আজ পহেলা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন। সবাইকে শুভ নববর্ষ। একটা দীর্ঘ স্ট্যাটাস লিখছি, দুঃখিত। স্ট্যাটাস দীর্ঘ হওয়া ও আপনাদের সেটি পড়া- দুটোকেই প্রয়োজনীয় মনে করছি!
২০১৯ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিক থেকে চীন, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ইউরোপ ও এশিয়ার কিছু দেশ, মার্চের শুরু থেকে আমেরিকাসহ পুরো পৃথিবী এক বিভিষীকাময় সময় পার করছে। আজ এপ্রিলের ১৪ তারিখে পৃথিবীর প্রায় সকল মানুষের চিন্তা একটাই- কোভিড-১৯ মহামারী কবে বিদায় নিবে?
এ সংক্রান্ত এক ভিডিও ডকুমেন্টারি ” করোনার ভবিষ্যৎ” এ আমরা ভবিষ্যতের একটা অনুমানভিত্তিক ছবি দিয়েছিলাম। আজকে বাংলা ক্যালেন্ডারের প্রথম দিনে আমি আপনাদের কিছু সুখবরের কথা বলতে চাই যেটি হবে এক পূর্নাঙ্গ ছবির মতো!
“মে মাসের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে (বাংলাদেশ সহ) করোনা আক্রান্তের সংখ্যা অনেক কমে আসবে। বিভিন্ন দেশে লকডাউন আগামী এক/দুই সপ্তাহের মাঝেই খুলে দেওয়া শুরু করতে পারে যা শেষ হতে মে মাসের শেষ সপ্তাহ লেগে যাবে। মে মাসের শেষ সপ্তাহ/জুনের প্রথম সপ্তাহ নাগাদ ইউরোপ, আমেরিকা ও বাংলাদেশের জীবনযাত্রা পরিপূর্ণভাবে স্বাভাবিক হওয়ার জোর সম্ভাবনা। জুনের প্রথম সপ্তাহের বা দ্বিতীয় সপ্তাহের মাঝে বাজারে কিছু ওষুধ যেমন এভিগ্যান (ফ্যাভিল্যাভির), প্লাজমা (থেরাপি) ও রেমডিজিভির চলে আসার সম্ভাবনাও প্রবল। ফলে, এরপর করোনা আবারো যখন সেপ্টেম্বরে বা ডিসেম্বরে আঘাত হানবে বলে অনেকের আশংকা; তখন সেটি আর আমাদের কাবু করতে পারবে না আমাদের কাছে ওষুধ থাকার কারণে। পরবর্তীতে ডিসেম্বর (২০২০) আসতে আসতে টীকাও বাজারে চলে আসার সম্ভাবনা আছে। যেটি করোনার বিরুদ্ধে মানুষের ভবিষ্যতের যুদ্ধে আর একটি মাত্রা যুক্ত করবে।”
আমি কিভাবে এই সময়সীমা সম্মন্ধে জানলাম বা নিশ্চিত হলাম?
কিভাবে জানলাম সেটা বলার আগে বলি, ভবিষ্যৎ আমরা কেউই জানিনা এবং ভবিষ্যৎ ভয়ানক ‘অনিশ্চিত’ যেখানে ‘জানিনা’ সবচেয়ে ‘নিশ্চিত’ উত্তর। ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত বলেই, কেউই এই সম্মন্ধে নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে চায় না। কারণ ভবিষ্যত বলার জন্য যে বিষয়গুলো জানতে হয় সেগুলোর অনেকগুলোই আমরা (মানবজাতি) জানি না।
তবে, এই অনিশ্চয়তা নতুন কিছু না। এই অনিশ্চয়তার সাথে মানুষের সংসার হাজার বছরের পুরনো। তারপরও, হাজার বছর ধরেই মানুষকে প্রতিদিন সিদ্ধান্ত নিতে হয় ভবিষ্যৎ ধরে নিয়েই; কিছুটা আন্দাজের ( ইনকমপ্লিট ইনফরমেশন) উপরই। প্রশ্ন হলো, আমি কিভাবে এসব সময়সীমাগুলো ধরে নিলাম বা আন্দাজ করলাম?
বিজ্ঞানী ও পলিসি মেকাররা স্বাভাবিকভাবেই এই মূহুর্তে বচনে বেশ সতর্ক, তাই নিশ্চিত করে কিছুই তারা বলতে চান না। কিন্তু বাতাসে অনেক ফিসফাস আছে। আমার এই সময়সীমার ভিত্তি বিজ্ঞানী ও নীতি নির্ধারকদের এসব ফিসফাস! তিনটি ফিসফাসের কথা উল্লেখ করছিঃ
আমার প্রথম বক্তব্য ” মে মাসের প্রথম/দ্বিতীয় সপ্তাহে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ব্যাপকহারে কমে যাবে” এর উৎস ডা. ফাউচিসহ বিখ্যাত বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য ও বাস্তবতার ( গত ৫/৭ দিনের ডাটা) সাথে এসব বক্তব্য মিলে যাওয়া!
উদাহরণ, ডা. ফাউচি ও ডা. ডেবোরা ব্রিক্স গত প্রায় পাঁচ দিন ধরে বলছেন,” মহামারী আমরা যেসব পাল্লা (প্যারামিটার) দিয়ে মাপি সেগুলো বলছে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে কোভিড-১৯ মহামারী চূড়ায় পৌঁছেছে এবং রেখাচিত্র নামা শুরু করেছে।”
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের রেখাচিত্র যদি গত ৩/৪/৫ দিনে দেখেন দেখবেন তাদের এই বক্তব্য সঠিক। অর্থাৎ বেশিরভাগ দেশ ও রাজ্যের মহামারীর রেখাচিত্র চূড়ায় পৌঁছেছে এবং এখন সেটির নামবার পালা। চূড়ায় পৌঁছানোর অর্থ হলো সর্বোচ্চ ক্ষতি হয়ে গিয়েছে এবং এখন ক্ষতি কমে আসবে ধীরে ধীরে। উল্লেখ্য, ডা. ফাউচি ও ডা. ব্রিক্স আমেরিকার করোনা যুদ্ধে টেকনিক্যাল অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছে।
বাংলাদেশেও আগামী দুই সপ্তাহের মাঝেই এটি চূড়ায় উঠে যাওয়ার সম্ভাবনা কারণ যুক্তরাষ্ট্রের সাথে প্রায় একই সময়ে এটি বাংলাদেশে উঠতে শুরু করেছিলো। তবে বাংলাদেশে আমরা ব্যবস্থা একটু দেরিতে নিয়েছি। সেই হিসেবে এক/ দুই সপ্তাহ দেরি হওয়ার সম্ভাবনা।
কিন্তু মাত্র তো ৩/৪/৫ দিনের ডাটা। এত কম সময়ে ডাটা থেকে কি সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়? না, যায়না। যায়না বলেই, দ্বিতীয় ফিসফাসের দিকে একটু তাকানো দরকার।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টসহ বিভিন্ন রাজ্যের গভর্নরেরা কিছু কিছু রাজ্যে ( যেমন ওয়াশিংটন) লকডাউন (সেই অর্থে নাই যদিও) বা স্টে হোম অর্ডার তুলে দেওয়ার ব্যাপারে গত দুই দিন ধরে পরিকল্পনা করেছেন যেটি আগামী ১/২/৩ সপ্তাহের মাঝে বাস্তবায়ন শুরু হবে। ফলে, এদের পরিমাপ মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই করোনা পরিস্থিত সমাপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখছে। না দেখলে অন্তত পরিকল্পনা শুরু হতো না। ইউরোপের দেশগুলোও আস্তে আস্তে একই ধরণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
এসব পরিকল্পনা বলছে, মহামারী মাপার পাল্লাগুলো কোভিড-১৯ এর চলে যাওয়ার ইংগিত দিচ্ছে। এবং সেখান থেকেই আমার ভবিষ্যদ্বাণীর প্রথম অংশের উৎপত্তি।
