মুগ্ধতা ব্লাড ব্যাংকে আপনার দেওয়া তথ্য বাঁচাতে পারে একটি জীবন। আপনার তথ্য দিন, প্রয়োজনে রক্ত খুঁজুন এখানে।

মায়া

মিকদাদ মুগ্ধ

৬ জুন, ২০২০ , ১০:৪৬ অপরাহ্ণ ;

মিকদাদ মুগ্ধর গল্প - মায়া

ফোনে কথা বলতে বলতে হঠাৎ রিশ আর তৃণা থেমে গেলো। দুজন অবাক। খুশিতে অবাক তারা। তৃণা বলে উঠলো, কিছু কি বুঝতে পারলে?

-হ্যাঁ। শান্তির দীর্ঘশ্বাস মিলে গেলো বোধহয়।

ভালোবাসার রঙ, গন্ধ জানা নেই রিশের। তবে এই ছোট ছোট বিষয়গুলো তৃণার প্রতি তার মোহের বন্যা বইয়ে চলে যায়। কীভাবে চাইলে এমন দীর্ঘশ্বাসের শান্তি একসাথে উপভোগ করা যায়!হিসেব মিলিয়ে দেখা শেষ। হয়তো বিধাতা তার জন্যেই তৃণাকে সৃষ্টি করেছেন। তৃণা শুধুই তার।

জীবনের হিসেব যোগ, বিয়োগ, গুণ বা ভাগে মেলানো যায় না। ভাগ্যে মেলানো হয়। ভাগ্য কেউ জানে না আর জানার উপায় পর্যন্ত নেই। তাই সময়ের সাথে সাথে ভাগ্যের হিসেব মেলানো হয়।প্রবীণকালে বেঁচে থাকলে হয়তো হিসেব করা সম্ভব তার ভাগ্য তার ইচ্ছে মতো ছিলো কি না। তবে ভাগ্যের উত্থান পতন নিয়েই জীবন চলে সময়ের সাথে তাল দিয়ে।

তৃণা আর রিশের পরিচয় কলেজ থেকে। কলেজের স্মৃতিময় সময়ের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত ওদের মতে। তৃণা খুব সাদাসিধে মেয়ে। সময়ের কাজ সময়ে শেষ। খুব কম কথা বলে। শুধু শুনে যায় তার আশপাশের বিভিন্ন জনের ভিন্ন ভিন্ন কথা। বিশেষত্ব হলো, যে যাই বলুক মুখে একটা হাসি নিয়ে সে শুনে যায়। খুব জোরে হাসি না। হাসির অনেক প্রকারভেদ আছে। খুশিতে একভাবে মানুষ হাসে, আবার উপরে উপরে একভাবে হাসির প্রকার আছে। ভিতরের দুঃখ ঢাকতে যেই হাসি আরকি।এখনকার দিনে যেটা কে ‘ফেইক হাসি’ বলে। কিন্তু তৃণার মুখের হাসিটি ছিল একেবারে অন্য রকমের।হাসিটা ছিল মাত্রাতিরিক্ত মায়াবী হাসি। যেই মায়াবী হাসির জালে জড়িয়ে ভালোবাসতে বাধ্য হয়ে পরে রিশের মন। মেয়েটার সব কিছুই যেন মায়া দিয়ে মোড়ানো। কাজল কালো চোখ, চোখের উপরে একটা চশমা, শ্যামলা গায়ের রঙের মায়াবতী।

রিশ চঞ্চল ছেলে। কলেজ জীবনের যত কিছু উপভোগ্য, তা সব করতে জানে। তবে তৃণার উপস্থিতিতে সব যেন সর্বশান্ত। কেন যেন ইচ্ছে করে চুপ হয়ে শুধু তাকিয়ে থাকতে তৃণার দিকে।অপলক দৃষ্টি যাকে বলে। কানে যেন কোনো আওয়াজ না হয়। শুধু তৃণার  মাঝে মধ্যে বলা কয়েকটি কথাই যেন তার কান শুনতে পারে।এতসব অনুভূতি আর বন্ধুমহল জানতে পারবে না তাহলে কি হয়! আস্তে আস্তে এর কান, ওর কান হতে হতে তৃণার কানে পৌঁছে গেল রিশের কথা।রিশের প্রতি তৃণারও দুর্বলতা কাজ করে। করবেই না বা কেন! চঞ্চল হলেও রিশের ব্যবহার, কথা বলার ভঙ্গি অন্যসবের চেয়ে আলাদা। যা বলে মুখেই বলে দেয়। তৃণার মতে ভালো যদি বেসেই থাকে, তবে বলতে হবে না, বুঝে নেবে চোখের দিকে তাকিয়ে, বুঝে নেবে মনের সূত্র।

মন বুঝে নিতেই কলেজ জীবন শেষের পথে। রিশ আর অপেক্ষা না করে তৃণাকে সব কথা বলে দিল।আর তৃণা অপেক্ষায় ছিলো কখন তার প্রিয় মানুষ তাকে প্রিয় বলে ঘোষণা করবে। তাই হয়েছে। রিশ তৃণার কথা চিন্তা করে লেখার নেশায় জড়িয়ে পরে। ভালোবাসার মানুষকে ভালোবাসার কথা নানান ভাবে বলতে ভালোই লাগে। কবির মতো ছন্দ হয়তো হয় না, কিন্তু ভালোবাসার কথা পুরোদমে প্রকাশ পায়। যা তৃণা খুব সহজেই বুঝে নেয়।

রিশ নিজেকে ‘অকবি’ বলতো। বন্ধুমহলে কবি উপাধি পেলেও নিজেকে ‘অকবি’ দাবি তার। তার অকবি ভাবের কবিতায় কখনো প্রশান্ত মহাসাগর প্রিয়তমার নামে করে দেয়, আবার কখন দু’জনে পৃথিবীর বাইরে হাতেহাত রেখে হাঁটতে চায়।গোধূলির সূর্যকে কপালের টিপ, আকাশে তার প্রতিচ্ছবি, যেন এক রূপকথার রাজ্য। কবি মন অনেক ভাবায় তাকে। যেখানে একটা ৩.২ ইঞ্চি লম্বা গোল দণ্ডের মাথায় আগুন দিলে প্রিয়তমার জন্য আরও রূপকথার জন্ম নেয় কবির মস্তিষ্কের নিউরনে। এক বসন্তে  তৃণা রিশের হাত ধরে বলল,”আচ্ছা, এই হাত ছাড়বে কখনো?”

“ভালোবাসা চলবে,হাতে হাত থাকবে। তুমি চাইলে সব সম্ভব। আমার দিক থেকে ‘তুমি’ বলতে জীবনে শুধু ‘তুমি-ই’ থাকবে। তুমি চাইলে এমনো কয়েকশো বসন্ত কেটে যাবে। প্রতি বসন্তে তুমি হলুদ শাড়িতে আমার সামনে আসবে। আর আমি প্রতিবারের মতো বলে উঠবো,’তোমার প্রণয়ের ভিড়ে আমি এক মাত্রাতিরিক্ত মাতাল……।”

অকবি মনের মানুষ। কথা বলতে শুরু করলে পুরো কথা বলে দেয় রিশ। অকবিকে সারাদিন রোদের নিচে দাঁড়িয়ে প্রেমিকার বারান্দার দিকে তাকিয়ে থাকতে বললে ‘না’ উত্তর আসাটা অস্বাভাবিক।তাঁরা তা পারবে। তবে তাদের যদি বলা হয় অনেক গুলো লাল গোলাপ নিয়ে এসো! তখন বলে উঠতে পারে,”প্রিয়,তোমায় গোলাপ দিতে হলে লাল নয়, নীল গোলাপ দেব….।” এটা স্বাভাবিক। নীল গোলাপের জন্ম শুধু কল্পনায় হয়। রিশ তৃণাকে ভালোবাসার চিহ্ন হিসেবে কিছু দেয়নি কখনো-তৃণার মতে। তবে দেখা হলেই একটা চিরকুট দিত, যাতে দু’চার লাইনের কবিতা বুনে দিত সে। তৃণার সেসব পড়তে ভালোই লাগে।ভালোবাসার মানুষের দেয়া বলে কথা।

ভালোবাসা শুরুর কয়েকমাস পরে তৃণার পরিবারে জানতে পারে। তৃণা একবার বলেছিল,”রিশ আমার জন্য হলেও বাস্তবতার কথা চিন্তা করে,কিছু একটা করো। এ-সব কবি ভাবে চলবে কীভাবে!”

রিশ কোনো উত্তর দেয়নি সেদিনের কথায়। এভাবে হঠাৎ নিজেদের মাঝে দূরত্ব বাড়ে। তৃণা নিজেই দূরত্ব বাড়াতে থাকে। হয়তো রিশকে বোঝাতে।ছেলে মানুষির দিন শেষ। এবার কল্পনার ঘোর কাটিয়ে প্রিয়কে আপন করে নেয়ার প্রস্তুতি নিতে হবে। রিশ এটা ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিল যে, তৃণা দূরে হারিয়ে যাচ্ছে। আর দেরি হলে হয়তো ভাগ্য সীমানার বাইরে চলে যাবে।

একদিন খুব ভোরে তৃণা ফোন করে রিশকে বলল,”সকাল দশটায় বাসার সামনে চলে এসো।”

“আচ্ছা” ঘুমের ঘোরে জবাব দিলো রিশ।

ঘুম ভাঙলে রিশ চিন্তায় পরে যায়। সকাল দশটায় ডাকবেই বা কেন? সে যা ভাবছে তাই হবে কি?

রিশ ভাবছে তৃণার বাসায় তাকে পরিচয় করিয়ে দেবে। হয়তো সম্পর্কটা আরও পাকাপোক্ত করার জন্য। সব ভাবনা চিন্তা ফেলে সে চলল তৃণার বাড়ির উদ্দেশ্যে। দশটার একটু আগেই পৌঁছেছে রিশ। অপেক্ষা করতে খুব বিরক্ত লাগছে তার। এই না জানা কথা শুনতে উদগ্রীব সে। ঠিক দশটা সাতে তৃণা রিশের সামনে দাঁড়িয়ে। রিশ বুঝতে পারছে কিছু একটা হয়েছে। তৃণার মুখে সেই মায়াবী হাসি নেই, নেই সেই মায়াবতী ভাব। রিশ কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই তৃণা বলে উঠলো,”ভুলে যাও।”

কী ভুলে যাব?

সব স্মৃতি। সব কথা। সব অনুভূতি। কোনো ভাবেই এগুনো সম্ভব না। যদি ভালোবেসে থাকো, তবে ‘কেন’, ‘কি কারণে’ এসব জানতে চাইবে না।অজান্তেই চলে যাও..।

রিশ কিছু বলতে পারছে না। বাগযন্ত্র বোধহয় কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। তার মন বলতে চাইছে,”আমি ভালোবেসে যাব। আমি সত্যি ভালোবেসে যাব। ষোল আনা জীবন তোমার নামে।এখন শুধু অপেক্ষার প্রহর গোনা বাকি।”

রিশ তার বাসায় ফিরে এসেছে। নানান চিন্তায় মগ্ন।প্রশ্নের পাহাড় যেন তার মাথায়। আসলে তৃণা কি তাকে ভালোবেসেছে? ভালোবাসলে কি এভাবে চলে যাওয়া যায়। তাদের ওয়াদা করা কয়েকটি বাক্যের কী হবে? ওগুলো কি ভেঙে গেল? কী হলো সেই মিলে যাওয়া দীর্ঘশ্বাসের শব্দের? নাকি রিশের কানে ভুল শব্দ এসেছিল!

এতসবের চিন্তায় নিজেকে শেষ করতে ইচ্ছে করছিল তার। শেষমেশ উৎসর্গ করতে ইচ্ছে হচ্ছিল নিজেকে ভালোবাসার মানুষের প্রতি। রিশ এটাও বুঝছে দীর্ঘশ্বাস মিলে যাওয়া মানুষ এত সহজে চলে যেতে পারে না। হয়তো মাথায় তৃণার অনেক প্রেসার ছিল পরিবার থেকে। কিন্তু দুম করে একদিনে এত সব পণ ভেঙে দিতে পারে না সত্যিকার অর্থে ভালোবাসার মানুষ। যদিও তৃণার চলে যাওয়ার কারণ অজানাই রয়ে গেলো। মস্তিষ্ক সায় দেয় সে অভিনয়শিল্পী। খুব নিখুঁত তার অভিনয়। যা ধরার মতো চোখ রিশের ছিল না।সে তো শুধু মনের চোখ দিয়ে দেখে ভালোবেসেছে।অভিমানে তলিয়ে, তৃণা ফিরবে আবারও, এই অপেক্ষা মনে নিয়ে বাসার দারোয়ান চাচাকে বলল,”চাচা, কোনো একদিন একজন চশমা পরা রূপবতী আসবে। আমার খোঁজ করবে খুব আকুলতা নিয়ে। আপনি তখন সহজ ভাবে বলে দিয়েন,’এই বাসায় অভিনেত্রীর সাথে অভিনয় করার মতো অভিনেতা থাকে না। সাদা রঙের ভালোবাসা নিয়ে আসবেন’-রিশবাবা বলেছে……….।”

সাদা নিঃস্বার্থ মোহ-ভালোবাসায় সিক্ত হোক প্রতিটি ‘প্রিয়’ মানুষের মন। অপেক্ষা হয়ে থাক ভালোবাসা, যেমন অপেক্ষা করছি অচেনা, অনিবার্য মৃত্যুর জন্য।

 

Latest posts by মিকদাদ মুগ্ধ (see all)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *