মূল : ইথেরিজ নাইট
ভূমিকা ও ভাষান্তর : রেজাউল ইসলাম হাসু
হাককু থেকে বদলে হাইকু নামে রূপান্তরিত হয় উনিশ শতকের শেষে জাপানি কবি মাসাওকা শিকির হাত ধরে কবিতা বিশ্বের এই ক্ষুদ্রতম সংস্করণটি। এর আদি উৎস তথ্য ও প্রযুক্তিতে উন্নত রাষ্ট্র সূর্যোদয়ের দেশ জাপান হলেও বর্তমান সারা পৃথিবীতে উজ্জ্বল স্বপ্ন ও সৌন্দর্য। আভিজাত্যের সৌকর্ষ হিসেবে জাপানিদের রক্তে মিশে আছে। হাইকু হলো একধরনের ক্ষুদ্র সংস্করণের জাপানি কবিতা। যার শরীর চুমুর চেয়েও ছোট কিন্তু রক্তাভ আর প্রগাঢ়। তিনটি পংক্তিতে যথাক্রমে ৭, ৫ এবং ৭ জাপানি শ্বাসাঘাত মোরাস বা সিলেবলস মিলে মোট ১৭ মোরাসের বা সিলেবলসের সংক্ষিপ্ত পরিসরে এক মুহূর্তেই ঘটিত মনের ভাব এর অভিব্যক্তি-নামা। জাপানি হাইকু একটি লাইনে লেখা হয়। সেই বাক্যটিতে ১৭টি মোরাস বা সিলেবলস থাকে।
মোরাস ও মাত্রা একই ব্যাপার নয়। ইউরোপিয়গণ ১৭ মোরাসকে ১৭ দল মনে করে হাইকু লেখার সূচনা শুরু করে। তাদের দেখাদেখি বাংলাভাষায় ১৭ মাত্রার হাইকু লেখার প্রচলন হয়। মোরাস, দল ও মাত্রা এক-একটি ভাষার নিজস্ব শ্বাস অনুসারী। সেই অনুযায়ী ১২ মোরাসে ১৭ সিলেবল হয়। ইউরোপে ইমেজিস্ট আন্দোলনের পর ১৭ সিলেবলের পরিবর্তে আরও বেশি সিলেবলের হাইকু লেখা শুরু হয়েছে। জ্যাক কেরুয়াক প্রমুখ মার্কিন কবিরা স্বীকার করেছেন যে মার্কিন উচ্চারণ জাপানি উচ্চারণ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। তারা ১৭ দল ও তিন বাক্য্ বন্ধন অস্বীকার করে হাইকু লিখছেন।সাধারণত ছবির বিষয় ও ভাব বর্ণনা করার জন্য হাইকু লেখার সূচনা হলেও তার সে বলয় ভেঙে সে আজ চৌহদ্দিতে বিপুলভাবে বিস্তৃত। কোবায়িশি ইশা, মাৎসু বাসো, য়োসা বুসনসহ প্রমুখ জাপানি কবিরা হাইকু লিখে বিশ্বসাহিত্যে তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন।
ইথেরিজ নাইট ১৯৩১ সালে মিসিসিপির করিন্থে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি কিশোর বয়সে হাই স্কুল ছেড়ে কোরিয়া যুদ্ধের জন্য সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। সংঘাত চলাকালীন আহত হয়ে তিনি নাগরিক জীবনে ফিরে আসেন। টেরেন্স হেইসের মতে,
“নাইটের জীবনী অস্থির আমেরিকানত্ব, আফ্রিকান আমেরিকানা ও কবিতার গল্প। এতে কিছু ফকনারিয়ান পারিবারিক কাহিনী রয়েছে, কিছু মধ্যসত্মার রূপান্তরের কাহিনী, নির্মম পুংলিঙ্গ ট্র্যাজেডি আর নিদাগ শিল্প-শ্রদ্ধা । ”
কারাগারে থাকাকালীন নাইট কবিতা লিখতে শুরু করেন। ডুডলি এবং গেন্ডেললিন ব্রুকসের মতো কৃষ্ণাঙ্গ আলোকিত সাহিত্যিকদের সাথে তার যোগাযোগ ছিলো এবং তাঁদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। ১৯৬৮ সালে কবিতা থেকে প্রিজন তাঁর প্রথম সংকলন বের হয়। কবিতা থেকে প্রিজন এর ব্যাকপেজের প্রচ্ছদে নিম্নলিখিত বয়ানটি অন্তর্ভুক্ত ছিলো :
“আমি কোরিয়ান শরীরে ক্ষত হয়ে মরে গেলাম আর মাদক আমাকে পুনরুত্থিত করলো। আমি কারাগারের অন্ধকারে মরে গেলাম আর কবিতা আমাকে পুনরুত্থিত করলো।”
তার উল্লেখযোগ্য রচনা হলো নাইট’স বার্ন অব এ ওম্যান : নতুন এবং নির্বাচিত কবিতা (১৯৮০)।
নিজের প্রচেষ্টায় সমাজকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকা মানুষ ইথেরিজ নাইট ১৯৯১ সালে মারা যান। নিচে এই মহান কবির কয়েকটি হাইকু ভাষান্তর করতে পেরে নিজেকে গর্বিত বোধ করছি।
পুবে প্রহরী-পাহাড়
অস্তমিত ছায়া; দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত
অশ্মের উপর যেন গিরগিটি।
বখিল বেহালাবাদক
বেজে ওঠে, মধ্যরাতে
তার ব্যাঞ্জণা ঝর্ণার মতো ঝরে।
তীর্যকভাবে খুপড়িতে ফেরে ভোর
টালমাতাল, যেন খুঁড়ে খুঁড়ে উড়ে চলা
কারাগারের ফ্লোর।
একটি বিষাদের গান লিখতে
অবাদে অপচয় করা,
আর অন্ধকার থেকে রত্ন আহরণ।
একটি শূন্য পিক্যান গাছ
পিছলে যাওয়া পেন্সিল ছায়াতলে
কোনো তুষারের জ্যোৎস্না।
পতিত তুষার ঝড়ে
বিদীর্ণ হবে না দীর্ঘস্থায়ী শোক অথবা
ইস্পাতের মতো স্তব্ধতা।
চাঁদের ছায়ার নিচে
একটি সুদীর্ঘ ছুরি জ্বলছে আর
নক্ষত্রের মতো উজ্জ্বল বরফখণ্ড।
শ্রাবণের ঘাস
সূর্যের অন্তিম আভায় অভিহত হয়
চায়ের কাপে মুষুলধারে মিনতি।
সতেরো শ্বাসাঘাতে
ব্যাঞ্জণার বিকাশ ছাড়া
কবিদের দায় নেই।
উৎস : পয়েট্রি ফাউন্ডেশন ও উইকিপিডিয়া।
লেখক : তরুণ সাহিত্যিক।
জন্ম : রংপুর, ১৯৮৭সাল।
প্রকাশিত বই দুইটা।
এক. ওকাবোকা তেলাপোকা (২০১৬) -শিশুতোষ
দুই. এলিয়েনের দেশ পেরিয়ে (২০১৭)-শিশুতোষ।