রাতে মেইল পেলাম অফিসের একজনের ব্লাড টেস্ট করতে দিয়েছে । আল্লাহর রহমতে দুদিন পরেই রেজাল্ট আসলো। নেগেটিভ । একসময় মনে হতো আমরা বাংলাদেশের মানুষ প্যানিক্ড, আতঙ্কগ্রস্ত । ব্যাপারটা তা না হলে কি আর অস্ট্রেলিয়ার নানান জায়গায় টয়লেট টিস্যু নিয়ে মারামারি কাড়াকাড়ি হয় ! আর্মিডেলেও এর প্রভাব পড়লো। কোন সুপারমলে, শপে কোন ধরণের টিস্যু নাই । আপাতত টিস্যু নিয়ে আমাদের চিন্তা নাই । টিস্যু তো আর খাওয়ার জন্য না । আর আমাদের বাঙ্গালীর ‘বদনা’ তো আছেই ।
বাংলাদেশ থেকে আসার সময় কয়েকজন কাঁথা, বালিশের সাথে বদনা নিয়ে এসেছিলেন । সেটা নিয়ে কি ভীষণ হাসাহাসি করেছি! এয়ারপোর্টে আরেকজনের ল্যগেজ থেকে বদনা বের হওয়ার পর খুব মুশকিল হয়েছিল । এনারা তো বদনা চিনেন না । কাজেই গুরুত্বও বুঝেন না । এই নিয়ে প্রায় ঘন্টাখানেক দেরি হয়েছিল তার । পরে অবশ্য বদনা সহই ছেড়ে দেয়া হয়েছিলো । অজি বন্ধুদের যখন বদনার ব্যবহার শেখানো দারকার ভাবছি, তখন একটু দুশ্চিন্তায় পড়লাম আমরাই দু’সপ্তাহ পর । স্টকের টিস্যু শেষের পথে । শুনলাম ‘কোলস’ সুপারশপে সকাল ৮ টায় লাইনে দাঁড়ালে টিস্যু কিনতে পাওয়া যায় ।
একদিন দুলাভাই, আরেকদিন ভাগনে বেচারা বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকলো; নাহ্ টিস্যু তো না ’হোয়াইট ডায়মন্ড’ শেষ। অবশ্য একটু বেশি দাম আর পরিমাণে কম হলেও পরের সপ্তাহে উলিজ সুপারশপে কাঙ্খিত হোয়াইট ডায়মন্ড পাওয়া গেল। এর পরের দু’সপ্তাহ পর টিস্যুর বাজার একটু স্বাভাবিক হলো ।
মার্চের শুরুর দিকেই সুপারশপগুলোতে নিয়ম করে ফেললো, একজন একটার বেশি পণ্য নিতে পারবেন না । এই অবস্থাতেই বাজারে চাল, আটার তাক খালি । কিছু সময় কিছু জিনিস পাওয়া যায়, কিছু সময় নাই । এদিকে অস্ট্রেলিয়ার গভ: এর পক্ষ থেকে প্রতিদিন নানান ব্রিফিং দিয়েই যাচ্ছেন । নিশ্চিত করছেন কৃষক সমিতিসহ নানান জায়গা থেকে যে, খাবার ও অন্যান্য সব কিছু সাপ্লাই নিশ্চিত করা হবে । কাজেই কেউ প্রয়োজনের বেশি স্টক না করার জন্য ।
এখানকার নিয়ম আর সংস্কৃতি যে যার মতো থাকবে । বাচ্চারা আঠারো বছর হলে নিজের মতো আলাদা থাকবে । বিয়ে করা না করা নিজেদের সিদ্ধান্ত । তবে পরিবারের দায়িত্ব ভালোবাসা অটুট থাকে । এটা তারা পারিবারিক, সামাজিকভাবেই শিখে থাকে। সময়মতো বিয়ে করে, চার/পাঁচজন বাচ্চা নিয়ে সংসারী বাবা-মা যেমন আছে, অবিবাহিত বাবা-মাও আছে । আছে অবিবাহিত বয়স্ক মানুষও । সবাই স্বনির্ভর । বয়স্ক মানুষ, যাদের সিনিয়র বলা হয় এখানে; ওনাদের জন্য বেশ কষ্ট হয়ে গেল । বাজার করার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা, এরপর প্রয়োজনীয় জিনিসের তাক খালি । তাঁদের জন্য সুপারশপে আলাদা একঘন্টা সময় বেঁধে দেয়া হলো ।
