পর্ব ২
** মুগ্ধতা ডট কমের নিয়মিত লেখক তাজনিন মেরিন লোপার আজ জন্মদিন। জন্মদিনে আমরা তাঁকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।**
দোলনচাঁপা
ঘুম ভেঙেই জেলেনের ক্যাপটা চোখে পড়লো উষার। ফেরত দেয়াটা জরুরি মনে হলো। ক্যাপটার সাথে কেমন মায়াময় ভয় জড়িয়ে আছে। স্বপ্নে সেই অসাধারণ সাদা ফুলের মায়াময় সৌন্দর্য ঘ্রাণ মাথায় ভর করে আছে। জেমি আর তার বাবা এখনও ঘুমোচ্ছে। মনে হলো এটাই ভালো সময় । ক্যাপটা হাতে নিয়ে চাবি আর মোবাইল নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো উষা। দশ নাম্বার বাসা, বাসার ডানদিকটায় হওয়ার কথা, নিশ্চয়ই খুব কাছেই। হাঁটতে শুরু করলো সে। বেশ সকাল, কিছু বাসায় কুকুরের একটু আধটু ডাক আর গ্যারেজে কাজ করার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। অনেকেই খুব ভোরে বেড়িয়ে গেছে কাজে। উষা হাঁটছে। এগারো নম্বর বাসা, এর উল্টো পাশেই তো দশ হওয়ার কথা। আট, সাত পেল কিন্তু আশেপাশে কোথাও দশ দেখা গেল না। আবারও ‘জিওগ্রাফি’! আচ্ছা, গুগল আপা তো পাশেই আছেন, ভাবলো সে। মোবাইল ফোনের গুগল ম্যাপে ঠিকানা দিলো। গুগল আপা দেখালো, এগারো থেকে একটু সামনে গিয়ে আরেকটা চিকন রাস্তা গেছে, মেঠোপথ। হাঁটতে হাঁটতে পেয়ে গেল রাস্তাটা। বাড়িটা কই? উফ্ এর মধ্যেই শুরু হলো বৃষ্টি, কী জ্বালা! একটু ভয় লাগছে ওর, জায়গাটা খুব শুনশান। মেঠোপথ থেকে আরেকটা মেঠোপথ গেছে। সামনে একটা ছোট লেক। কাল রাতেও বৃষ্টি হয়েছে, মাটি কাদা হয়ে ছিল। কাদামাটির মাঝে দুইটা বড় পায়ের ছাপ, কিন্তু একটা সোজা, আরেকটা উল্টো। বুকে কেমন মোচড় দিয়ে একটা ভয় পেঁচিয়ে ধরলো উষার! চারদিকে তাকালো, আর কোন বাড়িই দেখছে না সে এখন। উফফ আমার ‘জিওগ্রাফি’! আবার বিড়বিড় কারলে সে। লোকালয় থেকে দূরে চলে এলাম? এবার মনে হলো জিওগ্রাফি ফ্রাই করে খাই। ফ্রাই এর কথা মনে হতেই নাকে একটা ঘ্রাণ এলো, আহ! কে যেন কী একটা ফ্রাই করছে? “জিওগ্রাফি” আমার জন্য? এলোমেলো ভাবতে ভাবতে এগোতে থাকলো।
এর মধ্যেই কেউ আলতো করে ঝাঁকি দিলো। খুব চমকে গেল উষা। কে সানাউল! এখানে আছে তা জানলো কী করে?
-উষা, উঠবে, নাস্তা করবে আমার সাথে? উঠে বসলো।
-বৃষ্টি থেমে গেছে?
-কোথায় বৃষ্টি পেলে? অনেক রোদ উঠেছে আজ।
একটু অবিশ্বাস হলেও জানালার দিকে তাকালো উষা। তাইতো কাঠফাটা রোদ। চিরচেনা ক্যানবেরার রোদ, যা দেখলে অন্ধকারের চেহারা আর মনে পড়ে না। বাসায় তো সে, পাশে বাচ্চাটা ঘুমাচ্ছে। স্বপ্ন এতো তরতাজা হয় কী করে?
খাবার টেবিলে বসে দেখে বেশ আয়োজন। আলুভাজি, ডিমভাজি, মুরগির লটপটি, পরোটা। বৃষ্টির শব্দের মর্ম বোঝা গেল, জিওগ্রাফিও না, ডিমভাজির আওয়াজ!
