সামাদ স্যার ক্লাসে ঢুকলেন। যথারীতি এ্যাটেনডেন্স খাতা খুলে রোল কল করতে লাগলেন। এটা চলছে ৫ম পিরিয়ড। এ পিরিয়ডে রোল কল! কারণ হচ্ছে টিফিন আওয়ারের পরে অনেক ছাত্রই ইদানিং স্কুল পালাচ্ছে, তাদের আইডেনটিফাই করতেই এই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। সামাদ স্যার আবার ভীষণ কড়া শিক্ষক এবং বাংলা পড়ান। গ্রীষ্ম কে গ্রীষমো বললে ভীষণ ক্ষেপে যান। এরকম বাংলা শব্দের আরও অনেক বিকৃত উচ্চারণ শুনলে তিনি যারপর নাই রেগে ওঠেন, বলেন- “তুমি কী বাঙালি নাকি বাংলা ভাষা নিয়ে ফাজলামো করো? তুমি বাংলা না জানলে তো তোমার জন্মটাই বৃথা।
মাতৃভাষাকে ভালোবাসতে, সম্মান করতে শিখো। নচেৎ, দেখো একদিন তোমার অস্তিত্বই বিলীন হয়ে যাবে। এই বাংলা ভাষা আমাদের ভাষা শহীদদের নিরন্তর আত্মত্যাগের ফসল। অতএব, ভাষা শহীদদের প্রতি অসম্মান আমি কিছুতেই বরদাস্ত করবো না।”
আজ স্যার রোল কল শেষে বেশ কয়েকজন ছাত্রের অনুপস্থিতি লক্ষ করলেন এবং তাদের নামের পাশে লালকালি দিয়ে মার্ক করে বললেন- “আগামীকাল এদের খবর আছে।” তারপর এক এক করে সব ছাত্রদের জিজ্ঞেস করতে লাগলেন- “এই তুমি জীবনে কী হতে চাও, মানে তোমার জীবনের লক্ষ কী? কেউ কেউ বললো- স্যার, আমি ডাক্তার, আমি ইঞ্জিনিয়ার, আমি উকিল, আমি সরকারি কর্মকর্তা ইত্যাদি হতে চাই। তাদের মধ্য থেকে একজন বলে উঠলো-“স্যার, আমি ক্যানভাসার হতে চাই স্যার”। একথা শুনে ক্লাসের সকলে হো হো করে হেসে উঠলো। স্যার চিৎকার দিয়ে বললেন- “এই চুপ, একদম চুপ। ও-তো সৎসাহস নিয়েই ওর মনের ইচ্ছেটা বলেছে, এতে এতো হাসির কী হলো? বি পজেটিভ বয়। কেন, ওতো জীবনে বড় কোন কোম্পানির মার্কেটিং কর্মকর্তাও হতে পারে? মনে রাখবে, যে যেটাতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করে তার জীবনে সেটা হওয়াই যুক্তিযুক্ত, বুঝলে।”
আবির পেছনের বেঞ্চে বসে ছিলো তাকে দেখে সামাদ স্যার বললেন- “কী ব্যাপার আবির, তুমি ক্লাসের ফার্স্ট বয়, অথচ আমি বেশ কিছুদিন থেকে লক্ষ করছি তুমি বরাবর ব্যাক ব্রেঞ্চার! ব্যাপারটা আসলে কী আবির?” আবির বললো- “তেমন কিছু না স্যার, আমি আসলে অবজারভ করি।” স্যার বললো- “স্ট্রেঞ্জ! অবজারভ করো, মানে কী? তা… তুমি জীবনে কী হতে চাও আবির?”
আবির বললো- “স্যার, আমি সব হতে চাই।”
স্যার বললেন- “সব হতে চাও! মানে তোমার জীবনের কী কোন নির্দিষ্ট লক্ষ নাই?”
