আসরের নামাজ শেষে সবুরকে যখন বৈকুন্ঠপুর বাজারে আনা হলো, তখন সবে জমে উঠেছে বাজার। এখানে সোম আর বৃহস্পতিবার হাটবার। তাছাড়া অন্যদিনগুলো বাজার। শতবর্ষী বটগাছের তলে তাকে যখন বাঁধা হলো তখন উৎসুক ছেলে-ছোকড়ারা মজার আশায় গোল হয়ে ঘিরে থাকল সবুরকে। বটগাছের উত্তর দিকে কয়েকটা রুই আর পুঁটি নিয়ে বসে আছে কজন মাছ বিক্রেতা। কেনাবেচা আজ তেমন জমেনি, আজ বুধবার। বটগাছ ঘিরে এ বাজারের দক্ষিণ দিকে বড়া-পিয়াজুর দোকান। বিহারি সোবহান পিয়াজু ভাজছে আর নজর রাখছে সবুরকে ঘিরে ভিড়ের দিকে। আজ একজন কর্মচারী আসেনি, নাহলে জটলার কাছে যাওয়াযেত। এদিকে লোকজন মজা দেখতে এসে পিয়াজু, চা-ও খাচ্ছে। বেচাবিক্রি মন্দ না। সোবহানের মেয়ে আরজু ছোটমানুষ। সে একা ছোটাছুটি করছে। পিয়াজু-চা এগিয়ে দিচ্ছে। পেছনে রান্নাঘরে সফুরা বুড়ি শুধু প্লেট ধোওয়া আর ডাল বাটা কাজ। আজ সেও পান খাওয়ার কথা বলে ঘন ঘন বাইরে বের হচ্ছে। সবুরকে সবাই চেনে। সে বৈকুন্ঠপুর বাজার পাহারা দেয় রাতে। অনেক বছর থেকে। ইয়া লম্বা,স্বাস্থ্য ভালো আর লম্বা মোচ। তাকে দেখতে কাবুলিওয়ালা মনে হয়। আর সে বাঙালিও না, বিহারি। বৈকন্ঠপুরে রেললাইন ধরে যে বস্তি গড়ে উঠেছে সেখানে বিহারিরা থাকে। সবুরের বাবার জন্ম এদেশে। সবুরের দাদা ইয়াসির আসে রেলের লাইনম্যান হয়ে বৈকুন্ঠপুরে। তারপর আর ফিরে যাওয়া হয়নি। এদেশে বিয়ে। যুবক বয়স, এক আধটু নেশা করার অভ্যাস। স্টেশনমাস্টার একদিন ডেকে বললো, ইয়াসির বিয়ে করো না কেন?
হুজুর আমাকে কে মেয়ে দেবে?
কেন? তোমার পরিবার? বাবা-মা?
আমার কেউ নেই স্যার।
দাঙ্গার সময় বাড়িতে আগুন দিলো। মা বাবা তখন বাসায়, সাথে ছোটবোন। আমি তখন মিছিল দেখতে রাস্তায়- রাস্তায় ঘুরতাম। একবার হিন্দুরা তলোয়ার নিয়ে আর একবার মুসলমানর তলোয়ার নিয়ে মহড়া দিত। আমি কখনও মিশে যেতাম মুসলমানদের সাথে কখনও হিন্দুদের সাথে। বাসায় এসে দেখি বাড়ি পুড়ে শেষ। বাড়ির সাথে আমার বাবা- মা, বোন৷ আমার বই, ঘুড়ি পুড়ে কয়লা। এরপর ঠাঁই হয় মামার বাসায়। মামা রেলে চাকরি করত। সে ঢুকিয়ে দিলো চাকরিতে। চাকরির পোস্টিং হলো পূর্ব পাকিস্তান। মামি বলল এতদূর যাবে চাকরি করতে, দরকার নাই। আমিই শুধু বেঁকে বসলাম। মামার ঘাড়ে বসে খেতে আর ভালো লাগছিল না। আমি চলে এলাম স্যার এই বৈকুন্ঠপুর। মামাকে মাসে- মাসে কিছু টাকা পাঠাই। আমার বেশ চলে যায় বাকি টাকায়।
