-আরে লোপা, কেমন আছো?
-যেমন দেখছেন!
লোপা মিটিমিটি হাসছে।
দু’জনে হাঁটছিল আর এগুচ্ছিল। হঠাৎ লোপা বলে উঠলো- আচ্ছা সৌমিক ভাই, আপনাকে একটা কথা বলি।
-বলো।
-আপনার একটা বিশেষ গুণের কথা শুনলাম।
-কি রকম?
-আপনি নাকি আগে বেশ কবিতা লিখতেন?
-হ্যাঁ লিখতাম। তবে-
সৌমিক কথাটা শেষ করতে পারলনা লোপার আচমকা চিৎকারে। তার আনন্দ চিৎকারের কারণটা হলো, এক পিচ্চি মেয়ের হাতে দুটো কদম ফুল জ্বলজ্বল করছে।
এক হাতে এক গোছা বেগুনি রঙের জারুল ফুল। অন্য হাতে দুটো কদম ফুল।
-ইয়াও! কি সুন্দর! এই পিচ্চি শোন। কত দাম? দশ টাকা ?
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলল লোপা। এই উঠতি বয়সে তার হাতে ফুলগুলো যেন আরো বেশি শোভা পাচ্ছে। সৌমিক কে সে কিছু বুঝতে না দিয়েই কদম গোছাটা হঠাৎ করে তার হাতে তুলে দিয়ে বলল- নিন, আপনাকে দিলাম।
মাথাটা আলতো করে নুইয়ে লোপা খিল খিল করে হাসতে লাগল।
সৌমিক কিছু বলার আগেই লোপা হাত উঁচিয়ে- সৌমিক ভাই আজকে তাহলে আসি। বলে আগের মত হাসতে হাসতে চলে গেল।
সৌমিক হা হয়ে থাকল। লোপাকে সে যত দেখছে তত যেন অবাক হয়ে যাচ্ছে।
সারা রাত এক টানা বৃষ্টি চলেছে।
সকালের আবহাওয়া বেশ ফ্রেশ। মেঘের থমথমে ভাবটা এখনো আছে। মেঘের ফাঁক গলিয়ে এক টুকরো রোদ হাসছে।
সৌমিক আর লোপা মাঠের পূর্ব পাশের বড় কদম গাছটার নিচে একান্ত আপন হয়ে বসে আছে।
কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা সবে মাত্র আসতে শুরু করেছে। লোপা সৌমিকের বাম হাত নিয়ে খেলছে।
-আচ্ছা সৌমিক, ইদানিং বুকের ভেতরটায় যেন কেমন কেমন লাগে। এখান থেকে উঠে যখন ঐ ফার্স্ট বিল্ডিংটা পার হই, তখন কেমন যেন একা একা লাগে। বুকটা ঢিবঢিব করে। ভয় ভয় লাগে।
লোপা আনমনা হয়ে যায়।
সৌমিক লোপার দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে। কোন উত্তর না পেয়ে লোপা হঠাৎ ভ্রুকুটি করে তাকায়। কৃত্রিম রাগে ওর মুখটা লাল হয়ে যায়।
-কি ব্যাপার হাসছো কেন?
-জারুল বনে যে আগুন লেগেছে সখি!
লোপা কিছু না বুঝে হেসে ওঠে।
বিকেল পাঁচটার পর সাধারণত সৌমিক মাঠে থাকে না।
কিন্তু আজ ইচ্ছে করছে সারাটা বিকেল এখানে কাটায়। মাঠের সেই কদমগাছটা যেন তাকে চুম্বকের মত টানে। বুকের বামপাশটায় পিঁপড়ের কামড়ের
মত অনুভূতি হয়।
সৌমিক গাছের নিচে বসার স্থানটায় এক পলক তাকিয়ে থেকে কি মনে করে ঘুরে দাঁড়ায়। চোখের সামনের প্রশস্ত মাঠ যেন আরো প্রশস্থ মনেহয়।
সৌমিক উদ্ভ্রান্তের মত হাঁটতে হাঁটতে সবুজ ঘাসের ওপর বসে পড়ে। হাত দু’খানা মাটিতে ঠেস দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।
কী বিশাল বিস্তৃত নীল আকাশ। কোথাও মেঘের কোন ছিটেফোঁটা নেই। যেন বিষাদে ছেয়ে যাওয়া এক জগত।
-স্যার, কদম ফুল নেবেন না।
সৌমিক নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে ছেলেটির হাতের কদম ফুলের দিকে। তার চোখে ভাসে লোপার হাসি মুখ। ঘন কালো চুলের খোঁপায় গুঁজে দেওয়া টাটকা কদম ফুলের হাসি। কে জানত সে হাসি এত ক্ষণস্থায়ী হয়ে উড়ে যাবে।
ছেলেটির হাতের সদ্য ছেঁড়া ফুলের ওপর সৌমিক স্পষ্ট দেখতে পায় লোপার উল্টে যাওয়া রিকসাকে। মহাসড়ক ধরে দানবের মত ছুটে যাওয়া দৈত্যাকার ট্রাকের ছবি।
কদমের রেনুগুলো যেন ভয়ে কাটা দিয়ে ওঠা গায়ের রোম। রাস্তার পাশে ছিটকে পড়া লোপার নিষ্প্রাণ দেহ। কালো চুলের খোঁপায় গোঁজা কদম ফুল।