আমন্ত্রণে আসা অতিথি ও আত্মীয়গণের বিদায়-বিউগেল বাজলে মূহুর্তেই গমগমে বিয়ে বাড়িতে পিনপতন নীরবতা নেমে আসে। সদ্য বিয়ে বাড়ির ধকল কাটিয়ে উঠা ক্লেদাক্ত পরিবারটা ড্রয়িংরুমে শেষ সাক্ষাৎটা সেড়ে—যার যার রুমে গিয়ে বিশ্রামের বুকে নিজেদের সমর্পণ করতে এক প্রকার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে পড়ে। নকাশাদার ছয়তলা বাড়িটার দো তালার তিন নাম্বার রুমের বর্ণাঢ্য সাজে বরের অপেক্ষারত বিন্তি নামের কোনো এক নববধূ।
সিলভারের অর্গল টেনে রুমে ঢুকতে না ঢুকতেই কপালে পিস্তল ঠেকিয়ে নববধূর অভিনব অভ্যর্থনায় ভীষণভাবে ভড়কে যায় কবি। তুমি কি আমাকে খুন করবে? থোতলামি ভাব মিশ্রিত জগাখিচুড়ি ভাষায় নববধূকে জিজ্ঞেস করে কবি। তার হাত দুটো শাথা থেকে এক ফিট উঁচুতে ভাসানো। চোখমুখ—চিবুকে বেগানা ভয়ের ছাপ। ভাবখানা এমন—যেন কোনো এক খুনের কয়েদি—পুলিশের দাবড়ানি খেয়ে শেষমেষ ধরা পড়েছে।
একদম নড়বে না। কোনো আওয়াজ হবে না। চুপচাপ বাবুদের মতো সোফায় বসে পড়ো। কবির কপালে পিস্তল তাকরত অবস্থায় বিন্তি গাম্ভীর্য গলায় শাসায়। না নড়লে সোফায় গিয়ে বসবো কেমন করে? আবার থোতলামি ভাব মিশ্রিত জগাখিচুড়ি ভাষায় ভয় সাঁতরাতে সাঁতরাতে বলে কবি। চুপ শালা। বেশি কথা বলবে না। এখন নড়তে পারো। কান খুলে শুনে রাখো—আমি তোমাকে যখন যা বলবো—তুমি তখন তা-ই করবে। উঠতে বললে উঠবে। বসতে বললে বসবে। কথাগুলো বলেই বিন্তি আরেকবার ডান হাতে আঙুলবদ্ধ পিস্তলটা ঠিকঠাকভবে কবির কপালে তাক করতে থাকে ।
কবি আশ্চর্য হয়। মেয়ে মানুষ এমনও হতে পারে। বিয়ে করা স্বামীর সঙ্গে এমন অসাদাচারণ। এ তো পুরুষ নির্যাতন! এ কেমন যুগ এলো রে বাবা। এর চেয়ে তো শেষের কবিতার বন্যাই ভালো ছিলো। কবির বিরবিরানির গায়ে বিন্তি ধমকের চাবুক লাগিয় দেয় এক ঘা। চুপ শালা। ইঁদুরের মতো র্যাটেট-টেট না করে চুপচাপ সোফায় গিয়ে বসে থাকো। কাছে আসার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করবে না। করলেই কিন্তু মেরে দেবো। র্যাবের মতো ক্রসয়ায়ারের ভয় দেখায় বিন্তি।
এ তো দেখি সাক্ষাৎ ডাইনি। নজরুলের রাক্ষুসী গল্পের খপ্পড়ে ফেঁসে গেলাম বোধ হয়। মনে মনে ভাবে আর এক পা—দুপা করে ইদুরের মতো সোজা সোফায় গিয়ে বসে পড়ে। বিন্তি ঘড়ির দিকে তাকায়। সুইডিস থেকে কবির মামার পাঠানো ঘড়িটার ইমাজিনেশন ঘণ্টার কাটা রাত বারোটা ছোঁয় ছোঁয়। রাত বারোটা মানে মধ্যরাত। বান্ধবীরা বলতো—বিয়ের রাত যত বাড়তে থাকে প্রেম তত গভীর হতে থাকে। তবে বিন্তির বেলায় আজ তা উল্টো প্রবাদে পরিণত হয়েছে। রাত যত বাড়ছে ভয় তত গভীর হচ্ছে বিন্তির অনিদ্রিত মনোবনে।
পিস্তলটা এখনো কবির কপাল বরাবর তাক করে ধরে বসে আছে বিন্তি কোনো এক পূর্বাপক্ষায়। কবি তা আঁচ করতে পারে কবি মানুষ বলেই। বিন্তির চোখের দিকে তাকিয়ে সে বলে দিতে পারে—এই মেয়েটা হত্যাবিজ্ঞান জানে না। হয়তো কোনো এক কারণে সে এসব করছে—কবির অনুমানের জগতে ভাসতে ভাসতে ভাবে। কিছুক্ষণ পর বিন্তির ফোনে কল আসে। সে ডান হাত বদলে বাঁম হাতে পিস্তলটা আঙুলব্ধ করে কবির কপাল বরাবর তাক করে কলটা রিসিভ করে। হ্যালো বাচক সম্ভাষণ জানিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বেলকোনিতে আসে।
