মুগ্ধতা ব্লাড ব্যাংকে আপনার দেওয়া তথ্য বাঁচাতে পারে একটি জীবন। আপনার তথ্য দিন, প্রয়োজনে রক্ত খুঁজুন এখানে।

মনের আধাঁর পেরিয়ে

পল্লব শাহরিয়ার

১০ জুলাই, ২০২০ , ৭:৪৩ অপরাহ্ণ

মনের আধাঁর পেরিয়ে

(পর্ব-২)

ভাগ্যিস চলে গেছে, পিংকুকে আদর করতে গেলে না জানি খালাটা কী বলে বসত। মুখচোখ দেখলেই বোঝা যায় না। রাত্রি তবু বলল- খারাপ ভাবছিস কেন, হয়তো স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে আত্মীয়স্বনের বাড়িতে ঘাপটি মেরে আছে।

মীনা হাসল- দ্যাখ রাত্রি, ঐ বাচ্চাকে ফেলে কেউ রাগ দেখাতে যায় না। সঙ্গে নিয়ে যেত। কথাটা মিথ্যা নয়। রহস্যতো ঐখানেই। তাছাড়া পিংকুর মাকে দেখে কেমন একটা সন্দেহ সন্দেহ ওদের সকলেরই।

কিন্তু ঘটনাটা রাত্রিকে ভীষণ ভাবিয়ে তুলল, নাড়া দিল। ফেরার পথে ওযে রাতুলের হাত ছেড়ে দিয়েছিল, খেয়ালই ছিল না। রাতুল এমনিতেই হাত ধরতে দেয় না ঐ  বয়সের ছেলেদের ঐ এক দোষ, ভাবে খুব বড় হয়ে গেছি। তবু জোড় করে হাত ধরেই স্কুল ছুটির ভিড় থেকেই বেরিয়ে আসতে হয়, রাস্তা পার হওয়ার সময়ও।

মন কি বস্তু, অপরের ছেলের কথা ভাবতে গিয়ে নিজের ছেলেকে ভুলে গিয়েছিল। হাত না ধরেই রাস্তা পার হয়েছে। ভাগ্যিস কিছু একটা ঘটে যায়নি। আতঙ্কের সময়টুকু পার হয়ে এসে বুকের ভেতরটা আতঙ্কে কেঁপে উঠল।

বাড়ি ফিরে এসেও কথাটা মাথার মধ্যে ঘুরছে তো ঘুরছেই। না, বাড়িতে কাউকে বলবে না। বললে বড় জোর তমালকে বলতো। নিলয়ের ছোট ভাই, সে চাকরি পেয়ে চলে গেছে বেশ কিছুকাল। বড় একটা আসেও না। ঐ একমাত্র রাত্রির দুঃখ বুঝত। শ্বশুড়-শাশুড়ি কিংবা রবিনকেও বলবে না। নিলয়কে তো নয়ই। বললে যেন নিজেই ছোট হয়ে যাবে। আর নিলয়কে বললে হয়ত বলে বসবে, তোমরা মেয়েরা সব পারো। কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠবে শুনলে। অথচ একথাই তো মীনা বলেছে মেয়েরা দেখছি সব পারে। তখন নিজেও সাঁয় দিয়েছে।

কথাটা মিথ্যা নয়, বলার মতই। কারণ পিংকুর মায়ের মত একজনই পেরেছে। খবর সেটাই। ছেলেরা যে এরকম কান্ড হামেশাই করছে, বউ ছেলেকে ফেলে রেখে অণ্যত্র সংসার বাঁধছে, সুতরাং সেটা আর খবর হবে কি করে। ছেলেরা যে সব পারে সেটা আর মুখ ফুটে বলতে হয় না।

জুতো দেখতে পেয় বুঝল শ্বশুর এখনও বেরোননি। কবে কখন বেরোবেন তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। সরকারি চাকরিতো। গরমে ঘেমে এসেছে রাত্রি। এসেই পাখাটা জোড়ে চালিয়ে দিল, রাতুলকে বললো, এখানে দাঁড়া। কি ভাগ্য, কারেন্ট আছে।

ছোট্ট একটা কথা, যখন সমস্ত জীবনটাই বিস্বাদ করে দেয়। এখন ওসব বিশেষ শুনতে হয় না, কিন্তু মনে পড়ে যায়। সেই প্রথম প্রথম। এমনই গরম, পাখা ঘুরছিল। শ্বশুড় কাকে শুনিয়ে কে জানে বারান্দা থেকে বলছিলেন তোমাদের কি চব্বিশ ঘণ্টাই পাখা লাগে!

রত্রি ভয়ে ভয়ে পাখা বন্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে পাশের ঘর থেকে তমালের গলা শুনেছিল। হয়তো রাত্রির পক্ষ নিয়ে। পাখা যখন আছে, গরম লাগলে তো চালাবেই।

চালাতে তো বারন করছি না। একটু অসহায় শুনিয়েছিল শ্বশুড়ের কণ্ঠ। বলেছিলেন গত মাসের বিলটা দেখেছিস!

নিলয়ের ছোটভাই তমাল তখনও বেকার, কিন্তু ন্যায়-অন্যায়ে তার গলার জোর বেশি ছিল। নিলয়ের বেতন তখনো খুব একটা বলার মত নয়। নিলয় তখন তার বেতনের টাকাটা তার মা’র হাতে তুলে দিত। কত বেতন, হাতে কত পায় এসব কিছুই জানতো না রাত্রি।

ও পরে জেনেছে। শ্বশুড়ের বেতন যে তেমন নয় তাও জানে। তবু কথাটা তীর হয়ে বিঁধে আছে- তোমাদের কি চব্বিশ ঘণ্টাই পাখা লাগে! এখন আর এসব কথা শুনতে হয় না। তমাল আর বেকার নেই, নিলয়ের উন্নতি হয়েছে চাকরিতে।

তমাল মাসে মাসে কিছু পাঠায় কিনা জানার উপায় নেই। কি করেই বা পাঠাবে। নিজেরটা চালাতে পারলেই যথেষ্ট। বেতন কত তাও বলেনি তমাল, এড়িয়ে গিয়ে হেসে বলেছিল, চায়ের দোকান ছাড়া বসার জায়গা ছিল না, এখন একটা বসার চেয়ার পাবো তাই যথেষ্ট। তার আবার বেতন!

হেসে ফেলেছিল রাত্রি। বুঝেছিল ওটা মুখ ফুটে বলার মত নয়। তা হোক চাকরিতো। কিন্তু পিংকুর মায়ের ঘটনাটা কিছুতেই মাথা থেকে যাচ্ছিল না। ছেলেটার জন্য মায়া হচ্ছিল।

রাতুলকে গোসল করাতে করাতে আবার সেই চিন্তাটাই মাথার মধ্যে ঘুরছে ফিরছে। রাতুলের গায়ে পানি দিয়ে সোপ-কেস খুলে দেখে পাতলা এক চিলতে সাবান পড়ে আছে, নতুন সাবান রাখা হয়নি। হয়তো নিলয়ই শেষ করে দিয়ে গেছে। গোসল করতে গেলে সোপ কেসে সাবান শেষ, কি শ্যাম্পুর শিশিতে তলানি পড়ে থাকলে বিরক্তি লাগে। মনে হয় আগে যে ব্যবহার করেছে সে নতুন একটা সাবান কিংবা নতুন একটা শ্যাম্পুর শিশি রেখে যায়নি কেন? বিরক্তির সঙ্গেই সেজন্য রাত্রি চেচিয়ে ডাকলো, নিশি একটা সাবান দিয়ে যাবে।

– নিশি, আবার ডাকলো সাড়া না পেয়ে।

একটু পরেই সাবানের প্যাকেট খুলতে খুলতে এল নিশি, দিয়ে চলে গেল বেশ বিরক্তির সঙ্গে। নিশি, এ বাড়ির ছোট মেয়ে, রাত্রির ননদ।

নিশির এই এক দোষ, সাড়া দেয় না। শুনলো কি শুনলো না তা জানার উপায় নেই। অথচ বেশ শুনতে পেয়েছে, সাবানটা এনেও দিল। সাড়া দিতে কি অসুবিধে কে জানে। আসলে বিরক্তি। কাজ করতে হচ্ছে বলে নয়। বিয়ে হচ্ছে না বলে।

