বর্ষার মাঝামাঝি। তীব্র রোদ। ঝলসে যাচ্ছে চারদিক। দোলার জমিগুলোতে চারাগাছ তুলে কৃষক বোরোধান লাগিয়ে দেয় এখন।
সেই ধান বর্ষা আসার সময় ডুবে যেতে থাকলে আধাপাকা অবস্হায়ও কেটে ফেলে কৃষক। কখনো ধানের শীষের কাছে কেটে নেয়। পানিতে ডুবতে ডুবতে ধানগাছের যতটা পানির ওপরে থাকে সেখান থেকেই কৃষক ফ্যাসাতে থাকে ধান।
বৈশাখের শুরুতে বেশ বৃষ্টি হলেও এখন তেমন বৃষ্টি নেই। পানিতে টান পড়লে দোলার পাড়ের কেটে নেয়া ধানের নাড়ার কিছুটা অংশ জেগে উঠেছে।
পঁচার বাপ জয়নাল। এই ভরা আগুন ঝরা দুপুরে মাথাল মাথায় দিয়ে বরশি নিয়ে মাছ ধরতে বসে আছে দোলার পাড়ের রাস্তায়- যে রাস্তা চলে গেছে খাতরাপাড়া বরাবর।
দোলার এই নাড়াক্ষেতে পানি কোন জমিতে হাঁটু পরিমাণ, কোন জমিতে উড়ু পরিমাণ। নিচু জমিতে কোমড় ডোবে, কোথাও তো বুক পরিমাণ পানি।
হাঁটু পরিমাণ নাড়া ডোবা ক্ষেতে পঁচার বাপ লুঙ্গিতে মালকোচা মেরে নেমে গিয়ে বরশি ফেলার জায়গায় হাত দুই জায়গার নাড়া, শাপলা গাছ, আগাছা গোড়াসমেত উগলায়ে গোলাকার খলান বানায়। তিনটি বরশির জন্য তিনচার হাত দূরে দূরে তিনটি খলান। জয়নাল এগুলোকে বলে ফুট। ফুট বানানোর পর পাড়ে এসে ধানের কুড়া আর বাসী ভাত মিশিয়ে দলা পাকিয়ে ঢিল দিয়ে দিয়ে ফুটের মাঝখানে ফেলে। টেংরা, টাকি, মাগুর এসব মাছ ফুটের খাবারের লোভে এসে বরশির টোপটাও গিলে নেয়।
জাদুমন্ত্রের মত ভেলকি দিয়ে পঁচার বাপ টপাটপ টাকি, মাগুর বরশির ছিপ চটকা দিয়ে তুলে আনে পানির ওপরে ডাঙ্গায় আর রাস্তার কাছাড় ঘেঁষে পানিতে তলা ডোবানো খলাই ভরতে থাকে সে মাছ জমিয়ে জমিয়ে।
বরশির টোপ গিলে মাছ যখন বরশির ফাতনা ডুবিয়ে নিয়ে দিগবিদিগ ভোঁ দৌঁড় দেয় পানির ভেতর, পঁচার বাপ ছিপ ধরে কিছুটা হেলিয়ে মুহূর্তের মধ্যে চটকা মেরে মাছের গতিপথ একশো আশি ডিগ্রী বিপরীতে নিজের দিকে নিয়ে আসে।
ছিপের সু্তোর প্রান্তে বরশি গেলা হা করা গোলশা টেংরা, টাকি মাছ ঝ্যাঙ্টাতে থাকে আর কেমন সুতার পাক খুলতে ঘুরতে থাকে।
পঁচার বাপের এই এক গুণ এলাকায় সবার জানা। মাছ যেখানে নাই সেখান থেকেও সে মাছ ধরতে পটু।
আমরা ছেলেরা তারপাশে লোভে লোভে বরশি নিয়ে বসে যেতাম। আমাদেরকে তখন সে নড়াচড়া করতে নিষেধ করতো।
পাছে মাছ টের পেয়ে ভয়ে পালিয়ে যায় তাই চনচনা রোদে এমন চুপচাপ ধ্যান ধরে বসে থাকতো সে। দূর থেকে মনে হতো কাকতাড়ুয়া পানির ওপর হেলে বসে আছে যেন।
চুপচাপ রোদে বসে বা বৃষ্টির ভেতর দোলায় নদীতে পঁচার বাপ কী অদ্ভূতভাবে মাছ ধরতে কামিয়াব হতো আমরা বড়বড় চোখ করে দেখতাম।আমাদেরকে সে বলতো, আমি বরশিত্ সুপারগুলু লাগাইয়্যা দেই। হেই জুন্নে মাছ আইয়া কোনমতে ল্যাজের ছুয়াও যুদি দেয় আমার বশ্শিত্ তালি ওর বাপের ক্ষমুতাও নাই পলাইয়া যায়। আইটক্যা যাবোই।
আমাদের তখন করুণ দশা। ইশ, এরকম আমাদেরও যদি থাকতো বরশি। বুঝতে পেয়ে পঁচারবাপ বলতো, আরে, আমার বশ্শি অইলো জাদুর বশ্শি। তিরিশ টেহা দাম একেকটার। কিনবি নাহি। আচে আমার কাচে আরো কয়ডা।
তখন বরশির দাম চারআনা আটআনা বড়জোর একটাকা ছিলো। বরশি মানে লোহার কলটুকু। আমরা কল কিনে, ঘুড়ি ওড়ানো পাঁচ-সাত হাত সুতার একপ্রান্তে কল বেঁধে অন্যপ্রান্ত বাঁশের লম্বা মোটা কঞ্চির বাঁকানো মাথায় বেঁধে বরশি বানাতাম।
অত টাকা আমাদের থাকতোও না তখন। আমাদের বড় আফসোস হতো। আর লোভাতুর চোখে আমরা পঁচার বাপের মাছ শিকারের ভেলকিবাজি দেখতাম।
বর্ষায় উঁচু জমি থেকে নালা দিয়ে দোলায় পানি নামতো যেখানটাতে সেখানে পঁচার বাপ চটকা জাল ফেলতো। আমরাও ফেলতাম। কী যে জাদুমন্ত্র বলে পঁচারবাপের জালে সব দারকিনা, পু্ঁটি- খলশে মাছের ঝাঁক গিয়ে মুড়িমুড়কির মত উঠতো আমরা ভেবে পেতাম না।
একবার ওলাওঠা রোগ এলো গ্রামে। আরে বাপরে। মানুষ সব যা খায় অবিকল তাই হাগে। পথে-ঘাটে পাটক্ষেত, গমক্ষেতের আইলে মানুষ হাগতো তখন।
ওলাওঠা মানে কলেরায় সয়লাব হয়ে গেলো গ্রাম।
লোকমুখে আমরা শুনি, রাতের অন্ধকারে ওলাওঠা বুড়ি বাড়িবাড়ি নাকি ঘোরে আর রোগ ছড়িয়ে বেড়ায়। রাতে গ্রামের সব মানুষ দরজা জানালা খিল দিয়ে মটকা মেরে পড়ে থাকে।
এমন নিস্তব্ধ নিষুত রাতে দোলার পানিতে ঝপঝপ করে জাল পড়ে- ঝাঁকি জাল।
আমরা কাঁথার ভেতর থেকে কান খাড়া করে শুনি সে জাল পড়ার শব্দ।
পরের দিন পঁচারবাপ গল্প মারে আমাদের সামনে, তরা তো হইলি ডরপাদুরা সব। জানোস, আমি রাইতে মাচ মারতাচি, উপুর অইয়া জালের ফাঁস থিকা মাচ খুইলা খালোইয়ে থুইতাচি। সোজা অইয়া আচমকা দেহি আমার সামনে ওলাওঠা বুড়ি খাড়া। শুনে আমাদের ভেতর সে কী উত্তেজনা। -তারপর?
পঁচার বাপ আরো নাটকীয় বর্ণনার অবতারণা করে, -তরা মনে করতাছস ডরাইচি! না আমি ডরাইন্যা বান্দা না। বুড়িরে এমন ধমক দিয়া কইলাম, বুড়ি বাঁচপার চাস তো আমার খালই ধর। মাচ ধরতি অসুবিদা অইতাচে। নইলি এই জাল দিয়া আটকাইয়া তরে ওই পাগারের পানিত্ ডুবাইয়া থুমু। বুড়ি তো তরাশের চোটে কয়, দে দে, খালই দে ধরি। আমারে পাগারে ডুবাইশ না।
আমরা পঁচার বাপের গল্প গিলি হা করে।
কী ঘোর বৃষ্টিতে অথবা বানের পানি নেমে যাওয়া চাষের জমির অল্প অল্প পানিতে মাঝরাতে বাড়ির পেছনে আমরা দেখতাম পাটকাঠির আগুন আর কোচা নিয়ে থপথপ করে মাছের পেছনে দৌঁড়াচ্ছে পঁচার বাপ।
অল্প পানিতে সদ্য রোপা ধানক্ষেতে কাস্তে- বেকি দিয়ে কুপিয়ে রাতের আঁধারে শিং-টাকি মাছ মারতো পচার বাপ। গ্রামে একে বলতো শোলক কোপানো।
গত সপ্তাহে প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে। দোলা ভরে উঠেছে উঁচু জমির পানি নেমে। এই পানি কচুরিপানা সমেত স্রোত বয়ে নিয়ে পড়ছে গিয়ে মাদারকুড়ায়। মাদারকুড়া হলো ফুলকুমার নদীর শাখানদী। এই শাখা গিয়ে ধরকা নদী নাম নিয়ে এগিয়ে গিয়ে যুক্ত হয়েছে ধরলায়।
ঊজানের সীমান্ত এলাকা থেকে একরাতে বানের পানির স্রোতের পাকে গভীর খালের সৃষ্টি হয়েছে নদীর উত্তরদিকের পাড় ঘেঁষে। সেখানে যেতে হয় কুড়ার পানিতে নুয়ে পড়া বাঁশবনের ভেতর দিয়ে। বাঁশ বনের দু’পাশে ফার্ন গাছের চিরল চিরল পাতা। পাতার গায়ে চিনাজোঁক লকলকে জিহ্বা নিয়ে যেন বুনোঝোঁপ-ঝাড়ের পাতার ওপর দিয়ে সাঁতরে আসতে চায় কোন প্রাণী, বিশেষ করে মানুষের ভাঁজ পেলে।
আমরা পারতপক্ষে কুড়ার ওই এলাকায় যেতাম না। আমরা বড়দের কাছ থেকে কেমন করে জেনে যাই, কুড়ার গভীর পানির নিচে আছে কালা মাশান, তার জটাধরা চুল। সে সুযোগ পেলে নদীতে সাঁতরে নদীর মাঝে চলে যাওয়া ছোটদের পা টেনে কুড়ার গভীর তলদেশে নিয়ে ঘাড় মটকায়।
কুড়ার ওপাড়ে রবি ফসলের ক্ষেত। গম আর মশুর কলাইয়ের আবাদ বিস্তর। কুড়ার কাছাড়ের ওপর দীর্ঘদেহী বেলগাছ। গোড়ায় বেত আর হেলেঞ্চার ঝাড়। বেল গাছের তলায় শুনশান শ্মশান ঘাট।
শ্মশান ঘাটের কাছে কুড়া পড়ায় বাঁশবনের ওই পাড়ে মানুষের আনাগোনা তেমন সচরাচর থাকে না। ফলে মাছের অঘোষিত অভয়ারণ্য যেন কালোজলের টলটলে গভীর এ কুড়া।
সন্ধ্যা থেকেই জমাট মেঘে গুমোট ধারণ করে আছে আকাশ। একটা-দুইটা তারা এই দেখা যায়- এই ঢাকা পড়ে মেঘের আড়ালে।
রাত কিছুটা ভারী হলে ঝমঝম বৃষ্টি। এমন বৃষ্টি পড়ছে তো পড়ছেই একটানা।
মাঝরাত অব্দি বৃষ্টির তুমুল মাতম। মনে হয় দুনিয়া ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। আমরাও ঘুমিয়ে পড়ি কখন জানি না।
রাতের শেষ প্রহরে কুড়ার ওপারে কার একটানা ভয়ার্তনাদ পানিতে ভেসে এপাড়ে বসতি এলাকায় আছড়ে পড়ে মানুষের ঘরবাড়ির বেড়ায়-চালে।
-ওরে আসমত রেএএএএএএএএ, ওরে রমজাআআআআন, আমারে নিয়া যা রেএএএএএএএ…..
