সুস্থ্য হয়ে ওঠা এবং অ্যান্টিবডি রয়েছে এমন লোকেরা দ্বিতীয়বারসংক্রমণ থেকে সুরক্ষিত থাকার কোনও প্রমাণ নেই।”
১৯৬০ সালে প্রথমবারের মতো মানুষের দেহে করোনা ভাইরাস 229E পাওয়া গিয়েছিলো ।এটাকে বলে alpha coronavirus । গত ষাট বছরে আরো পাঁচটি করোনা ভাইরাস মানুষের দেহেপাওয়া গেছে । সর্বশেষ এই সাত নাম্বারটি হলো সবার মুখে মুখে থাকা বর্তমান করোনা ভাইরাস। যদিও করোনা ভাইরাস একটি জাত, তার সাতটি ধরন এবং সর্বশেষ টি হলো SARS-CoV-2 ।
এই জীবাণুতে আক্রান্ত হলে সে রোগের নাম COVID-19 । যদিও বেশিরভাগ মানুষ সহজেবলতে করোনা ভাইরাস বলে নতুন ভাইরাসটিকেও । এ জাতের সবগুলো ভাইরাস দেখতে মুকুটবা Crown এর মতো । ল্যাটিন Corona শব্দ থেকে ষোলো শতকে ইংরেজি Crown শব্দহয়েছিল । তাই পুরোনো ল্যাটিন নামে তাদের ডাকা হয় । যেকোনো জীবাণুর নাম ল্যাটিন থেকেনেয়া হয়, যাতে একনামে সব ভাষার লোক তাকে চিনতে পারে । যার যার ভাষায় নামকরণকরলে গোলমাল পাকিয়ে ফেলবে । ১৭৫৩ সালে সুইডেনের বিখ্যাত বিজ্ঞানী লিনিয়াস এইনামকরণ পদ্ধতি তৈরী করেন, যার নাম Binomial nomenclature, যা এখনো পর্যন্ত ব্যবহারকরা হয় । এইজন্যে মেডিক্যালের বিভিন্ন শব্দ খটমটে হয় ।
বলছিলাম করোনা ভাইরাসের ইমিনিটির কথা । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সম্প্রতি দেখলেন যে, বিভিন্নদেশ লকডাউন শিথিল করতে বা ধীরে ধীরে উঠিয়ে দিতে একটি টেস্ট চালু করার চিন্তা করছে ।সেটি হলো, যারা একবার এই কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছে, তাদের শরীরে এন্টিবডি পেলে, তাদেরকে শঙ্কামুক্ত ঘোষণা করে – বাহিরে যাওয়া, ভ্রমণ করা, কাজে যাওয়া, এইগুলোর অনুমতিদেবে । এটাকে কেউ বলছে Immunity Passport । WHO এর ভাষায় risk-free certificate !
কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বক্তব্যের সারমর্ম হলো : একবার করোনা আক্রান্ত হলে তাদের আরদ্বিতীয়বার হবে না, অথবা তাদের ভাইরাসটি প্রতিরোধের ক্ষমতা – যাকে Immunity বলে, সেimmunity তাদের আছে বলে আগে যা ভাবা হতো, অথবা এতদিন যা ধরে নেয়া হতো, সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখেছে – সুস্থ্য হয়ে ওঠাদের একেক জনের একেক ধরনের immunity পাওয়া যাচ্ছে । তার মানে – তারা পুনরায় আক্রান্ত হতে পারে, তাদের শরীরে পর্যাপ্ত এন্টিবডিনেই, অথবা যে এন্টিবডি আছে – সেটি ভাইরাসটি প্রতিরোধে দুর্বল ।
শরীর যখন করোনা ভাইরাস দ্বারা প্রথম আক্রান্ত হয়, তখন শরীর তার স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়ভাইরাসটি মেরে ফেলতে চেষ্টা করে । এই চেষ্টাকে মেডিক্যালের ভাষায় বলে non-specific response । চেষ্টাটি প্রথম এক সপ্তাহ পর্যন্ত ঘটে । তখন হালকা গলা ব্যথা, শরীর ব্যথা, দুর্বললাগতে থাকে । এই চেষ্টায় শরীরের WBC এর neutrophil নামের একটি রক্তকোষ, সাথেmacrophage এবং dendritic cell নামের কিছু কোষ এগিয়ে এসে ভাইরাসটি মারতে থাকে ।বয়স এবং স্বাস্থ্য ভেদে এই সামর্থ একেকজনের একেক রকম । যাদের দুর্বল, তারা ভাইরাসটিরকাছে হেরে যায় । তখন শরীরের আরো শক্তিশালী প্রতিরোধ ক্ষমতা মাঠে নামে । এটাকেমেডিকেলের ভাষায় বলে adaptive response । এই চেষ্টায় শরীরের Thymus নামের একটাগ্ল্যান্ড থেকে T কোষ তৈরী হয় । এই কোষটি ভাইরাসকে মারতে চেষ্টা করে । একদিকে সেভাইরাসটিকে মারে, আরেকদিকে Bone কে খবর পাঠিয়ে সেখান থেকে B কোষ বের করে । সেইB কোষ এক ধরনের Y শেইপের প্রোটিন তৈরী করে । এই প্রোটিনকে বলে immunoglobulins ।