বিয়ের আগে বাবা-মা বেশ ভয় পেয়েছিল। অবিবাহিত ননদ আছে শুনলে মেয়ের বাবা-মা আঁতকে উঠবেই। রাত্রিরও ভয় ছিল, কিন্তু উপায় ছিল না বলেই রাজি হয়েছিল ওরা। রাত্রিও আপত্তি করেনি।

বিয়ের পর কিন্তু নিশিকে ওর ভালই লেগেছিল। সব সময় কাছে কাছে ঘুরতো। রাত্রিও বেশ খুশি, একটা সঙ্গী তো গল্পগুজব করা যায়। বিয়েতে পাওয়া দু’চারটা শাড়ি, সেন্ট, ক্রিম সবই ও ব্যবহার করতে দেয় নিশিকে। অথচ দিনে দিনে কেমন একটা দূরত্ব তৈরি করে ফেলল মেয়েটা। বোধহয় ঐ একটাই কারণ, বিয়ে। কিন্তু সেটা তো রাত্রির দোষ নয়, কেন বোঝে না।

এই বয়েসের মেয়েদের নিয়ে সত্যি বড় সমস্যা। রাত্রিকে নিয়েই ওর বাবা-মা কি কম দুর্ভাবনায় ছিল। নিশি ছোটবেলায় দেখতে খুব ভাল ছিল। যত বয়স হচ্ছে তত দেখতে জানি কেমন হচ্ছে। এত সাজগোজ সত্বেও। দোষের মধ্যে রংটা একটু চাপা। ওখানেই ওর হার, ওখানেই রাত্রির জয়।

শ্বশুরের রিটায়ার করতে দেরি নেই। কি আছে না আছে একদিন আভাসে জানিয়েও দিয়েছেন ছেলেদের। সবকিছু কেটে কুটেনিয়ে যা হাতে পেতেন তা থেকে নাকি আর জমানো সম্ভব ছিল না। ভরসা একমাত্র পেনশন। কিছু হাবেভাবে বোঝা যায় ভরসা একমাত্র নিলয়।

রাত্রির এখানেই আপত্তি, এখানেই আতঙ্ক। ও এখন এ বাড়ি থেকে ছিটকে বেরিয়ে যেতে পারলেই যেন নিশ্চিন্ত। শ্বশুর একদিন রাতে খাওয়ার সময়, ছেলেদের সঙ্গে খেতে বসতেন, ওইটুকুই দেখা সাক্ষাৎ, কথা বলা, দুঃখে হেসে বলেছিলেন- এক সময় চাইলেই ঘুষ খেতে পারতাম, অনেকেই নিত, নিইনি। স্টুপিড ছিলাম তো। ছেলেরা চুপ করে ছিল। কোন কথা বলেনি।

রাত্রির ভাল লেগেছিল। বাঃ মানুষটা সৎ। অর্থ চিন্তায় এখন নিজেকে নামিয়ে আনতে চাইছে, হতাশায় স্টুপিড ভাবছে নিজেকে। বুকের মধ্যে একটা কষ্ট কষ্ট ভাব এসেছিল রাত্রির। শ্বশুরের জন্য মায়া হয়।

বলেছিলেন সেদিনই, ছেলেরা কিছু বললো না দেখে নিজেই ব্যাখ্যা দিলেন। গভর্মেন্ট যখন চায় লোকে ডিজঅনেস্ট হোক… পেনশন তো আধা মাইনে, লোকটা চলবে কি করে তা তো ভাবে না।

নিলয় সায় দিয়ে বলেছিল, জিনিসের দামতো বেড়েই চলছে। আর বেকার তমাল হেসে উঠে বলেছিল, চাকরি একবার পাই, ঘুষ নেয়া কাকে বলে দেখিয়ে দেব।

সবাই হেসে উঠেছে। হাসির কথা হলেও রাত্রি হাসতে পারেনি। শুধু নিশি টিপ্পনী কেটে বলেছিল, সব চাকরিতেই কি ঘুষ আছে, তোর যেমন বুদ্ধি!

