জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার লেখনিতে মানবতার কথা বলেছেন বললে তাঁকে সংকীর্ণ করা হবে বরং বলা যায় তিনি মানবতার পক্ষে, মানুষের পক্ষে কথা বলেছেন। সকল পেশার, সকল শ্রেণির, সকল ধর্মের ঊর্ধ্বে তিনি মানুষের পক্ষে তার কলম ধরেছেন। মানুষের প্রতি মানুষের অবিচার, মানুষে মানুষে পেশা-শ্রেণি-ধর্ম দ্বন্দ্বে মানুষের প্রতি অবহেলা তিনি মেনে নিতে পারেননি। তিনি মানুষের পক্ষে যা লিখেছেন তা যুক্তির মাধ্যমেই লিখেছেন। সভ্যতার ইতিহাস, বিকাশ তো মানুষেরই সৃষ্টি এবং মানুষই শ্রেষ্ঠ জীব- এ চরম সত্য মানুষকে বোঝাতেই তার লেখনি তাকে অমর করে রাখবে।
নজরুল প্রথমত মানুষ- তারপর কবি বা লেখক অর্থাৎ তিনি যত বড় কবি, তার চেয়ে অনেক বড় মানুষ। স্বভাবতই তার কেন্দ্রীয় চিন্তা- চেতনা মানূষকে নিয়ে। তাই তিনি তার ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতায় লিখলেন-
‘অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ,
কা-ারি! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি-পণ!
‘হিন্দু না ওরা মুসলিম?’ ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কাণ্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র!’
নজরুল তাঁর কবিতায় হিন্দু-মুসলিমকে পরস্পর সহোদর ভেবে নিয়েছেন। কারও থেকে কেউ বিচ্ছন্ন নয়। একই মায়ের জঠরে আমাদের জন্ম হলে আমরা যেমন ভাই, একই বৃন্তে থাকলে তো আমরা তেমন ভাই। তাঁর ‘মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম’ কবিতায় বলেছেন-
‘মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান।
মুসলিম তার নয়ন-মণি হিন্দু তাহার প্রাণ।
এক সে আকাশ মায়ের কোলে
যেন রবি শশী দোলে,
এক রক্ত বুকের তলে, এক সে নাড়ির টান।’
একই রক্ত ও মাংসের উপাদানে তৈরি হিন্দু-মুসলিম শ্রেণি বিভেদকে কবি দূরে ঠেলে দিয়েছেন। এ যেন সেই মহৎ শিক্ষা- কোন ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণির শিশুটি জলে পড়েছে তা না খুঁজে, আগে শিশুটিকে বাঁচান। তিনি উপলব্ধি করেছেন শ্রেণি বিভেদ মানুষের দুঃখ, দুর্দশা, পতনের কারণ। মানুষকে ভালোবাসার মাধ্যমেই সম্প্রীতি টিকিয়ে রাখা সম্ভব।
মানবতার মাধ্যমে নজরুল সাম্যবাদের ফুল ফোটাতে চেয়েছেন তাঁর কবিতায়। কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা সম্পদায়ের তিনি নন। তিনি কাউকে এককভাবে খুশি করতেও চাননি। তাঁর কাছে সবাই সমান- সকল মানুষ সমান, সকল ধর্ম সমান। ‘সাম্যবাদী’ কবিতায় কবি বলেন-
‘গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হ’য়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান,
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম ক্রীশ্চান।’
মানুষে মানুষে সমতার এ এক অনবদ্য উদাহরণ। সাম্যবাদের, মানবতাবাদের নির্যাস তার মেধায়-মননে। সকল কিছুর উৎসে তিনি মানুষকে একমাত্র আধার ধরে নিয়েছেন।
হিন্দু মুসলানের সেতুবন্ধন সৃষ্টি হয়েছে তাঁর কবিতায়। কার ধর্ম কী- এটা জানার আগে সে মানুষ। তিনি তাঁর কবিতায় হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মিল তুলে ধরেছেন। ‘ইন্দ্রপতন’ কবিতায় তিনি বলেছেন এভাবে-
‘হিন্দু-মুসলমানের পরানে তুমিই বাঁধিলে সেতু!
জানি না আজিকে কি অর্ঘ্য দেবে হিন্দু-মুসলমান,
ঈর্ষা-পঙ্কে পঙ্কজ হ’য়ে ফুটুক এদের প্রাণ!’
কিংবা, ‘প্যাক্ট্’ কবিতায়-
‘বদনা-গাড়ুতে গলাগলি করে, নব প্যাক্টের আস্নাই
মুসলমানের হাতে নাই ছুরি, হিন্দুর হাতে বাঁশ নাই।’
আবার ‘শ্রীচরণ ভরসা’য় পাই-
‘‘লখিতে চরিতে লঙ্ঘিয়া যায় গিরি দরী বন সিন্ধু,
এই এক পথে মিলিয়াছি মোরা সব মুসলিম-হিন্দু।’
মানুষে মানুষে এমন সুন্দর সেতুবন্ধনেই কেবল শান্তির পথে চলা যায়- এমন উপলব্ধি কবির। হোক না সে পথ দুর্গম- শুধুমাত্র মানুষে মানুষে যোগসূত্র থাকলে যেকোনো পরিত্রাণ সম্ভব।
শুধু কি কবিতায়? তার ‘মন্দির ও মসজিদ’ প্রবন্ধে রয়েছে মানুষের কথা- (‘মারো শালা যবনদের!’ ‘মারো শালা কাফেরদের!’ আবার হিন্দু মুসলমানি কাণ্ড বাঁধিয়া গিয়াছে। প্রথমে কথা-কাটাকাটি, তারপর মাথা-ফাটাফাটি আরম্ভ হইয়া গেল। আল্লার এবং মা কালীর ‘প্রেস্টিজ’ রক্ষার জন্য যাহারা এতক্ষণ মাতাল হইয়া চিৎকার করিতেছিল তাহারাই যখন মার খাইয়া পড়িয়া যাইতে লাগিল, দেখিলাম, তখন আর তাহারা আল্লা মিয়া বা কালী ঠাকুরানির নাম লইতেছে না। হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি পড়িয়া থাকিয়া এক ভাষায় আর্তনাদ করিতেছে, ‘বাবা গো, মা গো!’ মাতৃপরিত্যক্ত দুটি বিভিন্ন ধর্মের শিশু যেমন করিয়া এক স্বরে কাঁদিয়া তাহাদের মাকে ডাকে!
দেখিলাম, হত-আহতদের ক্রন্দনে মসজিদ টলিল না, মন্দিরের পাষাণ দেবতা সাড়া দিল না। শুধু নির্বোধ মানুষের রক্তে তাহাদের বেদি চিরকলঙ্কিত হইয়া রহিল।
মন্দির-মসজিদের ললাটে লেখা এই রক্তকলঙ্ক-রেখা কে মুছিয়া ফেলিবে, বীর?)’
অব্যই এখানে কোনো বীরের প্রয়োজন নেই। এ কলঙ্ক শুধুমাত্র সম্প্রীতির মাধ্যমেই মুছে ফেলা সম্ভব। কবির প্রশ্ন তাদের কাছে যারা মানুষে মানুষে বিভেদের মাধ্যমে মানবতার বুকে কলঙ্ক এঁটে দেয়।
একই গোত্রভুক্ত, ধর্মভুক্ত মানুষও যখন- মানুষ নামের কিছু দুপা বিশিষ্ট প্রাণীর দ্বারা লাঞ্ছিত হন, তখন মানুষের এ ব্যবধান নজরুল মানতে পারেননি। ‘মানুষ’ কবিতায় বললেন-
‘মানুষেরে ঘৃণা করি
ও’ কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি’ মরি’
ও’ মুখ হইতে কেতাব গ্রন্থ নাও জোর ক’রে কেড়ে,
যাহারা আনিল গ্রন্থ-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে।
পূজিছে গ্রন্থ ভ-ের দল!- মূর্খরা সব শোনো,
মানুষ এনেছে গ্রন্থ;- গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনও।’
…‘কাহারে করিছ ঘৃণা তুমি ভাই, কাহারে মারিছ লাথি?
হয়ত উহারই বুকে ভগবান জাগিছেন দিবা-রাতি।’
…‘চাষা ব’লে করো ঘৃণা!
দে’খো চাষা-রূপে লুকায়ে জনক বলরাম এলো কি না!’
ভুখারী নামাজ পড়ে না বলে মোল্লা তাকে খাবার দিতে চায়নি, কিন্তু সে ভুখারী আশি বছর খোদাকে না ডাকলেও তার ক্ষুধার অন্ন তার ¯্রষ্টা তো বন্ধ করেনি। এ কবিতায় কবির মানুষের প্রতি যে সম্মান তা বাংলা সাহিত্যে অনবদ্য।
গরিব-ধনীর ব্যবধানে ব্যথিত নজরুল। গরিব শ্রেণির মানুষ যখন ধনীর দ্বারা নিষ্পষিত নজরুল লিখলেন ‘কুলি-মজুর’ কবিতা-
দেখিনু সেদিন রেলে,
কুলি ব’লে এক বাবুসা’ব তারে ঠেলে দিলে নীচে ফেলে!
চোখ ফেটে এল জল
এমনি ক’রে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?’
…তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদেরি গান,
তাদেরি ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে নব উত্থান!’
…সকল কালের সকল দেশের সকর মানুষ আসি’
এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শোনো এক মিলনের বাঁশি।
একজন দিলে ব্যথা-
সমান হইয়া বাজে যে বেদনা সকলের বুকে হেথা।
একের অসম্মান
নিখিল মানব-জাতির লজ্জা- সকলের অপমান!’
মানুষকে নিয়ে নজরুলের ভাবনার এমন নমুনা নজরুলকে মর্যাদা দিয়েছে মানবতার কবি, সাম্যের কবি হিসেবে। কোনো ধর্মের কথা নয়, জাতের কথা নয়, কোন সম্প্রদায়ের কথা নয়, কোনো সম্প্রদায়ের কথা নয়- নজরুলের সোজাসাপটা বিষয় হচ্ছে মানুষের পক্ষে কথা, মানবতার পক্ষে, সাম্যের পক্ষে কথা বলা।
সাঈদ সাহেদুল ইসলাম