ওষুধ হিসেবে এভিগ্যানের ক্লিনিকাল ট্রায়ালের সাফল্যের খবর আপনারা জানেন। ওষুধ প্রস্তুত ও বাজারে ছাড়ার প্রয়োজনীয় দীর্ঘসূত্রিতা কমিয়ে আনার জন্য পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মাথাগুলো সর্বোচ্চ রিসোর্স নিয়ে কাজ করছে। যার ফলাফল আমরা ইতোমধ্যেই এভিগ্যানসহ অন্যান্য ওষুধে দেখতে পাচ্ছি। ইতোমধ্যেই অনেক সংবাদপত্রে (স্ট্যাটনিউজ) করোনার ওষুধ আসার ব্যাপারে ৩-৯ মাস লাগার কথা বলেছিলো। সেটি প্রায় তিন সপ্তাহ আগের কথা।
আমার ধারণা, এই সময়টা আরো এগিয়ে আসবে। এমনকি ৩ মাসকেও ধরে নিলে ওষুধ জুনের শেষের দিকে বাজারে আসার সম্ভাবনা প্রবল।
টীকা বা ভ্যাকসিনের ব্যাপারে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাকসিনোলজির প্রফেসর সারাহ গিলবার্ট ও বায়োটেক কোম্পানি মডের্নার প্রধান নির্বাহীর আশাবাদকে আমি সম্মান করেছি। সারাহ গিলবার্ট ৮০% নিশ্চিত, “আগামী ৬ মাসে ভ্যাকসিন বাজারে নিয়ে আসা যাবে” আর মডের্নার প্রধান নির্বাহীর দাবি এ বছরের (২০২০) সেপ্টেম্বরে স্বাস্থ্যসেবার সাথে জড়িতদের জন্য ভ্যাকসিন বাজারে নিয়ে আসা যাবে। উল্লেখ্য, মডের্না আমেরিকার একটি বায়োটেক কোম্পানি যেটি এই মূহুর্তে করোনার বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন বাজারে নিয়ে আসার নেতৃত্ব দিচ্ছে।
উপরের এসব তথ্যই নববর্ষের দিনে আমার আপনাদের সামনে আশাবাদ নিয়ে হাজির হওয়ার মূল কারণ। এগুলোই যে হবে সেটা নিয়ে শতকরা ১০০ ভাগ নিশ্চিত আমি বা কারোরই হওয়ার সুযোগ নাই। তবে, সম্ভাবনা প্রবল।
এবার আসুন দেখি বাংলাদেশ সরকার লকডাউন তুলে দেওয়ার সম্ভাবনা ঠিক কবে?
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্তের ভিত্তি হওয়া উচিৎ তিনটি-
১. তথ্য-উপাত্ত-বিশ্লেষণ (ডাটা)
২. বিজ্ঞান (সায়েন্স)
৩. সত্য ( ফ্যাক্ট)
এটা আমার কথা না, ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের গভর্নর গ্যাভিন নিওসম তার রাজ্যে ” স্টে হোম অর্ডার” কবে তুলে দিবেন সেই প্রশ্নের উত্তরে এই তিন উপাদানের কথা বলেছিলেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিদিন এই বিষয়ে ব্রিফ করছেন। দেশের লিডিং এক্সপার্ট ( ডাক্তার, সায়েন্টিস্ট ও ইকোনমিস্ট) ও আন্তর্জাতিক কনসাল্টিং এজেন্সীর ( বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা) নেতৃবৃন্দের সাথে বসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। এবং সেই সিদ্ধান্তের ভিত্তি হবে, তথ্য- উপাত্ত, বিজ্ঞান এবং সত্য। আমার ধারণা, অন্যান্য দেশগুলোর সাথে মে মাসের প্রথম/দ্বিতীয়/তৃতীয় সপ্তাহে সেটি বাংলাদেশেও হতে পারে।
সবাই ভালো থাকবেন ও এতদিন ভাইরাসের বিস্তার বন্ধে যা যা করেছেন সেগুলো চালিয়ে যাবেন। যে ধৈর্য্য এতদিন ধারণ করেছেন, আরো তিন/চার সপ্তাহ সেটি ধারণ করবেন আশা করি। করোনা চলে যাওয়ার পিছনে পুরো সাফল্যটুকুই মানুষের গৃহীত ব্যবস্থাগুলোর। এর সাথে কিছুটা আমাদের আবহাওয়ার। আশা করছি, আর ২ মাসের মাঝেই পৃথিবী আবারো পূর্বের মতো প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পাবে, ইনশাল্লা!
ফিংগারস ক্রসড (ফার্মলি)…
সোহেল রানা
সহকারী সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়
এবং
গ্র্যাজুয়েট টিচিং অ্যাসিসটেন্ট, ইউনিভার্সিটি অব মিনেসোটা, যুক্তরাষ্ট্র