আবির বললো- “ঠিক তা-না স্যার, লক্ষ আছে বলেই তো আমি সব হতে চাই।”
স্যার বললেন- “কী জানি বাপু ঠিক বুঝলাম না। সে যাক, জীবনে যাই হওনা কেন, একটা কথা সকলকেই বলে রাখছি, সকলে ভালো করে মনে রাখবে।
তাহলো, সর্বপ্রথম তোমরা ভালোমানুষ হও। তাহলেই তোমাদের জীবন সার্থক হবে। আর মানুষ হতে না পারলে জীবনের সকল সাফল্যই একদম বৃথা, বুঝতে পেরেছো।”
আবিরের বয়স ৫৫ পেরিয়ে গেছে। আজ এই গুমোট সকালে মনটা কেমন যেন তার আনমনা হয়ে আছে। এদিকে শীত পড়বে পড়বে ভাব চলছে। ভোরের দিকে এখন মোটামুটি কুয়াশা আচ্ছন্ন হয়ে থাকে প্রকৃতি। আজ আবার একদম সূর্যের দেখা মিলছে না। কেমন যেন একটা গুমোট গুমোট ভাব প্রকৃতি জুড়ে, সাথে শিরশির হালকা শীতের ঠান্ডা বাতাসও বয়ে যাচ্ছে। চারিদিকে প্রকৃতিটা যেন নিস্তব্ধ হয়ে আছে। আবির তার দোতলার বারান্দায় আরাম কেদারায় গা এলিয়ে দিয়ে আনমনে দূর মেঘাচ্ছন্ন আকাশ ও প্রকৃতির রূপ পর্যবেক্ষণ করছে আর থেকে থেকে দূর অতীতে হারিয়ে যাচ্ছে। আজ আবার শুক্রবার, ছুটির দিন। জাতীয় সে একটি দৈনিকে সহযোগী নিউজ এডিটরের কাজ করে। তার একমাত্র মেয়ে কানাডায় ‘ইন্টারন্যাশনাল লিটারেচার’ বিষয়ে অধ্যয়ন করছে। সে-ও ঠিক বাবার মতোই ভালো স্টুডেন্ট কিন্তু ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে না পড়ে বেছে নিয়েছে এই সাবজেক্ট। আবিরের ওয়াইফ সে-ও একজন উচ্চশিক্ষিতা, বর্তমানে বিদেশি দূতাবাসে বড় পদে চাকুরিরত। আর আবির এস.এস.সি ও এইচ.এস.সি তে যথাক্রমে মেধা তালিকায় ৩য় ও ৭ম স্থান অধিকার করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে সরকারি চাকুরিতে জয়েন করেছিলো কিন্তু মাত্র একমাস সে চাকুরি করে। তার এই বাঁধাধরা জীবন তার পছন্দের নয়, তাই তা ছেড়ে দিয়ে সে পত্রিকার সঙ্গে জীবনের গাঁট বেঁধেছে। অবশ্য ছোট বেলা থেকেই সে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও লেখালেখি নিয়ে মনে একটা বিশেষ টান অনুভব করতো এবং কমবেশি লেখালেখিরও চেষ্টা করতো। ছোটবেলায় সে বাংলাদেশ শিশু একাডেমিতে ছবি আঁকা শিখতো, বিতর্কে অংশগ্রহণ করতো ও যথারীতি প্লেসও করতো। সেসময় থেকেই তার মনে একটা সুপ্ত বাসনা সে লালন করতো, মনে মনে স্বপ্ন দেখতো সে একদিন একজন বড় কবি হবে, লেখালেখি করবে এবং লেখার প্লটে সবার চরিত্রের মাঝে নিজেকে ফুটিয়ে তুলবে, যেমনঃ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পাইলট, সায়েন্টিস্টসহ সমাজের সকলের চরিত্র। তাই তো সে ঐ দূর অতীতে সামাদ স্যার’র ক্লাসে স্যারকে বলেছিলো- “সে সব হতে চায়”। আজ এই মুহূর্তে তার বড়বেশি মনে পড়ে যাচ্ছে কানাডায় থাকা তার মেয়ের কথা, সেই দূর অতীতের কথা, স্কুল জীবনের কথা, ক্লাসের কথা এবং বিশেষ করে সামাদ স্যারের সেই অমলিন কথা- “জীবনে সবার আগে তোমরা ভালো মানুষ হও।”
আবিরের ভাবনার ভেতরে স্যারের কথাটা বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। সে মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করেই চলছে- “আজ তো আমি আমার জীবনে নিজের ইচ্ছেটা পুরণ করতে পেরেছি সৃষ্টিকর্তার অসীম আশীর্বাদে যেমনঃ আজ আমি কবি, গল্পকার, উপন্যাসিক, নাট্যকার এবং একজন জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত স্বনামধন্য লেখক। সাহিত্য মহলে এখন আমার অনেক নামডাক আমার বইয়ের কাটতিও এখন অনেক ভালো। তাইতো প্রকাশকরা এখন আমার একটা উপন্যাস পাওয়ার জন্য বারবার আমার দোরে ধর্ণা দিয়ে থাকেন। কিন্তু এতোকিছুর পরেও আমি কী সত্যিকার অর্থে একজন ভালোমানুষ হতে পেরেছি? আসলে একজন ভালো মানুষের সংজ্ঞাটাই বা আসলে কী? আজ যে বড়বেশি সামাদ স্যারকে মনে পড়ছে, স্যার’র কাছে খুব জেনে নিতে ইচ্ছে করছে- স্যার, আসলে সত্যিকার অর্থে ভালোমানুষ এর সংজ্ঞাটা কী স্যার? কিন্তু তাতো এখন আর সম্ভব নয়, স্যার যে এখন ঐ দূর পরবাসে।”
আবিরের চোখের কোনে কুয়াশাসিক্ত জল টলমল হয়ে খেলা করতে করতে মাটিতে গড়িয়ে পড়লো!
এদিকে আগমনী শীতের হিমহিম ঠান্ডা বাতাস শিরশির করে জানালার পর্দায় দোল খেতে খেতে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলো….