চিঠির কথা মনে আছে? হলুদ খাম, দুই টাকা। এই তো বিশ -একুশ বছর আগেও খবর নেবার মাধ্যম ছিল এই চিঠি। রংপুর থেকে ঢাকা চিঠি যেতে সময় লাগত প্রায় ৩/৪ দিন, এর মধ্যে সরকারি ছুটির দিন পড়লে আরও একদিন যোগ হতো। টেলিফোন ছিল হাতে গোনা কয়েকজনের বাসায়। এখন প্রতিমুহূর্ত যোগাযোগ মোবাইল বা ম্যাসেঞ্জারের মাধ্যমে। সবাই কত কাছের। অথচ আগে কত প্রতীক্ষার ছিল এ চিঠি। খামে কেউ ভরে দিত বকুল ফুল, কেউ বা গোলাপের পাপড়ি। প্রেমিক-প্রেমিকাকে, ভাই-বোনকে, ছেলে-বাবাকে আর সেটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই টাকা চাহিয়া-চিঠি লিখত। দুপুরবেলা হোস্টেলে ছেলে- মেয়েরা অপেক্ষায় থাকত ডাকপিওনের। সে সময় ছিল পত্রমিতালি। একটা হিট সিনেমাও ছিল, হঠাৎ বৃষ্টি। চিঠি নিয়ে রচিত হয়েছে কত গান কবিতা। তেমনি একটা কবিতা, হেলাল হাফিজের-
“এখন তুমি কোথায় আছো কেমন আছো, পত্র দিও
এক বিকেলে মেলায় কেনা খামখেয়ালীর তাল পাখাটা
খুব নিশীথে তোমার হাতে কেমন আছে, পত্র দিও।
ক্যালেন্ডারের কোন পাতাটা আমার মতো খুব ব্যথিত
ডাগর চোখে তাকিয়ে থাকে তোমার দিকে, পত্র দিও।
কোন কথাটা অষ্টপ্রহর কেবল বাজে মনের কানে
কোন স্মৃতিটা উস্কানি দেয় ভাসতে বলে প্রেমের বানে
পত্র দিও, পত্র দিও।”
চিঠি লিখতে ক্লান্তি ছিল না রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের । সব মিলিয়ে কয়েক হাজার চিঠি লিখেছিলেন তিনি। এত বেশি চিঠি আর কোনো লেখক- কবি লিখেছিলেন কি না জানি না। তবে একদিনে সবচেয়ে বেশি চিঠি লিখেছিলেন শার্ল বোদলেয়ার৷ তার এসব চিঠি কোনো প্রেমিকাকে উদ্দেশ্য করে না, মায়ের কাছে নালিশ করে লেখা হয় এগুলো। চিঠি লিখতে গিয়ে শেষের কয়েকটা চিঠি পোস্ট করার জন্য টাকা না থাকায় বেয়ারিং পোস্ট করেন। সাত নম্বর চিঠি লেখার পর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সাতদিন শুয়ে থাকেন।
চিঠি লিখতে চাইলেই যেমন লেখা যায় না, আবার সবাইকে ভালো চিঠি লেখাও হয় না। এ বিষয়ে ইন্দিরা দেবীকে রবীন্দ্রনাথের উক্তিটি উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারলাম না, “যদি কোনো লেখকের সব চেয়ে ভালো লেখা তার চিঠিতেই দেখা দেয় তা হলে এই বুঝতে হবে যে, যাকে চিঠি লেখা হচ্ছে তারও একটি চিঠি লেখাবার ক্ষমতা আছে।”
সৈয়দ শামসুল হকের সাথে যখন আনোয়ারা সৈয়দের বিয়ে হয় তখন সৈয়দ হক মোটামুটি পরিচিত সাহিত্য অঙ্গনে। ছোটগল্পের বই ‘তাস’ পেয়েছে বাংলা একাডেমির পুরস্কার, ১৯৬৬ সালে। অনেকেই মনে করে সৈয়দ হকের সংস্পর্শেই আনোয়ারা ম্যাডামের লেখা শুরু, আসলে তা নয়। আনোয়ারা ম্যাডাম লিখতেন ছেলেবেলা থেকেই, পেয়েছিলেন পুরস্কারও। পরে মেডিকেলে পড়ার ঠ্যালায় লেখালেখি কিছুদিন বন্ধ ছিল। সে সময় তিনি পড়তেন বিভিন্ন গল্প, উপন্যাস। তাদের পরিচয়, প্রেম কিন্তু বেশ রোমান্টিক। আনোয়ারা ১৯৬০ সালের আগষ্ট মাসের সংখ্যা ‘সচিত্র সন্ধানী’তে পড়েন ছোটগল্প ‘তিন পয়সার জ্যোছনা’, লেখক সৈয়দ শামসুল হক। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়ে ফেলেন। সিদ্ধান্ত নেন তার বই আরো পড়তে হবে, কিন্তু তার তেমন বই বাজারে পেলেন না। সৈয়দ হক তখন নিয়মিত লিখতেন চিত্রালী পত্রিকায়। সেখান থেকে ঠিকানা জোগাড় করে চিঠি লিখে ফেললেন আগষ্ট মাসের এক তপ্ত দুপুরে। সম্বোধন কী করেছিলেন জানি না তবে বিষয়বস্তু মোটামুটি এরকম-
…..
“আমি মেডিকেলে পড়ি। আপনার লেখা আমার ভালো লেগেছে। সাহিত্যের বই পড়া আমার অভ্যাস,নেশাও বলতে পারেন। নিৎসে, বোদলেয়ার,বুদ্ধদেব বসুর লেখা আমি পড়েছি। রবীন্দ্রনাথের লেখা অতটা পড়া হয় নি তবে পশ্চিমবঙ্গের অনেক লেখকের লেখা পড়েছি এবং এখনো পড়ছি ।
ইতি
আনোয়ারা।
এই চিঠি লেখার দুমাস পর চিঠি এল-
সুচরিতাসু,
আপনার চিঠির উত্তরে একটা চিঠি দিয়েছিলাম। মনে হয় সেটা আপনার হাতে পৌঁছায়নি।সেই জন্য এই দ্বিতীয় চিঠি দিলাম। আপনার চিঠি পেয়ে খুব খুশি হয়েছি। মেডিকেলের ছাত্রছাত্রীরা সাহিত্য নিয়ে এত আগ্রহী জানা ছিল না। আপনি সেই ভুল ভাঙালেন।
চিঠির নিচে ক্যালিগ্রাফির মতো একটা স্বাক্ষর, কিন্তু পড়া যায়: সৈয়দ শামসুল হক। পরবর্তীতে তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন।
বুদ্ধদেব গুহের চিঠি নিয়ে বিখ্যাত বই ‘অবরোহী’। দীর্ঘকাল পর অযর্মার (জি, এমনই বিদঘুটে নাম) সাথে ঝুমরি-তিলাইয়া স্টেশনে দেখা হয়ে যায় তার প্রাক্তন ছাত্রী যোজনগন্ধার। তারপর দুজন দুজনকে লিখে চলে পত্র। ঠিক প্রেমপত্র না, অন্যস্বাদের সেতুবন্ধন। পত্রে প্রকৃতি, ঈশ্বর বিশ্বাস, আর মানুষ। কত বিচিত্র ধরনের যে মানুষ আছে! একটা মানুষ মরে যায় সাথে নিয়ে যায় একটা গোটা জীবন উপন্যাস। পুরা বইটি চিঠির আদান প্রদান। যদিও বুদ্ধদেব গুহ একে ঠিক উপন্যাস বলতে রাজি না তারপরও বহুল নন্দিত এ উপন্যাস পড়লে আপনি অনুভব করবেন প্রেমের গভীরতা আর পাওনা হিসেবে অনেক অনেক বইয়ের রেফারেন্স, কোটেশন, যা বুদ্ধদেবের বইয়ে সচরাচর থাকেই। বইটি উৎসর্গ করেছেন আমাদের দেশের কবি ও সাহিত্যিক তসলিমা নাসরিনকে। এটাও একটা ঘটনা বটে।
‘একাত্তরের চিঠি’ একটু দুর্লভ চিঠির সংকলন। মুক্তিযোদ্ধাদের সেসব চিঠি পড়লে চোখে পানি চলে আসে এখনও।
তবে ব্যতিক্রম বিনয় মজুমদার। চিঠি নিয়ে হতাশ হয়েই কি না তিনি লিখেছিলেন-
“আমার ঠিকানা আছে তোমার বাড়িতে,
তোমার ঠিকানা আছে আমার বাড়িতে,
চিঠি লিখব না।
আমরা একত্রে আছি বইয়ের পাতায়।“
প্রেমের গভীরতা বোঝাতে একসময় নিজের রক্ত দিয়ে চিঠি লেখার কথাও শোনা যেত তবে সে রক্ত মুরগির বলে প্রেমিকার বাতিল করে দেবারও নজির আছে।
এখন হয়তো পোস্ট অফিসে চিঠি পোস্ট করা হয় না। সরকারি ডাকঘরগুলো ব্যাংকিং কার্যক্রমে ঝুঁকছে। দাপ্তরিক কিছু কাজে তারা আছে। তবুও চিঠির আদান-প্রদান হয়তো এখনো বন্ধ হয়নি। সুকান্তের সেই বিখ্যাত কবিতা রানার ছুটেছে রানার- হয়তো এযুগে সম্ভব না তবুও চিঠির আদান-প্রদান চলছে, চলবেই। অন্তত এর আবেদনটি অনন্ত।