বন্ধু রকিবুল ইসলামের সাথে পরিচয় ১৯৮৯ সালে। আমরা তখন নবম শ্রেণির ছাত্র। প্রথম ক্লাসেই আমাদের পরিচয় হয় এবং বন্ধুত্ব হতে বেশি সময় লাগল না। বিষয়টা এমন, পরিচয় পূর্ব জনমের আর নতুন করে বন্ধুত্ব এ জনমে।
নবম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে ওর চুল অনেক লম্বা আর সিলকি হওয়ায় যখন সে হাঁটত তখন মনে হতো কোনো ঘোড়া লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে। সামান্য বাতাসে ছন্দ মিলিয়ে লাফাত। কাব্যময় অনুভুতি হতো চোখজুড়ে। আ. কাদের স্যার ও আ. সামাদ স্যার প্রায়ই তার চুল ধরে টানতেন। খুব চাপে পড়ে সে মাঝে মাঝে কিছুটা ছোট করত।
এস এস সি পাশ করার পূর্বেই আমাদের বন্ধুত্ব গাঢ় হয়। আমরা তিন বন্ধু আমি রকিব ও মামুন হয়ে উঠি মরমি। মরমি ‘র’ হারিয়ে হয়ে গেছে মমি। যেন স্থির।
এইচ এস সি পাশ করার পর আমি আর মামুন কারমাইকেল কলেজে ভর্তি হই আর রকিব ভর্তি হয় রংপুর সরকারি কলেজে। কলেজে আমাদের দেখা না হলেও প্রতিদিন বিকেলে দেখা হতো কামাল কাছনায়। সেখানে থাকত মামুন। ওর বাসার আশেপাশে আমাদের আড্ডা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক। আড্ডায় মাঝে মাঝে যোগ হতো মিথি, সম্পা, ছন্দা, তিথি ও রোজী। আড্ডায় মাঝে নতুন কিছু যোগ করত চায়না ভাবি। সেই দিনগুলো ছিল অনেক মধুর।
আমাদের বন্ধুদের মধ্যে রকিব বিয়েটাও সময়ের পূর্বেই করে। তার বিয়েতে সে নিজেসহ কেউ-ই রাজি ছিল না। তার সাথে সম্পর্ক ছিল আমাদের একজন সহপাঠী রিপার। সেই রিপার বিয়ে হয়ে যাওয়ার ভয়ে ওরা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়। বিয়ের কাপড় কেনাকাটা করতে হয় বন্ধুদেরকেই। রাত বারোটায় দর্জিকে বাসা থেকে ডেকে এনে কাপড় তৈরি করে বন্ধুরাই। বন্ধুরা ওর ছিল প্রাণ। জীবনের সব ঘটনা দূর্ঘটনার রাজসাক্ষী বন্ধুরা।
এক ঈদে রকিবের পরিবার ঢাকায় ঈদ করে। ঈদের নামাজ পড়ার পর তার আর মন টিকল না। ঢাকায় বাসায় মা বাবা ভাই এবং স্ত্রীকে না বলে বাসে উঠে বসে। গন্তব্য রংপুর।
এরকম আমাদের বন্ধুদের নিয়ে হাজারো পাগলামো আছে এই বন্ধুকে ঘিরে।
মামুন বুয়েটে চাঞ্চ পাওয়ার পর যোগাযোগ অনেক কমে গেল। ব্যস্ততা আমাদের শারীরিক দূরত্ব বাড়িয়ে দিলেও মনের দূরত্ব ছিল পূর্বের মতোই।
যখন মোবাইল নেটওয়ার্ক এল। তিনজন তিন স্থানে থাকলেও যোগাযোগ হতো প্রায়ই। রকিব রংপুরে, আমি ছিলাম কুড়িগ্রামে আর মামুন ঢাকায়। একদিন মামুন ঢাকা থেকে এল কুড়িগ্রামে আমার সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে নিয়ে।
বারো বছর আগে মামুন রংপুরে পলিটেকনিক্যাল কলেজ দেওয়ার পর আমাদের তিন বন্ধুর বন্ধুত্ব আরো গাঢ় হলো। আমাদের শারীরিক দূরত্ব কমে গেল। আবারও প্রায়ই দেখা হতো। কথা হতো। হতো জমজমাট আড্ডা। আমার চাকরির ধরনের কারণে মামুনকে কলেজে সহযোগিতা করতে পারিনি। কিন্তু সেটা রকিব পারল। সে রেলওয়েতে কর্মরত থাকায় যেটুকু সময় পেত মামুনকে সাহায্য করেছে তার কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য। মৃত্যুর আগ মূহুর্ত পর্যন্ত রকিব সেটা করেছে।
সাধারণত ছেলেদের বন্ধুত্বে ভাটা পড়ে প্রধান দুটি কারণে। এক টাকা দুই নারী। এই প্রধান দুই কারণ আমাদের তিনজনের মাঝে বন্ধুত্বের ফাটল ধরাতে পারেনি।
সর্বশেষ:
২৩ ডিসেম্বর ২০২২ সন্ধ্যায় মামুনের ফোন পেয়ে আমি তার কলেজ রোডের নতুন স্থায়ী ক্যাম্পাসে এলাম। সেখানে মামুনের সাথে রকিবকেও পেলাম। তিন বন্ধু শেষ বারের মতো মিলিত হলাম। আমরা কি কেউ জানতাম! এটাই আমাদের শেষ সাক্ষাৎ! জানার কথাও না। আমরা তিনজনই খুব জটিল রোগে আক্রান্ত নই। বেশ কিছুক্ষণ আমাদের আড্ডা হলো। তারপর মামুন আর রকিব চলে গেল তাদের নিয়মিত খেলার স্থান বিয়াম স্কুলের মাঠে। শীতকালে ওরা নিয়মিত ব্যাটমিন্টন খেলত। আমি খেলতে কিংবা আড্ডা দিতে যেতাম মাঝে মাঝে।
২৪ ডিসেম্বর ২০২২ সন্ধ্যায় কামালের ফোন পেয়ে দেখা হলো রংপুর সিটি কর্পোরেশন মার্কেটে। এরপর পলাশ এলো সেখানে। পলাশ ঢাকা থেকে কয়েকদিন পূর্বে এসেছে।
পলাশসহ আমরা তিনজন অন্য আরো বন্ধুদের সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে জিলা স্কুলের সামনে গেলাম।
তখন বাজে রাত ৯.৫০ মি। মামুনের ফোন পেলাম। রিসিভ করতেই বলল, আমি বগুড়ায় এসেছি আজ রাতে। তুই এখন রংপুর মেডিকেলে যা। ওখানে রকিবকে বন্ধু ফেমাস ও ডা. ফারুক নিয়ে গেছে । খেলতে গিয়ে পড়ে গেছে। বলে রাখি আমাদের আরেক বন্ধু ফেমাস। ব্যাপারটা খুব জটিল ভাবলাম না। খেলতে গিয়ে সামান্য দূর্ঘটনা হতেই পারে। তবুও সময় নষ্ট না করে আমি পলাশ, কামাল তিনজনে মেডিকেলে দ্রুত পৌছালাম। জিলা স্কুল থেকে মেডিকেলের দূরত্ব পাঁচ মিনিটের। এর মধ্যে ফেমাসের আবারও ফোন। তুই দ্রুত রিপাকে খবর দে। রিপা হচ্ছে রকিবের স্ত্রী। বুঝলাম না কী এমন হলো? ওর স্ত্রীকে আসতে হবে! আমি চলতি পথেই আবার মামুনকে ফোন দিলাম। বললাম, তুই রিপাকে মেডিকেলে আসতে বল আমরা মেডিকেলে ঢুকছি। গ্যারেজ তখন বন্ধ করার আয়োজন চলছে। গ্যারেজ পরিচিত হওয়ায় অনুরোধ করে মোটরসাইকেল রাখলাম। পলাশ আর কামাল আমার জন্য অপেক্ষা করছিল ইমার্জেন্সিতে। গ্যারেজে মোটরসাইকেল রেখে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যাচ্ছিলাম মেডিকেল ইমার্জেন্সির দিকে। বন্ধু হারানোর ভয় কাজ করছিল মনে মনে। কিন্তু ভয়কে পাত্তা না দিয়ে পলাশ আর কামালসহ আমরা দ্বিতীয় তলার কার্ডিয়াক ইউনিটের সামনে এলাম। ডা. ফারুক আমাদের দেখে কান্নাকাটি শুরু করল। আমাদের বুঝে উঠতে বেশ সময় লাগল। ফারুক বলেই ফেলল রকিব আর নেই। সার্জারির ডাক্তার হওয়ায় অনেক মৃত্যুই ওদের হাতে হয় কিন্তু ফারুক কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিল না রকিবের মৃত্যু। বিশ্বাস করতে পারলাম না। আমরা সিসিইউতে ঢুকলাম। বন্ধু নিশ্চুপ শুয়ে আছে। মাথার উপর কোনো মেশিন কাজ করছে না। চিরঘুমে আমাদের বন্ধু। অবিশ্বাস নিয়ে করিডরে এলাম। কান্নাগুলো বুকের ভিতর জমাট বাঁধতে শুরু করছিল। চোখে মুখে উৎকন্ঠা ভয় ভীড় করছিল। অব্যক্ত কষ্টগুলো ঘুরছিল ব্রেনের শরীর ঘেঁষে। একে একে অনেক বন্ধু এল। কার্ডিয়াক ইউনিটের করিডোর ভর্তি হয়ে গেলো নিমিষেই। বন্ধুপ্রিয় রকিব বন্ধুর কোলেই মৃত্যুর স্বাদ নিল।