মুগ্ধতা ব্লাড ব্যাংকে আপনার দেওয়া তথ্য বাঁচাতে পারে একটি জীবন। আপনার তথ্য দিন, প্রয়োজনে রক্ত খুঁজুন এখানে।

করোনা ভাইরাস পরবর্তী সমস্যা এবং চিকিৎসা

মুগ্ধতা.কম

১৫ মে, ২০২০ , ৬:৩৫ অপরাহ্ণ ;

করোনা সমস্যা এবং চিকিৎসা

বেশিরভাগ লোকজন এই মুহূর্তে করোনা ভাইরাসের কারণে COVID-19 থেকে বাঁচতে এবং বাঁচাতে ব্যস্ত। সাধারণ মানুষ কথা বলছে –  হাত ধোয়া আর সামাজিক দূরত্ব নিয়ে, ডাক্তাররা বলছে উপসর্গ, মেডিসিন আর ভ্যাকসিন নিয়ে। খুব কম খবর নেয়া হচ্ছে যারা আক্রান্ত হলো তাদের কি অবস্থা, কেমন যাচ্ছে শরীর, কি অবস্থা দিয়ে গেলো তারা, কতটুকু সুস্থ্য হয়ে উঠলো, কতদিন লাগে এই অবস্থা থেকে বের হতে, তখন কি কি সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। আজ এসব নিয়ে বলবো। করোনা পরবর্তী সমস্যা এবং চিকিৎসা।

ক’ দিন আগে বাংলাদেশ থেকে এক তরুণী জানালেন- তাদের পরিবারে তারা তিনজন করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। বাবা, মা এবং তরুণী নিজে। বাবা মারা গেলেন, মা এবং তিনি এখনো বেঁচে আছেন, সুস্থ হয়ে উঠছেন ধীরে ধীরে। রোজা রাখতে চান, রাখতে পারবেন কিনা, জানতে চাইলেন। একবাক্যে – না করে দিলাম। কোনোভাবেই রোজা রাখা যাবে না। ওনাকে কথা দিয়েছিলাম, সময় পেলে এ নিয়ে লিখবো – করোনা পরবর্তী কি আমাদের করণীয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটা কমন গাইড লাইন দিয়েছে যে – লক্ষণ দেখা দেবার পর একটি নির্দিষ্ট সময়কাল পর্যন্ত ভাইরাসটি শরীরে থাকে। এ নিয়ে একটুপর লিখছি।

সহজ করে বলা যায় – এই গাইড লাইন নূন্যতম, কিন্তু সবার জন্যে সমান ভাবে প্রযোজ্য নয়। নিয়মের ছকে ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় সমস্যা থেকে বের হতে একেকজনের শরীরের উপর নির্ভর করবে কত দিন লাগবে। এখানে আরেকটি জিনিস বলতে হয় – লক্ষণগুলো না থাকা এবং শরীরে ভাইরাস না থাকা একই নয়। লক্ষণ গুলো আর নেই মানে – ভাইরাস দুর্বল হয়ে গেছে, কিন্তু এখনো আছে। সুতরাং পরিপূর্ণ সুস্থ্য না হওয়া পর্যন্ত ভাইরাস শরীর থেকে যায় না।

COVID-19 একটি নতুন সমস্যা। সত্যিকার অর্থে এখনো ভালো করে কোনো গবেষণা হয় নি, আসলেই কত দিন লাগে এই ভাইরাস থেকে বের হতে। যে সব গবেষণা হয়েছে, তা ছিল ছোট ছোট গ্ৰুপের পর্যবেক্ষণ। সময় গেলে সামনে আরো বড় আকারের গবেষণার ফলাফল হাতে আসবে।

প্রথমে ভাবা হয়েছিল এটি নরমাল ফ্লু এর মতো। কিন্তু বাস্তবে তা নয়। এটি ফ্লু এর চেয়েও মারাত্মক। COVID-19 এখনো পর্যন্ত প্রতিদিন নতুন নতুন সমস্যার মুখোমুখি করছে আমাদের, চিকিৎসকদের, বিজ্ঞানীদের। তারপরেও এ পর্যন্ত যা বলা হয়েছে এবং হচ্ছে – তার বেশিরভাগ পূর্বের করোনা ভাইরাসগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইড লাইন হচ্ছে –

» মাইল্ড সিম্পটম হলে রিকোভারি পিরিয়ড এক থেকে দুই সপ্তাহ।

» সিভিয়ার কিংবা ক্রিটিক্যাল হলে তিন থেকে ছয় সপ্তাহ লাগে পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠতে।

কিন্তু অনেক রিপোর্টে দেখা গেছে যে, অনেক মাইল্ড সিম্পটম যেতে তিন সপ্তাহ লেগে গেছে, অনেক সিভিয়ার কন্ডিশন থেকে নরমাল হতে আট সপ্তাহ লেগে গেছে।

এমনকি সিম্পটমগুলোরও দিনের সাথে দিনের পার্থক্য করে। প্রথমত ভাইরাসটি নতুন। আপনার শরীর জানে না কি করবে এই নতুন শত্রুর বিরুদ্ধে। একদিন ভালো থাকবেন তো পরের দিন হঠাৎ বেশি অসুস্থ অনুভব করবেন। আগের রাতে দেখলেন জ্বর কমে গেছে, খুশি হয়ে গেলেন। পরের দিন সন্ধ্যায় হঠাৎ দেখলেন তীব্র জ্বর এসেছে। এমন সুস্থ-অসুস্থর খেলা এই ভাইরাসটির একটি ধাঁধা। এই ভাবলেন সুস্থ হয়েই গেলেন, দুদিন যেতেই দেখলেন শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।

যদি দেখেন আপনার লক্ষণগুলো মারাত্মক নয়, তাহলে লক্ষণ শুরু হওয়া থেকে দুই সপ্তাহ নিজেকে পূর্ণ বিশ্রামে রাখুন। প্রথম দুই সপ্তাহ যাবার পর ঘরের বাহিরে না যেয়ে ছোটোখাটো কাজে মনোযোগ দিন, সাথে নিজের শরীরকে লক্ষ্য রাখুন। একটি আগাম সতর্কবাণী দেই – ভাইরাসটি চলে যাবার সময় ফুসফুস, পাকস্থলী এবং মস্তিষ্কের ক্ষতি করে যায়। এ নিয়ে বিস্তারিত অন্য লেখায় লিখবো। এটা বলার কারণ এই জন্যে যে, মূল উপসর্গ গুলো প্রথম দুই সপ্তাহে চলে গেলেও পরের দুই সপ্তাহ নিজের শরীরকে চোখে চোখে রাখবেন, শরীরের কোনো অংশে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করছেন কিনা, সেটাকে লক্ষ্য রাখবেন। তার মানে দু সপ্তাহের মাইল্ড সিম্পটমের যারা, তারা মূলত এক মাস হাতে রাখবেন পূর্ণ সুস্থ হতে।

শুধু মাইল্ড সিম্পটম দেখা দিলে টেস্ট করবার দরকার নেই। কিন্তু মারাত্মক হলে তখন হসপিটালে ভর্তির সাথে সাথে টেস্ট করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে মার্কিন CDC র গাইড লাইন হচ্ছে দু ধরনের।

» টেস্টের উপর ভিত্তি করে
» লক্ষণগুলোর উপর ভিত্তি করে

হসপিটালে ভর্তি হবার পর শরীর ঘরে যাওয়ার মতো স্বাভাবিক অবস্থায় আসার পর ২৪ থেকে ৪৮ ঘন্টার ব্যবধানে ২ বার টেস্ট রেজাল্ট নেগেটিভ হতে হবে। একবার নেগেটিভ পর্যাপ্ত নয়, কারণ ফলস নেগেটিভ হতে পারে।

যেখানে টেস্ট করে নিশ্চিত হবার উপায় নেই, সেখানে সিম্পটম দেখা দেয়ার দিন থেকে নূন্যতম ১০ থেকে ১৪ দিন অপেক্ষা করা শরীর স্বাভাবিক হয়ে উঠতে। পরবর্তী আরো ২ সপ্তাহ দেখা যে – শরীরের অন্য অংশে কোনো উপসর্গ দেখা যাচ্ছে কিনা, তাকে দেখা। সে ক্ষেত্রে শরীর বুঝে – চার থেকে ছয় এমনকি আট সপ্তাহ পর্যন্ত সময় নিতে হবে পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠতে।

সাত দিন থেকে আঠাশ দিনের এই রেঞ্জের মধ্যে আপনি অনেকগুলো সমস্যা দেখতে পারেন অথব মুখোমুখি। COVID-19 এর স্বাভাবিক সিম্পটম : গলা ব্যথা, তীব্র জ্বর, কাশি এসব থেকে সেরে ওঠার পর যখন ভাইরাসগুলো কমতে থাকে তখন কিছু সমস্যার মুখোমুখি হতে পারেন।

খুব দুর্বল অনুভব করতে পারেন, শরীরের পেশীগুলোয় থেকে থেকে ব্যথা। CDC র রিপোর্ট অনুযায়ী এমেরিকান এক মহিলার সিম্পটম দেখা দেয়ার ৫০ দিন পর্যন্ত জ্বর আসা যাওয়া করছিলো। এমনকি তার শরীরে দুবার টেস্ট নেগেটিভ এসেছিলো। আরেকজন রোগীর এমন প্রথম সপ্তাহে পজিটিভ এসেছিলো, পরের সপ্তাহে নেগেটিভ এলো। কিন্তু তৃতীয় সপ্তাহ থেকে সে হাতে এবং পায়ে ব্যথা, ঝিনঝিন করা, মাঝে মাঝে শ্বাস কষ্ট হওয়া অনুভব করতে লাগলো। এরকম দুই সপ্তাহ যাওয়ার পর পঞ্চম সপ্তাহে গিয়ে সমস্যাগুলো কমে যেতে থাকলো এবং ষষ্ট সপ্তাহে চলে গেলো।

অনেক রোগীর টেস্ট নেগেটিভ আসার দুই-তিনদিন পর হঠাৎ দেখলো সকাল বেলা ঝরঝরে শরীর, দুপুরে দুর্বল লাগতে শুরু করলো, বিকেলে শরীর গরম হয়ে উঠলো, রাতে আবার নরমাল হয়ে গেলো। অনেকে হয়তো ভয় পেয়ে যান, আবার আক্রান্ত হলেন কিনা। এমন সমস্যাও কেউ কেউ ভুগতে পারেন। উদ্বিগ্ন হবার কিছু নেই। দু তিন দিন এমন হতে পারে, শরীর যখন ভাইরাসের বিরুদ্ধে শক্তিশালী এবং সাঁড়াশি আক্রমণ করে।

কেউ কেউ নিউরোলোজিক্যাল কিছু প্রব্লেম ফেস করতে পারেন আফটার রিকোভারি টাইমে। যেমন, মস্তিষ্ক মনে হবে ভার, কোনো কিছুতে ফোকাস করতে পারছেন না, সকালে কি খেলেন – বিকেলে মনে করতে পারছেন না, উদ্বিগ্নতার চেয়ে কি নিয়ে উদ্বিগ্ন সেটাই বুঝতে পারছেন না। অথচ শরীরে কোনো তাপমাত্রা নেই, শ্বাস কষ্ট নেই।

রাতে ঘুমাতে গেলে হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে দেখলেন ঘামছেন, শীত শীত লাগছে, ভয় বেড়ে গেলো তাতে, এরপর ঘুম আর আসছে না। এমন হলে চেষ্টা করবেন ঘুমোতে। এমন দু তিন রাত হতে পারে, তার মানে নয় আপনি আবার আক্রান্ত হয়েছেন বা ভাইরাস এখনো যায় নি।

পেটের সমস্যায় অনেকে ভুগতে পারেন। ক্ষুধা কম লাগবে, খেতে ইচ্ছে করবে না কিন্তু ক্ষুধা লেগেছে, কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ পাতলা হয়ে গেলো টয়লেট, দু তিনবার এমন হয়ে আবার ঠিক হয়ে গেলো। পেট ব্যথা না করলেও মনে হবে পেট ফাঁপা। ফুসফুস যে কারণে করোনা ভাইরাস গুলোতে আক্রান্ত হয় বেশি, সেই একই ধরনের কোষ এবং রাসায়নিক উপাদান পেটেও বেশি বলে ফুসফুসের পর করোনা ভাইরাসে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হতে পারে পাকস্থলী। লক্ষণ চলাকালীন ডায়ারিয়া হওয়া এর আরেকটি লক্ষণ।

মাথা ব্যথা থেকে থেকে আসতে পারে, মাথা ভার ভার লাগতে পারে। পেট আপসেট থাকতে পারে তিন চার সপ্তাহ, শরীর জুড়ে ব্যথা থাকতে পারে কয়েক সপ্তাহ, স্বাভাবিক শ্বাস প্রশ্বাস নিতে মাঝে মাঝে কষ্ট হতে পারে,অল্পতে হাঁপিয়ে উঠতে পারেন, অযথা ক্লান্ত লাগবে, মুড্ অফ থাকতে পারে কারণ ছাড়াই, শরীর হঠাৎ হঠাৎউষ্ণ হয়ে উঠতে পারে, ঘুমে ঘামাতে পারেন, হঠাৎ হঠাৎ শীত অনুভব করতে পারেন, সহজে কাশি টা যাচ্ছে না, থেকে থেকে আসছে যাচ্ছে, যা কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত থাকতে পারে । করোনা পরবর্তী এসব সমস্যা অনুভব করলে উদ্বিগ্ন না হয়ে শরীরকে বিশ্রাম দিন, স্বাভাবিক খাবার খান, পর্যাপ্ত পানি খান, পূর্ব থেকে শরীরে কোনো সমস্যা থেকে থাকলে যেমন : ডায়াবেটিস, রক্তে কোলেস্টেরল বেশি, এসবে নিয়মিত যে মেডিসিনগুলো খেতেন, সেগুলো খান, ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন, কোনোভাবেই রোজা রাখবেন না এই মুহূর্তে, ভারী ব্যায়ামের চেয়ে হালকা হাঁটা চলা করে পেশীগুলো সচল রাখুন, দেখবেন – শরীর স্বাভাবিক হয়ে উঠছে ।

আরেকটি জিনিস : সুস্থ হয়ে উঠেছেন বলে অন্যদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ বাড়িয়ে দেবেন না । সুস্থ্য হয়ে ওঠার সময়টাতেও আপনি ভাইরাসটি ছড়াতে পারেন । সেদিকে লক্ষ্য রাখবেন ।

সূত্র :

1. WHO
2. CDC
3. CMJ : Chinese Medical Journal
4. Shanghai Public Health Clinical Center
5. NHS
6. American Journal of Respiratory and Critical Care Medicine
7. EID : Emergence of Infectious Diseases Journal

ডা.অপূর্ব চৌধুরী:
জন্ম বাংলাদেশ, বসবাস ইংল্যান্ড । পেশায় চিকিৎসক, মননে লেখক । ৭ টি গ্রন্থের প্রকাশ । উল্লেখযোগ্য বই : অনুকথা, জীবন গদ্য এবং বৃত্ত ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *