সুপ্রিয় পাঠক আমি প্রফেসর মোহাম্মদ ফারুক পাঠান আপনাদের কে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ১৯৮৪ থেকে আমি কাজ করে যাচ্ছি, ডায়াবেটিস রুগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছি।
আজকে আপনাদের সামনে কিছু কথা বলবো, যারা ডায়াবেটিস রুগী আছেন তারা কিভাবে ডায়াবেটিস কে সুনিয়ন্ত্রণ রাখতে পারবেন। এই বিষয়ে আমাদের প্রত্যেক ডায়াবেটিস রুগীদের জানা দরকার। আপনারা সবাই জানেন ডায়বেটিস মহামারি আকারে সারা দুনিয়াতে বিরাজমান। বাংলাদেশ এই বিষয়ে পিছিয়ে নেই। আজকে বাংলাদেশে সত্তর লক্ষ ডায়াবেটিস রুগী আছেন। চিন্তা করছি ২০৪০ সনে এই রোগীর সংখ্যা দাঁড়াবে দ্বিগুণ। যারা অলরেডি ডায়বেটিস এ আক্রান্ত হয়ে গেছেন তাদের পঞ্চাশ ভাগ রোগী জানেন না তারা ডায়াবেটিস এ আক্রান্ত আছেন।
বিজ্ঞাপন
অতএব এই ভয়াবহতা এমন এক পর্যায় চলে গেছে তাদের কোনো লক্ষ্মণ থাকে না। তারা যখন ডাক্তারের কাছে আসছে কিছু জটিলতা নিয়েই ডাক্তারের কাছে শরণাপন্ন হন। আর যাদের অলরেডি ডায়াবেটিস হয়ে গেছে তারা শর্করা কে সুনিয়ন্ত্রণ রাখেন, শর্করাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে আমাদের চিকিৎসা করার যে উদ্দেশ্য কমপ্লিকেশন কিংবা জটিলতার হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করা সেটা সম্ভব হবে। কারণ জটিলতার ব্যয় অনেক বেশি, কারণ জীবনের শক্তি কমে যায়। লাইফের এক্সপেন্স কমে যায়। দৈনন্দিন চিকিৎসায় ব্যয়ও অনেক বেড়ে যায়, যদি আমি সুনিয়ন্ত্রণ রাখতে পারি তাহলে ডায়াবেটিসের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারবো।
আসুন আমরা জেনে নেই আমরা কিভাবে এই ডায়াবেটিস, শর্করাকে সুনিয়ন্ত্রণ রাখতে পারি। তা হলো সারাদিন আমাদের ব্লাড সুগার আমরা যে টার্গেট দিয়ে থাকি প্রত্যেক রুগীর জন্য তা আছে কি না, এক এক রোগীর টার্গেট একেক রকম, ২৫ বছর বয়সে যদি ডায়বেটিস হয় তাহলে তার টার্গেট খালি পেটে ৬ মিলি মোল, খাবার পরে ৮ মিলি মোল, যারা সত্তর বছরের ডায়াবেটিস রোগী আছেন তাদের বেলায় কিন্তু একই টার্গেট না, খালি পেটে ৭/৮ থাকবে, খাবার খেলে ৮-১০ থাকবে।
তিন মাসের যে গড় হিসেব বলি এইচ বি ওয়ান সি এটা ইয়াং বয়সের যার ডায়বেটিস হয়েছে কিন্তু কোনো কমপ্লিকেশন হয় নি। তাদের বেলায় আমরা রাখবো ৭% এর নিচে এইচ বি ওয়ান সি আর যে বয়স্ক রোগী, জীবনের আয়ুস্কাল কমে গেছে, বিভিন্ন জটিলতায় ভুগছেন, আর কিছু দেওয়ার নাই পাওয়ার নাই, তাদের বেলায় এইচ বি ওয়ান সি’র টার্গেট হলো ৮-৮.৫ পারসেন্ট। এই যে বিষয় গুলি জানছেন একেক রুগীর জন্য আমরা একেক টার্গেট দিয়ে থাকি আপনি আপনার ডাক্তার এর কাছে জেনে নিবেন আপনার শরীরের শর্করার মাত্রা কতো থাকলে আপনি বলতে পারবেন আমার সুনিয়ন্ত্রণ আছে। দুই নম্বর হলো সারাদিনের ব্লাড সুগার ল্যাবরেটরিতে গিয়ে প্রতিবার ব্লাড সুগার চেক করা সম্ভব নয়, তার জন্য প্রয়োজন একটা গ্লুকো মিটার, তাই প্রত্যেক ডায়বেটিস রোগী গ্লুকো মিটার কিনে নিবেন। সাধারণত বলে থাকি একটা মোবাইল ফোন কেনার চেয়ে একটা গ্লুকো মিটার কেনা অনেক জরুরি। সেল ইওর মোবাইল ফোন বাই এ গ্লুকো মিটার। আপনারা এই গ্লুকো মিটারের মাধ্যমে ব্লাড সুগার দেখেন, এবং সারাদিনের চার্ট মেইনটেইন করেন। আমি নিজেও বুঝতে পারবেন আপনার শর্করায় কোন জায়গাটা নিয়ন্ত্রণ’এ নাই আর ডাক্তারও বুঝতে পারবে আপনার কোন জায়গাটা নিয়ন্ত্রণ এ নাই। তো সেভাবে প্লান করা ট্রিটমেন টা আপনার মোডিফাই করে দেওয়াটা ইম্পোর্টেন্স বিষয়। তো কয়বার চেক করতে হয়, কয়দিন পর পর চেক করতে হয়? সাধারণত চার থেকে পাঁচ বার কোনো ক্ষেত্রে ৬ বার আমরা করে থাকি।
প্রতিদিন করার দরকার নাই, যদি শর্করা সুনিয়ন্ত্রণ না থাকে তাহলে একদিন পর পর করলাম অথবা তিনদিন পর পর করলাম আর যদি সুনিয়ন্ত্রণ থাকে তাহলে সাতদিন পর পর করলাম। যখনই করবো তখনই দেখবো খালি পেটে ব্লাড সুগার কেমন আছে, নাস্তা খাওয়ার দুই থেকে তিন ঘন্টা পর কেমন আছে, দুপুরে খাওয়ার দুই থেকে তিন ঘন্টা পর কেমন আছে, রাতে খাওয়ার দুই থেকে তিন ঘন্টা পর কেমন আছে।তাহলে এই রেকর্ড এর ভিত্তিতে আপনার একদিন হলে চলবে না রেগুলার হতে হবে, তাহলে বরাবর আমার ফাসটিং, বরাবর আমার খাওয়ার পর এগুলো কেমন থাকে তারই ভিত্তিতে পরিবর্তন কিংবা পরিবর্ধন করতে হয়। এই হলো ডায়বেটিস সুনিয়ন্ত্রণ রাখার মাপকাঠি, আর তিন মাস পর পর আমি এইজ বয়েন্সি করে যাবো। তিন মাসে আমার শর্করা সুনিয়ন্ত্রণ ছিলো কি না কারণ তারই ভিত্তিতে আমার চিকিৎসা পরিবর্তন হয় এবং এই এইজ বয়েন্সির তিন মাসের গড় হিসেবে আমরা বলতে পারি কার কতো জটিলতা আসবে। অতএব, শর্করা নিয়ন্ত্রণ মাপকাঠি গুলো আপনি জেনে নিবেন। এবং পদক্ষেপগুলি সেইভাবে মেনে চলবেন। দ্বিতীয়ত ব্লাড সুগার সুনিয়ন্ত্রণ রাখতে গেলে কতগুলি পদক্ষেপ নিতে হয় তারমধ্যে মোস্ট ইমপর্টেন্ট জিনিস টা হলো ডিসিপ্লিন, আপনাকে শৃঙ্খলা মানতে হবে, আমার দৈনন্দিন জীবন যাত্রায় সুশৃঙ্খলা মানতে হবে। লাইফ স্টাইল টাকে আমার হেলদি লাইফ স্টাইলে নিয়ে আসতে হবে। এমন কোনো কথা নাই হেলদি লাইফ স্টাইল শুধু ডায়বেটিস রোগীদের জন্য প্রযোজ্য, সব মানুষের জন্যই প্রযোজ্য।
যদি আমরা হেলফি লাইফ স্টাইল মানতে পারতাম তাহলে আমাদের এই ডায়বেটিসের রোগে আক্রান্ত হইতে হতো না। যদিও জন্মগত ত্রুটি থাকুক না কেনো, যদি আমি জীবনটাকে সুনিয়ন্ত্রণ রাখতে পারতাম তাহলে আমাদের এই সমস্যাগুলো আসতো না। তার মানে হলো সুস্বাস্থ্য খাবার, দৈনন্দিন কায়িক পরিশ্রম এবং ওজনকে ঠিক রাখা। এই তিনটা পদক্ষেপ হলো ডায়াবেটিসকে নিয়ন্ত্রণ রাখার প্রধান উপায়। প্রতিকার মানে হলো সুনিয়ন্ত্রণ রাখা। হেলদি লাইফস্টাইলের দুইটি পার্ট ব্রাকগ্রাউন্ড। আমি একটি বিল্ডিং বানাতে চাই, টেকসই বানাতে চাই। এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ফাউন্ডেশন। এখানেও তাই আমি ঔষধপত্র যাই খাই না কেন আমার যদি ডায়াবেটিস এর ফাউন্ডেশন ঠিক না থাকে তাহলে সুনিয়ন্ত্রণ রাখতে পারবো না। ডায়াবেটিস রোগের ফাউন্ডেশন হলো শৃঙ্খল এবং হেলদি লাইফ। আবার হেলদি লাইফের দুইটি পার্ট। কি পরিমাণ কায়িক পরিশ্রম করবো। খাওয়াদাওয়া মানে ডায়েট কন্ট্রোল না। সবাই মনে করে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করা কিন্তু তা নয়। আমাকে ব্যালেন্স ডায়েট করতে হবে। এই ব্যালেন্স ডায়েট ডায়াবেটিস হলেও প্রযোজ্য না হলেও প্রযোজ্য। প্রত্যেক মানুষের জন্য প্রযোজ্য। এই ব্যালেন্স ডায়েট আমরা ঠিক করি আমার হাইট কত, ওজন কত, ভুড়ির সাইজ কত,আমি কি ধরনের কাজ করি তার ভিত্তিতে প্রত্যেক মানুষের ব্যালেন্স ডায়েট বানাতে হবে।
সুষম খাদ্য বা ব্যালেন্স ডায়েট হলো আমার খাদ্যে ৫০ থেকে ৬০% শর্করা থাকতে হবে।কিন্তু আমাদের খাদ্যাভাসে ৫০ থেকে ৯০% শর্করা থাকে। আমরা যদি সেটা কমিয়ে আনতে পারি তাহলে শর্করা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। ডায়াবেটিস ও অন্যদের পার্থক্য হলো আমরা সরাসরি চিনি মিষ্টি খাবো না। যাকে রিফাইন সুগার বলে। সেগুলো বাদে বাকীগুলোর কোন পরিবর্তন হবে না। ব্যালেন্স ডায়েটের নিয়ম হলো খাবারকে ছয়ভাগে ভাগ করা। প্রধানত তিনবেলা। তারপর সকালে নাস্তার আর দুপুরের খাবারের মাঝে হালকা খাওয়া, দুপুরের খাওয়ার পর এবং রাতে খাওয়ার মাঝখানে বিকেলের দিকে হালকা নাস্তা। আটটায় রাতের খাবারের পর ঘুমানোর আগে এগারোটার দিকে হালকা কিছু খাওয়া। এই সিডিউলটা নিয়মিত সময়মাফিক পালন করা যাতে টাইমের এদিক সেদিক না হওয়া। ঠিক তেমনিভাবে খাওয়ার পরিমাণটাও ঠিক রাখা। সকালে দুইটা রুটি খেলে প্রতিদিন দুইটা করেই খাওয়া। এটা ঠিক রাখতে না পারলে শর্করাকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। আর খাবারের ডিউরেশনটাও ঠিক রাখতে হবে। ত্রিশ মিনিট হলে ত্রিশ মিনিট, এক ঘন্টা হলে এক ঘন্টা। শৃঙ্খলা আমাকে মানতেই হবে। একই সময়ে খাবো, একই সময়ে ব্যায়াম করবো। তারপর সুনিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য আপনাকে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। তিনমাস অথবা দুই মাস পরপর নিতে হবে। আপনার শরীরের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পরামর্শ দিবেন।
তিনমাসের শর্করার গড় হিসেব দেখে ঔষধ দিবে। ঔষধ বিভিন্ন ধরনের দেয়া যায়। এক ধরনের, দুই ধরনের, তিন ধরনের। যখন ঔষধে নিয়ন্ত্রণ হবে না তখন ইনসুলিন নিতে হবে। প্রত্যেক ডায়াবেটিস রোগী, হোক টাইপ ১ কিংবা টাইপ ২ একসময় না একসময় ইনসুলিন এ আসতে হবে। কারণ আমাদের যে কোষ থেকে ইনসুলিন তৈরি হয় সেটা আসতে আসতে নিস্তেজ হয়ে যায়। ইনসুলিন যত তাড়াতাড়ি শুরু করবে ততো তাড়াতাড়ি শর্করা নিয়ন্ত্রণে থাকবে। রোগী বুদ্ধিমান হলে তাড়াতাড়ি শুরু করবে। ইনসুলিন কোন ক্যামিকেল সাবসটেন্স না। পানির মতোই এটি বাইরে থেকে দিতে হয়। আপনি ঔষধের মত খাবার পরে এটি নিতে পারবেন না। অনেকই ভুল করে থাকেন। ঔষধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে চান কিন্তু তা সম্ভব না।এটি একদিনের রোগ না সারাজীবনের রোগ। এই রোগ সম্পর্কে জানতে হবে। আপনি যতবেশী এই সম্পর্কে জানবেন ততো বেশী সচেতন হবেন এবং নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন। জানতে হলে আপনাকে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করতে হবে। ডাক্তার বলে দিবেন কিভাবে কি করতে হবে।
আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ। সুশৃঙ্খল জীবন যাপন করুন। ডায়াবেটিস কে নিয়ন্ত্রণে রাখুন।