শহরের সব হাসপাতাল, ক্লিনিক গত ১৩ দিন ধরে ডাক্তার, নার্স ও টেকনোলজিস্ট শূন্য। অনাহারে অর্ধাহারে ঘরে বসেই কাটছে আবীরের পরিবারের মত প্রায় সকলেরই জীবন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ডাক্তার-নার্সদের নিয়ে ভাইরাল হওয়া পোস্ট গুলোও ইদানিং বিরক্ত লাগছে আবীরের। স্বেচ্ছাসেবী মানসিকতার তরুণ প্রাণবন্ত ছেলেটিও আজ ভীষণ ক্লান্ত। আশা জাগানিয়া সংগঠক হিসেবে পরিচিত; চির নবীন ছেলেটি আজ প্রায় স্বপ্ন দেখাই ভুলতে বসেছে।
গত ১৬ তারিখে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসায়রত একজন ফ্রন্ট লাইনের ডাক্তার; নিজে করোনায় আক্রান্ত হলে, কুমিল্লার আদাবর গ্রামের এক শ্রেণির লোকজন তাঁকে অপমান অপদস্থ করে পরিবারসহ গ্রাম থেকে বের করে দেয়। আরেকজন চিকিৎসককে করোনা আক্রান্ত সন্দেহে ঐ এলাকার কাউন্সিলর অপমান অপদস্থ করে। এমনকি বাসা থেকে চলে না গেলে; বের করে দেওয়ারও হুমকি দেয়। অন্য এক গ্রামে অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভারকে বাড়িতে ঢুকতে দেয়না গ্রামের নেতারা। এমনকি দূর থেকেও দেখতে দেয়না তাঁর দু’বছরের অবুঝ সন্তানকে। বিচ্ছিন্নভাবে বেশ কয়েকজন ডাক্তার, নার্স, ব্যাংকারদের ভাড়াবাসা থেকে বের করে দেয় বাড়ির মালিকরা। এসব ঘটনা ছাড়াও সরকারিভাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে মানসম্মত পি.পি.ই. সরবরাহ না করায়, অনেক ডাক্তার-নার্স- টেকনোলজিস্টদের করোনায় আক্রান্ত হওয়া ও বেশ কয়েকজন ডাক্তার নার্স করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার প্রতিবাদে ডাক্তার-নার্স-টেকনোলজিস্টদের সংগঠন ডিএনটিএ’র ডাকা অনির্দিষ্ট কালের কর্মবিরতিতে দেশের স্বাস্থ্যসহ সকল সেক্টরে প্রায় অচল অবস্থা।
করোনার ভয়াবহতায় একদিকে লক-ডাউনে যানবাহনের সীমাবদ্ধতা অন্যদিকে ডাক্তার-নার্সদের কর্মবিরতি! সরকারি হাসপাতাল গুলোর বারান্দায় লাশের স্তুপের পাশে স্বজনের আহাজারি থামানোর মতও কেউ নেই! দুর্গন্ধে অনেক লাশের কাছেও যেতে পারছে না পুলিশ কিংবা সাংবাদিক। হাট-বাজারেও সাংবাদিকদের তেমন ছুটাছুটি নেই দু’একজন ছাড়া। খবরেও মৃত্যুর মিছিল যেভাবে বেড়েই চলছে, আতঙ্কিত লোকজনের খবর দেখা এক রকম বন্ধই প্রায়।
প্রথম দিকে লক-ডাউনে পুলিশ আর্মি দিয়েও জনসমাগম নিয়ন্ত্রণ করা না গেলেও এখন আর নিয়ন্ত্রণ করতে হচ্ছে না। অনেক পুলিশ ও সেনা সদস্যরা করোনায় আক্রান্ত হলেও, ডাক্তার-নার্সদের দেখা মিলছে না; ডা. মঈন উদ্দিন স্যারকে অসুস্থ অবস্থায় সিলেট থেকে ঢাকায় নেওয়ার সময় এয়ার-অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা না করায়; অকালে মৃত্যুবরণ করার জেরে। অবুঝ জনগণ আজ বুঝদার হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এখন আর কেউ গুজব ছড়াচ্ছে না। বেশ থমথমে শান্ত পরিবেশ।
গতকালই আবীর ফেসবুকে দেখে; করোনা ভাইরাসের তাণ্ডবলীলা ঐ আদাবর গ্রামকেও ছাড়েনি! আর স্বজনদের কোন খোঁজ না পাওয়ায় অবশেষে ঐ বিশিষ্ট কাউন্সিলরের দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করেছে মারকাজুল নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।
সাধারণ মানুষের আক্রান্ত ও মৃত্যুর খবর মিডিয়া গুলো না দেখালেও; এমপি মন্ত্রীদের খবর দেখাতে ভুলছে না মোটেও। ত্রাণের চাউল চোরদেরও গোডাউন এখন আর গোয়েন্দা সূত্রে জব্দ করতে হচ্ছে না, আবীর মিডিয়ায় দেখলো; চেয়ারম্যান নিজেই বস্তির লোকদেরকে, অনেক যত্নে রক্ষিত চাউল-আটার গোডাউনের চাবি দিয়ে দিচ্ছে। সকলের সামনে কান ধরে তওবা করছে। খাটের নিচে তেলের খনি থেকে পাওয়া তেল সাধারণ মানুষকে বিনামূল্যে দিচ্ছে জনদরদি ব্যবসায়ী। আর হত-দরিদ্র সকলেই প্রয়োজন মত নিয়ে যাচ্ছে চাউল-আটা-তেল। এসব দেখে এক রকম রাগও হচ্ছে, আবার কিছু একটা ভেবে ভালোও লাগছিল আবীরের। রাতে এন্ড্রয়েড ফোনে এসব দেখতে দেখতেই ঘুমিয়ে পড়ে আবীর।
আজ খুব সকালেই ফোনটা হাতে নিয়েই একটা খবরে চোখ পড়ে যায় আবীরের, “করোনা ভাইরাসের টীকা কয়েক দিনের মধ্যেই বাজারে আসছে। এদিকে সরকার প্রধান ও ডিএনটিএ’র প্রতিনিধি দল কয়েকজন মানবতাবাদী ডাক্তারের বৈঠকে অবশেষে সিদ্ধান্ত হয়; দেশমাতৃকার জন্য সকল পক্ষই পরম সহিষ্ণুতা অবলম্বন করে আজ থেকে কাজে মন দিবে। ডাক্তার-নার্সদের কর্মবিরতি প্রত্যাহার করা হয়েছে। করোনা চিকিৎসায় সংশ্লিষ্টদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তাসহ পি.পি.ই. সরবরাহ নিশ্চিত করবেন প্রধানমন্ত্রী নিজেই। চিকিৎসা সরঞ্জামের স্বল্পতার কারণে, অপেক্ষাকৃত তরুণ ও শিশুদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেবা দিবেন চিকিৎসকগণ। সকল আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যগণ চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করবেন। দেশের তরুণ-তরুণীদের স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে এগিয়ে আসার উদার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী”।
খবরটা শোনা মাত্রই ওর সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু শরীফকে ফোন দেয় আবীর। যে গভীর রাতে ওকে ফোন করেছিল। বলেছিল; শহরের খবর কী? দেশের এ পরিস্থিতির কী কোনদিন অবসান হবে না! শরীফের বাবা গত তিনদিন আগে হার্ট অ্যাটাক করে কোন প্রকার চিকিৎসা ছাড়াই মারা যান। সেই শোক সহ্য করতে না পেরে, শরীফের মাও তার বাবার কাছে চলে যান! এখন তার একমাত্র ছেলে স্বপন; দু’দিন ধরে ভীষণ অসুস্থ। কোন পরিচিত ডাক্তারের সাথে কথা বলা যায় কিনা? স্বপনের আগে থেকেই নিউমোনিয়া আছে, শ্বাস-কষ্ট ও কাশি হচ্ছে খুব, অবশ্য করোনার লক্ষণ শরীর ব্যথা, জ্বর ও তীব্র গলা ব্যথা বোঝা যাচ্ছে না!
কিন্তু তখন কোন উত্তরই দিতে পারেনি আবীর! গড়িয়ে পড়ছিলো শুধু উষ্ণ নীলাভ অশ্রু!
এস.এম আরিফ:
তরুণ লেখক ও সংগঠক
এই লেখাটি #মুগ্ধতা_সাহিত্য প্রতিযোগিতার অন্তর্ভুক্ত। প্রতিযোগিতার নিয়ম জানতে ক্লিক করুন এখানে