মুগ্ধতা ব্লাড ব্যাংকে আপনার দেওয়া তথ্য বাঁচাতে পারে একটি জীবন। আপনার তথ্য দিন, প্রয়োজনে রক্ত খুঁজুন এখানে।

মনের আধাঁর পেরিয়ে (পর্ব-৮)

পল্লব শাহরিয়ার

২৩ অক্টোবর, ২০২০ , ১০:১২ অপরাহ্ণ

মনের আধাঁর পেরিয়ে (পর্ব-৮)

(পর্ব-৮)

অনেকক্ষণ আগেই বাড়িতে আলো জ্বেলে উঠেছে। এ সময় কত কী কাজ আছে, সকলেই কিছু না কিছুতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। রান্নাঘর সামলাতে যায় মা, রাতুলকে পড়াতে বসায় রাত্রি। রাত্রি দূর থেক্ েচিৎকার করে বললো, বাবা, তারুলের পড়ার সময় হয়ে গেছে।

ওই লোকটি, অবাঞ্চিত একটা লোক হয়ে গেছে যে শ্রাবণ, কিছুকাল আগেও এ বাড়িতে এলে জামাই আদর পাক বা না পাক, একটা সৌজন্য দেখাতে কেউ কার্পণ্য করতো না। এখন হয়ে গেছে ্কটা বিব্রতকর শুঁয়োপোকা। ঝাটায় ডগায় তুলে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারলেই যেন শান্তি। শুধু ওই লোকটার উপস্থিতির কারণে সারা বাড়িটাই স্থির হয়ে গেছে। স্থির করে দেওয়া ভিডিও ছবির মতন, চলে গেলেই আবার সচল হবে।

শ্রাবণ চলে যাবার সাথে সাথে রাতুল একটা ব্যাগ হাতে লাফাতে লাফাতে এল, বেশ খুশি। সঙ্গে সঙ্গে রাত্রির সমস্ত মন বিস্বাদ হয়ে গেল।

হাসি হাসি মুখে রাতুল বললো- কাকু কত কী দিয়ে গেল দেখ মা। ব্যাগ থেকে একটা ক্যাডবেরি বের করে বললো- কত বড় দেখ।

রাত্রির মুখ ততক্ষণে ক্রুদ্ধ কঠিন। ক্যাডবেরি আর ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে বললো, এসব আমি তোমাকে কিনে দেব, আমি কিনে দেবো।

প্রথম প্রথম এই ভুলটাই তো করতে বসেছিল রাত্রি। ভাবত, রাতুল শুধুই আমার। এত স্নেহ, মমতা ভালোবাসা দিয়ে মানুষ করে তুলছে, সে তো শুধু আমার। আমাকে সেই ভালবাসা ফিরিয়ে দেওয়া ছাড়া তার যেন আর কোনো অস্তিত্ব না থাকে। তার ভবিষ্যৎ, তার ভালমন্দ বিচার, সবাই আমার দায়িত্ব।

অথচ শ্রাবণ এলেই কেমন খুশি হয়ে ওঠে রাতুল। বেশ খুশি খুশি ভাবেই একদিন বলেছিল, আজ কাকুর আসার দিন, না মা?

ওর ওই খুশি খুশি ভাব, মুখের হাসি বিষাক্ত তীর হয়ে এসে বিধত রাত্রির বুকে। ওর নিজের মুখটাই বিবর্ণ হয়ে যেত। ভিতরে ভিতরে ছেলের ওপর রেগে যেত। কী অকৃতজ্ঞ, কী অকৃতজ্ঞ। তোকে মানুষ করে তুলব, বড় করে তুলব বলেই এত কষ্ট সহ্য করছি। অথচ তুই….

সেই প্রথম দিন যখন শ্রাবণ এসে রাতুলকে একটা বড় ক্যাডবেরি, আর এক ব্যাগ কত কী উপহার দিয়ে গিয়েছিল, সেদিনই রাত্রি বুঝতে পেরেছিল কোন মানুষই শুধু একজনের সম্পত্তি নয়, হতে পারে না।

অথচ এই রাত্রিই একদিন রেগে গিয়ে বাবা-মাকে বলেছিল, আমি কি তোমাদের সম্পত্তি নাকি, যে যেমনটা চাইবে তেমনই করতে হবে। আমি কারো প্রপার্টি নই।

রাতুলের বেলায় ঠিক সেটাই করে বসেছিল। এখনো ভাবতে পারে না, রাতুল আর কাউকে এক আনা ভালোবাসাও দেবে। কারণ ওর মধ্যে এখন হারানোর ভয়টাই প্রবল।

আমি তোমাকে কালই একটা ক্যাডবেরি এনে দেবো। যা কিছু দিয়ে গেছে, কিছু ছুবি না তুই, আমি সব এনে দেব।

রাতুল সেদিন কিছুই বুঝতে পারেনি। বিভ্রান্তের মতন শুধু মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেছে। ওর চোখে জল এসেছিল কিনা তাও দেখেনি রাত্রি। ধীরে ধীরে সান্তনার স্বরে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেছে, তুই তো কিছুই বুঝিস না, ও তোকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে এসেছিল।

কিন্তু ছিনিয়ে নেওয়ার অর্থটা রাতুল বুঝতেই পারল না। শুধু ওকে দেখে মনে হয়েছিল একটা উল্লাস আর ফুর্তির মুখে কে যেন একটা প্রকান্ড চড় কষিয়ে দিয়েছে। রাত্রি কেন যে ওর আনন্দটুকু নষ্ট করে দিতে চায় তা কেমন করে বোঝাবে রাতুলকে। শুধুই হারাবার ভয়? নাকি রাতুল আর একজনকে, যাকে ও চায় না, পছন্দ করে না, তাকে একটু ভালবাসা দিয়ে দেবে সেই আশা।

রাতুল এক সময় নিরূপায় হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। রাত্রিই ঘুম পাড়ালো। জানালার বাইরে বাতাস লাগা নিম গাছ চামরের মতো দুলছে। শব্দটা যেন প্রকৃতির দীর্ঘশ্বাসের মতো। আজ রাতে রাত্রির পক্ষে ঘুমানো অসম্ভব। গাছের ডালে ভারি একটু কিছু এসে বসল। হয় প্যাঁচা না হয় বাদুর। রাতুল অকাতরে ঘুমাচ্ছে। রাত্রি এক ফাঁকে উঠে চোরের মতো পা টিপে টিপে অন্য ঘরে গেল। আজ তার মনটা ভীষণ খারাপ। নিলয়ের কথা বড্ড বেশি মনে পড়ছে। চার মাসের লড়াই শেষ।

রাত্রি পেছন ফিরে তাকাতেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। দরজার সামনে রাতুল। বড় বড় চোখ। কপালের ওপর চুল। ফুলের মতো মুখ। রাত্রি তাড়াতাড়ি সামনে গিয়ে হাঁটুমুড়ে বসে পড়ল। রাতুল তাকিয়ে আছে, যেন স্বপ্ন দেখছে।

আমার বাবা কোথায়? নেই তো!

রাত্রি দু’হাতে রাতুলকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরল।

রাতুল আবার বলল, আমার বাবা কোথায়? নেই তো! গলা ধরে এসেছে। গলা দিয়ে করুণ চিৎকারের মতো একটা শব্দ বেরুলেঅ – ‘বাবা।’

রাত্রি, রাতুলকে কোলে নিয়ে বসে পড়ল ঘরের লাল মেঝেতে। কান্না এসে গলার কাছে দলা পাকাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে কথা বলা খুবই কঠিন কাজ; তবুও রাতুলের জন্য হাসতে হবে। রাত্রি ছেলেকে বুকে চেপে ধরে বলল, তোমার বাবা বাইরে গেছে। দেখবে এবার তোমার জন্য কতকিছু নিয়ে আসবে।

ধরা ধরা গলায় রাতুল বলল, পিংকু যে বলে আমার বাবা নেই বলে আমরা নানু বাসায় থাকি। বাবা এবার যাবার সময় আমাকে কিছু বলে যায়নি। তোমাকে কিছু বলেছে কি?

বলে গেছে, রাতুল যেন লক্ষ্মী হয়ে থাকে। ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া করে। রাতুল স্কুলে কেউ যদি তোমাকে তোমার বাবার কথা জিজ্ঞেস করে বলবে- বাবা অফিসের কাজে বাইরে গেছে।

রাত্রি উঠে যাবে বাবছিল, হঠাৎ রাতুল মুখের দিকে তাকিয়ে বলল- ‘আমার বাবা মারা গেছে তাই না!’

রাত্রি স্বম্ভিত হয়ে গেল। এত চেষ্টা সব ব্যর্থ! রাত্রি ঘুরিয়ে ছেলেকে প্রশ্ন করল- ‘মরে যাওয়া কাকে বলে তুমি জান বাপি?’

রাতুল ঠিক জানে না। এই তো কয়েক বছর হলো পৃথিবীতে এসেছে। শুনেছে মানুষ মরে যায়। চলে যাওয়াকেই কি মরে যাওয়া বলে! কাকে বলে মা?

রত্রি আবার বিপদে পড়ল। কি উত্তর দিবে এখন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল- ‘মানুষ মরে না বাপি। ্ক জায়গা থেকে আর একজায়গায় চলে যায়।’

রাতুল সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করল, ‘তাহলে চলে যাওয়াকে মরে যাওয়া বলব?’

রাত্রি অবাক হয়ে গেল। এইটুকু ছেলে কি কথা! এখন কী বলব।

রাতুল আবার বলল- তাহলে তুমি দাদু বাসায় গেলে, বলব তুমি মরে গেছ।

রাত্রির আর কোন কথা বলার ক্ষমতা নেই। এ কী! এতো অসম্ভবব ছেলে, রাত্রি উত্তর হাতড়াতে লাগল।

রাতুল বলর, তাহলে সেদিন যে আমার বেড়ালটা মরে গেল, কই সে তো চলে গেল না। বারান্দায় পড়ে রইল। আমাদের রাস্তা দিয়ে যখন মানুষকে ঢেকে নিয়ে যায়, তোমরা বল লাশ যাচ্ছে। মরে গেলেই তো লাশ হয়। তুমি আমাকে মিথ্যা কথা বলছ কেন মা?

রাতুল রাত্রির কোলে মুখ গুঁজে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমি সব জানি, আমি সব জানি। বাবা ওই বেড়ালটার মতো মরে গেছে। তুমি এতদিন আমাকে মিথ্যে কথা বলেছো।

তোমাকে এসব কথা কে বলেছে?

শ্রাবণ কাকু।

সন্ধেবেলায় নিজের ঘরেই ছিলো রাত্রি।

আট মাস এই বাড়ি, এই ঘরের সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক ছিলো না। অবশ্য সেভাবে বললে- বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ছিলো না বলা যায় না, তবে ঘরের সঙ্গে ছিলো না। এতদিন পর ফিরে এসে নিজের ঘরটাকে তার নতুন বা অচেনা মনে হয়নি। ঘর তার ঠিকই আছে, যেমন ছিলো। ঘরতো উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় না। কাজেই যেমন ছিলো তেমনি আছে। আসবাবপত্রও সবই সেইরকম, যেখানে যা যা ছিলো তেমনই আছে। খাট, আলমারি, হাল্কা ছোট টেবিল, আয়না। ঘরে লোক না থাকলে, বসবাস না করলে যে কোথাও ময়লা বসবে, কোথাও ছাপ ছোপ পড়বে, ধুলোর দাগ বসবে – এতো স্বাভাবিক।

নিশি যতটুকু পারে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে দিয়েছে; তবু ঘরটা জেগে ওঠেনি। মানে রাত্রির নিত্যদিনের স্পর্শ পেলে যেমন সজীব থাকার তেমন দেখাচ্ছে না। খানিকটা বাসী বাসী, ময়লা, অসাড় দেখাচ্ছিল।

নিলয় মারা যাবার পর, রাত্রি যখন এ বাসা থেকে চলে গেল, তারপর থেকে এই ঘরে যে কোনোদিন হাত পড়ত না,  নজরে আনত না কেউ- তা নয়; তবে ওই মাঝেমধ্যে একবার ঝাটপাট দেওয়া, ধুলো ঝাড়া, জানালাগুলো খুলে দেওয়া- তার বেশি কিছু নয়।

সন্ধেবেলায় বাতি জ্বালাতে গিয়ে রাত্রি দেখল- দেওয়াল বাতির দুটোই খারাপ। বাল্ব নষ্ট হয়ে গিয়েছে। পাখাটা অবশ্য সামান্য শব্দ করল বিরক্তির, তারপর চলতে লাগল। এসব নিয়ে ভাবল না রাত্রি। কাল পরশু তরশু- দিন পড়ে আছে; গুছিয়ে নেবে ধীরেসুস্থে।

বাইরের জানালা খোলা। ভেতরেরটা বন্ধ। দরজা খোলা। বাইরে অন্ধকার। বৃষ্টি নেই, বাদলা বাতাস রয়েছে। ঘরের একটা বাতি জোরালেঅ নয় জ্বলছে এই।

ভাবি?

রাত্রি পায়ের শব্দ পায়নি, ডাক শুনল। তাকাল।

নিশি।

এগিয়ে  এল নিশি। াক, ফিরলে শেষ পর্যন্ত। সেই কবে গিয়েছো আর এই এলে। মাসের পর মাস যায় তোমার ফেরার নাম নেই। আমার তো মনে হয় তোমার কেসটা হলো- ফিরতে চাই না আমি পার্থিব সংসারে…।

(চলমান…)

মনের আধাঁর পেরিয়ে, পর্ব-১

মনের আধাঁর পেরিয়ে, পর্ব-২

মনের আধাঁর পেরিয়ে, পর্ব-৩

মনের আধাঁর পেরিয়ে, পর্ব-৪

মনের আধাঁর পেরিয়ে, পর্ব-৫

মনের আধাঁর পেরিয়ে, পর্ব-৬

মনের আধাঁর পেরিয়ে, পর্ব-৭

পল্লব শাহরিয়ার
Latest posts by পল্লব শাহরিয়ার (see all)