সংক্ষেপে লিখে Ig । Y শেইপের এই এন্টিবডি প্রোটিনের ভেতর ১৩০ ধরনের অ্যামিনোঅ্যাসিড থাকে । এই অ্যামিনো অ্যাসিড গুলো Y শেইপের দুই বাহু দিয়ে ভাইরাসটির গায়ে বসে থেকে ভাইরাসটির কোনো কোষে আক্রমণ করা থেকে বিরত রাখে । পরবর্তীতে কখনো শরীরেআরেকবার একই জাতীয় ভাইরাস ঢুকলে এই এন্টিবডি একদিকে T কোষকে খবর পাঠায়ভাইরাস মারতে, আরেকদিকে B কোষকে বলে আরো এন্টিবডি তৈরী করতে । তখন আরভাইরাসটি টিকতে পারে না । দৌড়ে পালায় । তখন দুর্বল হোক-সবল হোক, শরীরের প্রথমদিকের non-specific response -এরও তেমন দরকার পড়ে না । এই পুরো প্রক্রিয়াটিকে মেডিক্যালের ভাষায় বলে Cellular immunity ।
WHO এর পরীক্ষায় দেখা গেছে, কারো শরীরে এই Cellular immunity বেশ দুর্বল । অথচতারা কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছিল, অসুস্থ হয়েছিল, হসপিটালে ভর্তিও হতে হয়েছিল, টেস্টওপসিটিভ এসেছিলো, বাসায় ফেরার আগে টেস্ট নেগেটিভও এলো, সবকিছু হওয়ার পরেও তাদেরশরীরে যে মাত্রার এন্টিবডি থাকলে পরবর্তীতে আবার ভাইরাসটি আক্রমণ করলে T কোষকেসিগন্যাল পাঠাতে পারে না অথবা B কোষকে পর্যাপ্ত আরো এন্টিবডি তৈরী করতে উদ্দীপ্তকরতে পারে না । এই দুর্বল সমীকরণ বিজ্ঞানীদের ভাবনায় ফেলেছে । এই জটিলতার আরোকিছু গভীর জটিলতা আছে, এখন সেটা বলছি ।
COVID-19 এর এন্টিবডি শরীরে আছে কিনা, এটা জানলে – দুটো জিনিস জানা যায় ।
ল্যাবে কোভিড-১৯ এর এন্টিবডি পরীক্ষা করার টেস্ট -এর নাম : serological enzyme-linked immunosorbent assay সংক্ষেপে বলে ELISA । সাধারণের ভাষায় সহজ করে বলে rapid immunodiagnostic test । Eva Engvall এবং Peter Perlman নামের দুজন সুইডিশ বিজ্ঞানীএন্টিবডি টেস্টের এই পদ্ধতিটি ১৯৭১ সালে আবিষ্কার করেন ।
এন্টিবডি টেস্ট রেসাল্ট এনালাইসিস করতে গেলে বিশ্ব জুড়েই দুটো সহজ ভুল হয় ডাক্তারদের।
এক. কেউ আক্রান্ত হয়েছিল, কিন্তু এন্টিবডি নেই, তখন তাকে বলতে পারে নেগেটিভ বা ভুলকরে তাকে বলা হয় – আপনি কোরোনায় আক্রান্ত হন নি ।
দুই. আবার কারো শরীরে এন্টিবডি পেয়েছে, অথচ আসলে সে কোরোনায় আক্রান্ত হয় নি, কিন্তুতাকে পসিটিভ বলা হলো বা বলা হলো যে – আপনার শরীরে ভাইরাসটি ঢুকেছিলো ।
এটি কি করে সম্ভব ? নিশ্চয়ই অবাক লাগছে ! বলছি সেটি সহজ করে এবার ।
বলেছিলাম শুরুতে কোভিড ১৯ ছাড়াও আরো ছয় ধরনের করোনা ভাইরাস আছে । আমাদেরশরীরে প্রতিবছর যে ঠাণ্ডা, জ্বর, ফ্লু, সর্দি কাশি, এসব হয়, তার পিছনে অনেক ভাইরাসের সাথেবাকি চারটি করোনা ভাইরাস দায়ী । এরা হলো : 229E, NL63, OC43, HKU1 । সাথে বাকিদুটো ২০০৩ সালে এবং ২০১২ সালে হওয়ায় SARS এবং MERS । এই ছয়টি করোনাভাইরাসের কোনো একটিতেও এই সময়ে আক্রান্ত হলে, তার শরীরে যে এন্টিবডি তৈরী হবে, তাকোভিড ১৯ এর তৈরী করা এন্টিবডির সাথে ক্রস রিয়েক্ট করে False Result দিতে পারে ।বছরের এই সময়ে চারটি প্রধান করোনা ভাইরাসগুলোতে আক্রান্ত হওয়া খুব স্বাভাবিক ।
সুতরাং, একবার করোনা ভাইরাস-১৯ এ আক্রান্ত হলে আবার দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হবেন কিনা, এখনো পর্যন্ত পরীক্ষায় এটা প্রমাণিত যে, এই ভাইরাসের এন্টিবডি একেকজনের একেকধরনেরএবং অন্য ভাইরাস গুলোর সাথে ক্রিয়ার কারণে পাওয়া ফলাফলে ভুল সিদ্ধান্ত হওয়ারসম্ভাবনা আছে বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এখনো পর্যন্ত এন্টিবডি টেস্টকে পুনরায় আক্রান্ত হওয়ারসার্টিফিকেট হিসাবে পর্যাপ্ত মনে করে না ।
সূত্র :
1. WHO
2. Nature
3. Journal of Medical Virology
4. Lancet, March, 2020
5. Science, 2020
6. Journal of Infection
ডা. অপূর্ব চৌধুরী
লন্ডন, ইংল্যান্ড