অস্ট্রেলিয়া বিশাল দেশ, তাই তার একেকটা স্টেট এর নিয়ম কানুন আলাদা । লকডাউন, সংক্রমণ পরিস্থিতি, চিকিৎসা সুবিধা, বিধিনিষেধেও অনেক পার্থক্য । প্রথমেই লকডাউন হলো ভিক্টোরিয়া । তখনও আমাদের স্কুল, কলেজ, অফিস চলছে শঙ্কা নিয়েই । এপ্রিলের প্রথম দিকে নিউ সাউথ ওয়েলস লকডাউন করলো । প্রয়োজনীয় বাজার, অফিসের কাজ, যাঁদের শারীরিক পরিস্থিতিতে হাঁটতে হবে, যেমন : ডায়বেটিস বা এরকম কিছু, জরুরি অবস্থা ছাড়া কেউ বাইরে ঘোরাঘুরি করলেই এগারো হাজার ডলার জরিমানা । মেলবোর্ন থেকে নির্দশনা আসলো বাসা থেকে অফিস করতে হবে । সপ্তাহে দু/একদিন অফিসে যাওয়ার জন্য কাজ, সময়, একই সময়ে দুজনের বেশি অফিসে যেতে পারবে না ।
আমাদের সবাই বাংলাদেশে। আমার ছেলেটার বাবাও । যা শঙ্কা করা হচ্ছিল, সেরকম অনেক কিছুই ঘটে যাচ্ছে প্রায়দিন । খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে সবারই । আমরা এখানে ভালো আছি; কিন্তু ভালো থেকেও যেন শান্তি, স্থিরতা নেই বাংলাদেশের চিন্তায় । এটাই স্বাভাবিক । কিন্তু প্রতিদিনের কাজ আমাদের করতে হচ্ছে । আর মনে হচ্ছে এই বন্দী হওয়াটা সবাই একসাথে থেকে বন্দী হতে পারলে হয়তো একটু স্থিরতা থাকতো । যাই হোক একসাথেতো আছি ।
নতুন নতুন নিয়মের সাথে অভ্যস্ত হওয়া; খুব অল্প সময়ের মধ্যে পৃথিবী, আশপাশ বদলে যাওয়া দেখাটা আসলে এতোটা সহজ না ।
ওষুধ কিনতে গেছি একদিন । শপের বাইরে বেশ বড় লাইন; সবাই প্রায় সিনিয়র । খরগোশের মতো বিভ্রান্তি নিয়ে মাথা ঢুকাতেই কাস্টমার কেয়ারের একটা মেয়ে হেসে বললেন; আসতে পারবে, এটি প্রেসক্রিপশনের লাইন । খুব সাধারণ কিছু ওষুধ ছাড়া বাকি সকল ওষুধ প্রেসক্রিপশন ছাড়া দেয় না । এমনকি ডক্টর সংখ্যাও লিখে দেয় । অস্ট্রেলিয়ায় শীত আসছে। আসছে ‘ফ্লু’ এর জন্য বসন্তকাল । গত বছরও সারা অস্ট্রেলিয়ায় মানুষ মারা গিয়েছে ‘ফ্লু’ তে আক্রান্ত হয়ে । ‘ফ্লু’ আর কোভিড-১৯ এর লক্ষণগুলো একই । তাই এবারের ফ্লু ভ্যাকসিন সময়টা আগেই শুরু করে দিয়েছে । সাথে অনেক ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক করে দিচ্ছে ।
ফার্মেসিগুলো এখানে সুপারশপের মতই । পারফিউম, সাবান, লোশন ধরণের কসমেটিকস সহ অনেক শুকনো খাবার, বাচ্চাদের খাবার থাকে । এতো বড় একটা এরিয়াতে ভিড় হওয়ার এটাও একটা কারণ । আমার প্রয়োজনীয় ওষুধ নিয়ে কাউন্টারে দিলাম । মেয়েটি হেসে বললো, একটু পিছিয়ে দাগের পেছনে দাঁড়াও । দেখলাম ওহ আসলেই তো দাগ দেয়া । একটু অপ্রস্তুত লাগলো । বললাম, সবই নতুন তো, আমরা সবাই অভ্যস্ত হতে পারছি না । সেও স্বীকার করলো ।
