আত্মহননের মতো স্বেচ্ছা ছুরিতে নিজেকে রক্তজবা করে কেউ কেউ চলে যায় কখনো সখনো ইডিপাসের মতো। অথবা কোনো এক অদৃশ্য আঙুলের অভ্যাগত ইশারায় মায়ার বিশালতা ছেড়ে কাউকে না কাউকে চলে যেতে হয় কোনো একদিন শূন্যের অভিমুখে।
এই শূন্যতার নাম না থাকা। এই শূন্যতার নাম চলে যাওয়া। আর এইসব প্রাচীনতম সত্যর মহত্তম মিথ মেনে নিশ্চিন্তে চোখভর্তি রাজহাঁসের স্বপ্ন-সমেত বেঁচে থাকার কৌশলের নাম হচ্ছে মানুষ, কসরতের নাম হচ্ছে প্রেম। অথচ মাঝে মাঝে মানুষ ভুলে যায় সে কথা। প্রেমিকের মনে থাকে না সেই মিথ। সেরকমই কোনো এক ভুলে যাওয়া মানুষের নাম হলো আয়মান। সেরকমই কোনো এক অন্ধ প্রেমিকের নাম হলো আয়মানের পিতৃপ্রেম। কোনো এক চলে যাওয়াকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না ওর ভেতরের সন্তানসুলভ মানুষটা।
হাবিলের হন্তারক হাতের লালপথ ধরে আদিমকাল থেকেই চলে যাবার মিছিলে নেমেছে এইসব মানুষের দল। মানুষ কেনো চলে যায়? এই প্রশ্নবোধক দুঃখ তাকিয়ে থাকে চলে যাওয়া মানুষের শূন্যের অভিমুখে। সীমাহীন শূন্যতাও চেয়ে থাকে নিরুত্তর দুঃখের করুণ চোখের অভিমুখে। দুঃখ লজ্জা পায়। অচেনা আড়ালে মুখ লকায়। এই আড়ালের নাম হতাশা। এই আড়ালের নাম দুঃস্বপ্ন।
কোনো এক চলে যাওয়ার হতাশায় ডুবে আছে পঁচিশতম বসন্তে পা ছোঁয়া আয়মান। ওর সে চলে যাবার নাম বিকেলের ঠোঁট থেকে একটি অনিবার্য চুমু খসে যাওয়া। ওর সে চলে যাবার নাম হৃদয়ের অর্গল ফসকে যাওয়া কোনো এক সুখশ্বেতের নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি। ওর সে চলে যাবার নাম জীবনের বেষ্টনী ভেঙে সরে যাওয়া কোনো এক সহিষ্ণু ছায়া। ওর সে চলে যাবার নাম হলো পরম পিতা।
পিতার চলে যাওয়াকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না ও। কিছু কিছু চলে যাওয়া মাঝে মাঝে মেনে নেওয়া যায় না। কিছু কিছু চলে যাওয়ার জন্য থাকে না কোনো পূর্ব প্রস্তুতি। হুট করে চলে যাওয়া হারমোনিয়ামের সাদা কালো কিবোর্ডে ঝরা পাতার মর্মর ধ্বনি তুলে। সেরকমই এক চলে যাওয়ার নাম পিতা। তবু ওকে অঘোষিত চলে যাওয়ার সনদে স্বাক্ষর করে স্বাগত জানাতে হয় ‘উনি চলে গেছেন’। সাক্ষাৎ না করেই বলতে হয় ‘বিদায় পিতা’। টেলিভিশনের প্রত্যেক চ্যানেলে সম্প্রচার করা হচ্ছে সেই বিদায় বিবৃতি। আর বিবৃতিকারীর বিষাদাচ্ছন্ন বিত্রস্ত মুখ।
এমন একজন মানুষের মুখটা শেষবারের মতো দেখতে চেয়েও সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকায় না দেখার আফসোসে বারবার ফেটে পড়ছে করুণ কান্নাসমেত ভঙ্গিমায় কতিপয় মুখমণ্ডল। এইসব মুখ কতো কাছের ছিলো, কতো প্রিয় ছিলো চলে যাওয়ার মুখের। এইসব মুখের হাসি পাতায় ছেয়ে থাকতো সেই বিস্মৃত মুখ।
