পক্ষঘাতগ্রস্তে বাবাকে হারিয়ে সংসারের হাল ধরতে প্রকৃতি এরতাজকে বাধ্য করেছিলো একরকম। শূন্যের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে করুণ ক্লেদাক্ততার অতল অন্ধকারে রায়হান নামের কোনো এক পরম করুণাময় প্রদীপ জ্বলে ওঠে।
আকাশ ছাড়া এই অচেনা শহরে ছাদহীন মানুষটার ফ্যাক্টরির হেলপারের চাকরিটা ছিলো বেঁচে থাকাকার অন্তিম আকুতি।
সারাদিন গাদাখাটুনির পর কবুতোরের খুঁপড়ির মতো ঘরটা তিনজনের সঙ্গে গাদাগাদি করে রাত কাটিয়ে দিতো দুটো ডাল-ভাত খেয়ে। মাস গেলে হাজিরা বোনাস আর অভারটাইম মিলে দশ-বারো হাজার টাকা মাইনে পেতো। রোজগারের সিংহভাগ টাকাই বিকাশের মাধ্যমে মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিতো। আমিকে ভুলে আমার ভেতর অসুস্থ মা আর একমাত্র ছোট বোন রাহেলার জন্য ছিলো এরতাজের অবারিত জায়গা।
কোনো এক সামারের সকালে ফ্যাক্টরির গুদামঘরে তাকে ঝুলন্ত অবস্থায় আবিস্কার করে সিকিউরিটি মমতাজ। ফ্যাক্টরির সকলেই খুব আশ্চর্য হয়েছিলো এই ভেবে যে, এরকম এক সোজা-সাপ্টা ছেলেকে কোন শিমরের বাচ্চা গুদামঘরে ঝুলিয়ে রাখলো। আর এভাবেই একটা অসহায় পরিবার আরও অসীম অসহায়ের মুখে পতিত হলো এবং তারপর…
পক্ষঘাতগ্রস্ত স্বামী ও দুই ছেলেমেয়ের সংসারের ঘানি টানতে টানতে কখন যে, নিজের ডান কিডনিটা অকেজো হয়ে গেছে টেরই পাননি বৃদ্ধা রাবেয়া খাতুন।
প্রত্যেক মে দিবসে রাবেয়া খাতুনের কবুতোরের খুপড়ির মতো ঘরটা শ্রমিক ইউনিয়নের লোকজনের জোয়ারে ভেসে যায়। এরতাজের মৃত আত্মার শান্তি কামনা করে দোয়া খায়ের হয়। খিচুরি বিতরণ হয়।
রাষ্ট্রপক্ষের উকিল মামলার তারিখের জন্য সরকারি নোটিশবোর্ডে ঝুলে থাকেন ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানো কয়েদির মতো।
পুলিশ কর্মকর্তারা জোড় গলায় উপস্থিত জনতার সম্মুখে জানান দেয় যে, আমাদের কাছে যেসব আলামত আছে তা দিয়েই হত্যাকারীকে ধরতে পারিনি। তবে অচিরেই ধরতে পারবো বলে আশা করছি। হত্যাকারী আইনের হাত ফসকে বেশিদিন পালিয়ে থাকতে পারবে না। মনে রাখবেন, আইন সবার জন্য।
টিভি চ্যানেল ও পত্রিকার সাংবাদিকরা বয়সের ভারে ন্যুব্জ রাবেয়ার শীর্ণ ছবি তুলে ভাঙা ভাঙা আকুতি রেকর্ড করে নিয়ে যায় সম্প্রচার করার জন্য। সাত বছর ধরে তিনি একটিই দাবি করে আসছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রির কাছে,
‘মুই মোর ছাওয়ার খুনের বিচার চ্যাঁও।’
বলেই কাতান শাড়ির আঁচলে ক্লিষ্ট দৃষ্টি মোছেন। এই আঁচলে কতো পাথর জমেছে —এইসব সাংবাদিক অথবা শ্রমিক ইউনিয়নের লোকজনরা আদৌ কী উপলব্ধি করতে পারে!
পিএসসি পাশ করতে না করতেই সংসারের হাল ধরে জীবননৌকার মাঝি হয়েছে এরতাজের ছোট বোন রাহেলা। ঢাকার যে ফ্যাক্টরিতে এরতাজ হেলপারি করতো, সেই ফ্যাক্টরিতেই তার অপারেটর পদে একটা চাকরি হয়েছে।
অবিবাহিতা আর সুন্দরি হওয়ার সুবাদে কবুতোরের খুপড়ির মতো ঘর ছেড়ে বাইরে বেরোলেই ইভটিজিংয়ের শিকার হয়। কোথাও নালিশ করার সাহস পায় না। মেয়েদের মনে হয় ব্যক্তিগত দুঃখ ছাড়া কারো কাছে অভিযোগপত্র ড্রপের বাক্স থাকে না।
ডানবাঁ থেকে কেবল কুত্তার মতো তাড়া করে প্রেমের অফার। রাহেলা জানে, এগুলো প্রেম না কাম। কাম না কামড়-ক্লেদ। দেহ নিয়ে জুয়া আর ফূর্তিবাজি। কলসি খালি হলেই পাখি ফুরুত। তাদের ফ্যাক্টরির প্রোকডাকশন ম্যানেজার মইজ্জুদ্দিন তাকে চোখের আড়ালে যেতে দেয় না। কয়েকবার জবরদস্তি করে নাভি অব্দি চলে গিয়েছিলো।
এ কথা রাহেলার শরীর ছাড়া আর কেউ জানে না।
রাহেলাদের ফ্যাক্টরির প্রোডাকশন ম্যানেজার মইজুদ্দিন। উনি রাহেলাদের মতো মেয়েদের অসহায়ের সুযোগে জীবনযৌবনে ঢুকে পড়ে গিরগিটির মতো। সেবার নামে সেবন, দানের নামে দোহন করতে ওঁৎ পেতে থাকে ফুসরতের জানালায়। উদ্দেশ্য হাসিল হলেই টয়লেট পেপারের মতো ছুঁড়ে ফেলে ময়ল্রা বাস্কেটে। এমনই এক ফাঁদ পেতে ওঁৎ পেতে আছে রাহেলার যৌবনজানালায়।
মে দিবসে পড়ার জন্য পাশের বাসার রহিমন খালার কাছ থেকে হাওলাত করে আনা শাড়িটা খুলে পুরাতন ছিঁড়া একটা শাড়ি পড়ে বারান্দায় দাঁড়াতে গিয়ে কুঁকিয়ে ওঠেন বৃদ্ধা রাবেয়া খাতুন। রাহেলা শবজি কাটা ফেলে মাকে ধরতে দৌড়ে কিচেন থেকে ছুটে আসে।
একদিন ওষুধ না খেলে রাবেয়া খাতুন কাহিল হয়ে পড়েন। সকালে রাহেলাকে ওষুধ আনার কথা বলা হলেও দোকানদার বাকি না দেয়ায় আনতে পারেনি রাহেলা। সে বলেছে, কাল বেতন দিলে নিয়ে আসবো।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে রাবেয়া খাতুন ক্যালেন্ডারের দিকে অশ্রুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন এই ভেবে যে, এই ঘরে আবার কবে মে দিবস আসবে।
মাঝে মাঝে মধ্যরাতে কোনো এক দুঃস্বপ্নে রাহেলার ঘুম ভেঙে যায়। একবার ঘুম ভাঙলে তার আর ঘুম আসে না রোগ পেয়ে বসে। এই রোগের নাম সে বলতে পারে না। বড় ভাই এরতাজ বেঁচে থাকলে হয়তো আজকে সে তার সহপাঠি শারমিনের সঙ্গে ভার্সিটিতে পড়তো। অথচ একটি মৃত্যু তাদের সব উলটপালট করে দিয়েছে।
জীবিকার তাগিদে মায়াবতী গ্রাম ছেড়ে শেষমেষ ঢাকা নামক ডাকাতের নরকে নীড় বাঁধতে হয়েছে। বিয়ে নামের সোনার স্বপ্ন দেখতেও সাহসও পায় না অসুস্থ মায়ের করুণ মুখাবয়বে তাকিয়ে। বিয়ে হলে কে দেখবে এই মানুষটাকে?
প্রোডাকশন ম্যানেজার মইজুদ্দিনের নোংরা প্রস্তাবগুলো তাকে বিষমভাবে বিষিয়ে তুলেছে। ইচ্ছে করে তার খালাতো বোন পায়েলের মতো ঘুমের বড়ি খেয়ে সুইসাইট করতে। কিন্তু কোনো এক অসীম অপারগতার বেড়িতে আটকে থাকে তার সে অসহ ইচ্ছে। এই যাপিত দহনের ভেতরও ভালো লাগার রক্তজবা ফোটে। কেবল রায়হানের মতো কোনো এক সুদর্শনের একজোড়া চোখের মায়ায় তার ডুবতে ভালো লাগে।
কোনো এক শীতগ্রস্ত দিনে জীবনের পথে হাঁটতে হাঁটতে রায়হানের মতো অচেনা প্রদীপের সাথে দেখা হয়েছিলো এরতাজের। যখন এরতাজ না খেয়ে খেয়ে একটা কাজের জন্য ফ্যাক্টরির পর ফ্যাক্টরির গেটে গেটে ঘুরছিলো। রায়হান প্রদীপের মতো এরতাজের অন্ধকার অরণ্যে আলো ছড়ালো
হেলপারের চাকরিটা নিয়ে দিলো। হাজিরা বোনাস ও অভারটাইম মিলে দশ-বারো হাজার টাকা মাস গেলেই মাইনে পাওয়া শুরু হলো। কবুতোর খুপড়ির মতো একটা ঘর তিনজনের সাথে শেয়ার করে তিন হাজার টাকায় থাকা-খাওয়ায় মাস চলে যেতো। রোজগারের সিংহভাগ টাকা বিকাশের মাধ্যমে বৃদ্ধা মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিতো।
এভাবেই এরতাজের জীবন শুরু হয়েছিলো রায়হানের আলোকিত হাত ধরে। রাহেলাকে প্রায় এরতাজ রায়হানের গল্প শোনাতো বাটনআলা ফোনালাপের মাধ্যমে।
প্রোডাকশন ম্যানেজার মইজুদ্দিন অনেক ফলমূল, শাক-শবজি, মাছ ও ওষুধপত্র নিয়ে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে রাহেলাদের বাসায় আসেন। রাবেয়া খাতুনের হাতে খাদ্যসামগ্রী গুঁজে দিতে দিতে বলেন, মনে করেন খালাম্মা আপনার ছেলে এরতাজ এনেছে। মৃত ছেলের দোহাই শুনে রাবেয়া মায়ের ভূমিকায় নেমে খাদ্যসামগ্রী গ্রহণ করেন।
মাঝে মাঝে মইজুদ্দিন এখানে আসে। রাবেয়া খাতুনের খোঁজ-খবর নেয়। ভালো-মন্দ জিগায়। এটা-ওটা দেয়। এসবই কেবল রাহেলাকে নিজের করে পাওয়ার জন্য। কবে যে এই ময়না পাখিটা তার খাঁচায় ধরা দিবে…
নিদানের দিনে ফলমূল, শাক-শবজি, মাছ ও ওষুধ সামগ্রী পেয়ে মইজুদ্দিনকে ফেরেশতার সাথে তুলনা করেন বৃদ্ধা রাবেয়া খাতুন।
‘ভালা মানুষ রইচে বইলাই পৃথিবীডা এহনও ধ্বংস অয় নাই।’
দুপুরের লাঞ্চ সেড়েই ওষুধ খেয়ে শুয়ে ঘণ্টাখানেকের ভেতর একটু সুস্থতাবোধ করলে জায়নামাজে বসে বসে মইজুদ্দিনের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেন তিনি।
‘আল্লাহ, লোকডারে ভালা রাইখো তুমি!’