নীলনদের মতো একটা আসমান ঝুলছে অন্ধকারের মাথার উপর। দূরে সিলভারের চাঁদটা একাকীত্বের গাউন মুড়িয়ে বসে আছে আসমানের শিনায়। বেলকোনির রেলিঙ ছুঁয়ে বয়ে যাওয়া হুঁ-হুঁ হাওয়াটা—জানান দিয়ে গেলো কী যেন ঠিক নেই! সব ঠিক আছে? অপোজিট থেকে কলার ব্যাকুলতার সঙ্গে জানতে চায় বিন্তির কাছে। বিন্তি গলার লিলাবল বি স্কেলে নামিয়ে বলে—সব ঠিক আছে। কোনো প্রোবলেম নেই। তোমার সঙ্গে কাল দেখা হবে। উত্তরা এয়ারপোর্টে। আমরা আর ঢাকায় থাকবো না। সোজা অস্ট্রেলিয়া চলে যাবো। পাপন সব ব্যবস্থা করে রেখেছে। রাখি। বলেই কলটা ঘ্যাচাং করে কেটে ফোনটা বিছানায় ছুড়ে আবার কবির কপালে পিস্তল ঠিকঠাকমতো তাক করে ধরে।
আমি কি একবারের জন্য আমার হাত দুটো নামাতে পারি? ভীষণ ব্যথা করছে। ব্যথা ভালো হলে আবার উপরে ভাসিয়ে রাখবো। কবির ছেলেমানুষী কথা শুনে বিন্তির নির্মম মনটা মূহুর্তেই নরোম হয়ে যায়। মুচকি হেসেও ফেলে। আপনার হাসিটা প্রজাপতির মতো সুন্দর। আরেকবার হাসুন না। ড্যাস চিহ্নের মতো মাঝখানে বলে উঠে কবি। তেলবাজি চলছে। হু তেলবাজি। বাবু এসব তেলে আমি সমুচা-সিঙ্গাড়া—পিঁয়াজি কিছুই হবো না। বুঝলে বাবু। কবি আরেকবার তার ভাসানো হাত নামানোর অনুমতি প্রার্থনা করে কেবল জন্য একবারের জন্য। বিন্তি অনুমতি দেয়। অনুমতি দেবার আগে কবিকে একটু ঝাড়ফুঁক দিয়ে নেয়। তোমাকে কে কাকপাখির মতো হাত ভাসিয়ে রাখতে বলেছে। নামাও। নামাও শালা। এতক্ষণে হাত নিচে নামাতে পেরে একটু আরামবোধ করে কবি। লেফট-রাইট—আপ-ডাউন করতে থাকে।
এর মধ্যে বদ্ধ দরজাটা কোনো এক আঙুলাঘাতে ঠকঠক করে চেঁচিয়ে ওঠে। কবি, কোনো প্রয়োজন হলে বলবি। তোর দুলাভাই ও আমি পাশের রুমেই আছি। টেনশন নিস না। বিন্তি ভড়কে যায়। ডান হাতের আঙুলবদ্ধতায় তাক করে ধরে রাখা পিস্তলটাকে আড়াল করবার নিরাপদ আবডাল খুঁজতে শশব্যাস্ত হয়ে পড়ে। হতদম্যতায় খুঁজে না পেয়ে বেডশিটের নিচে কোনোমতো গুঁজে রাখে। তারপর লক্ষ্মি মেয়ের মতো ঘোঙটা টেনে বধূ সেজে বেডের উপর বসে পড়ে। কবি বিন্তির সমস্যাটা বুঝতে পেরে সমাধানে এগিয়ে আসে।
আপু, তুই কোনো চিন্তা করিস না। প্রয়োজন পড়লে আমি তোদের ডেকে নেবো। বিরক্ত করিস না। যা তো এখন—যা। বিয়ের রাতটাও ঠিকমতো…। কোনো প্রোবলেম নেই শুনে আপু ঘুমুতে চলে যায়। কবির অভিনয়লিপি শেষ না হতেই বিন্তি ঘোঙটা সড়িয়ে বেড থেকে লাফ দিয়ে বেডশিটে লুকানো পিস্তলটা বের করেই আবার কবির কপালের দিকে তাক করে সোফায় ধপ করে বসে পড়ে। তারপর এদিক ওদিক তাকায়। বেশ পরিপাটি তোমার ঘরটা। আমার পছন্দ হয়েছে। বিয়ের পর এরকমই একটি বেডরুম আমি চেয়েছিলাম। কিন্তু সেখানে তোমাকে হাজবেন্ড হিসেবে কখনোই কাঙ্ক্ষা করিনি। কষ্মিনকালেও করবো না। কারণ…। কারণটা আমি বলি। বিন্তির মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে কবি বলতে শুরু করে। কারণটা হলো—আপনি কাউকে ভালোবাসেন। তবে কারো কথা রাখতে গিয়ে আপনি গাধা মার্কা এই কবিকে—আই মিন আমাকে বিয়ে করেছেন। রাইট? প্রশ্নটা যেন চ্যালেঞ্জের মতো ছুড়ে দেয় বিন্তির উপর কবি।
বিন্তির নিউরোনের ব্যাটারি এমনিতেই ডাউন। তার উপর এমন জ্যোতিষী মার্কা কথাবার্তা শুনে বাকিটাও ডাউন হয়ে যাচ্ছে। মাথা কোনো কাজ করছে না তার। এই শালা তো দেখি অলরাউন্ডার। কখনো অভিনয় করছে। কখনো আমার গোপন চিন্তাদের নাগাল ধরে ফেলছে। শেষে না আমাকেই জাপটে ধরে। পুরুষ মানুষ বলে কথা। এদের জাতপাত নেই—মা-বোন নেই। আবার পিস্তলটা কবির কপালের দিকে তাক করে বলে, খবরদার। নড়বে না। সোফায় বসে থাকো। না হলে মেরে দেবো বলে দিলাম। অভিনয় তো ভালোই শিখেছো। থিয়েটার মিয়েটার করো বুঝি।
পিস্তলটা কপালের খুব কাছাকাছি দেখে ভীষণভাবে ভড়কে যায় কবি। হাফপ্যান্টবেলা থেকেই কবি পিস্তলকে ভয় পায়। কোনো এক মধ্যরাতে—তার চোখের সামনেই এরকম এক পিস্তল দিয়ে আঁততায়ীরা তার বন্ধু ফারহানকে গুলি করেছিলো। ফারহানকে বাঁচাতে না পারার আক্ষেপঅনল এখনও তাকে দগ্ধ করে। সেই থেকে পিস্তল দেখলেই কবির ফারহানের কথা মনে পড়ে। সেই থেকে পিস্তল দেখলেই বুকের ভেতর বিশ্রী ভূ-কম্পন বয়ে যায় তার। না…বলেই চিৎকার করে উঠে সে!
চিৎকার শুনে তার বড় আপা ও দুলাভাই পাশের রুম থেকে ছুটে আসে সাহায্যের তলোয়ার নিয়ে। বিন্তি পিস্তল ফেলে কবির চিৎকারের মুখ টিপে ধরে। চুপ শালা। চিল্লাবে তো মেরেই দেবো সত্যি সত্যি। খোদার কসম করে বলছি। কবিরের দম বন্ধ হয়ে আসে। ছাড়ুন—ছাড়ুন বলতে বলতে নিজেই এক পর্যায়ে বিন্তির জল্লাদের মতো হাতজোড় ঝটকে সড়িয়ে দেয়।
কবি—কবি—ভাই আমার, কী হয়েছে? দরজা খোল। কবি বিন্তির বিত্রস্ত মুখের দিকে তাকায়। বিন্তি ইশারাতে বোঝায় যে, দরজা খোলা যাবে না। কবি আবার রঙ্গমঞ্চে উঠে দাঁড়ায়। অভিনয়ের দক্ষতা জাহির করতে থাকে। না আপু। কিছু হয়নি। ওই ককরোজের বাচ্চা আর-কী। তাই দেখে ভড়কে গিয়েছিলাম। তোমরা ঘুমুতে যাও। কবির কথায় সে যে নিরাপদ আছে—তা আশ্বস্ত হয়ে তার আপা ও দুলাভাই ঘুমুতে যায়।
তখন রাত দুইটা। বিন্তি আরেকবার ঘড়ির দিকে তাকায়। তার অনিদ্রিত চোখে কেবল একটি অরুণোদয়ের অপেক্ষা। প্রত্যুষ হলে বিন্তি কোথায় যাবে? কবির জানতে ইচ্ছে করে। বিন্তি এবার ঘড়ি থেকে মুখ ফিরিয়ে কবির দিকে তাকায়। ওয়ান্ডারফুল! অভিনয় করলে নির্ঘাত তুমি তো মোশারফ করিমকেও ছাড়িয়ে যাবে। এই আমি হান্ড্রেড পারসেন গ্যারান্টি দিয়ে দিলাম। বিন্তির মুখের ঝিলিকের দিকে তাকালে কবির সব ভয়—রাগ নেমে তড়তড় করে নেমে যাচ্ছে। বিন্তি কেমন যেন একটা মায়াবতী চেহারায় দাঁড়িয়ে আছে কবির সামনে। তার ইচ্ছে করছে বিন্তিকে একটু ছুঁইয়ে দিই। কিন্তু সে তো কোনো এক পিস্তল আর বেগানা রহস্যের অন্তর্জালে অন্তরীণ।
দেখুন, বিশ্বনাট্যকর উইলিয়াম শেক্সপিয়র বলেছেন—
‘পৃথিবী একটা রঙ্গমঞ্চ, আমরা সকলে সেখানে অভিনেতা’।
আমি অভিনয় করছি আপনাকে বাঁচানোর জন্য। আপনি অভিনয় করছেন আপনাকে বাঁচানোর জন্য।
কবির কথা যতই শুনছে বিন্তি ততই মন্তমগ্ধ হয়ে যাচ্ছে। আপনি ঠিক বলেছেন কবির। শেষমেষ কবিকে সম্মানজনক সম্বোধন করে বিন্তি। কবির শুনতে চায় তার অব্যক্ত আখ্যান। ছিঁড়তে চায় সমূহ রহস্যের অন্তর্জাল। বিন্তি প্রথমে বলতে চায় না। আপত্তি তোলে। কবি আশ্বস্ত করে। ভয় নেই। কাউকে বলবো না। কোনো কাকপাখিও জানবে না। এমন কী এই চার দেয়ালের কানেও তালি লাগিয়ে দেবো। আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন। বিন্তি বিব্রতবোধ করে। আপনাকে? কবির শেষবারের মতো তাকে আশ্বস্ত করে জানায়—রবীন্দ্রনাথ বলেছেন—
মানুষকে অবিশ্বাস করা পাপ
শেষমেষ বিন্তি তার রহস্যের অন্তর্জাল ছিঁড়তে থাকে। কুন্ডলী পাঁকানো ধোঁয়াশার ধুলো থেকে বেড়িয়ে আবছা আলোয় আসে আস্তে আস্তে। যেভাবে চারাগাছ মৃত্তিকার অন্ধাকার ভেদ করে বেড়িয়ে আসে আবিরের চকমকে।
আমি একজনকে ভালোবাসি। আমাদের কড়ি মাসের সম্পর্ক। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, একই ছাদের তলে আমাদের বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবো। হঠাৎ করে বাবা স্ট্রোক করেন। আমাকে না জানিয়েই আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক করেন। ডাক্তার তাকে উত্তেজিত করতে নিষেধ করেছেন। এতে যেকোনো সময় খারাপ কিছু হতে পারে। বিধায় আমাদের পরিবারের কথা চিন্তা করে বাবা-মায়ের মুখের উপর না করতে পারিনি। কাল আমরা অস্ট্রেলিয়ায় পালিয়ে যাবো। পাসপোর্ট-ভিসা সব ব্যবস্থা করা আছে। কেবল এই বাড়ির প্রকাণ্ড প্রাচীরটা টপকাতে পারলেই আমাদের সেই অস্ট্রেলিয়া।
কবিরের অনুমানগুলোয় সত্যি হলো। সত্যি হলো না কেবল বন্ধুদের মুখ ফসকানো অনুমানগুলো। একটা দীর্ঘশ্বাস চড়ুই পাখির মতো ফুরুৎ করে বের হয়ে রাতের গুঁমোট মেশানো হাওয়ার সাথে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। আমি এই বাড়ির প্রাচীর টপকানোর জন্য আপনার মই হবো। অনুগ্রহ করে মিছেমিছি আর টেনশন নিবেন না। টেনশন নিতে নিতে এমনিতেই আপনার চাঁদমুখটা শনির ছায়ায় ছেয়ে গেছে। কফি খাবেন?
আস্তে আস্তে কবিকে বিশ্বাস করতে শুরু করে বিন্তি। পিস্তলটা ছুড়ে দেয় ফ্লোরে। ফ্লোর পিছলে বিশাল রুমটার কোনো এক ফাঁক-ফোঁকড়ে পিস্তলটা লা-পাত্তা হয়ে যায় অনিমেষ। কবিরের হাতজোড় ধরে বিন্তি পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে ছোট এক প্রশ্ন ছুড়ে বসে। পারবেন তো? বিন্তির নরোম হাতের ছোঁয়ায় কবিরের ভেতর ইলেক্ট্রিক শকের মতো কোনো এক বেগানা কম্পন বয়ে যায়। তারপর বিন্তির মায়াবতী মুখের দিকে তাকিয়ে অসহায়ের বেড়ি পড়া রাজহাঁসের মতো বলে, পারবো। কবি কেমন যেন চুপসে যায় কথা দিয়ে। বিন্তি কবির নৈঃশব্দ্যতা ভাঙানোর চেষ্টা করে। কই, আপনি নাকি কফি খাওয়াবেন।
কোনো এক অচেনা ঘোরের বলয় ভেঙে বিন্তি মাধ্যাকর্ষণ বলের ক্ষমতায় বস্তুগত জগতে ধরা দেয় কবি। ও হ্যাঁ। দেখুন না। কথা বলতে বলতে ভুলেই গেছি। এই হলো কবিদের প্রোবলেম। কবি ডান হাতের আঙুলাবলির ছোঁয়া মাথায় ছড়াতে ছড়াতে বিন্তির কাছে ব্যক্ত করে। আপনি কবিতা লিখেন নাকি? বিন্তি এরকম একটা প্রশ্ন ছুড়ে বসবে কবি আগেই আঁচ করতে পেরেছে। তবে এই প্রশ্ন অনেকেই করে কবিকে। কবিরও প্রশ্নটা শুনতে মোটামুটি খারাপ লাগে না।
হ্যাঁ লিখি। তবে একটু আধটু। কোনো এক মুগ্ধতা থেকে কবিতা লেখার শুরু। কী সেই মুগ্ধতা? বিন্তির প্রশ্নের সংখ্যা বাড়তে থাকে। কবি আপ্লুত হয়ে বিন্তির প্রশ্নাবলির উত্তর দিতে থাকে। আমার সেই মুগ্ধতার নাম রবীন্দ্রনাথ। তিনি আমার প্রেম। তিনি আমার পথ। তিনি আমার সৃষ্টির উৎস। বিন্তিও মুগ্ধ হয়ে কবির উত্তরগুলো শুনে। কবি কিচেনে গিয়ে নিজ হাতে দু কাপ কফি বানিয়ে আবারও ঝিমিয়ে পড়া আড্ডাকে জমিয়ে তোলার রসদ জোগায়। আপনি তো দারুণ কফি বানাতে পারেন। কাপে গোলাপি ঠোঁটের দু এক চুমুক লাগিয়েই কবির কফির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠে বিন্তি।
আইনস্টাইনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের একবার এক অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছিলো। ওই অনুষ্ঠানে সাংবাদিকরা আইনস্টাইন ও রবীন্দ্রনাথকে সাংঘাতিক দুটো প্রশ্ন করেছিলেন। কোন দুটি প্রশ্ন? বিন্তি কফির ধোঁয়ায় উড়তে উড়তে জানতে চায়। আইনস্টাইনকে বলেছিলেন—‘আপনি বিজ্ঞানী না হলে কী হতেন আর রবীন্দ্রনাথকে বলেছিলেন—আপনি কবি না হলে কী হতেন?’ উত্তরে তারা কী বলেছিলেন? বিন্তি ধোঁয়াটে উড়াল থেকেই জানতে চায়। আইনস্টাইন বলেছিলেন—আমি বিজ্ঞানী না হলে কবি হতাম। আর রবীন্দ্রনাথ বলেছিলো—আমি কবি না হলে বিজ্ঞানী হতাম। উত্তর শুনে সাংবাদিকরা স্ট্যাচু হয়ে যায়। যেমন প্রশ্ন তেমন উত্তর। কবি মিহি হাসির রঙ ছড়িয়ে বলতে বলতে থেমে যায়। কবির মিহি হাসির রঙের ছটা গিয়ে বিন্তির ঠোঁটেও ঠেস লেগে থাকা হাসিগুলো মর্মরি তুলে ঝরতে শুরু করে। কবি বিন্তির এই হাসির প্রপাতে প্রোথিত হতে ইচ্ছে করে। তবে অস্ট্রেলিয়া নামক কোনো এক অযাচিত স্বপ্ন দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে আছে কবির জীবনে।
বাকি রাতটা আমরা এভাবেই কফি আর গল্পে কাটিয়ে দেবার প্রস্তাব পেশ করে বিন্তি বিধ্বস্ত কবির কাছে। কবি আপত্তি করে না। পরের গল্পে পা বাড়ায়। একবার মহাত্মা গান্ধী আর রবীন্দ্রনাথ একসাথে বসে নাস্তা করছিলেন। মহাত্মা গান্ধী মজা করে বললেন,
‘এত লুচি খেয়ো না। ঘিয়ে ভেজাল আছে। তখন রবীন্দ্রনাথও মজাটাকে আরও মজাদার করে বললেন, গান্ধীজি—বিশ বছর এই ধরে এই ভেজাল খাচ্ছি কিন্তু মরছি না তো। মনে হয় ভেজালেও ভেজাল আছে।’
কথা শেষ না হতেই দুজনে এক সাথে মিহি গলায় হেসে ওঠলো। রাতের নৈঃশব্দ্যে হাসিগুলো চারদেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে একটা দ্বিরুক্তি দ্বিরুক্তি ভাব জেগে তুললো। এভাবে একটার পর একটা গল্পফুল ফুটতে থাকলো অজস্র কফির ধোঁয়ায়।
দিগন্তের খোসা ভেঙে কোনো এক দিবসের কুসুম ফেটে পড়ছে চৌহদ্দিতে। কবি ও বিন্তি গল্পঘরে তালা লাগিয়ে নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
কপালে লাল টিপ পড়নে ঢাকাই শাড়িতে খুব সুন্দর লাগছে আপনাকে। রবীন্দ্রনাথ দিয়েই শুরু হলো দিনটা। আশা করি ভালোই যাবে। কবির মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বিন্তি মিহি গলায় হেসে ওঠে। আরে, আপনি রবীন্দ্রনাথ পড়েন! কবি এমনভাবে কথাগুলো বললো যেন সপ্তম আশ্চর্যের চূড়া ভেঙে তার মাথায় পড়ছে। হ্যাঁ। একটু আধটু। আজ তো পঁচিশে বৈশাখ। সুখি মানুষের মতো প্রতিত্তরগুলো দিতে থাকে বিন্তি।
ইমাজিন। আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না। যে কিনা সারাক্ষণ অস্ট্রেলিয়ার স্বপ্নে বিভোর থাকে—সে কিনা বাংলা তারিখটাও জানে। মাইরি! আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না। আবেগে আপ্লুত হয়ে আনন্দবোধ প্রকাশ করে কবি। দেখুন কবি সাহেব—
মানুষকে অবিশ্বাস করা পাপ
মধ্যরাতের আড্ডা থেকে বেছে নেয়া রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত উক্তিটির ফিরতি শুনিয়ে দেয় বিন্তি। দুজন দুজনের দিকে নিবদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাসির ঝিলিক ছড়ায়। সেই ঝিলিকের রঙ থেকে উড়ে যায় কতোশতো প্রজাপতির অমিয় ডানা।
