মহান মুক্তিযুদ্ধে রংপুরের প্রথম শহীদ শংকু সমজদার। স্বাধীনতার ইতিহাসে, মাতৃভূমির জন্য যুদ্ধে রংপুরবাসীর ত্যাগ ও অবদান অনস্বীকার্য। ১৯৭১’র ০১ মার্চ ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্টকালের জন্য পূর্বনির্ধারিত ৩ মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করায় ঘোষণায় বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে সারা বাংলা। সারা দেশের মতো রংপুরেও দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো বিদ্রোহের আগুন। দেশব্যাপী হরতালের ডাক দেন বঙ্গবন্ধু।
০৩ মার্চ সকালে রংপুরেও হরতালের সমর্থনে কাচারী বাজার এলাকা থেকে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও রংপুর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম গোলাপ, অলক সরকার, মুকুল মুস্তাফিজ, নূর উর রসুল চৌধুরী, হারেস উদ্দিন সরকার, ইলিয়াস আহমেদ, মুসলিম উদ্দিন (মুসলিম কমিশনার), আবুল মনসুর আহমেদসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে মিছিল বের হয়।
মিছিলটি শহরের তেঁতুলতলা (বর্তমান শাপলা চত্বর) এলাকায় আসতেই কলেজ রোড থেকে কারমাইকেল কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি শহীদ মুখতার ইলাহি (কয়েক মাস পরে শহীদ ), জায়েদুল আলম (প্রয়াত), জিয়াউল হক সেবুসহ অন্যান্যদের নেতৃত্বে একটি মিছিল এসে যোগ দেয় মূল মিছিলের সাথে। কথা ছিল মূল মিছিল তেঁতুলতলা থেকে ব্যাক করবে। কিন্তু কারমাইকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের চাপে নেতৃবৃন্দ মিছিলটি স্টেশন অভিমুখে নিয়ে যেতে বাধ্য হন। মিছিলটি আলমনগর এলাকার অবাঙ্গালী ব্যবসায়ী সরফরাজ খানের বাসার (ছবির বাসা, ঘোড়াপীর মাজারের পাশে) সামনে যেতেই এক কিশোর ঐ বাসার দেয়ালে একটি উর্দুতে লেখা সাইনবোর্ড দেখে তা নামিয়ে ফেলতে যান সবার অলক্ষ্যে। আর তখনই বাসার ভেতর থেকে মিছিলে গুলিবর্ষণ করা হয়। সেখানে গুলিবিদ্ধ হন ৭ম শ্রেণীর ছাত্র কিশোর শংকু সমজদার । মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। গুলিবিদ্ধ কিশোরকে মুসলিম উদ্দিন কমিশনার পাঁজাকোলা করে নিয়ে দৌড়লেন হাসপাতালের দিকে। কিন্তু ততোক্ষণে ইতিহাস রচিত হয়ে গেছে। পথেই কিশোর শংকু মারা যান। হয়ে যান ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধে রংপুর অঞ্চলের প্রথম শহীদ তো সেই কিশোরই। অনেকের মতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের প্রথম শহীদ এই কিশোরই।
ইতোমধ্যে শংকুর শহীদ হওয়ার ঘটনায় বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে পুরো রংপুর। কিশোর শংকুর গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত দেহ দেখে জনতা উত্তেজিত হয়ে সারা শহরে অবাঙ্গালীদের দোকান ভাংচুর, সামগ্রী রাস্তায় এনে অগ্নি সংযোগ করতে থাকে। যে বাড়ি থেকে গুলি ছোড়া হয়েছিল সেই বাড়িতে অগ্নি সংযোগের চেষ্টা কালে ইপিআর বাহিনী এসে বাঁধা দান করে।
একই দিনে আরও দুইজন নিহত হয়েছেন অবাঙ্গালীদের হাতে। তাঁদের একজনের নাম আবুল কালাম আজাদ, যাকে গিনি এক্সচেঞ্জের (বাটার গলির পাশে, মেইন রোডের সাথেই, এখনকার রেইনবো প্লাজা) সামনে এক অবাঙ্গালী গুলি করে হত্যা করে। অপরজন জেনারেল বুট হাউসের (ঢাকা হোটেলের গলির পাশে, টাইম হাউস, ক্রোকারিজ মার্কেটের বিপরীতে) সামনে ছোড়ার আঘাতে মৃত্যুবরণ করেছেন। নাম ওমর আলী। বাসা শহরের মুলাটোলে। এছাড়াও সেদিন আরও দুইজন গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। যাঁদের একজন শরিফুল ইসলাম মকবুল এক মাস হাসপাতালে থেকে বিনা চিকিৎসায় মারা যান। পায়ে গুলিবিদ্ধ মোঃ আলী বেঁচে যান। তিনি ছিলেন রংপুর কলেজ ছাত্র সংসদের বিশ্রামাগার সম্পাদক।
৭ মার্চ রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণে রংপুরের ০৩ মার্চের ঘটনা উচ্চারিত হয়েছে গর্বের সাথে। আজকের এই দিন গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি শহীদ শংকু সমজদার, শহীদ ওমর আলী, শহীদ আবুল কালাম আজাদ, শহীদ শরিফুল ইসলামসহ মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মাহুতি দেয়া সকল শহীদদের।তোমরা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান, আমরা তোমাদের ভুলবো না।