নিশি বড় একটা হাসে না। হাসির কোন কথা হলে হেসে ওঠাও যেন অপরাধ। মেয়েটা কেমন যেন দিনে দিনে বদলে যাচ্ছে। বাড়িতে থেকেও নিজের অস্তিত্ব মুছে ফেলতে চায়। বিয়েটাই কি মেয়েদের সব, রাত্রি বুঝতে পারে না।

বাড়িটাও অদ্ভুত। সব ব্যাপারেই এক ধরনের গা ছেড়ে দেয়া অবস্থা। এক সময় নিশির বিয়ের চেষ্টা অবশ্য হয়েছিল। কিন্তু আজকাল কত কি পড়া যায়, করা যায়। কিছু একটা করলেও তো পারে। চাকরি?  চাকরি আর পাবে কোথায়, কে দেবে! সেজন্যই সবাই ভাবে বিয়েটাই একমাত্র গন্তব্য। সাধারণ মেয়েদের সামনে আর কি বা পথ আছে। যথেষ্ট টাকা থাকলে হয়ত একটা বিয়ে দেয়া যায়। কিন্তু তার পরের জীবনও সেই অন্ধকারে লাফ দেয়া। কতরকমই তো দেখছে শুনছে। রাত্রির নিজের জীবনই বা কী! সুখী না অসুখী নিজেই বুঝতে পারে না।

রাতুলকে খাওয়াতে বসিয়ে নিশির কথা মনে এল। একটু রাগ এবং একটু বিরক্তি ছিল। রাতুলকে গোসল করার সময় ডেকে সাড়া পায়নি বলে। সাবানটা দিয়ে গেল এমন অবহেলার সঙ্গে যেন বাড়ির লোক নয়, রাত্রির সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই।

অথচ এক সময় কত ভালবাসতো দুজন দুজনকে।

বিয়ের পর প্রথম প্রথম নিশির আব্দার ওর কসমেটিকসে ভাগ বসাতো। কিছু মনে করত না রাত্রি। দুচারটে শাড়ি পরতেও দিয়েছে, একেবারে দিয়ে দিয়েছে উপহার পাওয়া কয়েকটা ভাল শাড়ি। ও নিজেই দিয়ে দিয়েছিল নাকি শ্বাশুড়ি হাসতে হাসতে বলেছিল বলে, তা অবশ্য মনে নেই।

প্রথম রাগ সেই সেন্টের শিশি নিয়ে। সেন্টের শিশিতো টেবিলের ওপর থাকতো। সিনেমা যাওয়ার আগে সেজেগুঁজে এসে, তখন সাজতো, নিশি ওখান থেকে সেন্ট নিত। রাত্রি কিছু মনে করত না। কিন্তু একটা সেন্ট ছিল, আড়ালে আড়ালে রাখতো রাত্রি। দামি সেন্ট। বিয়ের বাজার করতে গিয়েও নিজেই কিনেছিল। তখন অনেক খরচ হয়ে গিয়েছিল, বাবা একটু হাতটান শুরু করেছে, দামী কিছু কিনলেই মা বিরক্ত হচ্ছে। বাবার কাছে ধমক খাওয়ার ভয়ে, তবু জেদাজেদী করে রাত্রি কিনেছিল ওটা, নিউমার্কেট থেকে, বেশ দামী।

ও জানত, একবার ফুরিয়ে গেলে আর কেনা যাবে না। লুকিয়ে লুকিয়ে কৃপণের মত কদাচিৎ ব্যবহার করত, নিলয়ের সঙ্গে সিনেমা যাওয়ার সময়।

তারপর ধরা পড়ে গেল হঠাৎ। নিশি দেখতে পেয়েই ছুটে এল, দেখি দেখি।

(চলমান…)

মনের আধাঁর পেরিয়ে, পর্ব-১

মনের আধাঁর পেরিয়ে, পর্ব-৩

মনের আধাঁর পেরিয়ে, পর্ব-৪

মনের আধাঁর পেরিয়ে, পর্ব-৫

মনের আধাঁর পেরিয়ে, পর্ব-৬

মনের আধাঁর পেরিয়ে, পর্ব-৭

মনের আধাঁর পেরিয়ে, পর্ব-৮

পল্লব শাহরিয়ার
Latest posts by পল্লব শাহরিয়ার (see all)