সকালের নাস্তাটা সেড়ে বাবামাকে বানোয়াট প্রয়োজনীয়তার অজুহাতে কবি বিন্তিকে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়। কেউ জানে না বিন্তি তার বধূ না। তাদের বিয়ে হয়েছে কেবল কোনো এক প্রাণ বাঁচানোর প্রয়োজনে। আর এখন তারা বের হয়েছে অস্ট্রেলিয়া নামক কোনো এক অযাচিত স্বপ্ন পূরণের অভিযাত্রায়।
কিছুই ভালো লাগছে না কবির। এরকম একটা দিনে এরকম একটা সিচুয়েশন তৈরি হবে ঘূর্ণাক্ষরে ভাবেনি। মুখে চুইংগামের মতো একটা রেডিমেড হাসি ধরে আছে গতরাত থেকে। এ কথা কেউ জানে না। কবির বাবা-মা—আপা-দুলাভাই—কেউ না। এমন কী বিন্তিও না।
আপনার ফ্লাইট কখন? কবি হাসিমুখে জানতে চায় বিন্তির কাছে। বিকেল পাঁচটায়। বিন্তি ওড়নায় গোপন বিভাকে আড়াল করতে করতে কবিকে জানায়। কবির চোখের ঝিলিক সেখানে পৌঁছানোর আগেই লজ্জায় মুখটা ঘুরিয়ে নেয় সে। এখন কোথায় যাবেন? বলেই একটা খালি রিক্সা ডাক দেয় কবি। বোডানিক্যাল গার্ডেনে। ও একটা কাজ সেরেই ওখানে আসবে। বিন্তি শাড়ির ভাঁজ ঠিক করতে করতে উত্তর দেয়।
কই যাবেন স্যার? খালি রিক্সাটা নিয়ে চালক কবির কাছে জানতে চায়। বোডানিক্যাল গার্ডেন। ভাড়া তয় স্যার একশো টাহা লাইগবো। বিন্তি প্রতিবাদের সুর তুলে বসে হুট করে। মামা—এক শ কেনো। যেটা ভাড়া সেটা দেবো। আমরা তো আর প্রেমটেম করতে যাচ্ছি না। গতকাল আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে। আমরা হাজবেন্ড-ওয়্যাইফ। প্রেমিক-প্রেমিকা না। বুঝলেন?
চালক বিন্তির কথা শুনে খালি মোশারফ করিম মার্কা একটা হাসি দিয়ে বলে, তয় হইবো না। একশো কইচি। একশোই দিতে অইবো। উডবেন নইলে যামু গা?
উপান্তর না পেয়ে কবি ও বিন্তি রিক্সায় উঠে পড়ে। রবীন্দ্রনাথ এই জন্য বলেছেন—
বাঙালি করে রেখেছো, মানুষ করোনি
খুব আক্ষেপের সুরে কথাটি বলতে বলতেই মিরপুর এক ক্রস করে ফেলে তাদের রিক্সাটা। ঢাকা শহরে বাস বা প্রাইভেট কারের চেয়ে রিক্সায় ঘুরতে সব থেকে বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করে কবি। আমারও। বলছিলো বিন্তি। বিন্তির সুদীর্ঘ চুল বেনিহীন বেড়িহীন বাতাসে উড়তে উড়তে কবির গালমুখ ছুঁয়ে যাচ্ছে। কবির এই মূহুর্তে অনেক কিছু করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু ইচ্ছের পায়ে সে বেড়ি পড়িয়ে রাখে। সংযত করে রাখে নিজের পুরুষত্বকে। এখানেই তো পুরুষদের অগ্নি পরীক্ষা।
বোডানিক্যাল গার্ডেনে বিন্তি তার অস্ট্রেলিয়ার জন্য অপেক্ষার আঙুলে ঝুলে থাকে। আর তার পাশে বটবৃক্ষের ছায়ার মতো সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছে কবি। প্রেম করেছেন? বিন্তি কবিকে প্রশ্ন ছুড়ে বসে আনমনে। করিনি—তবে করছি। অপ্রস্তুতভাবে উত্তরট দেয় কবি। মেয়ে দেখতে কেমন? বিন্তি সময় কাটানোর প্রয়োজনে প্রশ্নের সংখ্যা বাড়াতে থাকে। কবি নিঃসঙ্কোচে উত্তর দিয়ে যায়। হুম, আপনার মতো। নাম কী? বিন্তি প্রশ্ন করতেই থাকে। অধরা। কবিও উত্তর দিয়েই চলে।
বাহ! চমৎকার নাম তো। নামটাতে আর্ট আছে। বিন্তি প্রশ্নের সাথে দার্শনিকতাও ছড়িয়ে যায়। গান শুনবেন? কবি গানের অফার করে বিন্তির একগুঁয়েমি কাটানোর জন্য। কার গান? একটা মিষ্টি হাসির ঝিলিক ছড়িয়ে জানতে চায় বিন্তি। রবীন্দ্রসঙ্গীত। বলতে গিয়েই অনিচ্ছাকৃতভাবে বিন্তির ডান হাতের উপর কবির বাঁম হাত ছুঁয়ে যায়। দুজনেই কেমন যেন একটা অচেনা লজ্জার কোড়কে মুড়িয়ে যায়। দু এক মিনিট কেউ কারো সঙ্গে কথা বলে না।
আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রাণে।
এ জীবন পূর্ণ কর দহন-দানে।।
দু লাইন গলা ফসকাতে না ফসকাতেই দাড়ি বসিয়ে চুপসে যায় কবি। পাশ ঘুরে কবির মলিন মুখের দিকে তাকায়। আরে থামলেন কেনো। বেশ তো লাগছিলো। আপনি কবিতা লিখেন শুনেছি। কিন্তু এত ভালো গানও গাইতে পারেন তা তো গতরাতে বলেননি। বিন্তির কাছে নিজের প্রশংসাধ্বনি হাওয়ায় উড়িয়ে দেয় কবি। পাত্তা দেয় না ওসবে। এ আর এমন কী। ভালো লাগা থেকে একটু আধটু গাই। এই আর কী। রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইলে নিজের ভেতর যেন হারানো আমিকে ফিরে পাই। দেখতে না পাওয়া নৈর্ব্যক্তিক জগতটাকে দেখতে পাই। বেদনায় বিশুদ্ধ বীজ হয়ে ওঠি।
আপনি ঠিক বলেছেন কবি সাহেব। আজেবাজে গান না শুনে আমাদের বেশি করে রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনা উচিত। কারণ তার গানে আছে বিশুদ্ধতার বীজ। পরমের অনুসন্ধান। প্রাণের স্ফূরণ। বসে থাকা অনেক হয়েছে। এবার চলুন হাঁটা যাক। গার্ডেনটা ঘুরে ঘুরে দেখি। এই কর্পোরেট শহরে গার্ডেনগুলোয় হলো এক পশলা সবুজের ঝোপঝাড়। কবি আপত্তি করে না। চলুন তাহলে।
ম্যাডামকে একটা মালা কিনে দিন স্যার। হাঁটার পথে কোনো এক বাচ্চা মেয়ে এসে কবির কাছে আবদার করে বলে। এই শেষ বেলায় বিন্তিকে কিছু একটা দেবার সুযোগের দরজায় দাঁড়িয়ে কবি। সে একবার মালার দিকে তাকাই আরেকবার বিন্তির মায়াবতী মুখের দিকে তাকায়। বিন্তিও যেন এই শেষ বেলায় এসে কবির কাছে কিছু পেতে চাইছে। ম্যাডামকে একটা মালা কিনে দিন স্যার। বাচ্চা মেয়েটা এবার যেন কবির কাছে আবদারটা জোড়ালোভাবে করে বসে। কবি তাকে নিরাশ করে না। মানিব্যাগ থেকে একটা এক শ টাকার নোটের বিনিময়ে বাচ্চা মেয়েটার হাত থেকে জুঁই ফুলের মালাটা কিনে বিন্তির হাতে তুলে দিতে দিতে বলে—অনুগ্রহ করে ফিরিয়ে দিবেন না। অন্তত আমার একটা চিহ্ন আপনার সঙ্গে অস্ট্রেলিযা অব্দি যাক।
বিন্তি না করে না। হাসিমুখে পরম মায়ায় গলায় জড়িয়ে নেয় কবির একমাত্র স্মারক চিহ্ন জুঁই ফুলের মালাটা। তারা আবার হাঁটতে শুরু করে ছোট ছোট পথের বুকে ধীর ধীর পা ফেলে। মালাটা আপনার গলায় খুব সুন্দর লাগছে। কবির প্রশংসা বাক্য শুনে বিন্তি মুচকি হাসির রঙ ছড়ায়। এই মালা দেখে রবীন্দ্রনাথের কয়েকটা লাইন মনে পড়ে গেলো। হাঁটতে হাঁটতেই কবি ব্যক্ত করে। শোনানো যাবে? বিন্তি শুনতে চায়। হোয়াই নট? কবি আনন্দবোধ প্রকাশ করে শোনানোর জন্য। তারপর বিন্তির মায়াবতী মুখের দিকে তাকিয়ে আবৃত্তি করে—
তারি মাঝখানে শুধু একটুকু জুঁই,
একটুকু হাসিমাখা সৌরভের লেশ,
একটু অধর তার ছুঁই কি না—ছুঁই।’
আমাদের মনে হয় আর দেখা হবে না। আবৃত্তির রেশ কাটতে না কাটতেই বিন্তি কবিকে এরকম এক বাক্যে আরো নিরাশার অতলে ডুবিয়ে দেয়। অনেকক্ষণ তো হাঁটলাম। খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। চলুন কোথাও লাঞ্চটা সেড়ে নেই। এসব পাশ কাটানোর জন্য বিন্তিকে লাঞ্চের অফার করে কবি। ওর মনে হয় আসতে আরও লেট হবে। কবির অফারে সাড়া দিয়ে বলে বিন্তি। চলুন। কবি এক বাক্যেই রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করে।
