মুগ্ধতা ব্লাড ব্যাংকে আপনার দেওয়া তথ্য বাঁচাতে পারে একটি জীবন। আপনার তথ্য দিন, প্রয়োজনে রক্ত খুঁজুন এখানে।

নারী এবং ভাষা আন্দোলন 

নূরুন্নাহার বেগম

২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ , ১১:৩৪ অপরাহ্ণ ;

নারী এবং ভাষা আন্দোলন

ফেব্রুয়ারি মাস- ভাষার মাস ৷ বাঙালির ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায়  আন্দোলনের মাস ৷ মাতৃভাষা বাংলাকে নিয়ে কত কবি কবিতা রচনা করে বিখ্যাত হয়েছেন ৷ প্রবন্ধ লিখে নন্দিত হয়েছেন, পুরষ্কৃত হয়েছেন ৷ `মোদের গরব ,মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা ! তোমার কোলে তোমার বলে কতই শান্তি ভালোবাসা ৷’ ‘ আমার এমন মধুর বাঙলা ভাষা, ভায়ের বোনের আদর মাখা , মায়ের বুকের ভালোবাসা ৷ ‘ বাঙলায় কথা বলতে পারা, লিখতে পারি বলেই মধুর শব্দমালা কলমের খোঁচায় ,কাগজের পাতায় আটকাতে পেরেছি ৷ এও কি কম গৌরবের ! 

বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিশ্বের ইতিহাসে ভাষার আন্দোলন শুধু এদেশেই হয়েছে ৷ আর কোনো দেশে মায়ের মুখের ভাষা নিয়ে আন্দোলন হয়নি ৷ একুশে ফেব্রুয়ারি তাই বাঙালির জীবনে এক অবিস্মরণীয় দিন, উজ্জ্বল বাতিঘর ৷’ ৫২-র ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রথম স্ফূরণ ভাষা ও মাতৃভূমির মর্যাদা রক্ষার লড়াই ৷ ১৯৪৭ শেষের দিকে  করাচিতে একটি শিক্ষা সম্মেলন হয় ৷ ওই সম্মেলনে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে  উর্দূকে গ্রহণের সুপারিশ করা হয় ৷ এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ঢাকায় বিক্ষোভ হয় ৷ 

মহান ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সৃষ্টির পানি অনেক দূর গড়ালেও ভাষা আন্দোলনে নারীর অবদান বরাবব়ই খুব বড় করে লেখা হয় না ৷ নারীর অর্জন গৌণ, পার্শ্বচরিত্রের ভূমিকায় থেকেছে সবসময় ৷ অথচ কবির ভাষায় ,” কোনোকালে একা হয়নিক জয়ী পুরুষের তরবারী , শক্তি দিয়েছে সাহস দিয়েছে বিজয়লক্ষী নারী৷” নারী সবসময় বিজয়িনীর ভূমিকায় ছিল এবং আছে যেমন তেভাগা থেকে ব্রিটিশ বিরোধী, ভাষা থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন থেকে গণজাগরণ মঞ্চ সবগুলোতেই নারীর  অংশগ্রহণ ছিল দুর্বার ৷  

মহান ২১ শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ৷ মাতৃভাষা রক্ষায় আন্দোলন শুরু হয় ‘৪৮ সালে আর শেষ হয় ‘৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি ৷ ‘৪৭ সালে ভাষা আন্দোলনের গোড়াপত্তন হয় ৷ পাক- ভারত বিভক্তির পরপরই মাতৃভাষা রক্ষার দাবিতে নারীদের জন্য সংঘবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলা সহজসাধ্য বিষয় ছিল না ৷ কারণ প্রথমত, রক্ষনশীল সমাজ , নারীকে কোনঠাসা করে রাখার অপচেষ্টা দ্বিতীয়ত, নারী শিক্ষা ৷ 

তবে ভাষা আন্দোলন শুরুর প্রেক্ষাপট নারীকে এগিয়ে যাবার সাহস যোগায় ৷ ভাষা আন্দোলনে নারীর অংশগ্রহণ, শিক্ষায় নারীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে ৷ নারীরা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনে ছাত্রদের সহযোদ্ধা হিসাবে পাশে ছিলেন ৷ পাকিস্তান পুলিশের তাক করা বন্দুক নারীদের পিছপা করতে পারেনি ৷ মিছিলে আহতদের  সেবাদান , বাড়ি বাড়ি গিয়ে আর্থিক সহায়তা সংগ্রহে নারীরাই এগিয়ে, নিজেদের অলংকার বিক্রয়ের অর্থ সহায়তা ফান্ডে জমাদান করেন নারীরা,  শ্লোগান সম্বলিত পোস্টার নারীদের হাতেই লিখিত হয় , আহত ভাইদের নিজেদের কাছে রেখে চিকিৎসাসেবা নারীরাই প্রদান করে ৷ জীবনের মায়া , ঝুঁকির তোয়াক্কা করেনি নারীরা ৷ পরিনামে জেল খেটেছে, সংসার তছনছ হয়েছে ,শিক্ষা কার্যক্রম থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন নারীরা ৷ দেশের বিভিন্ন জেলাসমূহ যেমন ঢাকা , রাজশাহী, খুলনা, সাতক্ষীরা, টাঙ্গাইল , সিলেট, চট্টগ্রাম, বগুড়া , নারায়নগঞ্জ জেলার নারীরা একত্রিত হয়ে অসীম দৃঢ়তা ও সাহস নিয়ে এই আন্দোলনে একাত্নতা ঘোষণা করেন ৷ 

আন্দোলন শুরুর দিকে ৩১ শে জানুয়ারি ১৯৪৮  ঢাকার বার লাইব্রেরিতে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় সভায় ছাত্রীদের পক্ষে ইডেন কলেজের ছাত্রী মাহবুবা খাতুন বলেন, ‘বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি স্বীকার করিয়ে নেওয়ার জন্য প্রয়োজন হলে মেয়েরা তাদের রক্ত বিসর্জন দেবে ৷’ একজন ছাত্রীর এমন সাহসী উচ্চারণ কর্মীদের মাঝে উদ্দীপনা জাগাতে বিশেষ ভূমিকা রাখে ৷ 

বাঙালি জাতির কৃষ্টি – সংস্কৃতিকে সমুন্নত রাখার জন্য ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘তমদ্দুন মজলিস’ গঠিত হয় ৷ সংগঠন প্রতিষ্ঠা প্রাপ্তির পর একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয় ৷ এটি ছিল সে সময়কার একটি সাহসী ও উদ্যমী পদক্ষেপ ৷ এই কর্মসুচী সে সময় বাংলা ভাষাভাষী ভাবধারার মানুষের মধ্যে আশার কুসুম প্রস্ফুটিত হয়েছিল ৷ 

নারীদের অনেকেই এর সদস্যভুক্ত হন ৷ তম্মধ্যে ভাষাসৈনিক প্রফেসর চেমন আরা এবং তার ছোট বোন মমতাজ ছিলেন সক্রিয় কর্মী ৷ পোস্টার, ব্যানার বানানোসহ বিভিন্ন কাজে তাঁরা বড়দের সহযোগিতা করতেন ৷ তমদ্দুন মজলিসের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে জেবুন্নিসা বেগম, দৌলতুন্নেছা বেগম , আনোয়ারা বেগম মজলিসে আসতেন এবং ভাষার দাবিতে সোচ্চার ভূমিকা রাখতেন  ৷ 

বাংলা ভাষার দাবিতে একনিষ্ঠ এবং দুঃসাহসী কর্মীবাহিনী ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ওমেন হলের ছাত্রীরা ৷তাদের মধ্যে সুফিয়া খাতুন, সামসুননাহার , রওশন আরা বাচ্চু , সারা তৈফুর, কাজী আমিনা, মাহফিল আরা , খোরশেদী খানম , হালিমা খাতুন, রানু মুখার্জী, আফসারী খানম , সানজিদা খাতুন, সৈয়দা লুৎফুন্নেসা খাতুন, জোবেদা খাতুন, বেগম জাহানারা মতিন , রাবেয়া খাতুন, মিসেস কাজী মোতাহার হোসেন , সৈয়দা শাহরে বানু চৌধুরী , দৌলতুন্নেছা বেগম সহ আরো অনেক নাম না জানা নারী ভাষা আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন ৷ সে সময় ওমেন স্টুডেন্টস ইউনিয়নের সহসভাপতি ছিলেন ডঃ শাফিয়া খাতুন ৷ ১৯৫০ – ৫১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ওমেন হল ইউনিয়নের জি এস এবং  পরে ভিপি নির্বাচিত হন ৷ তাঁদের সক্রিয় আন্দোলনে আজ আমরা আমাদের মায়ের মধুর ভাষায় কথা বলতে পারছি ৷ 

বেগম সুফিয়া কামাল ,নাদিরা চৌধুরী, নুরজাহান মুরশিদ , ডঃ শাফিয়া খাতুন মিছিলে নেতৃত্ব দেন। পুলিশি হামলার তোয়াক্কা না করে ২১ ফেব্রুয়ারির ঐ দিনে স্কুল কলেজ পড়ুয়া  মেয়েরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে আমতলায় সভায় যোগ দেয়ার জন্য পায়ে হেঁটে এসেছিলেন ৷ ছিলেন মিছিলের সম্মুখভাগে ৷ মিছিলে ব্যবহৃত পোস্টার , ব্যানার প্রস্তুতে মেয়েরাই দায়িত্ব পালন করেছিলেন সেদিন ৷ এই আন্দোলনো ভাষাসৈনিক নারীরা অংশগ্রহণ করে প্রমাণ করেছেন নারী কেবল অন্ত:পুরবাসিনী বা ঘটনার অসহায় দর্শকমাত্র নন , আত্নমর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য দ্রোহী হয়ে ওঠাও তার পক্ষে অসম্ভব কাজ নয় ৷ এই সময়ে নারীরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে জীবন বাজী রেখে মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন , পুলিশী নির্যাতন সহ্য করেছিলেন ৷ তাঁদের মধ্যে ড: হালিমা খাতুন, প্রতিভা মৎসুদ্দী, সুফিয়া আহম্মেদ, রওশন আরা বাচ্চু, রানী ভট্টাচার্য, সোফিয়া খানের ভুমিকা ছিল অন্যতম ৷ 

সে সময়কার সামাজিক প্রেক্ষাপট এত সহজ ছিল না ৷ নারী ছিল ভিন্ন গ্রহের মানুষ ৷ বহিরাঙ্গনে নারী পুরুষের একত্রে আলাপচারিতা অকল্পনীয় ৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের পশ্চাদ অনুসরণ করে শ্রেণিতে প্রবেশ এবং ক্লাস শেষে কমনরুম বন্দী অবস্থায় দিনশেষ করতে হতো ৷ সেই অবস্থান থেকে নারীরা উদ্বুদ্ধ হয়ে মেয়েদের সংগঠিত করে ছেলেদের সম্মুখভাগে মিছিলের নেতৃত্বে আসা সত্যিই  দুঃসাহসিক ! 

ভাষা আন্দোলনের ফলাফল পেতে আমাদের অনেক ত্যাগ, অনেক রক্ত ঝরাতে হয়েছে ৷ রাজপথ রক্তাক্ত হয়েছে ৷ অনেক মা – বোন হারিয়েছে রক্তের ধন ৷ ভাষা আন্দোলন নারীদের মুক্তির পথ দেখিয়েছে ৷ বাঙালি নারীদের আজকের অবস্থানে আসার পিছনে এই ভাষা আন্দোলন ৷ ভাষা সংগ্রামের ইতিহাস প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে দায়িত্ব নিয়ে জানাতে হবে আমাদের৷ নারীর অবদান ইতিহাসবেত্তাদের উন্মোচন করতে হবে ৷ তাহলে আগামি প্রজন্ম জানবে তাদের স্বজাতি বোনদের গৌরব গাঁথা ইতিহাস ৷  নারীরা  উৎসাহিত হবে, উদ্দীপ্ত হবে সংগ্রামী উদ্দীপনায় ৷ মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় যেসব অসমসাহসী নারী যোদ্ধা আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন সেসব ভাষাজয়িতাদের প্রতি জানাই আমাদের গভীর শ্রদ্ধা ৷ ২১ শে ফেব্রুয়ারি শোকের মাস, ভাষাশহীদদের চেতনায় দৃপ্ত হওয়ার মাস, সংগ্রামী সাহসে বলীয়ান হওয়ার মাস ৷ এই মাসে তাদের জানাই আমাদের গভীর শ্রদ্ধা ৷ 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *