ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি হচ্ছে এমন এক ধরনের স্নায়ু বা নার্ভ ঘটিত অসুখ, যা শুধু ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদেরই হতে পারে। রক্তে উচ্চ মাত্রার শর্করার উপস্থিতির কারণে পুরো শরীরের বিভিন্ন স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বিশেষ করে হাত ও পায়ের স্নায়ু বেশি আক্রান্ত হয়।
কোন কোন নার্ভ বা স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার ওপর নির্ভর করে রোগের লক্ষণ কেমন হবে তা। সাধারণত আক্রান্ত অংশে ব্যথা হয়, অবশ অবশ ভাব হয়। একই সঙ্গে বদ হজম, প্রস্রাবে অসুবিধা, রক্তনালি ও হার্টের সমস্যাও হতে পারে। খাবার গিলে খেতে সমস্যা, খুব বেশি বা খুব কম ঘাম, যৌন কামনা কমে যাওয়া, মুখের একদিকে অবশ ভাব হওয়া, প্রস্রাবের অসুবিধা, বুক ধুকপুক করাও এ রোগের লক্ষণ। কিছু ক্ষেত্রে লক্ষণগুলো তেমন তীব্র হয় না। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষের ক্ষেত্রে লক্ষণ তীব্র হয়, এমনকি রোগীর মৃত্যুর কারণ হয়।
বিজ্ঞাপন
ডায়াবেটিস হলেই যে নিউরোপ্যাথি হবে তা নয়। রক্তে চিনির মাত্রা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা গেলে ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি প্রতিরোধ করা যায় বা রোগটির মাত্রা কম রাখা যায়।
ধারণা করা হয়, রক্তে গ্লুকোজের আধিক্যের কারণে স্নায়ুকোষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেখা গেছে, যেসব রোগীর ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে না, তারাই মূলত নিউরোপ্যাথির শিকার হয়। সাধারণত ডায়াবেটিস রোগীর প্রায় ৬০-৭০ শতাংশই কোনো না কোনো মাত্রায় নিউরোপ্যাথিতে আক্রান্ত হয়।
নিউরোপ্যাথি কয়েক রকমের হতে পারে। যেমন-
» পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি (হাত ও পায়ের স্নায়ু বেশি আক্রান্ত হয়);
» প্রক্সিমাল নিউরোপ্যাথি (হাত ও পায়ের ওপরের দিকে মাংসপেশির স্নায়ু আক্রান্ত হয়);
» অটোনমিক নিউরোপ্যাথি (হৃদযন্ত্র, রক্তনালি, পরিপাকতন্ত্র, মূত্র ও যৌনাঙ্গ, শরীরের রেচন প্রক্রিয়া ইত্যাদি আক্রান্ত হয়)
» ফোকাল নিউরোপ্যাথি (কোনো একটি নির্দিষ্ট স্নায়ু আক্রান্ত হয়)।
সবচেয়ে বেশি দেখা যায় পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি। এতে হাত ও পায়ের নিচের দিকের অংশ অর্থাৎ কনুইয়ের নিচে ও হাঁটুর নিচের দিকের অংশে ব্যথা করা, জ্বালা-পোড়া করা, ঝিনঝিন করা ও অবশ লাগা ভাব হয়। হাত ও পায়ের এই অংশ ঠাণ্ডা থাকে, লোম পড়ে যায়, হাত ও পায়ের অনুভূতি নষ্ট হয়ে যায়। আঘাত লাগলে বা পুড়ে গেলে ব্যথা পাওয়া যায় না। সে কারণে পায়ে প্রায় ঘা হয়, পচন ধরে। ডায়াবেটিসের রক্তনালি সরু হয়ে যায় বলে রক্ত চলাচল কম থাকায় ঘা সহজে শুকায় না। পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথির ব্যথা সাধারণত রাতের দিকে বেশি হয়। রোগী নিজে নিজে ভালোভাবে দাঁড়াতে পারে না।
এতে হাত ও পায়ের ওপরের দিকের অর্থাৎ উরু, বস্থিদেশ ও বাহুর মাংসপেশির দুর্বলতা দেখা যায় এবং মাংসপেশি শুকিয়ে যায়। এটা সাধারণত বয়স্ক মানুষদের হয় এবং চিকিৎসায় ভালো হয়। টাইপ টু ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের প্রক্সিমাল নিউরোপ্যাথি বা ডায়াবেটিক অ্যামিট্রফি হয়।
বিজ্ঞাপন
সাধারণত শরীরের একপাশ আক্রান্ত হয়। কিছু ক্ষেত্রে উভয় পাশেই হতে পারে। লক্ষণের মধ্যে আছে হঠাৎ উরু বা বস্থিদেশ বা মাংসপেশিতে তীব্র ব্যথা, বসা থেকে উঠতে অসুবিধা বোধ, পেট ফুলে যাওয়া, ওজন কমে যাওয়া, পায়ের শক্তি কমে যাওয়া ইত্যাদি।
শরীরের অভ্যন্তরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেও স্নায়ু আছে। সেখানকার অনুভূতি সাধারণত আমরা টের পাই না। তবে ওই অঙ্গে অসুখবিসুখ হলে ব্যথার অনুভূতি হতে পারে। স্নায়ুর মাধ্যমেই নিয়ন্ত্রিত হয় হার্টের পাম্পিং, ফুসফুসের শ্বাস-প্রশ্বাস, খাদ্যের পরিপাক, রেচন প্রক্রিয়া ইত্যাদি। এই স্নায়ুগুলো অটোনমিক নার্ভ বা স্নায়ু নামে পরিচিত। এসব স্নায়ু যখন ডায়াবেটিসের কারণে আক্রান্ত হয়-সেটাকে বলে অটোনমিক নিউরোপ্যাথি।
অটোনমিক নিউরোপ্যাথি হৃৎপিণ্ডের গতির অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়, রক্তচাপ কমে যায়। খাবার ঠিকমতো হজম হয় না। মস্তিষ্কে রক্ত চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। পায়খানা ও প্রস্রাবের নিয়ন্ত্রণ কমে যায় বা নষ্ট হয়। ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্য হয়। বমি ও বমিবমিভাব হয়, গিলতে অুসবিধা, যৌন প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত, শরীরের তাপমাত্রা অনিয়ন্ত্রিত হতে পারে।
যখন কোনো একটি নির্দিষ্ট নার্ভে সমস্যা দেখা দেয়, তখন তাকে ফোকাল বা মনো নিউরোপ্যাথি বলে। যেমন-শুধু হাত বা পায়ে সমস্যা হতে পারে। সাধারণত আগে থেকে কোনো লক্ষণ প্রকাশ ছাড়াই রোগী আক্রান্ত হয়। আবার কয়েক সপ্তাহ পরে কোনো চিকিৎসা ছাড়াই ভালো হয়ে যেতে পারে। কোন স্নায়ু আক্রান্ত হয়েছে তার ওপর লক্ষণ নির্ভর করে। সাধারণ লক্ষণের মধ্যে আছে নির্দিষ্ট কোনো কিছুর দিকে ভালো করে তাকাতে অসুবিধা বোধ, মুখের যেকোনো একপাশে অবশ (বেলস পালসি), পায়ে ব্যথা, থাইতে ব্যথা, পেটে বা বুকে ব্যথা, হাতের আঙুলে ব্যথা (কার্পাল টানেল সিনড্রোম), হাত থেকে জিনিসপত্র পড়ে যাওয়া ইত্যাদি।
আপনার যদি ডায়াবেটিস হয় তবে আপনার রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিয়মিত একজন ডাক্তারের সাথে দেখা করা উচিত। চিকিৎসক আপনার পায়ের অবস্থাও যাচাই করবেন, কারণ ডায়াবেটিস রোগীরা প্রায়শই বুঝতে পারেন না যে তার পায়ে আঘাত রয়েছে।
নিচের অবস্থাগুলো অনুভব করলে আপনাকে অবিলম্বে একজন ডাক্তারের সাথে দেখা করতে হবে:
» পায়ে এমন ক্ষত বা ঘা রয়েছে যা নিরাময় বা সংক্রামিত হচ্ছে না।
» যৌন উত্তেজনায় পরিবর্তন
» প্রস্রাবের সমস্যা দেখা দেওয়া।
» হাত বা পায়ে ব্যথা বা জ্বলন সংবেদন।
মনে রাখবেন, উপরের শর্তগুলি সর্বদা স্নায়ু ক্ষতি নিশ্চিত করে না, তবে অন্যান্য অবস্থার লক্ষণ হতে পারে যার জন্য তাৎক্ষণিক চিকিত্সা প্রয়োজন।
ডায়াবেটিসের চিকিৎসাই নিউরোপ্যাথির ভালো চিকিৎসা। এ জন্য তিনটি ডি মেনে চলা জরুরি। ডায়েট বা খাদ্যতালিকা, ডিসিপ্লিন বা নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন, ড্রাগ বা ওষুধ সেবন।
প্রতিরোধই হচ্ছে মূলত ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথির চিকিৎসা। একবার নিউরোপ্যাথি হয়ে গেলে তা আর নিরাময় করা সম্ভব না। তবে কঠোরভাবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা গেলে, নিউরোপ্যাথি আরো খারাপ অবস্থায় যাওয়া বন্ধ করা যায়।
» কঠোরভাবে যথাযথ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা এবং নিয়মিত ডায়াবেটিস পরীক্ষা করা।
» নিউরোপ্যাথির উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা গ্রহণ। যেমন-ব্যথা হলে ব্যথানাশক ওষুধ, স্নায়ু ভালো রাখে এমন ভিটামিন নিয়মিত সেবন ইত্যাদি। নিউরোপ্যাথিজনিত ব্যথার জন্য সাধারণ ওষুধ ছাড়াও কয়েকটি বিশেষ ওষুধ যেমন (Pregabalin, duloxetin) ব্যবহার করা যেতে পারে।
» রক্তের চর্বি নিয়ন্ত্রণে রাখার মাধ্যমে রক্তনালিকে সরু হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করা।
» অটোনমিক নিউরোপ্যাথির রোগীদের নিয়মিত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ।