লোকটার বয়স কত হবে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। চুল, দাড়ি এমনকি ভ্রু পর্যন্ত সাদা। মারুফের ধারণা বয়স ৭৫ বছর তো হবেই। কথা বলার সময় দাঁত দেখা যাচ্ছে না, তাই দাঁত আছে না নাই, তা বোঝা যাচ্ছে না। তবে উচ্চারিত কথা ভেসে আসার সময় শব্দই বলে দিচ্ছে সামনের দাঁত কয়েকটা তার নাই। এই খেলাটা খেলতে মারুফের ভালো লাগে। সামনের যে কোনও একজন লোক সম্বন্ধে ধারণা করতে। সবসময় মেলে না তবে মারুফ দেখেছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মিলে যায়। লোকটা রসিক, লোক না বলে বৃদ্ধ বলাই মনে হয় ভালো। বৈকুন্ঠপুরের এই জৈষ্ঠের দুপুরে কাঁঠাল গাছের নিচে টং এ বসে লোকটার কথা শুনছে মারুফ। এদিকে কখনো আসা হয়নি আগে, যদিও রংপুর শহর থেকে বারো -তেরো কিলোমিটার দূর, তারপরও। সে এসেছে একটা বইয়ের পার্সেল ডেলিভারি দেবার জন্য।
প্রযত্নে,
নীলা, বৈকুন্ঠপুর, রংপুর।
এটুকুই ঠিকানা, সাথে মোবাইল নম্বর। প্রেরকের ঠিকানাটাও অদ্ভুত, শুধু লেখা-
প্রেরক,
নীল আর মোবাইল নম্বর।
নাম দুটো দেখে হাসি পায় মারুফের। নিশ্চিত নকল নাম। আসলে সম্পর্ক দানা বাঁধে না বলেই গোপন নাম প্রকাশ্যে চলে আসে। গোপন নামে সেও তো ডাকত সুলতানাকে, নয়না নামে। নয়না কেমন আছে? কতদিন পর তার নাম মনে পড়ল। পেটভাতে একটা চাকরি করে আর যাই হোক মনে প্রেম আসে না।
আহ,আজ এত গরম। বৃদ্ধ এখন সাপের গল্প বলছে। বুঝলা মিয়া, বলাটা কানে মনে হলো, ভুজলা মিয়ারা। মুই সাপের মনি দেখছুনু একবার বাঁশের ঝাঁড়োত। চইত মাস, মুই তখন চেংড়া মানুষ। রাইত বারোটার সম কতাকলি সিনেমা হলোত রুপবান ছিনেমা দেখি আসছুনু। মোর বাড়ির গোড়ত একখান বড় বাঁশের ঝাড় আছিল। ওটা পার হয়ে মোর বাড়ি। এলাও নাম আচে ওটার, আন্ধার বাঁশের তল। দিনের বেলাতো ওটে সূর্যের আলো ঢুকছিল না। ডাকাতের ভয়ত লোকজন এটে রাইতোত আইসে না। মুই তখন তাগড়া জোয়ান, এক বসাত একখান কাডোল খায়া খেলবার পারছুনু। মোর অতো ভয় আছিল না। বাঁশের আড়াতের মাজের রাস্তা দিয়া যাওছুনু। এটুকু বলেই মারুফের মুখের দিকে তাকায় বৃদ্ধ। একটু ঘোলা চোখ।চোখে কি ছানি আছে? মনে হয় আছে। চোখ পিটপিট করে জিজ্ঞেস করে,তোরা ক্যায় বাহে? তোমাক তো চিননো না?
আমি কুরিয়ার সার্ভিসে কাজ করি। একটা পার্সেল ডেলিভারি দিতে আসছি, বলে মারুফ। আপনার গল্প শুনছি, খুব মজা করে গল্প বলতে পারেন আপনি।
এই ছ্যামড়া কয় কি? এগুলা গল্পো নোয়ায় সত্যি ঘটনা।
পাশে বসা লোকজন অধৈর্য হয়ে ওঠে, আরে তোরা থোন তো আন্দাসুন প্যাচাল। গল্পোটা শ্যাষ করেন।
বৃদ্ধ মাথা ঝুঁকিয়ে রাখে। নিশ্বাস নেয় শব্দ করে, মাথা কাঁধ ওঠানামা করে দ্রুত।
কী হইল তোমার বাহে? ঘুমাইনেন নাকি?কতা কন না কেন তা?
বৃদ্ধ মাথা নিচু করে আরও, চিবুক মিশে যায় বুকের সাথে। কোনও দিকে খেয়াল নাই।
টং এর সামনের চায়ের দোকানদার বলে, বুড়া ঘুমি গেইছে। এলা উয়াক চা, বিস্কুট, পান না খওয়াইলে কতা কবার নয়।
ধান কাটামারা শেষ। লোকজনের হাতে টাকা আছে। বিকালে নতুন চামড়ার সেন্ডেল আর প্রিন্টের শার্ট পরে শ্যামপুর বন্দরে যায়। চায়ের দোকানে বসে আলোচনা করে দেশ, ধর্ম আর নারীদের নিয়ে। শ্যাখের বেটি কী করলো, কী করা দরকার ছিল এসব নিয়ে জোর আলোচনা হয়। চৈত্রের এই দুপুরে বাসায় থাকা কঠিন, আড্ডা বসেছে তাই এই টং এ।
রহিমুদ্দিন গজগজ করে লুঙ্গির কোচায় হাত দিয়ে টাকা বের করে। চা দিতে বলে দোকানদারকে।
বেশ জোরেই চায়ের অর্ডার দেবার কারণেই কি না, বৃদ্ধ জেগে ওঠে। সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে বলে, মাঝ ঘাটাত আসি দ্যাকো আলো আর আলো, বাঁশের তলা উজাল হয়া গেইছে। একনা আগে গিয়া দেখো, দুইটা সেইরম বড়ো সাপ মারামারি করোচে আর একখান পাথর থাকি সেই আলো বেরাওচে। মুই বুঝবার পারনু এটা সাপের মাথার মনি। মুই আগবার গেনু, সেই শব্দ করোচে, ফোঁস ফোঁস শব্দোত, কান তালা নাগি যাবার অবস্থা। দৌড়ি বাড়ি চলি গেনু। হুড়োহুড়ি করি একখান ডালি নিয়া ফির আসি দ্যাকো কোনো কিছুই নাই। খালি ঐ জায়গাটা পুড়ি কালা হয়া গেছে। মুই ছুটাছুটি করনু, এপাক, ওপাক, কিছুই নাই। গলা জড়িয়ে আসে বৃদ্ধের, আবারও মাথা সামনের দিকে ঝুঁকে পরে। কয়েক মুহুর্তেই আবার গা ঝাড়া দিয়ে, চায়ে চুমুক দিয়ে শব্দ করে, আহ্। মাথা দোলায়, চোখ বন্ধ করে।
তারপর কী হলো? মারুফ অধৈর্য হয়ে বলে বসে। বলেই লজ্জা পায় কিন্তু কেউ বিষয়টা খেয়াল করে না, যেন এ প্রশ্নটা সবার।
মোবাইল বেজে ওঠে, লক্ষ্য করে দেখে নীলা ফোন দিয়েছে।
হ্যালো, ম্যাম আর কতক্ষণ বসে থাকব?
আপনি কোথায়? এই তো বৈকুন্ঠপুর, পুটিমারিতে একটা চায়ের দোকানে।
আরে ওখানে গেছেন কেন? আপনাকে না বললাম, জোদ্দার পাড়ায় আসেন।
ওহ্, আমি তাহলে শুনতে ভুল করেছি।
আসেন, তাড়াতাড়ি। আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে।
মারুফ তবুও বসে থাকে, অধীর আগ্রহে তাকিয়ে সবার মতো বৃদ্ধের দিকে। তার তাড়া আছে আরও একটা প্যাকেট ডেলিভারি দিতে হবে। নীলা অপেক্ষা করছে নীলের পাঠানো প্যাকেটের জন্য। জনা দশেক লোক আর চায়ের দোকানদার সবাই চুপ করে আছে। সবাই অপেক্ষা করছে, গল্প শুরুর। বৃদ্ধ মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে।