অনীশ,
“তুমি যদি হও রোদ্দুর আমি তবে ডানামেলা গাংচিল। আছড়ে পড়ব তোমার বুকে। সবটুকু নোনাজল মুছে দেবো। তুমি হবে নীল আর আমি সেই ডানামেলা গাংচিল। নদীর সাথে মিতালী পাতব কোনো বৈশাখে। তোমার লেখার গভীরতায় ডুবে গেলাম।” তুমি এমনটাই লিখেছিলে আমার লেখা কবিতা পড়ে।
আমার লেখা তোমার ভালো লেগেছিল। আমিও হারিয়ে গিয়েছিলাম মুগ্ধতায়। আমার কল্পনার জগতে তুমি এমনভাবে আঁচড় কেটেছিলে যে, আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম। ডুবে গিয়েছিলাম অপূর্ব এক স্বপ্ন সাগরে। সেখান থেকে আর উঠতে ইচ্ছেই করেনি।
আমাদের দুজনকে যখন পথ এক রাস্তায় চালান করে দিয়েছিল তখনকার সেই দিনগুলো মনে করেই আমার যুগ কেটে যেতে পারত। এখন আমার দিন কাটে না। রাত কাটে না। ফাগুনের এই রাতে মন পোড়ে। এখন আমার বসন্তেও শুষ্কতা।
অনীশ, আমার প্রিয় সব কবির মাঝে একজনের কবিতা অনেক বেশি পছন্দের। তাদেরই একজন লোরকা। জীবনানন্দ দাশও আমার প্রিয় কবিদের একজন। লোরকা’র লেখা একটা কবিতা –
“আমার ব্যালকনির জানালা বন্ধ রেখেছি,
কারণ, কান্নার শব্দ আমার পছন্দ নয়;
তবু ধুসর দেয়ালের আড়াল থেকে
কান্না ছাড়া কোনো কিছুরই শব্দ শোনা যায় না।” …. (লোরকা)….
সত্যি বলতে , আসলে ব্যালকনির আড়াল থেকে আমার নিজের কান্নাইতো প্রতিধ্বনিত হয়। নিজের মনকে প্রবোধ দেওয়া সবচেয়ে জটিল কাজ। কে হেরেছে, কেইবা জিতেছে তার হিসেবটাও ততোধিক জটিলতাপূর্ণ। ভালোবাসার ঘাটতি থাকে না। ভালোবাসা সবাই উপলব্ধিও করতে জানে না।
আমি কি ফুরিয়ে গিয়েও নিজের মাঝে কোথাও তোমাকে পেতে চাই? কেনইবা তা হতে যাবে? কেন তা চাইব? আমার এতদিনের শিক্ষা, ব্যক্তিত্ববোধ মিশে যাবে। আমি তা হতে দেবো না। দিনের পর দিন আমি যে যন্ত্রনায় দগ্ধ তা কোনোদিনই মিটে যাবার নয়। তবুও আমি কেন তোমাকেই এসব লিখি, বলি তার কোনো উত্তর খুঁজে পাই না।
আমি ইদানীং বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত হয়ে থাকায় নিয়মিত পত্রিকা পড়া হচ্ছে না। মাঝে মাঝে টেলিভিশনে সংবাদগুলো শুনি। সেদিন আমার প্রতিষ্ঠান থেকে বাড়ি ফেরার পথে ট্রাফিক জ্যামে আটকে গেলাম। এরই ফাঁকে দৈনিক পত্রিকাঅলার হাঁক। কিনে ফেলে পত্রিকার পাতায় চোখ পড়তেই দেখলাম-
“মায়ের হাতে শিশু সন্তান খুন! “
বুকের ভেতরটা কেমন ছ্যাত করে উঠল। মনে হলো কেমন অন্ধকার দেখছি। পুরো খবরটা পড়লাম এক নিশ্বাসে। মনে মনে প্রার্থনা করলাম, ক্ষমা চাইলাম শিশুটির কাছে। মন থেকে কে যেন বলে উঠল “ও মানিক, মাফ করে দে সোনা। ওরে জাদু পা ধরি বাবা। মাফ করে দে সোনা। বাপ আমার, জাদু আমার। আমি প্রার্থনা করি, এ দেশের সকল নারী বন্ধ্যা হোক। বন্ধ্যা হোক। ততদিন পর্যন্ত বন্ধ্যা থাকুক যতদিন না তোদের নিরাপত্তা দিতে পারি আমরা।”
আমি পত্রিকা খুলেই এমন হিংস্র সব খবর পড়তে চাই না। নীচতা দেখতে চাই না। সন্দেহপ্রবণ স্বামীর অত্যাচারে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের অন্ধত্বের ঘটনা জানতে চাই না। আমরা সমাজের এসব কীটদের থেকে দূরে থাকতে চেয়েও পারি না। যেমন আমি পারিনি। দিনের পর দিন সন্তানদের জন্য সয়ে গিয়েছি।
তুমিতো বেশ আছ। রাস্তায় কান পেতে কারো পদধ্বনি শুনতে পাও। মুঠোফোনে শুনতে পাও কোনো পরিচিতের প্রিয় কণ্ঠস্বর। তোমার এনজিও সহকর্মী ঘনিষ্ঠ নারীর কণ্ঠ এবং শয্যাপাতার সময় নির্ধারণ করতে পারো অনায়াসে। ধর্মে, সমাজে তোমার বিশ্বাস নেই। তাইতো “তুমি যার তার, যে কেউ তোমার”।
আমার মননে মগজে একটা ঘৃণার পাহাড় জন্মেছে। সেই পাহাড় সরাতে না পারলে আমি নিঃশেষ হয়ে যাব। আমিতো বাঁচতে চাই। আমার নিঃসঙ্গতাকে সাথী করে। বিশ্বস্ততার সমুদ্র সাথে করে।
অনীশ, কতটা ভালোবাসতে পারলে এমন হয় জানি না। কতটা কষ্টে এমন কবিতা আসে জানি না।
“নির্বাসিত প্রেম জাগিয়ে দেয় মধ্যরাতে,
একাকীত্বের প্রহর ফুরোতে চায় না
কিছুতেই।
হৃদয়ের প্রকোষ্ঠে বাড়ে অব্যক্ত
যন্ত্রণা,
দুচোখের নোনাজল শুকিয়ে বাষ্প হয়।
মননে চেতনায় ওড়ে অতীতের জলছবি,
আমার নিজস্বতায় অনন্তকাল ধরে নির্বাসিত স্বপ্ন।
নীলকষ্টের চাদরে জড়ানো প্রেম কফিনবন্দি,
দলিলটুকু আমার কাছেই থাক-
তোমাকে দেবো না।….
-অধরা