মুগ্ধতা ব্লাড ব্যাংকে আপনার দেওয়া তথ্য বাঁচাতে পারে একটি জীবন। আপনার তথ্য দিন, প্রয়োজনে রক্ত খুঁজুন এখানে।

বর্তমান কোভিড ১৯ পরিস্থিতিতে  পরীক্ষা বনাম পড়াশোনা। 

মুগ্ধতা.কম

৩১ আগস্ট, ২০২০ , ১১:৫৬ অপরাহ্ণ

বর্তমান কোভিড ১৯ পরিস্থিতিতে পরীক্ষা বনাম পড়াশোনা।

সেই ছোট্ট বেলায় যখন একটু আধটু বুঝতে শিখেছি, তখন থেকে দেখছি পড়াশোনা মানেই পরীক্ষা, সার্টিফকেট অর্জন, একটা ভাল চাকুরী ইত্যাদি ইত্যাদি। আমরা যখন লেখাপড়া শিখেছি, তখন পরীক্ষায় ভাল নম্বর পাওয়ার জন্য, পরীক্ষায় প্রশ্ন কমন পাওয়ার জন্য অধ্যায় বেছে বেছে বা পরীক্ষায় আসার মত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বেছে বেছে পড়তাম। আর চাকুরীর পরীক্ষার জন্য বড় বড় গাইড মুখস্ত করতাম। এমনকি বাংলা বর্ণমালায় কতটি মাত্রাযুক্ত বর্ণ, কতটি মাত্রাবিহীন বর্ণ এসবও মুখস্থ করেছি গাইড থেকে। “ছাত্রজীবন”, “আমার জীবনের লক্ষ্য”, “আমাদের বিদ্যালয়” -এসব রচনা অনেকেই মুখস্থ করে লিখেছি।

বর্তমান কোভিড ১৯ পরিস্থিতিতে পরীক্ষা বনাম পড়াশোনা।

আমার জন্ম শিক্ষক পরিবারে। বাবা ছিলেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। আমার চাচা, মামাসহ পরিবারে নিজেদের মধ্যে অনেকেই শিক্ষক ছিলেন ও আছেন। তারপরও পরিবার থেকে কিংবা ছাত্রজীবনের কোন পর্যায়ে জানা হয়নি যে- শিক্ষা কী,  শিক্ষার লক্ষ্য কী, কিংবা কেনইবা লেখাপড়া শিখব অর্থাৎ শিক্ষার উদ্দেশ্য কী?

বিভিন্ন যুগের বিভিন্ন চিন্তাবিদগণ শিক্ষাকে নানাভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। যেমনঃ

সক্রেটিস বলেছেন, “শিক্ষা হলো মিথ্যার অপনোদন এবং সত্যের আবিষ্কার।“

জন ফেডারিক হারবার্ট বলেছেন, “ শিক্ষা হচ্ছে মানুষের নৈতিক চরিত্রের বিকাশ সাধন।“

পার্সিনান বলেছেন, শিক্ষা বলতে শিশুর ব্যক্তিসত্ত্বার পরিপূর্ণ বিকাশকে বোঝায়, যার সাহায্যে সে নিজের সর্বোত্তম ক্ষমতা অনুযায়ী মানুষের কল্যাণে স্বকীয় অবদান রাখতে পারে।

এভাবে শিক্ষা চিন্তাবিদদের সংজ্ঞা লিখলে পাতার পর পাতা লিখা যাবে। যা পুঁথিগত বিদ্যার সাথে কোনই মিল নেই। এসব কিছুই জানলাম শিক্ষকতা পেশায় এসে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে । জানলাম যে, “পরীক্ষার জন্য পড়াশুনা নয়, কে কতটুকু শিখেছে তা যাচাই করার জন্য পরীক্ষা”।

কিন্তু জেনে খুব বেশি লাভ হয়েছে বলে তো মনে হয় না। যতটুকু লাভ হয়েছে তা হল- শেখানোর সময় শিক্ষার্থীদের পরিবেশের সাথে, সমাজের সাথে, বাস্তবতার সাথে সমন্বয় ঘটিয়ে শেখানো। অথচ শিক্ষার্থী, অভিভাবক আমরা সকলেই ছুটছি একটা ভাল ফলাফলের পিছনে। তাইতো বোর্ডবই পড়া ছেড়ে দিয়ে, নিজের চিন্তাশক্তিকে কাজে না লাগিয়ে, প্রাইভেট, কোচিং, গাইড বই ইত্যাদির আশ্রয় নিচ্ছে শিক্ষার্থীরা। কীভাবে বৃত্তি পাওয়া যাবে, কীভাবে এ+ হবে, কত পয়েণ্ট পেলে কোথায় ভর্তি পরীক্ষা দেয়া যাবে এসব টার্গেট নিয়েই পড়াশোনা করছে শিক্ষার্থীরা। এছাড়া আর উপায়ই বা কি? একটি পরীক্ষার ফলাফলই একটি শিশুর স্বপ্নকে ভেঙে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দেয়।

আজ কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে এসে দেখছি, শিশুরা কত অসহায়। যারা স্কুল, কোচিং, প্রাইভেট, বিভিন্ন একাডেমি, খেলাধুলা ইত্যাদি নিয়ে সারাদিন বাড়ির বাইরে থাকত, ব্যস্তও থাকত ভীষণ।  পড়াশোনা আর অভিভাবকদের চাপে দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম। তারা আজ বাড়িতে বন্দি। প্রথমত ভেবেছিলাম শিশুদের জন্য ভালই হয়েছে। এত চাপ…………। এই পরিস্থিতিতে তারা অন্তত দম ফেলার সুযোগ পাচ্ছে। প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। সুযোগ পাচ্ছে বাবা – মায়ের সাথে থাকার ।

কিন্তু না, প্রথম দিকে ভাল থাকলেও দিন যতই যাচ্ছে, শিশুরা ততই মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। সংসদ টিভির ক্লাস, অনলাইনে ভিডিও/অডিও ক্লাস কিছুই ভাল লাগছে না তাদের। প্রত্যেকের মনে ২টি প্রশ্ন ১) পরীক্ষা কি হবে? ২) স্কুল কবে খুলবে? যে সকল প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব এ মুহুর্তে নেই।

শিশুরা বলছে, পরীক্ষা যদি না-ই হয়, তাহলে পড়ব কেন?

ভাবছি এখনই সময়, তাদেরকে এই সীমাবদ্ধতা থেকে বাইরে বের করে আনার। আমরা শিক্ষকরা ফোন করে কথা বলছি শিশুদের সাথে। সত্যি কথা বলতে কি, শিশুরা যে কি পরিমাণ খুশি হচ্ছে স্যার- আপাদের সাথে কথা বলতে পারায় তা হয়ত বলে প্রকাশ করা যাবে না। এ সময় আমরা যদি সরাসরি পাঠের কথা না বলে গল্পের ছলে পড়াশোনার গুরুত্ব সম্পর্কে বলি, আমরা যদি মাঝে মাঝে নৈতিকতার গল্প শোনাই, আমরা যদি বাবা – মা’কে বিভিন্ন কাজে সহযোগিতার কথা বলি, কিংবা পাঠ সংশ্লিষ্ঠ গল্প শুনিয়ে ঐ পাঠটি পড়তে বলি, তাহলে মন্দ হয় না। মাঝে মাঝে কোভিড-১৯ সম্পর্কেও আলোচনা করতে পারি। একদিনে অনেক শিশুকে ২/১ মিনিট করে সময় না দিয়ে অল্প কয়েকজন শিশুকে একটু বেশি সময় দেয়া যেতে পারে। এতে শিক্ষকদের হয়ত খরচ টা একটু বেশিই হবে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের অন্তত একঘেয়েমিটা দূর হবে।

আমার মনে হয় বর্তমান পরিস্থিতিতে পরীক্ষার টেনশন মাথা থেকে ঝেরে ফেলা দরকার। কেননা পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা নয়, শিক্ষার মান যাচাইয়ের জন্য পড়াশোনা। তবে পড়াশোনা থেকে শিক্ষার্থীরা যেন মুখ ফিরিয়ে না নেয়, তার জন্য সকল প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে আসলেই কেবল পরীক্ষা নেয়া সম্ভব। শুধুমাত্র পাবলিক পরীক্ষা ছাড়া সকল শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নমনীয় প্রমোশন দেয়া যেতে পারে। এমনকি বর্তমান পরিস্থিতিতে পঞ্চম শ্রেণির প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা এবং অষ্টম শ্রেণির জেএসসি পরীক্ষারও প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে নিজ বিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্তৃক বাছাইকৃত কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদানের নিমিত্তে মেধা মূল্যায়নের জন্য  সীমিত আকারে একটা পরীক্ষা নেয়া যেতে পারে।

সর্বোপরি বলতে চাই, আমাদের সকলের উচিত শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের বোঝানো যে, “কেবল পড়াশোনার মান যাচাইয়ের জন্যই পরীক্ষা। কাজেই পরীক্ষা হোক আর না ই হোক শেখার জন্য, জানার জন্য লেখাপড়া অব্যাহত রাখতে হবে”।

 

লেখকঃ প্রধান শিক্ষক,
পূর্ব গিলাবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
রংপুর মহানগর, রংপুর।