খাবার খেতে খেতেই নাকে আবার সেই অসম্ভব সুন্দর ফুলের ঘ্রাণ এলো।
-সান, তুমি কি কোন ফুলের ঘ্রাণ পাচ্ছো? (সানাউলকে সান বলে ডাকে উষা। এতোবড় নাম বলতে ক্লান্ত লাগে। সান বললে জান জান একটা ভাব আসে। আর উষার সাথেও সখ্যতাটা গাঢ়।)
-পাচ্ছি মানে কি, ফুল তো আমিই নিয়ে এলাম। কতো খুঁজে এই বিদেশে তোমার জন্য দোলনচাঁপা নিয়ে এলাম সেইই ম্যাগপাই ডাকা ভোরে (এখানে কাকের চাইতে ম্যাগপাইয়ের জোর বেশি )। সারপ্রাইজ দেবো ভাবলাম, কিন্তু ম্যামের কোন খবরই নেই।
তাইতো টিভির পাশেই রূপসী দোলনচাঁপারা অপলক নয়নে তাকিয়ে আছে উষার দিকে। সে এমন আনমনা হয়ে আছে, আজ যে ওর জন্মদিন তাই মনে নেই। ফুলের পাশে একটা কাগজ রাখা। তাতে একটা নতুন কবিতা, প্রথম লাইনটা দেখেই মন ভালো হয়ে গেলো;
“এই বিদেশের জন্মদিনে উষা
তোমার জন্য আমার অনেক ভালোবাসা।”
এই প্রথম সান স্ত্রীর জন্য ফুল নিয়ে এসেছে। ফুলের ভালোবাসায় বিশ্বাসী না সে। দায়িত্বের নির্ভরশীলতায়, বোঝাবুঝিতে রিদম খুঁজে পায়। অনেক ঝগড়া হতো দুজনায় এই নিয়ে। তবে দিন শেষে আমি তোমাতেই শুধু তোমাতেই জীবনের আসল ঘ্রাণ খুঁজে পেয়েছি, আবার আনমনে নিজের সাথেই কথা বলতে লাগে উষা, অস্ফুটে বলে উঠে, ফুলের ডালা নিয়ে এসে মন ভরা ঘ্রাণ নিয়ে ঘুমোতে গেছি।
-উষা, আমি বের হচ্ছি। তোমরা সাবধানে থেকো। আমি তাড়াতাড়ি আসার চেষ্টা করবো।
-(সম্বিত ফিরে পেয়ে উষা বলে) থ্যাংকু, ফুলের দিকে তাকিয়ে, ওর সুবাসেই মনে হয় বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারবো।
-ফুলের মধ্যে নাক ডুবিয়ে বসে থেকো না যেন। পরে তো টিস্যুতে নাক ডুবিয়ে বসে থাকতে হবে!
এতো রোমান্টিকতায় এই কথা শুনে রাগ করতে ইচ্ছে করে কিন্তু ঠিক তখন সান তার শ্রেষ্ঠ হাসিটা দিলো, ডান দিকের ঠোঁটটা একটু উপরে, বাঁ দিকেরটা একটু নিচে, মাঝের দুই ঠোঁট একটু খুলেও কেমন যেন বন্ধ বন্ধ ভাব। অসাধারণ এক আজিব, সুপার গ্লু হাসি, উষার রাগ আর আসে না।
-গুড মর্নিং জেমি বাবা মা।
ছেলেটা ঘুম থেকে উঠে এসে কখন যেন মাঝখানে দাঁড়িয়েছে, দুজনই খেয়াল করেনি। জেমি মাঝে মধ্যেই জেমি বাবা, জেমি মা বলে ডাকে। সে মনে করে দুজনের পরিচয় একমাত্র তার বাবা-মা। ওর অনুভূতিটা আসলেই খুব আদর, আবদার, ভালোবাসায় মোড়ানো নিষ্পাপ। জীবনের ভালোবাসার ছোটাছুটির প্রশ্রয়।
সান বেড়িয়ে গেলে উষা ছেলেকে নিয়ে কিছু পর বের হলো। বাসা থেকে দশ মিনিটের মতো হেঁটে ট্রাম ধরতে হয়। ট্রামে মাত্র পাঁচ মিনিটের রাস্তা। ট্রাম থেমে অটো ডোর এক মিনিটের জন্য খোলে, এরপর আর কোনভাবেই দরজা খোলার উপায় নেই। পরের ট্রামের জন্য অপেক্ষা ছাড়া। উষা এমনিতে এটাতে অভ্যস্ত কিন্তু আজ কী যে হলো, বাটন চেপে জেমির প্র্যামটা সামনে নিতেই দরজাটা আটকে গেল। পিছনের দিকে টান দিল, আসছে না, ভেতরেও ঢুকছে না। একটা ভয় শরীর বেয়ে শীতল ভাবে নামতে লাগলো। হাত-পা কাঁপতে শুরু করেছে ততক্ষণে। কী করবে এখন? ঠিক তখনই পিছন থেকে কেউ একজন সাহায্যে করলো, দরজাটা খুলে গেলো আবার। তাড়াতাড়ি ভিতরে ঢুকেই দেখে জেলেন, ট্রামের স্টাফের ইউনিফর্ম পড়া।