স্মৃতির স্কেচ ঘষতে ঘষতে কাঁচ ও কংক্রিটের দেয়ালে ভেসে ওঠে কোনো এক সাঁটানো আলোকচিত্র। তার অপার আলোর দিকে তাকাতেই অচেনা অন্ধকার কেমন যেন হুঁহুঁ করে উঠে ওদের। সত্যি সত্যি লোকটা এভাবে চলে যাবেন কেউ দুঃস্বপ্নেও ভাবে নি। হায় রে নিয়তি। নিয়তি একটি উত্তর না মেলা জীবনের কোনো এক কঠিন অঙ্ক। পিতার চলে যাওয়ার পর থেকে হিসাবের সঙ্গে নিয়তির কোথায় যেন একটা সংঘাত টের পেতে থাকে ওর পরিবার।
কী থেকে কী হয়ে গেলো কেউ হিসাব মিলাতে পারছে না। কোনো এক ফুরফুরে ছুটির বিকেলে আসরের নামাজ সেড়ে মসজিদ থেকে এসে আর জায়নামাজে দাঁড়াতে পারেন নি ষাটোর্ধ্ব লোকটা। কেমন জানি একটা অস্বস্তিবোধে বিছানায় শুয়ে বিব্রত গোঙানির গহনে ডুবতে থাকেন তুমুলভাবে। এই কেমন থেকে কতো কী হয়ে যাবে কেউ ভাবতেও পারে নি। কেবল হাসপাতাল থেকে হাসপাতাল ঘুরতে ঘুরতে শেষমেষ আইসোলেশন থেকে আইসিইউ’র নৈঃশব্দ্যের কড়িডোরে এসেই জায়গা হলো ওনার। কেউই হিসাব মিলাতে পারছে না কোনোভাবে। না গাণিতিক, না রাজনৈতিক, না পারিবারিক, কোনোভাবেই হিসাব কষে উত্তরের কোনো আগামাথা পাওয়া যাচ্ছে না। এই হিসাব না মিলানোর মানেই কি হলো চলে যাওয়া? ঘোরের ঘোড়ায় ছুটে চলেছে যেন যাবতীয় যন্ত্রণা।
সরকারি লোকের গ্লোভসবন্দি আঙুল ধরে হাসপাতাল থেকেই চলে গেলেন লোকটা। শেষ মুহূর্তে একটি বারের জন্যেও এই বাড়িতে পা রাখতে পারলেন না এই শূন্যের অভিমুখী। আহা বাড়ি! মায়ার বিশালতায় ছোট্ট একটি বাড়ি। কতো শ্রম আর সঞ্চয়ে বানানো পিতাহীন বাড়িটা যেন দাঁড়িয়ে আছে শোকের তরঙ্গে প্রবাহিত সমুদ্রের উপর। পলেস্তরা যেন খসে খসে উড়ে যাচ্ছে কান্না ও করুণার পালক হয়ে বাড়ির চোহদ্দিতে। সুবিশাল আম, জাম, সুপুরিগাছগুলো যেন অন্তরঙ্গ আত্মীয়ের মতো আগলে আছে শোকগ্রস্ত বাড়ি ও বাড়ির অধিবাসীদের।
দুপুর বেলা সরকারি লোক এসে পুরো বাড়িটা সিলগালা করে লকডাউন ঘোষণা দিয়ে গেছে। আয়মান, ওর পাঁচ বছরের বাচ্চা তুবা আর একুশ বছরের যুবতী স্ত্রী আদিবা মিলে তিনজন প্রাণি কেবল এই নিস্তব্ধ বাড়ির নির্মম নৈঃশব্দ্যে অবরুদ্ধ হয়ে আছে। জনসাধারণ থেকে শুরু করে সরকারি লোকজন সবসময় কড়া নজদারি রেখেছে এই একটি বাড়ির গতিবিধির উপর। এই একটি বাড়িই যেন অন্য বাড়িগুলোকে বিভক্ত করে ফেলছে ডিভিশনের মতো। এই একটি বাড়িই যেন সারা শহরে চাঞ্চল্যকর বিশেষ কিছু বহন করে যাচ্ছে। সমূহ সন্দেহের বন্দুক যেন তাক করে আছে সামরিক বাহিনী এই একটি বাড়ির দিকেই। আহা বাড়ি! মায়ার বিশালতায় যেন নিষ্ঠুর একটি সুঁড়ঙ্গ।
ওদের ফোন নাম্বার বার বার ট্রেস করে অবগত হচ্ছে যে ওরা বাইরে গেছে কিনা। বাড়ির বাইরে যাওয়া ওদের সরকারীভাবে সম্পূর্ণ নিষেধ। ঘরের ভেতরেও ওরা যেন পরস্পর থেকে একা। ভীষণ একা। এভাবে অবরুদ্ধতার নৈঃশব্দের ভেতর একা থাকতে হবে ওরা কেউ কস্মিনকালেও ভাবে নি। তিন মিটার সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলছে। খুব একটা কথাবার্তা বলছে না কেউ কারো সঙ্গে। নেহাৎ খুব প্রয়োজন না পড়লে কেউ কারো কাছে যাচ্ছে না। সেভাবে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে না। নিজেরাই নিজেদেরকে সাহায্য করছে। এটা বেঁচে থাকার নতুন কৌশল, কার্যকর কসরত। এভাবেই ওরা বেঁচে আছে। এভাবে বেঁচে থাকার নামও চলে যাওয়া হয়তো। হয়তো সেই অপেক্ষার আঙুল ধরে বেঁচে আছে ওদের বিপন্ন প্রানগুলো।
বাইরের পৃথিবী কেমন আছে? ঝিরিঝিরি হাওয়ায় উঠোনে কী আগের মতো ভোর নামে? পিতার স্বহস্তে লাগানো পারুল গাছে পানি সেচের দায়িত্বটা আমার পরিবর্তে অন্য কাউকে দেয়া হয়েছে তো? জলপাই, আমলকি, হরতকি আর নিমগাছেরা ভালো আছে তো? বিরিশিরি বিকেলের টেবিলের অব্যক্ত গল্পগুলো কি বুঁদবুঁদি তোলে ধোঁয়া উঠা কবিতাক্যাফে? বিবিধ প্রশ্ন এসে ধাক্কা দিতে থাকে ওদের রুগ্ন হৃদয়ের অবরুদ্ধ দরজায়।
বাইর থেকে লোকজনের যাওয়া-আসা নিষেধ এই বাড়িতে। পিতার চলে যাওয়ার পর কোনো আত্মীয়ই এই বাড়িতে পা রাখেনি। ফোনে দু চারজনের সঙ্গে কথা হয়েছিলো ওদের। তাও দিন দুই তিনেক হবে হয়তো। সরকারি লোকজন চাল ডাল শাকসবজি না দিয়ে গেলে চুলায় কোনো হাড়ি উঠছে না। ফ্রিজে যা ছিলো তা ফুরিয়ে গেছে বেশ কয়েকদিন আগেই। গতকাল দুপুরের পর থেকে পেটে পানি ছাড়া আর কোনো দাঁনা পড়েনি ওদের।
অসহায় মুরগির বাচ্চার মতো তাকিয়ে আছে তুবা। ওর মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। তুবা মানে আয়মানের প্রেম ও প্রদীপ। বারবার বাবা বাবা বলে কাছে আসতে চাচ্ছে সপ্তাহখানে থেকে। কতোদিন থেকে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে ওর নরোম গালে চুমু খাওয়া হয় না আয়মানের। লাল নীল সাদা কালো কতো রকমের পরির গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়ানো হয় না কতো রাত ওকে। ওর কি ঘুম আসে আমাদের ছাড়া? আহা অতোটুকু বাচ্চার উপরও কি ঈশ্বরের দয়া হয় না। ঈশ্বরের উপর মনের ভেতর জন্মানো বিপুল বিতৃষ্ণার বিজ্ঞান থেকে বলে উঠে আয়মান।
তুবাকে নিয়ে তুমি তোমাদের বাড়ি চলে যাও। স্ত্রী আদিবাকে পিতার অসুস্থতার প্রথম দিনেই বলেছিলো আয়মান। মরলে এক সঙ্গে মরবো। আদিবার এরকমই এক বাক্যের সবুজে আয়মানের ধূসর মাঠ সেদিন সবুজে সবুজ হয়ে ওঠেছিলো। হয়তো কোনো এক মহৎ মায়ায় আচ্ছন্ন হয়েই আদিবা যেতে পারে নি সেদিন। মাঝে মাঝে মায়া মনে হয় দেয়াল ভেঙে এভাবেই একই ছাদের নিচে নিয়ে আসে মায়াশীল মানুষগুলোকে। ভিন্ন ভিন্ন আত্মাগুলোকে একত্রে করে গেয়ে উঠে অভিন্ন আত্মার কোরাস।
কিন্তু তুবা? ও তো কোনো পাপ করেনি। তাহলে ওর কী হবে? মৃতপ্রায় মাছের লাল কানকোর মতো প্রবল হাঁশফাঁশ তুলে আদিবাকে বলে আয়মান। আমি চলে না যাওয়া অব্দি তুবা ও তোমাকে সামলাবো। আর আমি চলে গেলে সরকারি লোক ওর দেখাশোনা করবে। চলে যাবার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। খুব স্বাভাবিকভাবেই বলে আদিবা। চলে যাবার আগে মানুষ কী সত্যিই এত শক্ত থাকে! এত স্বাভাবিক থাকে! আদিবার কথা শুনে সপ্তম আশ্চার্যের পাথুরে ভাস্করের মতো মূর্ত হয়ে ভাবতে থাকে চলে যাওয়া শূন্যের অভিমুখে চেয়ে থাকা আয়মান।
যে কোনো সময় যে কেউ চলে যেতে পারি। কথা বলতে গিয়ে গলাটা প্রচণ্ড ব্যথা করে ওঠে আয়মানের। কাশের ধাক্কা যেন কোনোভাবে সামলাতেই পারছে না ও। একটু পর পর সর্দি যেন মোমের মতো গলে গলে পড়তে চাইছে ওর নাকের সুঁড়ঙ্গ বেয়ে। টিস্যু পেপার যা ছিলো সব ফুরিয়ে গেছে। একটু চা খাবে সেই চিনিটুকু পর্যন্ত ঘরে নেই। আদিবা সরকারি লোককে ফোন করেছিলো কিছু চাল, ডাল, শাকসবজি, চাচিনি আর বাচ্চাটার জন্য এক লিটার দুধের জন্য। আসি আসি করে সন্ধ্যা হয়ে গেলেও তবু জিনিসপত্র নিয়ে কেউ আসে নি।
ল্যাম্পোস্টের নিচে আবছা রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে জানালার রেলিঙ ধরে অবচেতনে কখন যেন চোখের পাতা মুদে আসে আদিবার টের পায় না। অশ্রু ভেজা তেলচিটচিটে বালিশে জ¦রে পুড়ে যাওয়া মাথাটা রেখে বিছানায় পড়ে আছে আয়মানের নিস্তেজ দেহ। পঁচে যাওয়ার দুর্গন্ধে ভরে গেছে সারা বাড়ি। একটু পর পর বমি করছে পাঁচ বছরের তুবা। পাশের ঘর থেকে ভেসে আসছে মা…মা…আব্বু…আব্বু বাচক কান্না মেশানো করুণ আর অবুঝ ধ্বনিগুলো।
কেবল তখনও ল্যাম্পোস্টের নিচে আবছা রাস্তার দিকে তাকিয়ে আদিবার দীর্ঘশ্বাসসমূহ। তখনও পলেস্তরার মতো খসে খসে উড়ে যাচ্ছে সুখশ্বেতের পালকসমূহ কোনো এক শূন্যের অভিমুখে…
লেখক : তরুণ সাহিত্যিক।
জন্ম : ১৯৮৭ সাল, রংপুর।
প্রকাশিত বই দুইটা।
এক. ওকাবোকা তেলাপোকা (২০১৬) -শিশুতোষ
দুই. এলিয়েনের দেশ পেরিয়ে (২০১৭)-শিশুতোষ।