(পর্ব-৫)
কেউ বলেনি, এখনও জীবন আছে, ফিরে আয়।
নিলয়কে তখন কত টুকরো টুকরো কথাই না বলেছে। এইসব ছোট ছোট ব্যাপার কেন লাগে, কোথায় লাগে, আর কেন তা এত বড় হয়ে দেখা দেয় রাত্রি নিজেও বুঝতে পারে না। শ্রাবণ কফি ভালবাসে, চা একেবারেই নয়। এদিকে বাপের বাড়িতে ছোটবেলা থেকে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা রাত্রির চা না হলে চলে না। এটা এমন কিছু একটা বিপর্যয় নয়, রাত্রি নিজেও জানে।
নিজর দুঃখের প্রসঙ্গ টেনে এনে একদিন সে সব কথা নিলয়কে শোনাতে গিয়ে বলেছিল, কোথায় লাগত জানেন, এই যে আমি মনে করে রেখেছি, ওর কফিতে কতটা দুধ, ক’চামচ চিনি, ক’টার সময় ওর কোথায় কোথায় প্রোগ্রাম, অথচ ও আমার জন্য ….
নিলয় শুধু হেসে চুপ করে গেলেও ভাল ছিল, তার বদলে ও বলে উঠল, আসলে রাত্রি, তুমি আগে থেকেই তোমার ভালবাসার মানুষকে, তার সবকিছুকে অপছন্দ করে ফেলেছো। সে কারণেই ছোটখাটো জিনিসগুলো বড় হয়ে দেখা দিত।
কথাটা হঠাৎ যেন একটা নাড়া দিল রাত্রিকে। ঠিক এভাবে ও কোনদিনও ভেবে দেখেনি। খুঁজে দেখার চেষ্টা করল ঠিক কবে থেকে ও শ্রাবণকে অপছন্দ করতে শুরু করেছিল। ভালবাসার পর মানুষটাকেই কী ও অপছন্দ করতে শুরু করেছিল, নাকি ওর ওপর অধিকার খাটাতে চাইতো সেই ব্যাপারটাকেই ও পছন্দ করতে পারতো না। শ্রাবণকে রাত্রি এখন আর তেমন সহ্য করতে পারে না, না পারারই কথা, কারণ এখন ওর মনে হয় এই লোকটা ওর স্বপ্নই ভেঙে দেয়নি, জীবনটাই নষ্ট করতে চেয়েছিল। কিন্তু এখনকার ব্যাপারটা পুরোটাই ভদ্রতা।
তখন রাত্রির মধ্যে আর কী বা ছিল, শুধু নিঃসঙ্গতা ছাড়া।
না, তখন আর বাবা-মা বলত না তুই ভুল করছিস। স্পষ্ট করে ওরা না বললেও, মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারত ওরা বলতে চাইছে, তুই ভুল করেছিলি, এখন বুঝতে পারছিস তো! জীবনে এর চেয়ে আর বড় লজ্জা কি হতে পারে। কী ভুলই না করেছিল ও।
তখন ওর যে কী হয়েছিল কে জানে। শ্রাবণের নেশায় পড়ে গিয়েছিল হয়ত। মানুষটাকে আদৌ চিনতে পারেনি। নাকি নিজেকেই চিনতে পারেনি! বাবা-মা, বন্ধু-বান্ধব সকলেই বারণ করেছিল। কারও কথা কানে নেয়নি। মনে হয়েছে ওর চারপাশের সকলেই শত্রু।
শেষ অবধি বাবা বলেছিল, যা ভাল বুঝিস।
কত কি রঙিন স্বপ্ন দেখেছিল। বিয়েটা যে শেষ অবধি এভাবে, এত সহজে ভেঙে যাবে কল্পনাও করিনি। এক ছাদের নিচে না থাকলে কোন মানুষকেই চেনা যায় না। যত দিন না ডিভোর্স হয়ে গেছে, রাত্রির মনে হয়েছে ওকে কে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। তখন শুধুই রাগ আর ক্ষোভ তীব্র ঘৃণা। জালে আটকে যাওয়া পাখির মত ছটফঠটানি। কেমন একটা অনিশ্চয়তা আর ভয়। কোন দিক থেকে অচেনা একটা জটিলতা এসে দেখা দেবে সেই আতঙ্ক। ছাড়া পাওয়ার জন্য কি অধৈর্য ব্যাগ্রতা। এক একটা দিন যেন এক একটা বছর। যেন কতকাল রাত্রি বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পায়নি। অথচ ওদের বিয়েটা এক মাসও টেকেনি।