-থ্যাংকু সো মাচ জেলেন। ইট ওয়াজ রিয়েলি ডেনজেরাস।
-নট আ প্রোবলেম। বাই দা ওয়ে, আই অ্যাম এ্যানথোনিও। নাইস টু মিট ইউ। বাই।
– ইউ আর নট জে………… (উষার উত্তরটা শেষ হয় না)
-বাই। [জেমি এ্যনথোনিওকে বাই দিচ্ছে!]।
এখানেই উষার খটকা লাগলো। ঘোর কাটছে না। জেলেন কী করে এ্যানথোনিও হয়? আমি রাতকানা হলেও দিনকানা তো নই, ভাবলো সে। চেহারা তো বলে এইটা জেলেন। ছেলেকে নিয়ে সে প্লে গ্রুপে যায়, সবার সাথে গল্প করে, ছেলের সাথে খেলে, সবই ঠিক মনে আছে। ভাবতে ভাবতে বাজার করতে যায়। মাছ কিনতে গিয়ে মুরগি কিনে আরেক দোকানে রেখে চলে আসে মনের ভুলে। অংক মেলে না তার। মানুষ এরকম একইরকম হয় কী করে? জেলেন কে? এনথোনিও কে? ট্রামে উঠে দেখলো ফোন কল। যে দোকানে বাজার ফেলে এসেছে, তারা নাম্বার পেয়েছে, কার সদাই তাও খেয়াল করেছে, কতো ভালো মানুষ আল্লাহর এই দুনিয়ায়। এদিকে সে তখনো তো উল্টাপাল্টা অংক নিয়েই ঘুরপাক খাচ্ছিল। যাই হোক, বাজার নিয়ে এসে পরের ট্রামটা ধরলো তারা। একটা বেজে গেছে। একটু সামনে গিয়ে সিটে বসে, চমকে দেখে পাশে জেলেন! ভয়ে গলা দিয়ে বাংলা বেড়িয়ে পড়লো।
-কেমন আছো জেলেন। এবার তুমি সত্যিই জেলেন তো! নাকি এ্যানথোনিও?
-উফউফউফ। ট্রাগাস জেমিকে চিনেছে আর জেমিও ট্রাগাসের সাথে খেলতে শুরু করে দিয়েছে।
যাক ট্রাগাস আছে, মানে এইটা জেলেন। হালকা নিশ্বাস ছাড়লো উষা।
-আই কান্ট আন্ডারস্টান্ড ইউ। ডু ইউ মিট এ্যানথোনিও?
-ওহ, সরি, ইয়েস।
-এ্যাট মর্নিং। আই থট; ইট ওয়াজ ইউ।
-এভরিবডি ইজ কনফিউজড্, দো হি ইজ আ বয়।
এর পরের প্রশ্নটা কী হওয়া উচিত মাথায় আসছে না। ফাইনাল পরীক্ষার আগের রাতে নতুন সাজেশন পাওয়ার মতো অবস্থা। কোনটা ছেড়ে কোনটা জানতে চাইবো। কোনটাই আর জানা হলো না, গন্তব্য এসে গেলো। নামতে হলো। জেলেন শহরের দিকে যাবে বললো। নামার আগে জেমির সাথে কথা বললো ওদের সেই সাংকেতিক ভাষায়।
জেলেন-কুসুকিকলুলিকিসা।
জেমি-কিসুকিসুলিকুলকিসা।
ওরাই জানে এই ভাষা। তারপর দুজনই অনেক হাসলো, সাথে ট্রাগাস আনন্দে লাফাতে থাকলো। নামার ঠিক আগে জেলেন ভীষণ চমকে দিয়ে বললো, হ্যাপি বার্থডে হানি।
থ্যাংকু বলে নেমে গেল উষা। কিন্তু নেমেই আবার অংকে কঠিন গোলমাল লেগে গেলো। জেলেনের সাথে নিজের কোন কানেকশন ভেবে পেল না। ওর বার্থডে জানার কোন কারণ খুঁজে পাওয়া গেল না। এইদিকে ট্রাগাসের ‘উফউফ’ মানে “ভুক্ভুক্” কানে এখনো শুনতে পাওয়া যাচ্ছেই। আর জেমি অনেক দূরের ট্রামটার দিকে তাকিয়ে ভীষণ হাসছে।…
(চলবে)
৮ জানুয়ারি ২০২১