তার সাথে আমার পরিচয় জয়নুল গ্যালারিতে। সেদিন সব্যসাচী হাজরার চিত্র প্রদর্শনী হচ্ছিল। তার পরনে ছিল কলাপাতা শাড়ি। কপালে কালো টিপ। চোখে গোল ফ্রেমের চশমা। সাউথইস্টে বিবিএ করছে। শখের চিত্রশিল্পী। আমি বাউন্ডুলে। তবুও আমাদের বন্ধুত্ব হয়। আমি নাকি তার কাছে চিত্রশিল্পী ফিদা মকবুলের মতো। আমার উসকো খুসকো চুলগুলো নাকি তার খুব পছন্দ। আমি কবি না হলেও নিজেকে কবি ভাবতে ভালোবাসি। আর এ জন্যই মনে হয় এ বাউন্ডুলে জীবন। যদিও আমি কোনো কবিতা লিখিনি তবে মুখস্থ করেছি অনেক। কেউ জিজ্ঞেস করলেই বলে দেই, হায় চিল, সোনালি ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে
তুমি আর কেঁদো নাকো উড়ে উড়ে ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে!
তাকে শোনালাম, তুমি মোর প্রিয়া হবে দুই জন্ম পরে…….। তার নাম ইপ্সা।
ইপ্সা একদিন আমাকে তার বাসায় নিয়ে গেল। তার ইচ্ছে বড় করে আমার পেইন্টিং এঁকে তার ঘরে টাঙিয়ে রাখবে। আমার হাসি পায়। এভাবে দিন এগিয়ে চলে। প্রতি বিকেলে আড্ডা চলে টিএসসি চত্বর, ধানমন্ডি লেক কিংবা সংসদ ভবনে। কখনো কখনো সাভারের সুবিস্তীর্ণ তৃণভূমিতে বসি কিংবা বুড়িগঙ্গার দুষিত জলে নৌকা বাই। নৌকোয় পা দুলোতে দুলোতে গল্প করি। সুখের গল্প, দুখের গল্প। দেশের গল্প বিদেশের গল্প। হাতে হাত ধরি। কখনো কখনো বাদামের খোসা খুলতে খুলতে দূর অজানায় হারিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখি। অথচ আমরা কেউ কারো নই। অন্যের হয়ে যাবো। কৃপান্তির কথা মনে পড়ে।কৃপান্তির কথা ইপ্সার কাছেই শুনেছি। আমাদের গল্পের বিশাল অংশ জুড়ে থাকে কৃপান্তি। আমি তাকে দেখিনি, অথচ কখনো তা মনে হয় না। আমার আপন হয়ে উঠেছে। কৃপান্তি কবিতা ভালোবাসে। জীবনানন্দের। ইপ্সার হাত দিয়েই ‘জীবনানন্দ কবিতাসমগ্র’ পাঠিয়েছি। একদিন দুটো কাঠগোলাপের চারা পাঠালাম। তার নাকি খুব ইচ্ছে বাড়ির মেইন গেটের দুপাশে দুটি কাঠগোলাপ গাছ লাগাবে।
কৃপান্তির সাথে খুব দেখা করতে ইচ্ছে করে।কিন্তু ইপ্সা করায় না। অনেক বলার পর একদিন সে রাজি হলো, মোবাইলে কথা বলাবে। রাত নয়টায় মাত্র পাঁচ মিনিটের জন্য।
রাত নয়টা।সমস্ত ঢাকা শহর অন্ধকারে নিমজ্জিত। লোডশেডিং চলছে। অথচ আমার হৃদয়ে জ্বলে আছে অজস্র ইলেট্রিক বাতি। ডায়াল করলাম। একটি মিষ্টি স্বর বলে উঠলো, আপনার ডায়ালকৃত নাম্বারে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এভাবে কয়েকবার চেষ্টা করলাম। অবশেষে সংযোগ পেলাম। সে দেখি ইপ্সার সাথে আমার বলা সব কথা জানে। বলল, আপনার খুব কষ্ট না? আমি বললাম, কিসের কষ্ট? সেতো জীবনের পরশপাথর। আপনাকে পেয়েছি!
সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। আবার ডায়াল করলাম। আবার সেই মিষ্টি স্বর বলে উঠলো, সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
পরদিন ইপ্সাকে সবকিছু বললাম। সে শুধু হেসে আমাকে শিল্পকলা একাডেমিতে নাটক দেখাতে নিয়ে গেল। শেকসপিয়ারের হ্যামলেট। কিছুতেই মন বসাতে পারলাম না। সে আমার মনের বিমর্ষতা বুঝতে পেরে বলল, শুক্রবার ভাদুনে এসো। কৃপান্তির সাথে দেখা হবে। এবার ইলেট্রিক বাতি নয়; মনের আকাশে জ্বলে উঠলো অজস্র তারকারাজি। নাটকে মন দিলাম। ওফেলিয়া জলে ডুবে মারা যাচ্ছে। নদীর বুকে নেমে আসা একটি শাখায় ভর দিয়ে সে একটি উইলো গাছের মাথায় বনমুকুট পরাতে যাচ্ছিল। হঠাৎ শাখাটি তার ভারে ভেঙে যেতেই সে জলে পড়ে গেল। তার পোশাক তার চারপাশে ছড়িয়ে পড়লো। তখন তাকে দেখাচ্ছিল মৎসকন্যার মতো।
শুক্রবার ভাদুনে গেলাম। পুব দিকে লাল মেঠো পথ। মিনিট দশেক হাঁটলে একটা ছোট্ট ব্রিজ। সেই ব্রিজ পেরিয়ে প্রাইমারী স্কুল। সেখানে কৃপান্তির সাথে দেখা হবে। পরনে থাকবে কলাপাতা শাড়ি। অপেক্ষায় আছি। কিন্তু সে আসে না। ইপ্সার নাম্বারও বন্ধ। অবশেষে সন্ধ্যার একটু আগে ঢাকা থেকে একটা লাশ আসলো। ধর্ষিত নারীর লাশ। পরনে ছিল কলাপাতা শাড়ি। কপালে কালো টিপ। চোখে গোল ফ্রেমের চশমা নেই। পাখির নীড়ের মতো চক্ষু মুদে আছে অনন্তকালের যাত্রায়। আমি মরামাছের চোখ দিয়ে দেখলাম। ইপ্সার লাশ। খড়কুটো লাশ। পুড়ে ছাই হবে। হায় কৃপান্তি তুমি কোথায়? তুমি কি ইপ্সা? যে আমায় সবসময় বলতো, আমরা কেউ কারো নই। আমরা চলে যাবো দু’জনার পথে। তুমিতো তোমার পথে চলে গেলে। আর আমি উন্মাদের মতো ঘুরে বেড়াই টিএসসি চত্বর, ধানমন্ডি লেক, সংসদ ভবন। কখনো কখনো সাভারে সুবিস্তীর্ণ তৃণভূমি কিংবা বুড়িগঙ্গার দুষিত জলে তোমাকে খুঁজি। কৃপান্তিকে খুঁজি। আর বার বার শুনি, আমি হবো তোমার প্রিয়া দুই জন্ম পরে……..।