বাবার কথাটা কানে গেল- যাঃ সব পিছুটান শেষ।
দূরে দাঁড়ানো শ্রাবণের দিকে একবারেই চোখ পড়েছিল, দ্বিতীয়বার ফিরে তাকায়নি রাত্রি। তখন ওর মনে শুধুই ঘৃণা। একটু আগে পর্যন্ত ছিল একটা দুর্বোধ আতঙ্ক। শেষ মুহূর্তে না কোনও আইনের ফাঁকে সব ভেস্তে দেয় ওই লোকটা। কিন্তু উকিল ভদ্রলোক যেই হেসে হেসে বললেন, শুনলে তো, ডিভোর্স হয়ে গেল, অমনি এক দমকা উজ্জ্বল আনন্দ ওর বুকের মধ্যে তুবড়ি জ্বালিয়েই কেমন নি®প্রভ হয়ে গেল।
হঠাৎ রাত্রির নিজেকে বড় বেশি নিঃশ্ব মনে হল। ক্রোধ আর ঘৃণা সামনে এতদিন একটা লক্ষ্য এনে রেখেছিল। ওই লোকটার হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে হবে। অথচ সঙ্গে সঙ্গে মনে হল সামনে আর যেন কোনও লক্ষ্য নেই। শুধুই শূন্যতা। বাবার কথাটাই শুধু কানে বাজছে; যাঃ আর কোন পিছুটান রইল না।
রাত্রি ভেবেছিল ক্রোধ, ক্ষোভ আর ঘৃণা থেকে ও একেবারে মুক্তি পেয়ে যাবে, ছেড়ে আসার পর শ্রাবণের কাছ থেকে একেবারে ছাড়া পেয়ে গেল। যেন সঙ্গে সঙ্গে মানুষটাই পৃথিবী থেকে উবে যাবে, কোনওদিন আর রাত্রির চোখের সামনে পড়বে না, এ রকম একটা ধারণা ছিল।
বাবা ফিরতে ফিরতে পাশে বসা রাত্রিকে বলেছিল- আবার মুখ ভার করে আছিস কেন? প্রাণ খুলে হেসে ওঠ। তোর তো উচিত ছিল ওই কোর্ট রুমেই হেসে হেসে কথা বলা, দ্যাখানো দ্যাট ইউ আর এ ফ্রি ওম্যান্য। স্বাধীন-সুখী। মুখের মত জবাব হত, ওই হাসি।
রাত্রি চুপ করেই ছিল, কোন কথা বলেনি।
বাড়িতে ফিরে বাবা বলেছে, মনে কর আজ থেকেই তোর জীবন শুরু, আগের জীবনটা শুধুই একটা দুঃস্বপ্ন। আমি তোর আবার বিয়ে দেব। আর আমার সেই গরীব বাবা আবার আমার বিয়ের ব্যবস্থা করলেন। এখন আমি নিলয়ের বউ। এবং সুখী। আর সেটা রাতুলের কারণেই। ওর দিকে তাকিয়ে একটাই কথা মনে হয়, আমার ছেলে, আমার রক্তমাংস দিয়ে গড়া। ও চিরকাল আমারই থাকবে।
বাবাকে অনেক অপমান সইতে হয়েছে, অনেক কষ্ট পেয়েছে। মা হয়ত আরও বেশি, শুধু তার একটি ভুলের জন্য। মাঝে মাঝেই নিজের দুঃখের কথা, কষ্টের কথা, কোনও অসহ্য ঘটনার কথা এই এক জায়গাতেই ও উজার করতে পারে। নিলয়ের কাছে। এখানেই শুধু কেঁদে হাল্কা হতে পারে। সান্তনা পায় সঙ্গে উপদেশও। এই নিলয়ের কারণেই শ্রাবণ আবার এ বাসায় আসতে শুরু করেছে। এটা নিলয়ের উদারতা নাকি অন্য কিছু রাত্রি তা এখনও জানে না।
নিলয় ফিরেছিল বেশ রাত করেই। রাত্রি জানতো নিলয় দেরি করেই ফিরবে। বিশেষ দিনগুলোতে নিলয়ের এই দেরী করে ফেরা ওর দিক থেকে খারাপই লাগে, কারণ বাড়িতে থাকলে নিলয় দেখতে পেত। সারাক্ষণ ও দূরে দূরে থাকে। রাতুল ডেকে কোনও কথা বললেও দূর থেকে উত্তর দেয়। স্বাভাবিকতা দেখানোর জন্য কোনও না কোনও কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখে।
প্রথম প্রথম শ্রাবণকে কি ভয়ই না পেত। ভয় ঠিক শ্রাবণকে নয়, রাতুলকে। ওইটুকু বাচ্চা ছেলেও কী বোঝে। কোনটা আসল ভালবাসা আর কোনটা নকল ভালবাসা তা বোঝার বয়স কী ওর। কথাটা মনে আসতেই হেসে উঠল। বয়সের কথা ভাবছে কেন, মানুষ চেনা কি এতই সহজ? রাত্রির তো যথেষ্ট বয়স হয়েছিল, বুদ্ধিসুদ্ধিও কম নয়, তাহলে ওই বা কেন শ্রাবণকে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে উঠেছিল। সেসব দিনের কথা মনে পড়লেই লজ্জায় অনুশোচনায় নিজের মধ্যেই নিজে মুষড়ে পড়ে।
সবচেয়ে ভাল বন্ধু, সেই স্কুল থেকে কলেজ অবধি, কনা আরও কে কে বলেছিল, তুই কী পাগল হয়ে গেছিস, ওকে ওই লোকটাকে তোর এত পছন্দ? বিয়ে করবি?
ও তখন প্রেমে অন্ধ। মানুষ যে প্রেমে অন্ধ হয় তা ও নিজের জীবন দিয়েই বুঝতে পেরেছে। শ্রাবণের কোনও কিছুই ওর খারাপ লাগত না। কেন যে লাগেনি, নিজেই জানে না। সে সময় ওর ভেতর থেকে সব যুক্তিবুদ্ধি যে উবে গিয়েছিল তাই নয়, ভদ্রতা কর্তব্যবোধ এ সবও হয়ত ছিল না। তা না হলে বাবা-মা’র সাথে ওভাবে কথা বলত।
রাত্রি তখন শ্রাবণের প্রেমে পাগল। আর কাউকে বিয়ে করার কথা ভাবতেই পারে না। মা বাধা দেওয়ার ফলে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলেছিল, কেন, খারাপটা কী দেখলে তোমরা? বাবাকে বলে দিও তোমাদের মত না থাকলে আমি বেরিয়ে গিয়েই ওকে বিয়ে করব।
ব্যাস এ কথার পর আর কোনও কথাই খাটে না।
তবুও বাবা পিঠে স্নেহের হাত রেখে বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন। স্নেহের হাতটাকে তখন রাত্রির কাছে বিছুটি মনে হচ্ছে। স্নেহ না ছাই, এসব বাবার পলিসি। মত বদলানোর চেষ্টা। তাই গলার স্বর ঝাঁ ঝাঁ । – যুক্তি দিয়ে বলোনা কী খারাপটা দেখলে ওর মধ্যে।
বাবা তখন বলেছিল, সব কি যুক্তি দিয়ে বোঝানো যায়। ওকে দেখলেই আমার মনে হয় তুই ওখানে সুখী হতে পারবি না। শুধু মুখ দেখেই মনে হয়েছে।
