একটা মজার ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। এটা ফেসবুকের কল্যাণে পেয়েছি। একটি কোরিয়ান কোম্পানিতে বাংলাদেশি শ্রমিক কাজ করেন। রোজা নিয়ে তাদের কথোপকথন তুলে ধরছি।
কোরিয়ানদের কাছে রোজা এক বিস্ময়ের নাম। তাদের অনেক মজার মজার প্রশ্নও আছে এর মধ্যে
– পানিও খাওয়া যাবে না?
– সিগারেটও না?
– আচ্ছা, লুকিয়ে যদি খাও? যদি গোসলের সময় পানি খাও?
অনেক হেসে আমার বাঙালি মুসলিম ভাই ফের জবাব দেন, গোসল করতে লুকিয়ে কেন খাবো? ইচ্ছা করলে বিরিয়ানি রেঁধে ঘরে বসেই খেতে পারি। ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এতে আমরা অভ্যস্ত।
তখন শুরু হয় বিস্ময়ের আরেক ধাপ!
– কেন খাও না?
– অদৃশ্য খোদা বলেছেন বলে?
– তিনি দেখতে পাবেন বলে?
– তোমাদের এতো সংযম! এত আত্মনিয়ন্ত্রণ!
– তবে তো নিশ্চয়ই তোমাদের দেশে কেউ মিথ্যা বলে না, কেউ পাপ করে না!
– পুলিশও লাগে না!
– জেলখানাও নাই!
এর কী জবাব হতে পারে?
আমার সেই ভাই সেসময় নিশ্চয় মাথা হেট করে সরতে পারলে বর্তে যান, বোঝা যায়।
বাংলাদেশ প্রতিদিনে একটা খবর কদিন আগে প্রকাশিত হয়েছে আরব আমিরাতের ব্যবসায়ীরা প্রতিবারের ন্যায় এবারের রমজান মাসেও বাজারে কমলাভে, বিনালাভে পণ্যদ্রব্য বিক্রি করবেন।
– এর মানে কী?
মানে খুবই সহজ। তাঁরা সারাবছর ব্যবসা করেন। কিন্তু রোজায় ব্যবসা করবেন না। তাঁরা পবিত্র রমজান মাসে আল্লাহর সান্যিধ্য লাভের আশায় ছাড় দিয়ে ব্যবসা করবেন। জনগণের কাতারে থাকবেন।
আর পুরো উল্টোচিত্র বাংলাদেশে।
এখানে রমজানে বেশি ব্যবসা করে ব্যবসায়ীরা। সারাবছরের বানিজ্যটা এ মাসেই করবে। প্রচুর লাভ করার আশায় ছয়মাস আগ থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য স্টক করছেন। অর্থাৎ ছয়মাস আগ থেকে নিরীহ জনসাধারণকে কষ্টে রাখার সুন্দর পাঁয়তারা শুয়ে-বসে ভাবে আর করে।
বাড়িতে, দোকানে, গোডাউনে, কোল্ড স্টোরেজে রমজান মাস উপলক্ষে প্রচুর পণ্য স্টক করে রাখে। ফলে বাজারে অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের কৃত্রিম একটা সংকট শুরু হয়েছে। রোজা না আসতেই অনেক পণ্যের আকাশছোঁয়া দাম। তাহলে রোজায় কী হবে?
-যা হবার তাই হবে।
রমজান মাস ধর্মীয় দিক থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাস হলেও ব্যবসায়ীদের কোন মানবতা নেই। এখানে কারও কোন দায়বদ্ধতা নেই। অনুশোচনা নেই। সবাই অর্থ কামাই করতে ব্যস্ত। তাদের আরও ধনী হতে হবে।
বাজারে ঝোলাভর্তি খরচ করছে কারা?
– ব্যবসায়ী, মুনাফালোভী, সুদখোর, ঘুষখোররা। আর গরিব মানুষ, স্বল্প আয়ের মানুষ, নিম্নশ্রেণির চাকরিজীবী বাজারে খুব অসহায়। শখ আল্লাদের খরচ করা তো দূরের কথা, দু’বেলা দু’মুঠো সুন্দর করে খাবেন সে উপায় নেই। সরে যাওয়া, পঁচে যাওয়া ফেলনা মাছও কিনতে পারেন না। গোশত তো দূরের ব্যাপার। গরুর মাংস ৭০০ টাকা কেজি। যেন সোনার বাজার। এমন অনেক মানুষ আছেন সারাবছর মাংসের কথা ভাবতেই পারে না। শুধু দাওয়াতের বাড়িতে মাংস খায়। কিংবা ঈদে কোনরকমে।
মাননীয় বানিজ্য মন্ত্রী টিপু মুনশি মহোদয় বলেছেন, বাজারে পণ্য সরবরাহ ঠিক থাকবে, যদি ভোক্তারা রমজান শুরুর আগেই বাজারে হুমড়ি খেয়ে না পড়েন। তখন বাজারে চাপও পড়বে না।
তিনি আরও বলেছেন, অবৈধ মজুতদারদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ব্যবস্থা নেয়া হবে কি, এখন থেকে মাঠে থাকতে হবে। নজরদারিসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি ব্যবসায়ী মানুষ, তিনি ভাল জানেন এখানে কিভাবে সিন্ডিকেট করে, কারা তারা? শুধু বলার জন্য বললে হবে না। আন্তরিকতার সাথে তৎপর হয়ে রুখে দিতে হবে এসব সিন্ডিকেটদের।
বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, রমজানে দু’বার অসচ্ছল পরিবারের সদস্যদের টিসিবির পণ্য দেওয়া হবে, যাতে মানুষের কোনো সমস্যা না হয়।
সে মোতাবেক নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সাশ্রয়ী দামে পণ্য বিক্রি করতে যাচ্ছে টিসিবি। ভোক্তারা ১কেজি চিনি ৬০ টাকা দরে, মসুর ডাল ৭০ টাকা দরে সর্বোচ্চ ২ কেজি। সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১১০ টাকা দরে ১ লিটার হিসেবে সর্বোচ্চ ২ লিটার, ছোলা প্রতি কেজি ৫০ টাকা দরে ১ কেজি কিনতে পারবেন।
সারাদেশে ১কোটি উপকারভোগী কার্ডধারী পরিবার ভর্তুকি মূল্যে এ সুযোগ পাবেন। কিন্তু খেজুরের উল্লেখ চোখে পড়ল না। যদিও এর আগের রমজানে ছিল।
শেষ করছি আমার চেনাশোনা এক বন্ধুর কথা দিয়ে।
সে বন্ধু দীর্ঘদিন বাজারে যায় না। বন্ধুর স্ত্রী ছেলে-মেয়ের মা, তিনি সন্তানদের মুখের দিকে চেয়ে বোরকা পরে শেষবেলা বাজারে যান যাতে কেউ না চেনে তাকে। তিনি কোন রকমে বাজারটা সেরে পালান। অনেকের এমন অবস্থা।
ভাগ্যিস, কিছু হকার এখন সর্বত্র। তারা পাড়ায় পাড়ায় হেঁকে ডেকে নিরস-সরস, উচ্ছিষ্ট কিছু বেচতে আসেন বলে অনেক পরিবার এখনও কোনরকমে টিকে আছেন।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের একটা উদাহরণ দিচ্ছি, পড়ুন।
কমিউনিস্ট নেতা কমরেড জ্যোতি বসু টানা ২৪ বছর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তাঁর শাসনামলে তাঁর দলের লোকরা বাজারে বাজারে লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো হুজুগে কোন জিনিসের দাম যেন না বাড়ে। তিনি শক্ত হাতে বাজার নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন।
বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারকে শক্ত হাতে বাজারের নিয়ন্ত্রণ নিতে তাদের দলের লোকদের নির্দেশ দিতে হবে। অরাজকতা এড়িয়ে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে যেন সেসব কাজ নেতাকর্মীরা করেন-তেমন হুকুম দিতে হবে।
পাশাপাশি আমরাও যেন হুমড়ি খেয়ে না পড়ি – সে ব্যাপারে সচেতন থাকব।
পবিত্র রমজান শেষে ঈদ।
মানুষ নিশ্চিন্তে নির্বিঘ্নে যেন ঈদ উদযাপন করতে পারে- সে প্রত্যাশা করছি।
● মাসুম মোরশেদ
শিক্ষক, সাহিত্যকর্মী