রাহেলার ইচ্ছে করছিলো মইজুদ্দিনের মুখে থুথু ছিটিয়ে আসে। মোরা গরিব হইবার পারি বি ফকির না। হ্যার কাচে ভিক্ষা লমু কুনু।
প্রতিবেশীরা মুইজুদ্দিনের আসা-যাওয়া বাঁকা চোখে দেখে। কথা ফিসফাসের পথে হাঁটতে হাঁটতে চৌহদ্দি অব্দি ছড়ায়। আজেবাজে গল্প বিষ্ফোরিত হয় মইজুদ্দিন ও রাহেলাকে কেন্দ্র করে।
রাহেলা কেবল অসহায় মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সব ক্ষোভ দমিয়ে রাখে। চাকরিটা না থাকলে কি করে খাবে তারা। সাত বছর ধরে ভাইয়ের হত্যার বিচার চাইতে চাইতে ক্লেদাক্ত।
সব কথা মাকে বলা যায় না। রাহেলা কেবল মুখে ওড়না চেপে বুকের ভেতর পাথর পুষে যায় দিনের পর দিন।
ইদানিং রায়হানের শিমুলটাও রাহেলার শীতঋতুতে শিশিরের মতো নিঃশব্দে ঝরে পড়ছে। রায়হান মাঝে মাঝে বুকের মাঝখানে কোনো এক বেগানা স্পর্শ টের পেতে থাকে।
রোজ তাদের কতো কথা হয়। খালাম্মা কেমন রইচে? তর কুনু সমস্যা অইতেচে না তো? কিচু লাইগলে আমারে কইবি। এরতাজ খুব ভালা পোলা আচিলো। ওর হত্যার বিচার অ্যাকদিন অইবোই অইবো।
কিন্তু শত কথার ভিড়ে কেবল একটি কথা কোনোদিনও বলা হয় না তাদের। কখনো বলা হবে কি-না তাও জানে না তারা। দীর্ঘশ্বাসের ছিপি খুলে ঠাস করে বের হয় হাওয়াইমিঠাইর মতো মিশে যায় বাতাসের গর্ভাশয়ে। আর সেই না বলার নাম ‘আমি তুমারে ভালাবাচি।’
অসুস্থ মাকে একটা সুস্থ পৃথিবী এনে দিতে ইচ্ছে করে রাহেলার। ডাক্তার বলেছেন, অপারেশন করলে আপনার মা ভালো হয়ে যাবেন। উনি আবার আগের মতো চলতে ফিরতে পাবেন। অনেক ব্যয়হুল হবার কারণে আজও তার অপারেশন করানো সম্ভব হয়নি ওয়ার্কার রাহেলার পক্ষে।
জীবনের রেলিঙ ধরে হুট করে এসে যায় রায়হানের প্রেম। প্রতিদিন কাজের ফাঁকে চোখাচোখি হয়। ইশারা বিনিময় হয়। চাঁদনি রাতে আসমানের দিকে তাকালেই রায়হানের জন্য রাহেলার গহীনগহন ব্যাকুল হয়ে ওঠে।
অনেক দিন হয়ে গেলো রাহেলা। আমার আর ত্বর সইছে না। জানো তো, অপেক্ষা করতে আমার একদম ভালো লাগে না। তুমি খালাম্মাকে সব খুলে বলো। আমি তোমাদের নতুন জীবন দেবো। উত্তরায় তোমার নামে ফ্লাট হবে। আমার মিরপুরের কাপড়ের দোকানটা তোমার নামে লিখে দেবো। আগের বউকে ডিভোর্স দিয়ে সোজা তোমার কাছে চলে আসবো। রাহেলা কিছু বলে না। কেবল বোবা কান্নার মতো মইজুদ্দিনের লোভার্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকে।
আমারে আর কডাদিন সময় দেন।
দেখো, বেশি দেরি করতে করতে ততদিনে না তুমি ভাইরাল হয়ে যাও…
রাহেলার ইচ্ছে করছিলো মুইজুদ্দিনের মুখের উপর জীবনের সমস্ত থুথু ছিটিয়ে দেয়।
ব্যাডা, লম্পট কোথাকার। বউ থাইকতে বিয়া কইরতে চায়। কতো মাইগো জেবন নষ্ট কইরছে তার কুনু হিশাব নাই।
আরেকটা মে দিবসের দিকে তাকিয়ে রাবেয়া খাতুন। কবুতোরের খুপড়ির মতো ঘরটা শ্রমিক ইউনিয়ন থেকে আসা লোকজনের জোয়ারে ভেসে যাবে। এরতাজের মৃত আত্মার শান্তি কামনা করে দোয়া খায়ের হবে। খিচুরি বিতরণ হবে।
রাষ্ট্রপক্ষের উকিল মামলার তারিখের জন্য সরকারি নোটিশবোর্ডে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানো কয়েদির মতো ঝুলে থাকবে মাসের পর মাস।
পুলিশ কর্মকর্তারা জোড় গলায় উপস্থিত জনতার সম্মুখে জানান দেবে যে, আমাদের কাছে যেসব আলামত আছে তা দিয়ে এখনও হত্যাকারীকে আমরা ধরতে পারিনি। তবে অচিরেই ধরতে পারবো বলে আশা করছি। হত্যাকারী আইনের হাত ফসকে বেশিদিন পালিয়ে থাকতে পারবে না। মনে রাখবেন, আইন সবার জন্য।
টিভি চ্যানেল ও পত্রিকার সাংবাদিকরা বয়সের ভারে ন্যুব্জ রাবেয়ার শীর্ণ ছবি তুলে ভাঙা ভাঙা আকুতি রেকর্ড করে নিয়ে যাবে সম্প্রচার করার জন্য। সাত বছর ধরে তিনি একটি দাবিই আবার জোড় দিয়ে করবেন,
‘মুই মোর ছাওয়ার খুনের বিচার চ্যাঁও।’
বলেই হাওলাত করা কাতান শাড়ির আঁচল দিয়ে অশ্রুত দৃষ্টি মোছবেন। এই আঁচলে কতো শোক জমে আছে এইসব সাংবাদিক অথবা শ্রমিক ইউনিয়নের লোকজনরা আদৌ কী উপলব্ধি করতে পারবে!
রায়হানকে সবশেষ জামালের চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে রাহেলা। এরপর থেকে তাকে আর কোথাও দেখা যায়নি। শোনা যাচ্ছে, আজ তিনদিন অব্দি তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হঠাৎ করে কোথাও হাওয়া হলো লোকটা কেউ বলতে পারে না। রাহেলার সন্দেহের ছুরি মইজুদ্দিনের দিকে ছুটতে থাকে…
কোনো এক সাপ্তাহিক ছুটির দিনে রাহেলাকে কাজের অছিলায় বাসা থেকে নিয়ে যায় মইজুদ্দিন। এরপর তাকেও আর পাওয়া যায় না তিনদিন অব্দি। মইজুদ্দিনের ফোন সুইসঅফ। ফ্যাক্টরিতেও আসা না। প্রায় তিনদিন পর বৃষ্টিভেজা সকালে রাহেলাকে ঝুলন্ত অবস্থায় ফ্যাক্টরির গুদামঘরে আবিস্কার করে সেই সিকিউরিটি মমতাজ।
মনে হচ্ছে যেন একটি ময়না পাখি ভাঙা ডানার যন্ত্রণায় ছটফটাতে ছটঅটাতে কোথায় যেন নিরুদ্দেশ হয়ে গেলো। বৃদ্ধা রাবেয়া খাতুনের পৃথিবী জুড়ে নেমে আসে অসীম স্তব্ধতা!
মে দিবস এসে গেছে রাবেয়া খাতুনের সেই কবুতোরের খুপড়ির মতো ঘরটাতে। শ্রমিক ইউনিয়নের লোকজনের জোয়ারে ভেসে গেছে চৌকাঠ পেরিয়ে বারান্দা অব্দি। এরতাজ ও রাহেলার মৃত আত্মার শান্তি কামনা করে দোয়া খায়েরে উপচে পড়ছে সমূহ প্রাণোস্পন্দন। খিচুরি বিতরণের হিড়িক লেগেছে
রাষ্ট্রপক্ষের উকিল মামলার তারিখের জন্য সরকারি নোটিশবোর্ডে আজও ঝুলে আছেন ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলোনো কয়েদির মতো।
পুলিশ কর্মকর্তারা জোড় গলায় উপস্থিত জনতার সম্মুখে এবারও জানান দিচ্ছে যে, আমাদের কাছে যেসব আলামত আছে তা দিয়ে এখনও হত্যাকারীকে আমরা ধরতে পারিনি। তবে অচিরেই ধরতে পারবো বলে আশা করছি। হত্যাকারী আইনের হাত ফসকে বেশিদিন পালিয়ে থাকতে পারবে না। মনে রাখবেন, আইন সবার জন্য।
টিভি চ্যানেল ও পত্রিকার সাংবাদিকরা অসহায়ের ভারে ন্যুব্জ রাবেয়ার শীর্ণ ছবি তুলে ভাঙা ভাঙা আকুতি রেকর্ড করছেন সম্প্রচার করার জন্য। আট বছর পর তিনি তার দাবিগুলো আরও জোড় দিয়ে বলছেন,
‘মুই মোর ছাওয়ালদের খুনের বিচার চ্যাঁও।
মুই মোর ছাওয়ালদের খুনের বিচার চ্যাঁও।’
বলেই হাওলাত করা কাতান শাড়ির আঁচল দিয়ে অশ্রুত দৃষ্টি মোছেন। এই আঁচলে কতো পাথর জমেছে —এইসব সাংবাদিক অথবা শ্রমিক ইউনিয়নের লোকজনরা আদৌ কী উপলব্ধি করতে পেরেছে!
লেখক : তরুণ সাহিত্যিক।
জন্ম : ১৯৮৭ সাল, রংপুর।
প্রকাশিত বই দুইটা।
এক. ওকাবোকা তেলাপোকা (২০১৬) -শিশুতোষ
দুই. এলিয়েনের দেশ পেরিয়ে (২০১৭)-শিশুতোষ।