আতিকের (ছদ্মনাম) বয়স ৩৫ বছর। একজন ব্যাংকার।
এক মাস পর বিয়ে, কিন্তু বিয়েতে তার কোন মত নেই। তার পরিবার এক প্রকার জোর করেই এই বিয়ে দিচ্ছে। এজন্য দুঃশ্চিন্তায় তার ঘুম হচ্ছে না। কাজে মনোযোগ দিতে পারছে না, অস্থিরতায় ভুগছে এবং অল্পতেই বিরক্ত হয়ে উঠছে। সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না কী করবে।
এজন্য তিনি একজন মনোবিদের কাছে এসেছেন সহায়তা নিতে। কারণ অনুসন্ধান করে জানা গেল যৌনকর্মে তিনি কোন আগ্রহ পান না। যদিও বা কখনও আগ্রহ হয় কিন্তু পুরুষাঙ্গ খুব বেশি শক্ত হয় না এবং দ্রুত বীর্যপাত ঘটে যায়।
ইদানিং তার পুরুষাঙ্গকে অনেক ছোট এবং চিকন মনে হয়। এজন্য আতিকের দুঃশ্চিন্তা অনেক বেশি। তিনি নিজেকে পুরুষ হিসেবে অক্ষম মনে করেন। সমাজে ছোট হবার ভয়ে কাউকে বলতেও পারেন না। চুপি চুপি তিনি অনেক কবিরাজি, হোমিপ্যাথি এমনকি বিশেষজ্ঞ ডাক্তারও দেখিয়েছেন। অনেক পরীক্ষা-নীরিক্ষাও করিয়েছেন কিন্তু কোন সমস্যা ধরা পড়ে নি এবং কোন সুফল আসছে না।
শাকিব ও অনন্যার (ছদ্মনাম) বিবাহিত জীবন তিন বছর। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন পরস্পরকে তালাক দিবেন।
অনন্যার অভিযোগ সাকিব তার সব চাহিদা পূরণ করতে পারে না। সব সময় অনন্যাকে এড়িয়ে চলে।
অনন্যার ইচ্ছাতেই সবসময় যৌনমিলন হয় তবে সেটা খুব জোরপূর্বক এবং অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই সাকিবের বীর্যপাত হয়। এজন্য প্রায়ই ওদের দ্বন্দ্ব লেগেই থাকে।
সাকিব দিনের বেলা অফিসে থাকেন আর রাতে বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে খাওয়া-দাওয়া করে নিজের একটা ব্যক্তিগত পড়ার রুম আছে সেখানে অনেক রাত পর্যন্ত সময় কাটান। ঐ রুমে অন্য ব্যক্তিদের প্রবেশ নিষেধ করে দিয়েছেন সাকিব।
অনন্যা অনেক প্রশ্ন করেছেন এবং খোঁজও নিয়েছেন কোন উত্তর পান নি। এমনকি অন্য মেয়েদের সাথে কোন সম্পর্কও খুঁজে পান নি।
সাকিবের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে জানা গেল, সাকিবের যৌন চাহিদা অন্যদের থেকে আলাদা। তিনি মেয়েদের প্রতি যৌন আকর্ষণ অনুভব না করে মেয়েদের পোশাক পরিচ্ছদের প্রতি যৌন অনুভূতি অনুভব করেন। তার নিজস্ব রুমে তিনি মেয়েদের ব্রা, প্যান্টি, শাড়ি, ব্লাউজ, লিপস্টিক, মেকাপ রেখে দিয়েছেন।
একান্ত সময়ে তিনি এক এক করে শরীরে পরতে থাকেন এবং উত্তেজনায় কাঁপতে থাকেন।
প্রথমে ব্রা, তারপর প্যান্টি পড়েন এবং বিশাল আয়নায় নিজেকে দেখেন আর যৌন উত্তেজনায় লাল হতে থাকেন। এভাবে তিনি শাড়ি পড়েন, ঠোঁটে লিপস্টিক দেন এবং প্রছ- কামনায় তাকিয়ে থাকেন নিজের দিকে। নিজেকে তখন তার অন্য নারী মনে হয়। এইভাবেই সেই ছবির দিকে তাকিয়ে হস্তমৈথুন করে তিনি যৌন তৃপ্তি লাভ করেন।
রুমা ও সোমা (ছদ্মনাম) দীর্ঘদিন থেকে একই হোস্টেলে থাকেন। একই বিছানায় ঘুমান। একসাথে খান, বাইরে যান, আবেগীয় অনুভূতি শেয়ার করেন। তারা দুজন দুজনকে প্রচ- রকম ভালোবাসেন। কেউ কাউকে ছাড়া থাকতে পারেন না।
তারা দুজন দুজনের প্রতি প্রচ-ভাবে শারীরিক ও আবেগীয় আকর্ষণ অনুভব করেন। ছেলেদের প্রতি তাদের কোন কোন আকর্ষণ নেই। তারা মাঝে মাঝে যৌনকর্মও করে থাকে। তারা একে অপরকে বিয়ে করবে বলেও সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