আমার বোন গেছে কে-মার্ট শপে । এটাতে যাবতীয় কাপড়, খেলনা, ইলেকট্রনিক্স থাকে । সুপারশপে ঢোকার কিছুক্ষণের মধ্যেই ওর কাশি এলো । এখন মাথায় নানান চিন্তা; কাশি দিলে আশেপাশে মানুষ না দৌড় দেয় ভয়ে । সে নিজেই তাই এক দৌড় দিয়ে চলে গেল বাথরুমে। গ্রীষ্মকাল ছাড়া বাকি সময় আমি বাইরে বের হলেই আমার হাঁচি আসে । এমনিতে হাঁচি কনুইয়ের মধ্যেই দেই। কিন্তু এখন এমন হলেই আড়াল খুঁজি, বসে পড়ি, সরে গিয়ে হাঁচি দেই ! কি যে শঙ্কায় পৃথিবী আছে । আল্লাহর কাছে শুকরিয়া বেঁচে আছি, সুস্থ আছি, ভালো আছি ।
লকডাউনের মাসখানেক পর আজকে সবাই একটু বেড়িয়েছি নানান সময়ে । অনেক মানুষই বের হতে পেরে খুশি । কাউকে কেমন আছো জিজ্ঞেস করলে বলছে, ‘বোরিং’। বাস্তবতা । সবাই একটু হালকা মানে একটু রিলাক্স ছিলাম । রাতে জানলাম, এখানকার সরকারী সার্ভিস অফিস; যেখান থেকে ড্রাইভিং, গাড়ির কাজসহ ,কমিউনিটির নানান সার্ভিস দেয়; সেখানে দুজনের পজিটিভ পেয়েছে । আর উনিশজন কোয়ারাইন্টাইনে । ওখানে একজন প্রেগনেন্ট মেয়ে আছে । আমি গেলেই ওর সাথে দেখা হতো । আর আমার ওরকম সময়টার কথা মনে হতো । জানি না ওর কথা, কেমন আছে !
চলবে
তাজনিন মেরিন লোপা
জন্ম রংপুরের এক সাহিত্যানুরাগী পরিবারে। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র, রংপুরের জনপ্রিয় মুখ। ’যুগের আলো’ পত্রিকায় নিয়মিত লেখক হিসেবে লিখেছেন ছড়া, কবিতা, সায়েন্স ফিকশন, ছোট গল্প, লিখেছেন কলাম। ঢাকায় ‘ছোটদের কাগজ’ এ লেখক হিসাবে সক্রিয় ছিলেন। শিশু-কিশোর সাহিত্য নিয়ে ২০১৯ একুশে বইমেলায় আত্মপ্রকাশ করছেন ‘ডাইনীর ফলবাগান’, ২০২০ এ ‘অস্ট্রেলিয়ার রূপকথা’ বই নিয়ে। নৃবিজ্ঞানের ছাত্রী হিসাবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক আর স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। বাংলাদেশে কলেরা হাসপাতালে সামাজিক গবেষক হিসেবে কাজ করেছেন অনেকদিন। খুব সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার ফেডারেল সরকার এর অনুদানে পরিচালিত ’হিপ্পি অস্ট্রেলিয়া’ নামে একটি সংস্থায় টিউটর হিসেবে কাজ শুরু করেছেন। সংস্থাটি মূলত তাদের নিজেদের কারিকুলামে কমিউনিটির ছোট শিশুদের মানসিক ও ইতিবাচক সামাজিক উন্নতির জন্য কাজ করে। বর্তমান নিবাস আরমিডেল, নিউ সাউথ ওয়েলস, অস্ট্রেলিয়া ।