গ্রামের মানুষ সব জেগে ওঠে এমন বিপদাপন্ন মানুষের আর্তনাদে। সবাই আগুন ও টর্স লাইট নিয়ে ছুটে বের হয়ে কান খাড়া করে আন্দাজ করে বিপদাপন্নের অবস্থান।
হৈহৈ রবে সবে ধুপধাপ ছুটে যায় মাদার কুড়ার পাড়ে।
এপাড় থেকে আসকর আলী মুখে দুই হাত বিশেষ কায়দায় মাইকের হর্নের মত বানিয়ে ডাক ছাড়ে, ক্যারা গোওওওওও।
কুড়ার ওপাড়ে শ্মশান ঘাটের পাশ থেকে জবাব আসে, আমি গোওওওওও, আমি জয়নাল, পঁচার বাআআআআপ। আমারে নিয়া যাইন গোওওও।
বড় অসহায় আর ভয়ার্ত সে অনুনয় ভেসে আসে মাদারকুড়ার পানি ছুঁয়েছুঁয়ে।
কয়েকজন ডাকাবুকো লোক জোট বেঁধে বাঁশঝাড়ের ভেতর দিয়ে লাঠি সোটা হাতে ডানে-বামে ঝাড়-জঙ্গলে, বাঁশের গায়ে ঠংটং পিটন দিয়ে শশব্দে এগিয়ে গিয়ে শ্মশান ঘাটের চাতালে উপস্থিত হয়।
আলো ফেলে নিচে তাকিয়ে দেখে বুকসমান পোঁতা বাঁশের গোঁজ ধরে ভেসে আছে জয়নাল।
কয়েকজন যারা বেলতলায় কোন পুজো শেষে সবাই চলে গেলে নারকোল আর বেল ও অন্যান্য সামগ্রী চুরি করে খায় নানা সময়, যাদের কাছে ভুতুরে এ মাদার কুড়ার শ্মশান ঘাট নস্যি ব্যাপার, তারা রারা করে নেমে গিয়ে তুলে আনে পঁচার বাপ জয়নালকে।
দেখা যায় জয়নালের হাতের কবজিতে বাঁধা ঝাঁকি জালের রশি। আর জাল পড়েছে গিয়ে পানিতে পোঁতা বাঁশের গোঁজের ওপর।
জাল ছাড়িয়ে জয়নালকে নিয়ে সবে এপাড়ে ফিরে এলে উদ্ভ্রান্ত, সন্ত্রস্ত জয়নালের কাছে জানতে চায় এই তুমুল বৃষ্টির মাঝরাতে সে কেন মরতে গেছে বাঁশবন পেরিয়ে শ্মশান ঘাটের ওখানে।
জয়নাল ভুতে পাওয়ার মত বলে, আমি তো জাগনা জাগনা ভাব। কহন চোক্কের ওপর ঘুম নাইমা আইছে। বিষ্টি খানেক কইমা আইলে হুনি, ঘরের বাইরে বেড়ার ফাঁকে বছর আলি ডাহে, অ জয়নাল, বিস্টি নাইকা, বাইরইয়া আয় জাল নিয়া। মাদার কুড়ায় মাচ গাবাইচে। দেরি করিস না। চুপচাপ বাইরইয়া আয়।
আমি জালডা ঘাড়ে ফালাইয়া বছর আলির পাছে পাছে কিবা দৌড়াইয়া দৌড়াইয়া যাইতে থাকলাম। আমি যত কই, বছর বাই, একটু থাম, তোমার কাচাকাচি হইবার পারতাচি না। ততই বছর বাই মুনে অয় পানি আর জমিনের ওপর দিয়া ভাইসা ভাইসা যায়।
আমিও কিবা কইরা জানি হের পাচেপাচে কুড়ার ওইপারে চইলা গেলাম।
যাইয়া যেই খারাইচি কুড়ার ওপর দেহি পানির ওপর বছর ভাই। কয় জাল ফালা জাল ফালা জয়নাল। দেহস না কত বড় বড় মাচ। আমি চাইয়া দেহি, হ, কত বড়বড় মাচের মাতা, বড় বড় হা কইরা পানিত ভাইসা ফাকাত ফাকাত শব্দ করতাচে। এরপর বড় মাচের ঝাকের ওপর যেই না জাল ফালাইছি, বছর ভাই কিবা জানি বিটকইল হাসি হাসতি হাসতি মিলাইয়া গেল আইন্দারের ভিতর। হের পর চাইয়া দেহি, জালের টানে আমি চিতা ঘাটের কাছাড় থিকা নিচের দিকে ছেলচেলাইয়্যা পড়তে আছি।
পচার বাপ জয়নালের এইসব কথা গ্রামের লোকজন ঘিরে ধরে শুনতে থাকে। শুনতে শুনতে কখন পূব আকাশে লাল আভা দেখা যায়।
আর দেওয়ানীবাড়ি থেকে মোরগের কুক্কুরু কুউউউউ ডাকে সবাই সম্বিত ফিরে পায়।
ততক্ষণে ভোর হয়ে গেছে।
মারুফ হোসেন মাহবুব
কবি ও গল্পকার, রংপুর।
জন্ম: ১৯৮৪, কুড়িগ্রাম
প্রকাশিত বই: অবিরাম একটি প্রদীপ (কবিতা)