বিপত্তি ঘটল তখনই যখন তারা তাদের পরিবারকে বিষয়টা জানালেন। তাদের সিদ্ধান্ত আমাদের সমাজের প্রচলিত নিয়মের সাথে যায় না। এজন্য রুমার পরিবার তাকে জোর করে একজন মনোবিদের কাছে এনেছেন।
উপরে বর্ণিত তিনটি পৃথক কেস থেকে আমরা ৩ ধরণের সমস্যা দেখতে পাচ্ছি যেগুলোকে বলা হয় মনোযৌন সমস্যা, ইংরেজিতে যাকে বলা হয় Psychosexual-disorders. মনোযৌন সমস্যা হলো সেই সমস্যা যেগুলো কোন শারীরিক কারণ বা রোগ থেকে হয় না। শুধুমাত্র কতগুলো মানসিক মানসিক ও সামাজিক কারণে ঘটে থাকে। এ সমস্যাগুলো সাধারণত তখনই ঘটে যখন ব্যক্তি বিভিন্ন ধরণের ভয়, দুঃশ্চিন্তা এবং অপরাধবোধে ভোগে। তাছাড়াও যৌন যৌন বিষয় সম্পর্কে সঠিক ও পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাব, সঙ্গীর সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে না ওঠা, পূর্বের দুঃখজনক যৌন অভিজ্ঞতা, অসুখী বিয়ে, উপযুক্ত পরিবেশের অভাব, অতিরিক্ত কাজের চাপ ইত্যাদি কারণেও যৌন সমস্যা দেখা দিতে পারে। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ব্যক্তির মূল্যবোধ বা বিশ্বাসের সাথে যৌন সম্পর্ক বা কর্মের মানসিক দ্বন্দ্ব। যেমন ব্যক্তি যদি ছোট থেকে জেনে আসে যে, যৌনকর্ম পাপ এবং নোংরা কাজ তাও তার জীবনে যৌন কাজে বাধা প্রদান করতে পারে।
আমরা সাধারণত তিন শ্রেণির বা ক্যাটাগরির মনোযৌন সমস্যা দেখতে পাই।
১. যৌন ক্রিয়ার অস্বাভাবিকতা (Abnormality in sexual act): এক্ষেত্রে ব্যক্তির যৌন আগ্রহ বা উত্তেজন কমে যায়, লিঙ্গ উত্থানজনিত সমস্যা দেখা যায়, দ্রুত বীর্যপাত ঘটে। আবার অনেকে আছে যৌন কর্ম করে কোন রকম আনন্দ বা তৃপ্তি লাভ করে না। তাছাড়া ব্যথাযুক্ত যৌন মিলন এবং অনেকের মধ্যে যৌন বিদ্বেষও দেখা যায়।
২. লিঙ্গের বৈশিষ্ট্য সনাক্তকরণে অস্বাভাবিকতা। এক্ষেত্রে ব্যক্তি শারীরিকভাবে কোন বিশেষ লিঙ্গের অধিকারী কিন্তু মনস্তাত্ত্বিকভাবে কোন বিশেষ লিঙ্গের অধিকারী কিন্তু মনস্তাত্ত্বিকভাবে যে নিজেকে অন্য লিঙ্গের মনে করে। এবং তার কার্যকলাপেও তা প্রকাশ পায়। যেমন একজন ছেলে নিজেকে মেয়ে মনে বা একজন মেয়ে নিজেকে ছেলে মনে করে। তারা সেভাবেই ছেলেদের বা মেয়েদের মতো আচার আচরণ করে থাকে। এমনকি অপারেশন করেও তারা নিজেদের লিঙ্গের পরিবর্তন ঘটাতে চায়। হিজরা (অপারেশন করিয়ে যারা হিজরা হয়), পুরুষ/নারী সমকামিতা এর উদাহরণ।
৩. যৌন উত্তেজনার উৎস সম্পর্কিত অস্বাভাবিকতা। এক্ষেত্রে ব্যক্তি তার বিপরীত লিঙ্গের প্রতি যৌন উত্তেজনা লাভ করে থাকে। যেমন নারীদের পোশাক, শিশু, বিভিন্ন প্রাণী বা বিভিন্ন যন্ত্রপাতির প্রতি যৌন আকর্ষণ অনুভব করে থাকে। এইসব মনোযৌন সমস্যার কোন শারীরিক ভিত্তি থাকে না। সমস্যার মাত্রা অনুযায়ী চিকিৎসা প্রদান করা হয়ে থাকে। সমস্যা বেশি হলে ঔষধের চিকিৎসার পাশাপাশি সাইকোথেরাপি বা কাউন্সেলিং নিয়ে ব্যক্তি এ ধরণের সমস্যাগুলো থেকে বের হয়ে আসতে পারে।
সাবিনা ইয়াসমিন
ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, রিজিওনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টার রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রংপুর।
চেম্বার: ব্রেইন এন্ড মাইন্ড, ধাপ, রংপুর