ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে ট্যাম্ওরথে ট্রেনিং ছিল আমাদের আরেকটা অফিসে । ট্যামওরথ আরমিডেল থেকে প্রায় ১১০ কি. মি দূরে ।
অস্ট্রেলিয়ার নিউ ইংল্যান্ড এর এ্যাডমিনিসট্রেটিভ সিটি । কাজেই মানুষ আর গাড়িতে গিজ গিজ করে ।
৩১৪ কি.মি এড়িয়াতে প্রায় ৬২ হাজার লোকের বাস ।
বেশ অন্যরকম একটা ভাব ছিল ট্রেনিং নিয়ে; এটা ছিল একরকম ”লেডিস ডে আউট”। আমরা বাংলাদেশের মেয়রা তো নিজেরা গাড়ি চালিয়ে অনেক দূর যাচ্ছি; এরকম অভিজ্ঞতা পাই না । দেখি মুভিতে ।
আমরা এই প্রজেক্টে চারজন টিউটর, দুজন কোঅর ডিনেটর; সবাই ভদ্রমহিলা । তিনজন বাংলাদেশী, দুজন অজি, একজন কলোম্বিয়ান ।
বাংলাদেশী সাহসী আপু অফিসের গাড়ি চালানোর দায়িত্ব নিলো ।
হাইওয়ে পার হয়ে যাওয়ার সময় কোন এক মুভির দৃশ্যই মনে হচ্ছিল । অবশ্য এতোকিছুর মাঝেও আমাদের চিন্তা ছিল, ট্রেনিং সময়মতো শেষ করে সময়মতো ফেরা । বিশেষ করে বাচ্চাদের জন্য । দেখশোনার জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করতে হয়েছে যদিও । এখানে অবশ্য বিকল্প ব্যবস্থা মানে বাচ্চার মা বিকল্প বাবার, বাবা মায়ের । এছাড়া যারা নাগরিক নন, তারা বিশাল অংকের টাকা দিয়ে বেবিসিটারের কাছে রাখতে পারেন ।
আমার সাড়ে তিন বছরের বাচ্চার জন্য অবশ্য আমার বোন-দুলাভাই আছেন । শুধু আমাকে ছাড়া সে খাবারটা খায় না! এছাড়া আর কোন ঝামেলা নেই ।
সে যাই হোক ট্রেনিং শেষের তৃপ্তি নিয়ে ফেরা হলো । কিন্তু তার একদিন পরেই আমরা জানলাম, ট্যামওরথে একজন করোনা পজেটিভ পাওয়া গেছে । সেখানে সব লকডাউন । অস্ট্রেলিয়া এক মহাদেশ, আর তার নিজের দেশেরই ৬ টা স্টেট । একেকটা স্টেট একেকটা দেশের সমান বা তারচেয়েও বড় । সময় এবং আবহাওয়ার দিক থেকেও আলাদা । অস্ট্রেলিয়া সরকার তখনোও আর্ন্তজাতিক যাতায়াত সহ সকল লকডাউন নিয়ে ভাবছেন ।
সোমবার আমাদের অফিসিয়াল টিউটর ট্রেনিং থাকে । বাচ্চাকে সকালে প্রিস্কুলে দিয়ে অফিস গেলাম । ঘন্টাখানেক পরেই স্কুল থেকে ফোন । নাবহান বমি করেছে, শরীরের তাপমাত্রা ঠিক আছে। এখন খেলছে, কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতেও সামান্য অসুস্থতাকেও সবাই গুরুত্বের সাথে দেখছে । এর আগেও আমার ছেলের একবার এরকম হয়েছে: কারণ সকালে সে প্রায় কিছুই খায় না । কিন্তু ঐসময় স্কুল থেকে নিয়ে আসতে হয়নি ।
স্কুলে লাঞ্জ বক্স দেই নানান খাবার দিয়ে; তবে সে কিছুই খায় না প্রায় । স্কুলের নিজেদের বাস থাকলেও ওই মুহূর্তে সার্ভিস পাওয়া যাবে না । কিভাবে বাচ্চাকে আনি সেটা একটা দুশ্চিন্তা । দুলাভাই ইউনিভার্সটিতে, এসে ওকে নিতে সময় লাগবে । আর কাউকে অনুরোধ করলেই তো হবে না, বেবেসিটও লাগবে । এদিকে শরীর খারাপ নিয়ে সবার উদ্বিগনতা; যদিও জানি তার এটা সাধারণ ঘটনা ।
মনে পড়লো, আমার বান্ধবীর ছেলেও ওই প্রিস্কুলেই । তার গাড়িতে বেবেসিটও আছে । ফোন দিলাম, আল্লাহ্ র রহমতে সে ছেলেকে দিয়েই গাড়ি স্টার্ট দেয়ার সময় আমার কল দেখে আগে রিসিভ করেছে । স্কুলে বলতেই ওর কাছে বাচ্চা দিয়ে দিলো । বাচ্চাকে পেয়ে সেও আমাকে ফোন দিলো, চিন্তা করো না, নাবহান ভালো আছে, আমি ওকে নিয়ে আসছি অফিসে । কোঅরডিনেটর বাসায় চলে আসার পরামর্শ দিলেন, কারণ ওর বিশ্রাম জরুরি । দুপুরের দিকে প্রিস্কুল থেকে সুপারভাইজার বেক ফোন করলো । নাবহানের খোঁজ নেয়ার জন্য ।
করোনা পরিস্থিতির কারণে আগামী ৪৮ ঘন্টা একটু খেয়াল রাখতে আর স্কুলে বা বাইরে না যেতে । বেক ভীষণ ভালো আর আন্তরিক । কিন্তু কেন জানি আমার একটু হিউমেলিয়েশন, অস্বস্তি লগলো, মন আরও খারাপ করলো । ছেলেটার বাবা দেশে । এই পরিস্থিতি এমনিতেও খারাপ লাগাটা বেশিই হয়, কিছু না হলেও অসহায় লাগে মাঝে মাঝে । মনে হলো সারা পৃথিবীর করোনা পজিটিভ মানুষগুলোর কতটা অসহায় অনুভূতি পার করছে ।
এমনকি আমাদের যাদের ঠান্ডা, হাঁচি, কাশি, এলার্জি বা অন্য সমস্যা আছে; তারাও কি ভয়ঙ্কর সময় পার করছি । একটু গলা ব্যাথা, হাঁচি, কাশি হলেই আশেপাশের মানুষজন ভয়ে অস্থির হয়ে যাচ্ছে । নিজেদের ভয় তো আছেই । সবই ঠিক আছে জানি, কিন্তু পরের সাতদিন সবার মাঝে একটা আতঙ্ক, দুশ্চিন্তা কাজ করেছে ।
চলবে
তাজনিন মেরিন লোপা
জন্ম রংপুরের এক সাহিত্যানুরাগী পরিবারে। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র, রংপুরের জনপ্রিয় মুখ। ’যুগের আলো’ পত্রিকায় নিয়মিত লেখক হিসেবে লিখেছেন ছড়া, কবিতা, সায়েন্স ফিকশন, ছোট গল্প, লিখেছেন কলাম। ঢাকায় ‘ছোটদের কাগজ’ এ লেখক হিসাবে সক্রিয় ছিলেন। শিশু-কিশোর সাহিত্য নিয়ে ২০১৯ একুশে বইমেলায় আত্মপ্রকাশ করছেন ‘ডাইনীর ফলবাগান’, ২০২০ এ ‘অস্ট্রেলিয়ার রূপকথা’ বই নিয়ে। নৃবিজ্ঞানের ছাত্রী হিসাবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক আর স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। বাংলাদেশে কলেরা হাসপাতালে সামাজিক গবেষক হিসেবে কাজ করেছেন অনেকদিন। খুব সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার ফেডারেল সরকার এর অনুদানে পরিচালিত ’হিপ্পি অস্ট্রেলিয়া’ নামে একটি সংস্থায় টিউটর হিসেবে কাজ শুরু করেছেন। সংস্থাটি মূলত তাদের নিজেদের কারিকুলামে কমিউনিটির ছোট শিশুদের মানসিক ও ইতিবাচক সামাজিক উন্নতির জন্য কাজ করে। বর্তমান নিবাস আরমিডেল, নিউ সাউথ ওয়েলস, অস্ট্রেলিয়া ।