এর কয়েকদিন পর সবুরের দাদা এই দাদা ইয়াসিরের বিয়ে হয়ে যায়। মেয়ে মাছুয়া পাড়ার ফজিলা। তারপর একে একে জন্ম নেয় চার সন্তান। সবুরের বাবা পুরোদস্তুর বাঙালি হয়ে যায়। আর আজ সবুর শুধু বিশাল শরীর নিয়ে বটগাছে বিহারি-বাঙালি রক্ত নিয়ে দড়ি দিয়ে বাঁধা দাঁড়িয়ে থাকে।
একপ্রস্থ মারপিট হয়ে গেছে একটু আগে। সবুরের মাথাটা ঝুঁকে আছে সামনের দিকে। বাজারের পাশে সবুরের বাসা। বেড়ার বাড়ি উপরে টিনের ছাদ। সবুরের ছেলে সবুজ বসে আছে ভিড়ের ভিতরে। হাপুসনয়নে কাঁদছে। বারেক, যার দোকানে চুরি হয়েছে সে লাঠি দিয়ে পিটানোর পর এখন ক্লান্ত হয়ে চেয়ারে বসে আছে।
সবুরের ডিউটি শুরু হয় রাত দশটার পর। রাতে ভাত খেয়ে লম্বা একটা উলের ওভারকোট, মাথায় কান ঢাকা টুপি আর একটা লাঠি হাতে যখন বের হয় তখন সবুজের খুব ইচ্ছে হয় বাপের সাথে ডিউটিতে যেতে। সাহস হয় না। বাবা কম কথা বলে আর চেহারাটাই কেমন রাগী রাগী। এই তো সেদিন বন্ধু রুমা বলল, এই তোর বাপ কি ডাকাত ছিল নাকি রে সবুজ?
সেদিন খুব কষ্ট পেয়েছিল সবুজ। আজ যদি জানতে পারে তার বাপ চুরির দায়ে ধরা পড়েছে তাহলে তো রুমা বিশ্বাস করবেই,ওর বাপ ডাকাত ছিল। সবুজ ডুকরে কেঁদে ওঠে।
ভিড়ের ভেতর কয়েকটা কাঠের চেয়ার আনা হলো। মনে হয় চেয়ারম্যান, বাজার কমিটির লোকজন আসবে। বারেক মিয়াকে চা দেয় চায়ের দোকানদার সোবহান। পানি দিয়ে কুলি করে বারেক। পানের টুকরা, লাল রং মিশ্রিত পানি সবুরের পায়ের কাছে পড়ে। বিসমিল্লাহ বলে পানি খায় বারেক তারপর চায়ে চুমুক দেয় আরাম করে। পানি পিপাসা পায় সবুরের, একটু পানি খেতে পারলে —-। সবুরের শ্বশুর সাহাপুর মসজিদের মোয়াজ্জিন। সময় পেলেই হাশরের ময়দানের কথা বলে নাতি সবুজকে। ঘর থেকে শ্বশুরের কথা শুনতে বেশ লাগত সবুরের। ডিউটি করে সকাল আটটায় ঘরে ফিরলে বৌ গরম ভাত দিত। ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে যেত সবুর। ঘুম ভাঙত শ্বশুরের মিহি কন্ঠের হাদিস কোরআনের কথায়। বুঝলা সবুজ, হাশরের ময়দানে কেউ কাউকে চিনবে না। তোমার বাপ, মা সবাই মুখ ফেরায় নিবে। সবার মুখে শুধু ইয়া নফসি, ইয়া নফসি। সূর্য নেমে আসবে নিচে। পানির তিয়াসে বুক ফেটে যাবে। পানি পাবে না পাপিরা।