ঠিক যেন বাবাকে অপমান করার জন্যই অট্টহাসি হেসে উঠেছিল রাত্রি। হাসতে হাসতেই বলেছিল, শুনলে মা, শুধু মুখ দেখেই মনে হয়েছে। সেই বাবার কথাটাই ফলে গিয়েছিল বলে, রাত্ররি বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠত। কলেজের বন্ধুরা শ্রাবণকে বিয়ে করতে নিষেধ করেছিল বলে তাদেরকেও রাত্রি অপছন্দ করা শুরু করেছিল। ভেবেছিল, স্রেফ হিংসে। শ্রাবণকে বিয়ে করাই ওরা সহ্য করতে পারছে না। এ সমস্ত কথাই ও দিনে দিনে নিলয়কে বলেছিল। নিলয় সবই জানে।
মানুষে মানুষে সম্পর্ক জিনিসটা বড় অ™ভুত। এক একজনের সঙ্গে সম্পর্ক মানে একজন মানুষের ছোট ছোট অনেকগুলো অংশ। টুকরো টুকরো ভাবে কেউ বাবার, কেউ মায়ের, কখনও স্বামীর কিংবা স্ত্রীর, কখনও সন্তানের কখনও বন্ধু, কখনও সহকর্মীর। আরও কত রকমের সম্পর্ক আছে। এই সম্পর্কগুলো থেকেই একজন মানুষের এক এক টুকরো পৃথক চরিত্র বেরিয়ে আসে। তার কোন একটিকে নিয়ে মানুষটাকে বিচার করা যায় না। সম্পর্ক যত গাঢ় আর অন্তরঙ্গ হোকনা কেন গোটা মানুষটার ওপর আমাদের কোনও অধিকার নেই। সেই সম্পর্কটুকুর বাইরে তার আলাদা একটা অস্তিত্ব থাকে, কিন্তু কেউ সেটা মনে রাখে না। সেই অস্তিত্ব আসলে একজন মানুষের আরও অনেক টুকরো টুকরো অংশ।
রাত্রি নিজেও এসব কথা মাঝে মাঝে ভাবে, বুঝতেও পারে। মুশকিল হল এই যে, কেউই সে কথা বোযে না। সম্পর্ক যাই হোক না কেন সে গোটা মানুষটাকেই নিজের করে নিতে চায়। যেন তার নিজস্ব সম্পত্তি। আমার মতো তোমার এই সম্পর্কের বাইরে তোমার আর কোনও অস্তিত্ব থাকতে পারবে না।
নিলয় তো সবই জানে। কিন্তু সেও কেন রাত্রির সব অস্তিত্ব গ্রাস করে একা ওর সম্পত্তি ভাবতে বসেছে। তাই কি খবরের কাগজ পড়তে পড়তে ঠাট্টা করে বলেছিল সেই ছোট শব্দটি ‘ও’।
যা যেখানে আছে সব পড়ে থাক, ভুল করে থাকা অসুখী জীবনটার মতই। ওর বাবা-মা’র সব আপত্তি, সব যুক্তি যখন রাত্রি উড়িয়ে দিয়েছে তখন বাধ্য হয়েই ওরা এ বিয়েতে রাজি হয়েছিল। আর বিয়ের পরতো বাবা-মা দুজনেই খুশি হয়েছিল। রাত্রি তখনই ভেবে নিয়েছিল ওর একটাই কর্তব্য। শ্রাবণ আর ও যে সঙ্গী হতে পারবে সেটা প্রমাণ করে বাবা-মা’কে সুখী করা। কিন্তু শেষ অবধি পারল না। এমনকি ভেতরের যন্ত্রণা চেপে রেখে এক ছাদের নিচে কাটিয়ে সুখী জীবনের অভিনয় দিয়ে বাবাকে মাকে সুখী করে তুলবে তারও উপায় রইল না। মাত্র এক মাসের মাথায় তারা দুজন একেবারেই আলাদা হয়ে গেল।
আত্মসম্মানে লাগছিল। তবুও রাত্রি রান্নাঘর থেকে বেররিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। রাতুলের সামনেই শ্রাবণকে বলে বসলো- তোমার কাছে আমার একটাই রিকোয়েস্ট, এ বাড়িতে তুমি আর কখনও এসো না।
নিস্তরঙ্গ পুকুরে ঢিল পড়লেও তরঙ্গ ওঠে বইকি। তবে সেই তরঙ্গের স্থায়িত্ব আর কতটুকু? দশ সেকেন্ড, বিশ সেকেন্ড, বড় জোড় এক মিনিট! এ তরঙ্গ বড় মৃদু, শক্তিহীন। দুর্বল বৃত্তাকার ঢেউ হয়তো এক সময় কাঁপতে কাঁপতে পাড়ে এসে পৌঁছায়, কিন্তু তখন তার অস্তিত্বই অনুভব করা কঠিন। স্থির পুকুরের দিকে তাকিয়ে কে তখন বলবে, একটু আগে ঢিল পড়েছিল এখানে।
শ্রাবণের আগমন রাত্রির কাছে অনেকটাই এই গোত্রেরই। শ্রাবণকে নিয়ে এখন সে তেমন একটা ভাবে না। সে ভাবে তার স্বামী, সংসার, ছেলের কথা। তার সময় কাটছে এদের ভাবনাতেই। সময়কে ছুঁয়ে ছুঁয়ে পার করছে সময়। অথবা সময় কাটছে না।
তাতেই বা রাত্রির কি এল গেল? সময়তো আর সত্যি সত্যি নিশ্চল, অনড় এক পাহাড় নয়, যেমন ভাবেই হোক সে ঠিক গড়িয়ে গড়িয়ে এগিয়ে যাবে।
যাচ্ছেও তো। একেকজন লোক আছে যাদের হঠাৎ মনে হয় পরম আশ্রয়। নিলয় ঠিক সেরকমই। সেই সময়ের কষ্টের কথাগুলো ও যখন নিলয়কে বলতো, সহানুভূতি, সমবেদনা সব তখন ওর কাছ থেকেই পেত।
বুকের মধ্যে এই অশান্তি আর কষ্ট চাপা রাত্রির কোনও কোনও নির্জন দুপুর সেসব কথা মনে পড়িয়ে দিয়েই ওর চোখে পানি এসে যেত। এমন একটা স্বপ্রসঙ্গের দিন ওর জন্য অপেক্ষা করে আছে কোনও দিন কল্পনা করেনি। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল যেন, প্রেম ভালবাসা ছাড়াও যে পার্থিব জীবনে আরও কত কী আছে, তার কিছুই তখন চোখে পড়েনি। রাত্রি তখন ভালবাসার অন্ধ গলিতে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। শ্রাবণকেও ভাল করে বুঝে ওঠার মত দৃষ্টি ছিল না।
ছোট ছোট ঘটনা, একটুকরো বাঁকা কথা, সামান্য তাচ্ছিল্য মেয়েদের মনে কখন কী যে জ্বালা ধরিয়ে দেয়, নিজের কাছেই নিজেকে ছোট করে দেয় তা বোঝার মত বোধশক্তি শ্রাবণের ছিল কিনা সন্দেহ হয় রাত্রির।
শ্রাবণের কি দোষ দেবে, বিয়ের পর মাত্র এই কটা দিন এর মধ্যেই ওকে কেন সব ছিঁড়ে ফেলে বেরিয়ে আসতে হল তা কি কেউ বুঝবে? অন্য কাউকেও বোঝাতে পারবে! যার বুকের মধ্যে জ্বালা সেই বোঝে, আর সকলেই উপদেশ দেন, মানিয়ে নে, মানিয়ে নে, যেমন রাত্রি নিজেই মানিয়ে নিতে চায়নি।
মদ খেলে মাতলামি করতে করতে বাড়ি ফিরে বউকে ধরে পেটালেই লোকে সেই অসহায় বউটার জন্যই সহানুভূতি জানায়, কষ্ট পায়, সাহস জুগিয়ে বলে, আছিস কেন; বেরিয়ে যা। শারীরিক নির্যাতনই যেন একমাত্র নির্যাতন। আগুনে পোড়া খুব কষ্টের, কিন্তু মনের ভেতরের আগুন যখন কাউকে পুড়িয়ে ছাই করে দিতে থাকে, তার কষ্ট বাইরের কেউ টের পায় না। বোঝেও না হয়ত।
সেই অসহ্য দাহ থেকে মুক্তি পাবার জন্যই তো রাত্রি সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আশা করেছিল জ্বালাটা একদিন নিবে যাবে, নেবেনি।
– আমাকে যদি তোমার এত অসহ্য লাগে তা হলে তখন বিয়ে করার জন্য পাগল হয়েছিলে কেন?
এই কথাটাতো রাত্রির নিজেরও প্রশ্ন, নিজেই নিজেকে করেছে বহুবার। কিন্তু শ্রাবণের কাছ থেকে প্রশ্নটা আসতেই রাগে ফেটে পড়ে দাঁতে দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বলেছিল, কারণ তখন জানতাম না তুমি এত নিচ।
রাত্রি তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল এ বিয়ে ভেঙ্গে যাবে, ভেঙ্গে ফেলাই উচিত। তবু একটা সঙ্কোচ, একটা লজ্জা ছিল। কেন সঙ্কোচ, কেন লজ্জা তা হয়ত শ্রাবণও জানতো। তাই হয়ত ওর বিশ্বাস গড়ে উঠেছে, নতুন বউ, বিয়ে ভেঙ্গে দিয়ে ফিরে যাবার সাহসই হবে না। কারণ এখন আর ওর ফিরে যাবার কোনও ঠিকানা নেই। এক এক সময়ে অবশ্য রাত্রি নিজেরই সন্দেহ হয়েছে, শ্রাবণের এই উদাসীন শান্ত ব্যবহারের মধ্যে আসলে রাত্রির কাছ থেকে ছাড়া পাবার একট আগ্রহ লুকিয়ে নেই তো? এই বাড়িটাকে ও কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারছিল না। ওরাও কী ভেবেছে রাত্রিকে এ বাড়িতে মানায় না।
রাত্রি এতদিন তার বাবা-মা’র কথা চিন্তা করেই বেরিয়ে আসতে পারেনি। কিন্তু যখন আর সহ্য করতে পারছিল না, তাই বেরিয়ে এসেছিল ও বাড়ি থেকে।
ইচ্ছে করলে শ্রাবণের জন্য একটা ছোট্ট চিঠি রেখে দিয়ে আসতে পারত, কিন্তু সেটা করেনি। বাইরে এসে ফোনের দোকান থেকে ফোন করেছিল। রিসিভারটা মুখের কাছে এনে, দোকানের লোকটাকে দেখে নিয়ে রাত্রি বলল- আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছি, ফিরে যাওয়ার আর প্রশ্ন ওঠে না।
ও প্রান্তে শ্রাবণ কয়েক সেকেন্ড একেবারে চুপ। এরকম একটা কথা হঠাৎ শুনতে হবে হয়ত ভাবেনি। তারপর শান্ত গলা- কি পাগলামী করছ।
রাত্রি বলল- আমি বাড়ি থেকে ফোন করছি না, বেরিয়ে এসে রাস্তার বুথ থেকে ফোন করছি। আবার কয়েক সেকেন্ড চুপ। তারপর শ্রাবণের গলা। বাড়ি ফিরে যাও, অফিস থেকে ফিরে সব শুনবো।
উত্তরোত্তর রাগ করছিল রাত্রির, অসহায় লাগছিল, কারণ এই সরল কথাটা ও কিছুতেই শ্রাবণকে বিশ্বাস করাতে পারছে না। রাত্রি নিজেকে সংযত করল, ও একটুও রাগবে না। ধীরে ধীরে বলল, ভুল আমারই। বন্ধুরা, সবাই বারণ করেছিল শুনিনি, বাবা-মা’র কিরকম আপত্তি ছিল তাও তুমি জানো।
শ্রাবণের কণ্ঠস্বর বিব্রত। বলল, অফিস থেকে কথা বলা অসুবিধে, তুমি ফিরে যাও, সব শুনবো তখন।
রাগের মধ্যেও রাত্রির হাসি পেল। লোকটা মানে শ্রাবণ ভাবছে এরপরও আগেরমত ধানাইপানাই করে ওকে শান্ত করা যাবে। রাত্রি এবার গলায় একটু রূঢ়তা আনল। বলল, অত সময় নেই, আমি বাবার বাড়িতে যাচ্ছি না; কোন মুখে যাবো। কিন্তু যেখানেই যাই তোমার কাছে ফিরে আসবো না। তোমার কাছে একটাই রিকোয়েস্ট, তুমি আমার খোঁজ করবে না। আমি চাই না, বাবা-মা জানুক … এখনই … কষ্ট পাবে।
ওপ্রান্ত এবোরে চুপ।
রাত্রি বলল, কী কথা দিচ্ছ তো?
কোনও উত্তর শোনা গেল না। কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে রিসিভার নামিয়ে রাখর রাত্রি। আর সঙ্গে সঙ্গে মনে হল ওর চতুর্দিকে শুধু একটা বিরাট শূন্যতা। এতক্ষণ তার আভাসটুকুও পায়নি। কারণ মাথার মধ্যে এতক্ষণ একটাই চিন্তা ঘুরছে। একটাই দুশ্চিন্তা। বাবা-মা। একবার মনে হয়েছিল সটান বাবা-মা’র কাছে ফিরে যাবে। মেয়েদের কাছে ফিরে যাবার জায়গা তো একটাই। সকলে।ি যায়। সংসার ভেঙ্গে গেলে আর কোথায়ই বা যাবে।
(চলমান…)