প্রতিভা কখনোই চাপা থাকে না। যত প্রতিকূলতাই থাকুক তা একদিন প্রকাশিত হবেই। অতি প্রাচীন কালেও তাই ছিল, যখন প্রতিভা মেলে ধরার যথেষ্ট সুযোগও ছিল না। প্রতিভাবানদের প্রতিভার জৌলুশ ঠিকই দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। আজও সেই বিখ্যাত প্রতিভাবান ব্যক্তিগণ স্মরণীয় হয়ে ঠাঁই নিয়েছেন ইতিহাসের পাতায়, পাঠ্যবইয়ের পাতায়। হাল আমলের কত অ-প্রতিভাবান ব্যক্তিও জনপ্রিয় হওয়ার ইঁদুর দৌড়ে ব্যস্ত। তথাকথিত সস্তা জনপ্রিয়তা পাবার জন্য ফেসবুক, ইউটিউব সহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারা আসক্ত। অল্পকিছু দিন পরই তারা হারিয়ে যান। কিন্তু সত্যিকারের প্রতিভাবান ব্যক্তি সহজে হারিয়ে যান না। তার সৃষ্টিকর্ম যুগ যুগ ধরে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নেয়।
মহেশ চন্দ্র রায় কিশোরগঞ্জের মাটিতে জন্ম নেয়া একজন বিরল প্রতিভার মানুষ। তিনি কিশোরগঞ্জের অহংকার। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিষয়ের পাঠ্যসূচিতে তার গান ও জীবনী অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মহেশ চন্দ্র রায়ের প্রতিভা শুধুমাত্র কণ্ঠশিল্পী হিসেবেই সীমাবদ্ধ ছিল না। গান রচনা, সুরারোপ, পরিবেশন ইত্যাদির ক্ষেত্রে এক পরিশীলিত অবস্থান সৃষ্টিতে সক্ষম হন তিনি। তাঁর গাওয়া বহু গান অনেকের কণ্ঠে কণ্ঠে ফেরে। প্রয়াত এই শিল্পীর লেখা ও সুর করা গানগুলো গেয়েছেন অনেকেই। বিশেষ করে বাংলাদেশের ভাওয়াইয়া গানের প্রধান শিল্পী মুস্তাফা জামান আব্বাসী, শরিফা রানী, নাদিরা বেগম, প্রয়াত হরলাল রায়, রথীন্দ্রনাথ রায়সহ আরো অনেকে। এছাড়া দীর্ঘ সংগীত জীবনে তাঁর সান্নিধ্যে এসেছেন তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী খয়রাত হোসেন, অধ্যাপক ইউসুফ আলী (প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী), এমাজ উদ্দিন আহমদ (সাবেক ভিসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), মশিউর রহমান যাদু মিয়া (প্রাক্তন সিনিয়র মন্ত্রী) কবি বন্দে আলী মিঞা, আসাদুজ্জামান নূর (সাবেক সংস্কৃতি-মন্ত্রী), বিশিষ্ট সাংবাদিক মরহুম কামাল লোহানীসহ অনেক স্বনামধন্য ব্যক্তি।
ধীরে বোলাও গাড়িরে গাড়িয়াল, কোন বিদেশি বাবরীয়ালা, ফাক্কাউ করি জিউকোনা মোর, যম শালা হইছে কানারে, আগিনা সান্টোং মুই আগোলে দিগলে কিংবা তিস্তা নদীরে এই কিরে তোর খেলা- এমনি হাজারো ভাওয়াইয়া গানের কিংবদন্তী রচয়িতা মহেশ চন্দ্র রায়ের ৩০ তম মৃত্যুবার্ষিকী ছিল ২৯ জানুয়ারি। আবার আজ ১ ফেব্রুয়ারি তাঁর ১০৪ তম জন্মবার্ষিকী। তিনি ছিলেন একাধারে গীতিকার, সুরকার ও সংগীতশিল্পী। মূলত এ দেশের লোকসংগীতকে দেশ-বিদেশ তথা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত করার পেছনে যে কজন জ্ঞানী-গুণী শিল্পী অবদান রেখে গেছেন তাদের মধ্যে মহেশ চন্দ্র রায় অন্যতম। লোকসঙ্গীতের বিভিন্ন ধারা যেমন- পল্লীগীতি, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালী ইত্যাদির ক্ষেত্রে মহেশ চন্দ্র রায় একটি ব্যতিক্রমধর্মী প্রথা প্রচলন করে গেছেন। সেই প্রচলিত প্রথার রেশ ধরেই এখনও লোকসংগীতের গীত হয়।
কীর্তিমান মহেশচন্দ্র রায়ের জন্ম ১৩২৫ সালের ১৯ মাঘ (১৯১৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি) রাজবংশী ক্ষত্রিয় বংশে। তার জন্ম আমাদের নীলফামারী জেলার কিশোরীগঞ্জ উপজেলার পুটিমারী গ্রামে। বাবা বাবুরাম রায় ও মাতা বিমলা রানী। জন্মের পাঁচ বছর পরেই মহেশ রায়ের মা মারা যান। পিতার আদরে লালিত-পালিত শিশু মহেশকে বাবা গ্রাম্য পাঠশালায় ভর্তি করান। তিন বছরের মাথায় প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে কিশোরীগঞ্জ ইংরেজি স্কুলে ভর্তি হন। ১১-১২ বছর বয়সেই তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে।
শিক্ষাজীবন শেষ করে যোগ দেন গ্রাম্য যাত্রা সংকীর্তন প্রভৃতির দলে। জনপ্রিয়ও হয়ে ওঠেন অল্প দিনেই। এ সময় তার বাবা ছেলের ভবিষ্যত উন্নতির জন্য নীলফামারীর প্রবীণ উকিল সুরথ কুমার ঘোষের তত্ত্বাবধানে রেখে আসেন শহরে। এই শহরে ঘটনাক্রমে পরিচয় ঘটে ভারতবর্ষ অবতার পত্রিকার লেখক অধ্যাপক তারা প্রসন্ন মুখোপাধ্যায় ও লেখক বলাই দেব শর্ম্মার সঙ্গে। তাদের নির্দেশেই পরবর্তীকালে তিনি সংগ্রহ করতে শুরু করেন প্রাচীন পুঁথি। কণ্ঠে ধারণ করতে থাকেন এই গানের অনেকগুলোই।
নীলফামারী শহরে তার পালনকর্তা সুরথ কুমার ঘোষের মৃত্যুর পর মহেশচন্দ্র ছেড়ে দেন শহরবাস। এর মধ্যেই গান গাওয়ার সুবাদে তিনি শিক্ষকতার সুযোগ পান শহর থেকে দূরে জয়চণ্ডী পুটীহারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১৩৪৪ থেকে ১৩৪৬ সন পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন তিনি এ বিদ্যালয়ে। আর সে সময়ই সংগলসী ইউনিয়নের দীঘলডাঙ্গী গ্রামের গগনচন্দ্র রায়ের কন্যা বীণাপাণি রায়ের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এবং স্থায়ীভাবে থেকে যান শ্বশুরালয়েই। কিন্তু বেশিদিন টেকেনি তার স্থায়ী দাম্পত্য জীবন। স্ত্রী বীণাপাণি মৃত্যুবরণ করেন ১৩৪৯ সনে দুটি সন্তান রেখে। ১৩৫০ সনে তিনি বিয়ে করেন কামিনী বালা রায়কে। কয়েক বছর পর চারটি সন্তান রেখে দ্বিতীয় স্ত্রীরও বিয়োগ ঘটে। দীর্ঘদিন ধরে মাতৃহীন সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত করার পর শেষ বয়সে সরলা বালা নামক একজন বিধবাকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করেছিলেন।
পাকিস্তান আমলে তিনি রাজশাহী বেতার কেন্দ্রে কণ্ঠস্বর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে গীতিকার, সুরকার ও সংগীতশিল্পী হিসেবে প্রতিমাসে অনিয়মিত শিল্পী হিসেবে সংগীত পরিবেশন করতেন। সেখানে কয়েক বছর অতিবাহিত করার পর রংপুর কেন্দ্রে সংগীত পরিবেশন করতেন। আমৃত্যু তিনি রংপুর বেতারের শিল্পী হিসেবে যুক্ত ছিলেন।
মহেশচন্দ্র রায় তার দীর্ঘ জীবনে যে গানগুলো সৃষ্টি করেছেন, ধারণ করেছেন, সেগুলোর যথাযথ সংরক্ষণের চেষ্টাও চালিয়েছেন নিরন্তর। বাংলা একাডেমি ও শিল্পকলা একাডেমি প্রকাশ করেছে গানের সংকলন ও জীবনী। এছাড়া ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিস বাংলাদেশ বেতার আর্কাইভসে সংরক্ষিত হচ্ছে তার গানের সুর। কথিত আছে যে, মহেশচন্দ্র রায়ের লিখিত গানের সংখ্যা এক হাজারের মতো। কিন্তু গবেষকের তথ্য অনুযায়ী সংগ্রহ করা গেছে মাত্র ২০০ গান।
১৯৯৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর মহেশ চন্দ্র রায় রচিত ‘ধীরে বোলাও গাড়ী’ (প্রথম খণ্ড) নামে একটি গানের বই নীলফামারী শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে প্রকাশ করা হয়। ২০০৩ সালে বাংলা একাডেমি থেকে ‘মহেশ চন্দ্র রায়ের গান’ নামে একটি বই বের করা হয়। ২০১০ সালে শিল্পকলা একাডেমি ‘ভাওয়াইয়া শিল্পী মহেশ চন্দ্র রায়ের জীবনী ও গান’ নামে একটি বই প্রকাশ করে।
মহান এই শিল্পী ১৯৯৩ সালের ২৯ জানুয়ারি ৭৫ বছর বয়সে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। শেষ হয়ে যায় একটি অধ্যায়ের। বহুমুখী প্রতিভার এই মানুষটির স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য কিছুই করা হয়নি আজও। না তার জন্মস্থান কিশোরগঞ্জে না তার শেষ জীবনের আবাসস্থল নীলফামারী সদরে। নতুন প্রজন্মের অনেকেই তার নামটিও জানে না। আগামী দিনে তাঁর সৃষ্টিকর্ম রক্ষা ও গান চর্চার জন্য নীলফামারীর প্রাণকেন্দ্রে ‘মহেশ চন্দ্র রায় ভাওয়াইয়া একাডেমি’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলে উত্তরবঙ্গ তথা ভাওয়াইয়াপ্রেমীদের স্বপ্ন সার্থক হবে। এছাড়াও কিশোরগঞ্জের উপজেলা শিল্পকলা একাডেমি তার নামে ‘মহেশ চন্দ্র রায় শিল্পকলা একাডেমি’ করার জোর দাবি জানাচ্ছি। আর এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে জাতীয় প্রতিষ্ঠান শিল্পকলা একাডেমিকেই পদক্ষেপ নেওয়ার আহবান জানাই। আমার এ দাবির প্রতি তথা মহেশ চন্দ্র রায়ের স্মৃতি সংরক্ষণের দাবির প্রতি সোচ্চার হবে এ অঞ্চলের আপামর মানুষ এই বিশ্বাস রাখছি।