লাঞ্চ শেষ না হতেই বিন্তির সেই অস্ট্রেলিয়া এসে হাজির হয়। কবির সঙ্গে বিন্তি অস্ট্রেলিয়াকে পরিচয় করিয়ে দেয়। সাদাফ, ইনিই হলেন মিস্টার কবি। কবি করমর্দনে বিন্তির অস্ট্রেলিয়াকে মানে সাদাফকে অভ্যর্থনা জানায়। কবি সাদাফকে বসতে বললে সাদাফ ঘড়ির দিকে ইশারা ছুড়ে খুব তাড়া দেখায়। বিন্তির হাত ধরে চেয়ার থেকে টেনে কবিকে বায় বলে রেস্টুরেন্ট থেকে বেড়িয়ে গাড়িতে ওঠে। বিন্তি বারবার কবিকে ঘাড় ফিরে দেখছিলো। কবিও অশ্রুত এক নিবদ্ধ দৃষ্টিতে বিন্তির প্রস্থানে তাকিয়ে আছে। আর শূন্য বুকের ভেতর হুঁ-হুঁ বেহালায় বেজে উঠছে শেষের কবিতার রাগিণী—
কোনদিন কর্মহীন পূর্ণ অবকাশে
বসন্তবাতাসে
অতীতের তীর হতে যে রাত্রে বহিবে দীর্ঘশ্বাস,
ঝরা বকুলের কান্না ব্যথিবে আকাশ,
সেইক্ষণে খুঁজে দেখো, কিছু মোর পিছে রহিল সে
তোমার প্রাণের প্রাণে, বিস্মৃতি প্রাদোষে
হয়তো দিবে সে জ্যোতি,
হয়তো ধরিবে কভু নামহারা স্বপ্নে মুরতি।
তবু সে তো স্বপ্ন নয়,
সব চেয়ে সত্য মোর সেই মৃত্যুঞ্জয়—
সে আমার প্রেম।
তারে আমি রাখিয়া এলেম
অপরিবর্তন অর্ঘ্য তোমার উদ্দেশ্যে।
পরিবর্তনের স্রোতে আমি যাই ভেসে
কালের যাত্রায়।
হে বন্ধু বিদায়।
বিন্তির প্রস্থান সঙ্গীতে কবির পৃথিবীটা যেন রানাপ্লাজার মতো ধ্বসে পড়ছে। প্রাণোচ্ছল পরিবেশটা যেন মূহুর্তেই কুয়াশাকহুকে ভরে গেলো। কবি কেবল জিরাফের মতো সেসবের নিঃসঙ্গ দর্শক। কালো রঙের গাড়িটা যেন শোকবাহী কোনো এক কফিন। গাড়িতে বসে বিন্তির মনের স্ক্রিনে বারবার কবির মসৃণ মুখের ছবিটাই ভেসে ওঠছে। তার সঙ্গে কাটানো ছোট ছোট স্মৃতিগুলো তাকে তাড়া করছে অন্ধ তিরের মতো। গলায় জড়িয়ে যাওয়া জুঁই ফুলের মালাটাকে মনে হচ্ছে—কবি। কবি যেন তার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে জড়িয়ে আছে।
এয়ারপোর্টের কোলাহলে পা রাখে বিন্তির শোকবাহী কালো রঙের গাড়ি নামক কফিন। একটার পর একটা ফ্লাইটগুলো বাজপাখির মতো উড়ে যাচ্ছে অনিমেষ—এইসব চেনাজানার দিগন্ত ছেড়ে সুদূরব্যাপী।
কবির ফুরিয়ে যাওয়া হাসির মতো দিনের আলো নিভে যাচ্ছে। বিপুল বিকেলের রেলিঙ বেয়ে বেয়ে একটা অযাচিত সন্ধ্যা উপচে পড়ছে শহরের কদর্য কোলাহলে। তার ভেতর কান্না ও করুণার বুদবুদে হারানো কোনো এক নিঃসঙ্গ কবি হেঁটে যাচ্ছে এক পা দু পা করে। রবীন্দ্রনাথ কি আমার মতো কখনো কেঁদেছিলো প্রেম হারিয়ে? হয়তোবা।
মিরপুর দশ। রোড নাম্বার ছয়। গলি নাম্বার তিন। এই খালি—যাবে? ভীষণ রকম মন খারাপ নিয়ে একটা রিক্সাকে ডাক দেয় কবি। এমন সময় কোনো এক নরোম গলার আওয়াজ উড়ে আসে পেছন থেকে। কবি।
এ তো বিন্তির গলা। কবি ঘুরে দাঁড়ায়। বিন্তিকে দেখে চোখমুখ আনন্দ-আভায় ঝলমল করে ওঠে। আপনি অস্ট্রেলিয়া যাননি? চোখের কোণে অজান্তে জমে যাওয়া জলের জোয়ার মুছে জানতে চায় কবি। আপনি না—তুমি। বলেই বিন্তি কবির বুকে মাথা গুঁজে কবিতার মতো মিশে যায় তার ধমনী-শিরায়। একজোড় অভিন্ন্ সত্তার সিঁড়ি বেয়ে বেজে ওঠে—
আমার মিলন লাগি তুমি
আসছ কবে থেকে।
তোমার চন্দ্র-সূর্য তোমায়
রাখবে কোথায় ঢেকে।
কতো কালের সকাল-সাঁঝে
তোমার চরণধ্বনি বাজে,
গোপনে দূত গৃহ-মাঝে
গেছে আমায় ডেকে।
লেখক : তরুণ সাহিত্যিক।
জন্ম : ১৯৮৭ সাল, রংপুর।
প্রকাশিত বই দুইটা।
এক. ওকাবোকা তেলাপোকা (২০১৬) -শিশুতোষ
দুই. এলিয়েনের দেশ পেরিয়ে (২০১৭)-শিশুতোষ।