মুগ্ধতা ব্লাড ব্যাংকে আপনার দেওয়া তথ্য বাঁচাতে পারে একটি জীবন। আপনার তথ্য দিন, প্রয়োজনে রক্ত খুঁজুন এখানে।

প্রভাতফেরির গান

ডা.ফেরদৌস রহমান পলাশ

২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ , ১২:৪৪ পূর্বাহ্ণ

প্রভাতফেরির গান

আজ সারাদিন সাম্যের উত্তেজনায় কেটেছে। আগামিকাল একুশে ফেব্রুয়ারি, সে জীবনে প্রথম ফুল দিতে যাবে শহিদ মিনারে। সাম্যর বয়স দশ। সে পড়ে বদরগঞ্জ মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে। যদিও সে বদরগঞ্জে থাকে তবে এখন সে আছে রংপুর, তার নানাবাড়িতে। তখনও শহর ঠিক শহর হয়ে ওঠেনি। সময়টা ১৯৮৩। সাম্যর নানাবাড়িটা একতলা হাফ বিল্ডিং। উপরে খাড়া টিনের ছাদ। মামা খালারা সবাই সৌখিন আর সাহিত্য সমজদার। সেজো মামার বইয়ের ঘর ছিল হাতের ডানে। কালো কাঠের বুকসেলফে শুধু বই আর বই। দরজা দিয়ে ঢুকতেই দরজার ওপরে সাজানো ছিলো কাটা হরিণের মাথা। তখনও বাড়িতে সাজিয়ে রাখা হতো হরিণের মাথা যতদিন না নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ছুটিতে নানাবাড়িতে এলে সারাদিন কাটে সাম্যর সেজো মামার বইঘরে। কত বই যে আছে! দস্যু বনহুর, কুয়াশা, তিন গোয়েন্দা, পড়ে শেষ করার জো নাই। ছুটি হলেই সাম্য বায়না ধরে নানাবাড়ি যাবার জন্য। এবার বইপড়ার চেয়েও মজার ঘটনা ঘটতে চলছে। মামাবাড়ি থেকে সবাই শহিদ মিনারে ফুল দিতে যাবে। সাম্যর মামা মুক্তিযোদ্ধা রাকিব মামা এবার নিজ উদ্যোগে পারিবারিকভাবে ফুল দিতে যাবেন শহিদ মিনারে। কয়েকদিন ধরেই চলছে তার প্রস্তুতি। ছোট খালা, বন্যা পিসি, বাবু মামা সারাদিন হারমনিয়ামে গান প্রাকটিস করছে। প্রভাতফেরি কী? মামাকে জিজ্ঞেস করায় মামা বললো সূর্য ওঠার আগেই ফুল দিতে যাওয়াকে বলে প্রভাতফেরি। মামা বললেন, ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য প্রাণ দিয়েছিল সালাম, রফিক, বরকত ছাড়াও নাম না জানা আরও অনেকে। পৃথিবীতে আর কোনও জাতি ভাষার জন্য প্রাণ দেয়নি। সেই ভাষা শহিদদের স্মরনে রচনা করা হয়েছে এবং হচ্ছে কত গান, কবিতা। সেসবকে ছাপিয়ে সবচেয়ে পরিচিত গান, যে গানের সুর সবাই জানে। 

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো, একুশে ফেব্রুয়ারি

আমি কি ভুলিতে পারি?

গানটি লিখেছেন আবদুল গাফফার চৌধুরী। মামা বলে জানিস, গাফফার চৌধুরী যখন গানটি লিখেন তখন তিনি নিজেও ছাত্র। সুর করেছেন আলতাফ মাহমুদ। গানের সুরটা শুনলেই কেমন কান্না পেত সাম্যর। আজ আরও বেশি করে কান্না পেল যখন সে শুনল, হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী সেই সুরকার আলতাফ মাহমুদকে হত্যা করেছে। সন্ধ্যা হতেই নানির কাছে বায়না আমাকে ভাত দাও, আমি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ব। সকালে প্রভাতফেরিতে যাব। সবাই সাম্যর কান্ড দেখে হাসে। মামার ঘরে ভাত খেয়ে শুয়ে থাকে সাম্য। ঘুম কি আর আসতে চায়। ছোট মামা বলেছে, ফুল চুরি হতে পারে। মামা বাগান করেছে বাড়ির সামনে। কত ধরনের ফুল সেখানে। গাঁদা, কসমস, চন্দ্রমল্লিকা, সূর্যমুখী। বিকালে নানা বড় একটা ঝাঁঝরি দিয়ে পানি দেয় গাছগুলোর গোড়ায়। ফুলে-ফুলে উড়ে বেড়ায় মৌমাছি। কসমসগুলো বড় দূর্বল, একটুতেই হেলে পরে বাতাসে। সেজো মামা খুঁটি দিয়ে গাছগুলোকে খাড়া করে দিয়েছে। বিকেলে বাগানে ঢুকলেই মিষ্টি একটা গন্ধ নাকে লাগে। হাত দিয়ে কসমসের রঙিন পাপড়িগুলো নাড়তে কী যে ভালো লাগে! সেই ফুলগুলো যদি আজ চুরি হয়ে যায়। আজ দুষ্টু ছেলেরা ফুল চুরি করতে বের হবে। সেই ফুল নিয়ে যাবে শহিদ মিনারে। ঘুম আসতে চায় না, ফুলদের কথা ভেবে। এপাশ-ওপাশ করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলো সাম্য! ঘুম ভাঙে নানীর ডাকে,এই সাম্য,এই সাম্য। কীরে যাবি না? ওঠ বাবা।সবাই তৈরী হয়ে বসে আছে। হুড়োহুড়ি করে তৈরী হয়ে বের হবার সময় মামা বললো, কীরে স্যান্ডেল পরে যাবি নাকি?

হ্যাঁ,স্যান্ডেল পরেই তো যাব। স্যান্ডেল ছাড়া আমাকে হাঁটতে দেখেছেন কখনও?

হা,হা, মা শোনও তোমার নাতি প্রভাতফেরিতে নাকি স্যান্ডেল পরে যাবে বলে মামা অট্টহাসিতে ফেটে পরে।

প্রভাতফেরিতে খালি পায়ে যেতে হয় রে বোকা।শহিদদের সম্মানে পায়ে জুতা পরা হয় না। চল,দেরী হয়ে যাচ্ছে বলে মামা বের হয়ে আসে।

ফুল বাগান পার হয়ে গেট। আড় চোখে বাগান দেখলো সাম্য। নাহ্,কোনও ফুল চুরি হয়নি। গেটের বাইরে জটলা করা পাড়ার সবাই। শ্যামল কাকার গলায় হারমোনিয়াম, ছোট খালা রেডি গান গাওয়া শুরু করার জন্য। সুমিত স্টোর পার হয়ে, রঞ্জন এক্সরেকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলে প্রভাতফেরি। পথে আরও অনেক মিছিল। ছোট খালা,শ্যামল কাকার হারমনিয়ামের সাথে গান শুরু করে।ছোট্ট সাম্য আর সবার সাথে গলা মেলায়-

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো, একুশে ফেব্রুয়ারী

আমি কি ভুলিতে পারি।।

ছেলে হারা শত মায়ের অশ্রু

গড়ায়ে ফেব্রুয়ারী।।

আমার সোনার দেশের

রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী।’

ডা.ফেরদৌস রহমান পলাশ
Latest posts by ডা.ফেরদৌস রহমান পলাশ (see all)