বৃষ্টি, আষাঢ়-শ্রাবণে প্রায় প্রতিদিনই ঝরে পড়ে এই ধরণীতে। পথ-ঘাট তলিয়ে যায় আকাশ থেকে ঝরে পড়া ওই জলে, কাদায় বিরক্ত হয় পথচারী। তবুও বৃষ্টিকে আমরা সবাই খুব ভালোবাসি। বৃষ্টি এলে ভুলেই যাই সর্দি-জ্বরের কথা। যেভাবেই হোক ভিজতেই হবে, এই ইচ্ছেটা অপূর্ণ রাখা একদম চলবেই না।
বৃষ্টির মাঝেও আকাশের দিকে তাকিয়ে আকাশ দেখার চেষ্টা, মেঘের চিৎকার শোনা, এ যেন আমার আজন্ম অভ্যেস ছিলো। মাটির উপর শুয়ে থেকে বৃষ্টিকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখা, তাকে জানানো “বড্ড প্রিয় তুমি যে আমার হে বৃষ্টি”।
যখনই আকাশ কালো হয়ে বৃষ্টি আশার প্রস্তুতি নিতো, আমি তখনই ওই আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে শুধু দেখতাম কালো মেঘের ভিতর কতটা কষ্ট জমেছে, কতটা পথ তারা এই কষ্ট বয়ে বেড়াচ্ছে। মেঘের এই কালো কান্না আমি খুব আগ্রহ নিয়ে শুনতাম, আর অপেক্ষা করতাম কখন আমার উপর ঝরে পড়বে ওই কালো মেঘের অশ্রুবিন্দু। আমি তো বৃষ্টির বন্ধু। সে এলে আমি কি আর নিজেকে ঘরে বন্দি রাখতে পারি। তাইতো পরম ভালোলাগায় মিশে যাই পরম বৃষ্টির মাঝে।
একদিন সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে ঘন কালো মেঘে ওই আকাশটা ঢেকে গেলো, আকাশে কেমন যেন একটা গুরু গম্ভীর ভাব। চারদিকে হৈচৈ পড়ে গেলো সবাই ঘরে আসো বৃষ্টি নামবে এখনি। মা তাঁর প্রয়োজনীয় জিনিস বৃষ্টির থেকে বাঁচানোর জন্য সবকিছু তাড়াহুড়ো করে ঘরের ভিতর এনে রাখছে। সন্ধ্যার আকাশে এমন চিত্র দেখে আমার অদ্ভুত ভালো লাগলো, যেন শুধু আমার জন্যই এই বৃষ্টির আগমন হচ্ছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি নামলো, ঝুম বৃষ্টি, টিনে বৃষ্টি পড়ার শব্দ খুব সুন্দর লাগছিলো। আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল বৃষ্টিতে ভিজতে, মন চাইছিল আজ সারারাত বৃষ্টির মাঝেই থাকবো। কিন্তু মায়ের কড়া শাসনে ঘর থেকে আর এক পা-ও বাইরে ফেলতে পারিনি।
ওইদিন রাতে একটি ইচ্ছে অপূর্ণ রেখেই বৃষ্টির অনিন্দ্য শব্দে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
আজ বহুদিন পর তেমনিই একটি সন্ধ্যা। আমি চাইলেই আজ ভিজতে পারতাম কিন্তু আজ আর সেই ইচ্ছেটা আমার নেই। বৃষ্টির প্রতি আগের ভালোবাসাটা বোধহয় নেই। হারিয়ে গেছে!
আজ আমার শুধু মনে পড়ছে শৈশবের সেইসব স্মৃতি। গ্রামীণ জীবনে সেই হারানো দিনগুলির কথা, যা আজ আর নেই! তবুও তখনকার ভালোলাগা গুলো এখনো স্পষ্ট ভেসে উঠে চোখের কোনে। সেই বৃষ্টি বিশ্রিত প্রিয় পথ… বাতাসে গাছের গায়ে থেকে থেকে ঝরে পড়া জলে হঠাৎই ভিজে যাওয়ার মুহূর্ত।
শহর জীবনে এসে এখন হারিয়ে ফেলেছি অনেক কিছুই, হারিয়েছি আমার প্রিয় বৃষ্টি বন্ধুকেও। এখানেও বৃষ্টি হয়, আসে। মেঘের কান্নায় এই শহরও মাঝে মাঝে ভেসে যায়। তবে আমাকে আর ভালোবাসে না আগেরমতো করে এখানকার বৃষ্টি, আমিও ভালোবাসি না হয়তো, তাই এতোটা অভিমানে সে আমাকে আর ডাকে না কাছে। শুধু ভিজতে বলে তার কষ্টের অশ্রুতে।
জীবনের পালাবদলে আমি ভুলেই গিয়েছি আমি যে বৃষ্টিতে ভিজতে বড়োই ভালোবাসি, বৃষ্টির দিনে আমাকে কেউ আটকে রাখতে পারতো না ঘরে। আকাশ কালো হতে দেখলেই আমি হারিয়ে যেতাম মেঘের কান্নার মায়ায়। সেই আমি আজ বৃষ্টি দেখলে অন্য সবার মতোই লুকিয়ে পড়ি, নিজেকে বাঁচাতে চাই বৃষ্টি থেতে। অথচ এই আমিই কিনা একদিন এই বৃষ্টির জন্য কতটা আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে বসে থাকতাম।
আমার মাঝে মাঝে ইচ্ছে হতো আমি যদি পাখি হতে পারতাম, বৃষ্টির মাঝেও তবে সারাদিন উড়ে বেড়াতে পারতাম। কি মজাই না হতো! কেউ আমাকে বাঁধা দিতে পারতো না। স্বাধীনতা নিয়ে একা ও-ই আকাশে বৃষ্টির জলে শুধুই ভিজতাম। কিংবা আমার একটি পাখির দল থাকতো যারা শুধু বৃষ্টি দেখলেই আমার মতো আকাশে উড়াল দিতো…
পাখি আর আমি হতে পারিনি, হয়েছি এক ভীরু যান্ত্রিক পথিক। যার সারাদিন বদ্ধ দেয়ালের মাঝেই কেটে যায়। টানাপোড়েনে আজ হারিয়ে গেছে বৃষ্টির মতো কতোশত প্রিয়বন্ধু, কতশত প্রিয় ইচ্ছে আমার….।