সবুরের মনে হয় হাশরে এমনই তেষ্টা পাবে। ইয়া নফসি, ইয়া নফসি পড়ব কি? সবুর বুঝে পায় না। মনে করার চেষ্টা করে সে কবে কী পাপ করছে। একবার বাপের পকেট থেকে দশ টাকা চুরি করছিল। তখন শাপলা সিনেমা হল হইছে রংপুরে। বন্ধুরা সবাই বলল, চল চল আজিম, সুজাতার সিনেমা দেখব। সেবার দশ টাকা চুরি করছিল সবুর। আর একবার পাশের বাড়ির লাভলী আপা গোসল করছিল কুয়ারপাড়ে, বেড়ার ফাঁক দিয়ে তাকে দেখেছিল। লাভলী আপার বুকটা এত সুন্দর! তখন তো পাপ মনে হয় নাই। মনে হয়েছিল বেহেশতের হুর গোসল করছে। আজ কি তবে মাফ চাবো আল্লাহর কাছে? নিশ্চয় কোন পাপ করেছি। তা না হলে আল্লাহ্ এতো অপমান, কষ্ট দিবে কেন? দবির চেয়ারম্যান, বাজার কমিটির সভাপতি আলি ভাই সবাই এসে গেছে। বিচার শুরু হয়। কানে কোনো কথা আসে না শুধু বিজ্ বিজ্ বিজ্ একটা শব্দ। এ শব্দ কই শুনছি। মনে করার চেষ্টা করে সবুর। চেয়ারম্যান গম্ভীর কন্ঠে বলে তুই যেহেতু দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করিস নাই আবার কে তোর সাথে ছিল চুরির সময় তাও কওছিস না। তোকে হারা চোর বলি মানমো। এলাও সময় আছে কয়া ফেলা কোটে থুছিস চুরির মাল নাইলে তোর চোখ উপড়ি ফেলা হইবে। বাবা,বাবা বলে চিৎকার করে জড়িয়ে ধরে সবুজ তার বাপকে।
সবুর কী বলবে? সে তো জানে না, কে চুরি করছে? কাকে বলবে? আল্লাহকে ডাকবে? কোন সুরা পড়লে রক্ষা পাওয়া যাবে? সবুরের কিছুই মনে পড়ে না।
চামুচ হাতে এগিয়ে আসে শফি আর হেদায়েত। বিজ্ বিজ্ বিজ্ শব্দটা বেড়েছে। ঠিক তখুনি মনে পড়ে এটা মৌমাছির শব্দ। বিয়ের পর নতুন বৌকে নিয়ে নাওপাড়া মামা শ্বশুরের বাড়ি গেছিল সবুর। যৌবনাবতী পার হয়ে। হলুদ সরিষা ক্ষেত। তার মাঝখান দিয়ে আইলবাড়ি দিয়ে। বৌয়ের আলতা পরা, কমদামি হিল পরা পা। বারেবারে পা ফসকে যায়। সবুর তখন হাত ধরে বৌয়ের। লজ্জায় কুঁকড়ে যাওয়া বৌ আর সে হেঁটে চলে সেই হলুদের মাঝ দিয়ে। কত মৌমাছি! আর তাদের বিজ্ বিজ্ বিজ্ শব্দ। নাকে সরিষা ফুলের গন্ধ পায় সবুর। আহা, আর দেখা হবে না সেই সরিষাক্ষেত, বাজারের দোকানের ঝাপগুলো। লাঠি দিয়ে রাতে হালকা করে বাড়ি দিত আর বাঁশি বাজাত সবুর। বাড়ি খেয়ে কেমন ঝমঝম করে হেসে উঠতো দোকানের ঝাপগুলো। বলত কথা সবুরের সাথে। আছি ভালো,ধন্যবাদ আমাদের পাহারা দিয়ে রাখার জন্য। মাগরিবের নামাজের সময় কি হয়ে গেল? নিশ্চয় মাগরিবের ওয়াক্তে লোকজন তার চোখ তুলবে না। মাগরিবের ওয়াক্ত কখন শুরু হবে?