মুগ্ধতা ব্লাড ব্যাংকে আপনার দেওয়া তথ্য বাঁচাতে পারে একটি জীবন। আপনার তথ্য দিন, প্রয়োজনে রক্ত খুঁজুন এখানে।

ডায়াবেটিস ও মানসিক স্বাস্থ্য

সাবিনা ইয়াসমিন

১৪ জুলাই, ২০২১ , ৯:৪০ অপরাহ্ণ

ডায়াবেটিস ও মানসিক স্বাস্থ্য

ডায়াবেটিস সম্পর্কে আমরা সবাই কমবেশি জানি যে, এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি নিয়ন্ত্রণযোগ্য শারীরিক রোগ। কিন্তু ডায়াবেটিস এর সাথে মানসিক রোগের যে একটা দ্বিমুখী সম্পর্ক রয়েছে তা হয়তো গোটা কয়েকজনেরই জানা। আসুন জেনে নেই ডায়াবেটিস ও মানসিক রোগের কী সম্পর্ক? তার আগে জানা দরকার মানসিক স্বাস্থ্য কী?

মানসিক স্বাস্থ্য বলতে ব্যক্তির এমন একটা মানসিক অবস্থাকে বুঝায় যখন ব্যক্তি সুস্থ্য স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করতে পারে। সঠিকভাবে অনুভূতি যেমন রাগ, হাসি, কান্না প্রকাশ করতে পারে। নিজের কর্মক্ষমতা ও সক্ষমতাগুলোকে বুঝতে পারে এবং সেগুলোকে কাজে লাগিয়ে সমস্যার সমাধান করতে পারে। সর্বোপরি সবার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে পরিবার ও সমাজে অবদান রাখতে পারে। সুতরাং শুধু মানসিক রোগের অনুপস্থিতিই নয়, বরং সর্বক্ষেত্রে সুস্থ ও স্বাভাবিক কর্মক্ষম থাকাকে বুঝায়। কাজেকর্মে আগ্রহ কমে যাওয়া, মন ও মেজাজের নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটা, ঘুম ও খাবারের পরিবর্তন যেমন বেশি ঘুম বা ঘুম না হওয়া বেশি খাওয়া বা অরুচি) চিন্তা ও ভাবনার মধ্যে নেতিবাচকতা, বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রম থেকে দূরে থাকা, কাজে ও কর্মে আগের থেকে দক্ষতা কমে আসা, মনোযোগের হ্রাস পাওয়া। মনের মধ্যে অস্থিরতা বা অশান্তি অনুভব করা, ভয় পাওয়া, সন্দেহ করা, সম্পর্কের অবনতি ইত্যাদি লক্ষণগুলো থাকলে বোঝা যায় যে, ব্যক্তি কোনো না কোনো মানসিক রোগে ভুগছে।

বিজ্ঞাপন

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায় যে, ডায়াবেটিস ও মানসিক স্বাস্থ্যের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। একটা হলে আরেকটা হতে পারে। অসচেতনতা, ভুল তথ্য, ডিভাইস নির্ভর বিনোদন, যান্ত্রিকতা ইত্যাদি রোগ দুটি বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। ফলে দিন দিন রোগ দুটি বেড়েই চলেছে। কয়েকটি উদাহরণ থেকে আমরা বিষয়টি সহজেই বুঝতে পারি।

কেস- ১:

আব্দুর রাজ্জাক মিয়ার বয়স ৫৫ বছর। ছোটবেলা থেকে প্রচণ্ড খেতে ভালোবাসতেন। বিরিয়ানী, পোলাও, গরুর মাংস, ভাত, পায়েস মিষ্টি মিঠাই সব খাবার তার ভীষণ পছন্দ।

জীবনে তিনি একজন প্রায় সফল ব্যবসায়ী। ৩৫ বছর হলো তার ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে। ডায়াবেটিস যে একটা রোগ এটা তিনি মানতেই পারেন না। ফলে তার জীবন যাপন প্রায় অনিয়ন্ত্রিত। এজন্য প্রায়ই অসুস্থ থাকেন। ফলে তার মন ও মেজাজ ভালো থাকে না। কান্না করেন, অস্থির হয়ে যান, মন খারাপ করে থাকেন। সব কিছুতেই বিরক্ত আর অস্থিরতা। কোনো ধৈর্য ও  সহ্য ক্ষমতা নেই বললেই চলে। ইদানিং ঘুম হয় না। প্রতিরাতে ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমান। দিনে দিনে তার শারীরিক জটিলতা তো বাড়ছেই সাথে সাথে কমে যাচ্ছে মনের জোর ও আগ্রহ। কোনো কাজ বা স্বাস্থ্য বিধি মানতে তার জীবন অনাগ্রহ। যেন কোনো ইচ্ছা শক্তিই নেই আর বেঁচে থাকার। উল্লেখ্য এখানে রাজ্জাক মিয়া ডায়াবেটিসের পাশাপাশি বিষণ্ণতায় ভুগছেন।

কেস ২: ৪৫ বছর বয়সী আফজাল হোসেন দীর্ঘ ১২ বছর হলো সিজোফ্রেনিয়া নামক মানসিক রোগে আক্রান্ত। এজন্য তাকে দীর্ঘদিন থেকে এ্যান্টিসাইকোটিক ঔষধ খেতে হচ্ছে। তার সিজোফ্রেনিয়া নিয়ন্ত্রণে থাকলেও তিনি প্রচুর খাওয়া দাওয়া করেন। শারীরিক কোনো কাজকর্ম বা পরিশ্রম করেন না এবং ঘুমানও বেশি। এতো খান, বিশ্রাম নেন ও পর্যাপ্ত ঘুমের পরও শারীরটা তার খুব দুর্বল। ঘন ঘন প্রসাব হয়, মাঝে মাঝে জামাকাপড় ভিজিয়েও ফেলেন। সারাক্ষণ নাকি ক্ষুধা লাগে তার, তাই ডাক্তার পরীক্ষা করে দেখেন যে, তিনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।

কেস-৩ : হালিমা বেগম ৫০ বছর বয়সী নারী। ১৫ বছর হলো ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে। খুব সাবধানী ও নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন তার। তাই দীর্ঘদিনও ডায়াবেটিসও কন্ট্রোলে। প্রতিদিন বিকেল বেলা হাঁটেন তিনি। একদিন হাটতে গেলে হঠাৎ করে চোখমুখ অন্ধকার হয়ে গেল এবং অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। পরে রাস্তার মানুষজন তাকে বাসায় নিয়ে আসেন এবং প্রাথমিক চিকিৎসার পর তিনি সুস্থ হন। কিন্তু সেদিনের পর থেকেই তার মনে অসুখ বাসা বাঁধল। আর তিনি বাইরে হাঁটতে যেতে পারেন না। ভয় করে যদি আবার পড়ে যান। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকার পরও ভয় আর কাটছে না। প্রতিদিন নিয়মিত সুতার লেভেল চেক করেন। একসময় বাসাতেও থাকতে চান না। ঘুম ঠিক মতো হয় না। সারাক্ষণ ভয় আর বোধহয় বাঁচবেন না। অস্থিরতা বেড়ে গেছে, আগের মতো ঘুমও হচ্ছে না। উল্লেখ্য এখানে ব্যক্তির মধ্যে ফোবিয়া তৈরি হয়েছে যা একটি মানসিক অসুস্থতা।

বিজ্ঞাপন

কাজেই উপরে উদাহরণগুলো থেকে দেখা যাচ্ছে যে, কখনও প্রত্যক্ষ বা কখনও পরোক্ষভাবে একটা আরেকটা তৈরিতে বা বাড়াতে সাহায্য করছে।

গবেষণায় দেখা যায় যে, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিরা কিছু মানসিক রোগ যেমন, বিষন্নতা উদ্বিগ্নতা, প্যানিক এ্যাটাক, ফোবিয়া ইটিং ডিসঅর্ডার, ডিমেনশিয়া, নেশাগ্রস্থ রোগ হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। যারা বিষণ্নতায় ভোগেন তারা সাধারণ মানুষের তুলনায় ৪ গুণ বেশি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আবার যারা উদ্বিগ্নতা রোগে ভোগেন তারা ৩ গুণ বেশি ঝুঁকিতে থাকেন।

বিষন্নতা রোগীদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, তাদের কাজের মধ্যে আগ্রহ কমে যায়, খাদ্য ভীষণ মাত্রায় এলোমেলো হয়ে যায় ফলে তাদের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

আবার অনেক সময় দেখা যায় যে, ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে হাইপোগ্লাইসিমিয়া বা গ্লুকোজের মাত্রা কমে গিয়ে হাত পা কাঁপাকাঁপি, বুক ধরফর, মাথা ঘুরানো, শরীর দুর্বল লাগা, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া যা ব্যক্তির মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করে ফলে ব্যক্তি তার চলাফেরা বন্ধ করে দেয়। ব্যক্তি সবসময় এটা নিয়ে ভাবতে থাকে। বাইরে যাওয়া বা বেশি পরিশ্রম বন্ধ করে দেয়। তা ব্যক্তির প্যানিক এ্যাটাকের মাত্রা বাড়ায় ও পরে রোগে পরিণত হয়।

আবার দীর্ঘদিন ইনসুলিন নিতে নিতে বা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকলে ইনসুলিন নিতে হয় যা অনেক সময় ফোরিয়া তৈরি করে। অন্যদিকে বার বার হাইপোগ্লিইসিমিয়া হওয়ার ফলে ব্রেইনের হোয়াইট পদার্থ বসে যেতে পারে যা পরবর্তীতে ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।

যেহেতু ডায়াবেটিস রোগে খাদ্যাভ্যাসে একটা পরিবর্তন আনতে হয় বা নিয়ন্ত্রিত খাবার খেতে হয় এতে ব্যক্তির মাধ্যমে ভয় তৈরি হয় যা এ্যানোরেক্সিয়া বা বুলিমিয়া ডিসঅর্ডার তৈরি করতে পারে।

গবেষণায় এটাও দেখা যায় যে, যারা দীর্ঘদিন ডায়াবেটিস ও বিষণ্নতায় ভুগছেন পরবর্তীতে তাদের মনোযৌন সমস্যা যেমন Erectile dysfunction বা লিঙ্গ উত্থানজনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে।

আবার বিপরীতভাবে দেখা যায় যে, দীর্ঘদিন মানসিক রোগে ভুগলে ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। কতগুলো স্ট্রেস হরমোন যেমন, কর্টিসল, ক্যাটাকোলামাইন, ভ্যাসোপ্রেমিন, প্রল্যাকটিন ইত্যাদি মানসিক রোগীদের বেড়ে যায় যা ডায়াবেটিস তৈরির ঝুঁকি বাড়ায়।

এছাড়াও কতগুলো মানসিক ঔষধ যেমন এ্যান্টিডিপ্রেস্যান্ট, মুডস্টাবিলাইজার বা এ্যান্টিসাইকোটিক দীর্ঘদিন নিলে শরীরে ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, ডায়াবেটিস এর সাথে মানসিক রোগের একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। অতএব, রোগ দুটি এক সাথে বা আলাদা আলাদাভাবে যেভাবেই থাকুক না কেন রোগ দুটির একই সাথে উপস্থিতি চিকিৎসা ব্যবস্থাকে জটিল করে তোলে। কাজেই কোনো একটাকে অবহেলা না করে দুটির জন্যই সমান চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সচেতনতা, সঠিক খাদ্যাভাস, নিয়ন্ত্রিত জীবন-যাপন ও চিকিৎসকের নিয়মিত ফলোআপ যেমন জরুরি তেমনি মানসিক রোগের জন্য জরুরি দুঃশ্চিন্তা ও বিষন্নতা মুক্ত জীবন। প্রয়োজন হলে মনোরোগের বিশেষজ্ঞ ও ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টদের পরামর্শ গ্রহণ করা দরকার।

সাবিনা ইয়াসমিন
Latest posts by সাবিনা ইয়াসমিন (see all)